টেক ডাইভারশন অথবা পথের পাঁচালি : কৌশিক চক্রবর্তী

ওহ্‌। এই তাহলে। শীতঘুমের সিদ্ধান্ত। শুধুই স্মৃতিসন্ধান। অন্ধের পথ হাতড়ানো। ভয় হয়, এই পারের ঘুম থেকে ওই পারে উঠে সেদিন নিজেকে দেখতে পাব কি? রাতঘুম ভেঙে যায় আচমকা। আমার মেয়েটা? ঘুমোচ্ছে তো? নাকের কাছে হাত নিয়ে যাই। বারবার গুনতে ভুল হয়। আমার তাই আরও একবার ভয় করে ওঠে। কাল সকালবেলা এই কলকাতা শহর একইরকম থাকবে তো? পালানো যায় না কোথাও? খুঁজতে চেষ্টা করি গোপন সুড়ঙ্গের নক্‌শা। কোথায় পালাবে হে? পৃথিবীকে নাকাবন্দী করে রেখেছ যে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম আর জন্মগত জড়ুলচিহ্ন ছাড়া আর কিচ্ছু পাই না। আলোকবর্ষ জোড়া ঘুমের ভেতর কেবল কয়েকটা একমুখী ফোনকল। বিষণ্ণ নাবিকের মাঝসমুদ্রে হারিয়ে আর ভাসতে ইচ্ছে না করার মতন এক মেঘাচ্ছন্ন নেশা। খেলা ফেলে রেখে যাওয়া বিকেল। এ এক ভুলভুলাইয়ার পরিখা। নিজের কাছ থেকে পালাতে চাই তাই। আর তাই, দীর্ঘ, আরও দীর্ঘ ছুটি নিতে ইচ্ছে করে। চিবুকের নিচে আরও আরও সাদা নুনের গুঁড়ো জমে। আমার ঘুম আসে না। আমার ভয় করে, যদি জেগে না উঠি। আয়নার উল্টোদিকে এক হয়তচেনা মুখ বারবার নখ বার করে। গা-গুলোনো হাসি মাখিয়ে দেয়। তার নাম মৃত্যুভয়। কাচের আস্তরণ ভেঙে ভাবি তার টুঁটি টিপে ধরব। ওফ্‌ফ্‌, কী দুর্বিষহ মনোবেদনা কামড়ে ধরেছে আমায়। ঘাড়ে তার বিষদাঁত। আমি এইবার হয়ত পাগল হয়ে যাব।
জানলার ধারে আচমকা পাখি আসে। একটা কাঠবেড়ালি। এই কলকাতায়। কোন গোপন গুহা থেকে তারা বেরিয়ে আসে আজ। পৃথিবী হয়ত একদিন পাখিদের হয়ে যাবে। ফড়িঙের, দোয়েলের। তবুও মানুষ থেকে যায়? মানুষ নিকটে গেলে সেদিন প্রকৃত সারস তবে উড়েই যাবে, না? এই শহরের অরণ্যে পতঙ্গেরা হাওয়ার চেয়ে দ্রুততর। এই শহরের মহাকাশে মনোবেদনারা আলোর চাইতে বেশি দ্রুততায় উড়ে চলে। এখানে রাস্তায় তাই হাঁটা বারণ। এই রাস্তায় হাঁটতে আমার ভয় করে। সুরঞ্জনাও আজ আর ওইখানে যায় না … ওই যুবকদের সঙ্গে কথা বলতেও তার আর ভালো লাগে না … তাহলে কোথায় আজ আমাদের প্রণামপত্র রেখে যাব ? আজ এক পৃথিবী থেকে ত্যাজ্য হতে হতে যখন অপর পৃথিবীও ক্রমাগত অস্বীকার করছে আমাদের, তখন আর কী-ই বা উপায়, এই এক নো-ম্যান্‌স ল্যাণ্ডে আছড়ে পড়া ছাড়া। এখানে এক গোলার্ধে যখন কেবলই মাটি খোঁড়া রোগগ্রস্ত করোটির ভিড়, যাদের ছুঁয়ে দেখা নিষেধ। মারণরোগের ট্রেঞ্চ থেকে তুলে আনা শ্বাসবায়ু। সভ্যতার আলেয়া দর্শন… শ্বাস নিতে ভয় করে। আদর করা এখন মারণাস্ত্র। অনেকগুলো দৌড় থেকে খুঁটে খুঁটে রাখা টাইমফ্রেম দিয়ে যেখানে সাড়ে সাত মিনিটের বেশি চোক মোছা যায় না। এই জীবাণুখচিত কলোসিয়ামের ডেথ অপেরায় আর কোন তৃতীয় দৃশ্য নেই।
অবচেতনার গহন কি তবে কোনো রাক্ষস ? তার দাঁত নখ বেরিয়ে আসে এভাবেই ? নাকে এসে লাগে মৃত্যুর ডিওগন্ধ ? তার সামনে ছায়াপথগুলো ক্রমশ মুখোশহীন, আর সেই ভয়ে সে বুঝি ততই তার বিষকালো নিঃশ্বাস, ক্রোধ উগরে দিয়ে আরও নিঃস্ব হতে চায়। আকশ কালো ইগল পাখায় ঢেকে দেয় আমাদের। আর যে সময়ে তার রাত্রি এসে মিশে যায় দিনের পারাবারে … সেখানেই কখনও কখনও দেখা হয়ে যায় তার সঙ্গে … রাস্তায় আবার। আর আচমকা নিঃশব্দ এক হাওয়া দিলে, অনেকে একসঙ্গে হারিয়ে যায়। তাদের আর ফিরে পাওয়া যায় না।
এ তো আসলে আমাদেরই সম্মিলিত আত্মহননের ইতিহাস। এক প্রগাঢ় অন্ধকার ঘেঁটে মহাশূণ্যতার দিকে এগিয়ে চলেছে সময়। সেখানে হল্ট্‌ স্টেশনে বসে আছি যত ভেসে আসা আলোবাতাস … কান্নার কন্টিনেন্ট … ক্রমাগত খননের পর আদিম গুম্ফার বাঁশি প্রাচীণ অরণ্য পার করে ভাসমান। আমরা আজও লিখে উঠতে পারিনি সেই অপরের ইতিহাস … লিখে উঠতে পারিনি সেই উন্মাদনা। যেখানে মানুষ রাক্ষসের ঘরবাড়ি থেকে উঠে এসে একঘরে করে দেয় প্রতিবেশীকে, তার দিকে চেয়ে হাসতে ভয় পায়। ভয় পায়, মৃত্যু হলে তার শবদেহের কপালে হাত ছোঁওয়াবার। ক্রমাগত আড়াল করে রাখার এক নির্দয় ভাষাতন্ত্রে তারা কথা বলে।
আমার ভয় করে। ঘুমিয়ে থাকা আমার মেয়েটার দিকে দেখি। নাকের নিচে হাত পেতে গুনি। আর তাই, মৃত্যুভয় কোথাও না কোথাও সেই ইতিহাসের দিকেই ফিরিয়ে নিয়ে যায় আমাদের … উন্মাদনার পথের সেই শেষতম বিন্দুটির দিকে, যেখানে তার শরীরে কোনো শ্রেণীবিভাজন লেগে নেই। যেখানে সামান্য আয়োজনে বেঁচে থাকাটাই একমাত্র বিষয়। যেখানে প্রাচুর্য নেই। যেখানে চয়েস নেই কোন। মৃত্যুভয়ে সমস্ত মানুষ যেখানে এক হয়ে যায়। দেখতে থাকে, পাখির দল, কাঠবেড়ালির দল, নীলগাইয়ের দল, হরিণের দলে একে একে দখল করছে সমস্ত নগর। পথ। নীলগ্রহ ক্রমে ক্রমে হয়ে উঠছে প্ল্যানেট অফ এপ্‌স। এই মৃত্যু পৃথিবী কি তবে সেই কক্ষপথটি লিখে রাখতে চায়? সেই অস্বস্তির মহাদেশের মানচিত্র? তার অন্তর্বর্তী আলোকবর্ষ?
আজ সেখানে খাদের কিনারা ঘেঁষে একে অপরের থেকে দূরে সরে যেতে চাওয়াই একমাত্র লজিক ও গণ-উন্মাদনা … যদিও এখনও সম্পূর্ণ ভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় আসেনি যেন … যেন আমরা শুধু মেপে নিচ্ছি নিজেদের, এক সীমাহীন দূরত্বে … এক রুক্ষ, মেদহীন, কর্কশ ভাষায় শুরু হয়েছে সেই বিচ্ছেদের সংলাপ নির্মাণ। যে ভাষাতেই হয়ত একদিন কথা হবে। যে ভাষায় শুধুই একে অপরকে ধ্বংস করার উপন্যাস লেখা হবে। অপরে পাওনা আদায় করেছে বলে আমরা আর দেনা শোধবার ভার নেব না। সে ভাষা শুধু হত্যা, ষড়যন্ত্র, অবিশ্বাস, মৃত্যু আর ক্ষুন্নিবৃত্তির ইতিহাস লিখতে পারে।
আমরা সেই সম্মিলিত হননের ইতিহাসই তো লিখতে চাই। অচেতন স্রোত থেকে সেই ইতিহাসই তো লিখেছি। কালো ধোঁয়ায় ঢেকে দিয়েছি মুখ, বিষে মৌন করে দিয়েছি পোকামাকড়ের ঘরবসতি। আত্মপরিচয় বলে আর কিছু আছে না কি আমাদের? এই মৃত্যুভয় যেন বা আবার কিছু বার্তা পাঠাচ্ছে – বিমূর্ত – আদিম। আর তার ভেতর থেকে প্রাণপণ খুঁজে বেড়াচ্ছি বেঁচে থাকার সেই প্রামাণ্য ভাষাকে। সেইসব বিড়বিড় শ্বাসশব্দ, সেইসব আধাশরীরী গোঙানি, সেইসব স্পষ্ট অবয়বহীন উচ্চারণগুলো – তারা মাইলব্যাপী জলাভূমিতে মাঝেমাঝে আলেয়ার সন্ধান দেবে। ততদিন রাত্রি আর আলোর মধ্যেকার সংলাপ শুধুই বিভাজন আর দূরত্বের ইঙ্গিতবাহী। কে জানে, এই আমাদের আত্মকথনের ভাসাভাসা ইতিহাস…
ওফ্‌ফ্‌, কী দুর্বিষহ মনোবেদনা কামড়ে ধরেছে আমায়। ঘাড়ে তার বিষদাঁত। আমি এইবার হয়ত পাগল হয়ে যাব। সাপলুডো খেলার ছক প্রথম প্রথম চেনবার দিনগুলোয়, মনে আছে, মনোবেদনার রঙ ছিল হাল্কা গোলাপি, স্বপ্নের রঙ ছিল সাদা। ভাবনাগুলো স্বচ্ছ ছিল। আত্মউন্মোচনের খেলা ছিল অজানা। চেতনার অনেক অন্তর্লীন গহনতা অচেনা ছিল তখন। ক্রমশ শুরু হল ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকে নিজের সঙ্গে কথাবার্তা। ল্যাণ্ডস্কেপ তাই ক্রমে ধূসরতর। আরও এক ত্রস্ত নীলিমা। মুঠোর নাগাল পেরোতে থাকে কক্ষপথ। আয়নার উল্টোদিকের মুখটি ক্রমশ এক হয়ত অচেনার দিকে। ঘোলাটে এক কন্‌ফিউশনে আক্রান্ত। হারানো স্বচ্ছ উজ্জ্বল রংগুলোর অনুপস্থিতিতে তাই প্রতিরোধ জাগে। মনে হয়, এই স্তব্ধতা তো আসলে স্বেচ্ছা উৎপাদিত। তবু আরও আরও ঘোলাটে ভাবনায় ডুবে যাই। খোলসে ঢুকে পড়ি। প্রজাপতি হব বলে। আমি স্বীকার করি এই অজ্ঞতা। কারণ প্রতিমুহূর্তে নিজেকে বুঝে ফেলবার আপাত সরল প্রক্রিয়ায় জিতে যেতে ভালো লাগে না। আমার বাড়ির তিনশো মিটারের মধ্যে সাক্ষাৎ মৃত্যু এসে ডাক দিয়ে গেছে। আমার জানলা দিয়ে মাঝরাতে আমি তার কাশির শব্দ শুনতে পাই। আমাদের দুজনের মধ্যবর্তী শূণ্যতাটুকু লেখা থাকে সংকেতলিপিতে, প্রাচীন অরণ্যগন্ধে। বিকেলে রাস্তায় মুখোশপরা অশরীরীদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। হয়ত এইবার চোখ বেঁধে নিয়ে চলে যাবে ডিটেন্‌শন ক্যাম্পে। আমি লুকোচুরি খেলি। আমি গোপনে সিগারেট ধরিয়ে বুবিট্র্যাপের মায়া এড়ানো দেওয়ালে দেওয়ালে পালাবার নিষিদ্ধ সংকেত খুঁজে বেড়াই। চুপিচুপি সন্ধিপ্রস্তাবের অপেক্ষায় চোরাগোপ্তা শিস্‌ দিই কখনও কখনও। আবার অবস্থাবিশেষে কিছুদিন গোপন বাঙ্কারে মুখ লুকোনোই সারভাইভালের একমাত্র পন্থা বলে মনে হয়। আর এভাবেই একদিন চৌচির করে দিই আয়নার খোলস। এরপর… বাঙ্কার থেকে প্রায়দিনই পাঠাই কফির গুঁড়ো। উত্তেজিত হই। শাওয়ারের ঠাণ্ডা স্রোতে, টেলিছবির রঙিন বুদ্‌বুদে শুরু করি আত্মবিনোদন। আর সেই কারণেই আর হাঁটতে পারি না। সারাটা দিন কেবলই অপরিচিত বর্ণমালার মধ্যে পছন্দমত গন্ধের শব্দ খুঁজে বেড়াই।
তারপর একদিন, আবার আবছায়াতে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায়। তার হাতে ধরা দোমড়ানো পাঁজর। পায়ের নিচে ছটফট করা অসমাপ্ত হত্যার কারুকাজ। শরীরের অসংখ্য কানাগলি থেকে প্লাস্টিক নল আর ব্যাগ নিয়ে সে চওড়া বেল্ট খুলে ক্ষুৎপিপাসায় চিৎকার করে। আমাদের বেঁচে থাকা কেবলই লাট খায় এক বহুকাঙ্ক্ষিত সংঘাতে। তাই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়তে হয়। তাই আত্মগোপনের দিনগুলোয় জমিয়ে রাখা সোঁদা রুক্‌স্যাকে ভরে ফেলি আততায়ীর কালো চশমা, যোদ্ধার ভিজে জার্সি, পরিব্রাজকের ঝুরো পাণ্ডুলিপি, ভবঘুরের ভাঁজকরা তাঁবু — কেবল কম্পাসকাঁটা আর জালকাঠি আর চকমকি পাথরখণ্ড দেখতে পাই না।
আমার আবার ভয় করে। আমার মেয়েটার দিকে দেখি আবার। নাকের নিচে হাত পেতে গুনি। গণিত কিন্তু এত সরলাকৃতি নয়। আজ এই ৪৩ বছর আমি১… আমি২… আমি৩… ৪… ৫… … … … গুপ্তহত্যাকারীর হাতের নাগাল থেকে ফেরার। নিজেকে দাফন করতে কোনো কসুর রাখছি না, অথচ তা সত্ত্বেও, আজকাল, বিশেষত এই ঝিমধরা সকালবেলার কলকাতা শহরে, একা, ক্ষুধার্তও কিছুটা, আমি মাঝপথে খেলা ছেড়ে দিতে উৎসাহী। দৌড়তে শুরু করি। কিন্তু হাতঘড়ির স্থানু কাঁটা জানান দেয় আমাদের অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। সোজা এগোনোর রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে কখন। সামনের কালভার্ট উড়িয়ে রাস্তা কেটে রেখেছে অনুসন্ধানকারী। ঘুরপথে স্টেশনে ঢুকতে চেষ্টা করি। দরজায় কালোমুখোশের প্রহরী আমার আঙুলছাপের নমুনা দেওয়া কাগজ চায়, বদলে আমি তাকে জলপাইরঙা শিকারটুপির কিছু পালক উপহার দিয়ে ফুটব্রিজের দিকে দৌড়ই। ট্রেন ছাড়ার শব্দ কানে আসে। আমি প্ল্যাটফর্মে একা দাঁড়িয়ে থাকি। স্বপ্নগুলো আবার জটিল জ্যামিতি হয়ে যায়। হাত থেকে বেরিয়ে গিয়ে তারা পাক খেতে থাকে ভাঙাচোরা বাক্যের মাঠে। তারপর আহত জন্তুর মত গোঙায়। হিংস্র কুকুরের নিঃশ্বাস এড়িয়ে ঢুকে পড়ি তাই মাইনভরা জঙ্গলে। নাকে এসে লাগে পেট্রলগন্ধের বাতাস। প্রতিধ্বনি হয়ে তারা ফিরে এসে ঝটিতি আক্রমণ করে। বিভ্রান্ত করে। সমবেত হোসপাইপের নিচে আমাদের ফেলে ঢেলে দেয় বিষাক্ত কীটনাশকের বন্যা। আমাদের চামড়ায় পোড়া গন্ধ লাগে। আমাদের চোখ জ্বলে যায়। আমাদের মাথার মধ্যে অসংখ্য মেডুসা হাত বাড়ায়, মাংসাশী লতা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যেন শিকারের সঙ্গে রমণ করতে চায়।
সত্যি বলছি। এই রাতগুলোয় ভয় করে আমার। মেয়েটার ঘুমের দিকে দেখি। নাকের নিচে হাত পাতি। কী দুর্বিষহ মনোবেদনা কামড়ে ধরছে আমায়। ঘাড়ে তার বিষদাঁত। আমি এইবার হয়ত সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে যাব। আমি দেখতে পাই বই থেকে উঠে আসা উন্মাদনায় বিধ্বস্ত মেধা; উপোসি মৃগী আক্রান্ত উদোম ভোরবেলা অন্ধকার এলাকায় নিজেদের ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে নিয়ে গেছে তারা। আমি দেখতে থাকি দেবদূতসুলভ লাফাংগাদের, যারা রাত্রির কলকব্জায় তারাঝিলমিল ডায়নামোর সঙ্গে বিবাহসম্পর্ক খুঁজতে পুড়ে পুড়ে যায়। যারা গরিবি আর ন্যাকড়াচোকড়া আর কোটরেবসা চোখ আর শহরের মাথায় ভাসতে থাকা ঠাণ্ডাজল বাসাবাড়ির অলৌকিক আঁধারে বসে জ্যাজসঙ্গীত উপভোগ শেষে সোজা হয়ে উঠে বসে টান দিতে থাকে ধোঁয়ায় ; যারা প্রতিদিন খ্যাপামি আর খুলির জানলায় অশ্লীল বন্দনাগান প্রকাশ করার দায়ে শিক্ষাসদন থেকে বিতাড়িত ; যারা রঙসরাইয়ে বসে আগুন খায় অথবা ব্লাইণ্ডলেনে বসে গেলে তার্পিন ; যারা প্রতিমুহূর্তে মৃত্যু বা নিজেদের ধড়কেই রাতের পর রাত জোলাপ দিতে থাকে স্বপ্ন দিয়ে, চলমান দুঃস্বপ্ন দিয়ে, সিগারেট আর অন্তহীন অক্ষম অণ্ডকোষ দিয়ে। যারা বীতকাম বুকনিবাজদের বাহিনী হয়ে ঝাঁপ দিতে থাকে সিঁড়ি ভেঙে নিচে ফায়ার এস্‌কেপ থেকে জানলার আলসে থেকে চাঁদ থেকে ; যারা চেঁচিয়ে বমি করে দেয় হাসপাতাল আর স্ট্রিটলাইট আর মায়াবী কফিশপ আর স্মৃতি আর গপ্পো’র শরীরে ; যারা নির্জনতায় একা একা ফুটপাথের পাশে সমাধিমন্দিরে উগরে দিতে থাকে বাসি মাংস ; যারা শীতকাল… মাঝরাত্তির… শহরতলির… বৃষ্টির… নেশায় বুঁদ হতে থাকে ; যারা কর্পোরেট মিডিয়ার মাদক-কুয়াশার প্রতিবাদে নিজেদের হাতে রোজ সন্ধেবেলা সিগারেট ছ্যাঁকা দিয়ে ফুটো করে দেয়, যারা কাঁদতে কাঁদতে উদোম হয়ে ভেঙে পড়তে থাকে চুনসাদা জিমনাসিয়ামে… মারণ এক গুপঘাতক তাদের সকলকেই চুম্বন শেষে একে একে খুন করতে থাকে।
মানুষের গোপনগুহায় যে প্রগাঢ় সংবেগের ঝর্ণাজল লুকিয়ে, তার প্রতিবিম্ব আজকাল আর আয়নায় পড়ে না। গোপনে এক কাকপাখি এসে অন্ধকারে ডানা ঝাপটায় … কীভাবে এই বিলম্বিত লয়ের পথঘাট তবে পার হয়ে যাব পাতালবিলাসী হাওয়ায়, কীভাবে ব্যর্থ ছদ্মবেশ নিয়েও পৌঁছনো যাবে নিশ্চিন্ত উপসংহারেরগুলো কাঠামোয় ! এই যে আমরা আজ অবধি আমি শিখে উঠতে পারলাম না সংখ্যাতত্ত্বের প্রকৃত সংজ্ঞা, এই যে আমরা কেবলই নির্মাণ করলাম নিজেদের ধ্বংসস্তূপ — এই দুই পরস্পরসংযোগের পেছনে তো কোন গেরিলাকারণ নেই। আমরা চাইনি প্রচলিত প্রমোদকাহিনির নিশ্চিন্ত শিবিকা। চাইনি, গলে যাক রোদলাগা জানলার স্তব। আর সেই দুঃসাহসী অভিযানের উত্তেজনায় বারবার ধ্বংস নির্মাণ করেছি। অতর্কিত আক্রমণে … অসুখে … একাকীত্বে … নির্জনতায় … আত্মধ্বংসের এই সহস্রাব্দ শুরু হয়েছিল তবে সেদিনই ?
এই তবে আমাদের ভ্রমণকাহিনি। এই সুসভ্য প্রসাধন পুস্তিকার পরিসর। সবটাই এক স্বপ্নের অংশমাত্র। রুগ্ন ও অশরীরী আত্মারা যেখানে পাহারায়। শাপভ্রষ্ট অ্যাঞ্জেলরা যেখানে অন্তরীক্ষে অপেক্ষমান। তাদের পায়ের কাছে পড়ে চিনারবৃক্ষের শুকনো জরাগ্রস্ত পত্রমর্মর। যারা বারবার বলে যায়, এই পৃথিবীতে তুমি আর অবিনশ্বর নও। দরকারীও নও। তোমার যন্ত্র, তোমার সভ্যতা, তোমার লোভ, তোমার বাহুল্য নিয়ে তুমি থাকো, যেখানে ইচ্ছে, যেভাবে ইচ্ছে। তোমায় ছাড়া দিব্যি আছি। তোমায় ছাড়াই ভালো থাকব।
তাই, রাতগুলোয় হয়ত ভয় করে আমার। মেয়েটার ঘুমের দিকে দেখি। নাকের নিচে হাত পাতি। কী দুর্বিষহ মনোবেদনা কামড়ে ধরে। এইবার হয়ত সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে যাব। তবু, ব্যথার মাঝে তবুও আমরা ঘুমিয়ে পড়ি আজকাল। নিজস্ব স্বর্গের সন্ধানে তবুও মানুষ থেকে যায়। তাদের হাতে নিষিদ্ধ ইস্তেহার। নির্জনতা–নিঃসঙ্গতা নিয়েই তাদের অন্তর্বর্তী রূপকথার প্রচ্ছদ। সেইসব বেদনাবাগানে পর্যটন করতে ভালো লাগে তাই। তার মধ্যিখানে সামান্য শ্রান্তিমাখা হেঁটে চলা। দিনের আলো কখনও কোমল হয় তবুও, সহজে সন্ধেও নেমে আসে না সবসময়ে। মনে করতে ভালো লাগে এইসব। দেখতে পাই, পাথরের গায়ে পথের দেবতা লিখে রেখে গেছেন –
“মূর্খ বালক, পথ তো তোমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে, ঠ্যাঙাড়ে বীরু রায়ের বটতলায় কি ধলচিতের খেয়াঘাতের সীমানায়। তোমাদের সোনাডাঙার মাঠ ছাড়িয়ে, ইছামতী পার হয়ে, পদ্মফুলে ভরা মধুখালি বিলের পাশ কাটিয়ে, বেত্রবতীর খেয়ায় পাড়ি দিয়ে, পথ আমার চলে গেল সামনে, সামনে, শুধুই সামনে… দেশ ছেড়ে বিদেশের দিকে, সূর্যোদয় ছেড়ে সূর্যাস্তের দিকে, জনার গণ্ডি এড়িয়ে অপরিচয়ের উদ্দেশে…
দিন রাত্রি পার হয়ে, জন্ম মরন পার হয়ে, মাস, বর্ষ, মন্বন্তর, মহাযুগ পার হয়ে চলে যায়… তোমাদের মর্মর জীবন-স্বপ্ন শেওলা ছাতার দলে ভরে আসে, পথ আমার তখনও ফুরোয় না… চলে… চলে… এগিয়েই চলে…
অনির্বাণ তার বীণ শোনে শুধু অনন্ত কাল আর অনন্ত আকাশ…
সে পথের বিচিত্র আনন্দ-যাত্রার অদৃশ্য তিল তোমার ললাটে পরিয়েই তো তোমায় ঘরছাড়া করে এনেছি! … চল এগিয়ে যাই।”
আমি দেখি, অনেক দূরের এক ছায়াপথে, চাঁদের গায়ে লেগে ঠিকরে আসা বাড়ি ফেরার অন্ধকারে, সর্বস্ব কাঁধে নিয়ে মাথায় নিয়ে একদল হাড়হাভাতে হাঁটছে… তাদের ভাঙাচোরা বাড়ির দিকে। রাত ঠিকরে বেরিয়ে আসা সেই গুঁড়িমারা মানুষেরা, দিনের আলোয় যাদের দেখা যায় না – এক অপার আলোয় তাদের বুকের ভেতর বেঁচে থাকার তীব্র খিদেগুলো চিকচিক করে উঠল। আবছায়া বকুল বিছানো পথ … সেখানেও গভীর খাদ, তবু জেগে আছে পাশে ঝোলানো সংকেত… ‘টেক ডাইভারশন’ …
চলাচল তাই শেষ হয় না।
আমি মিশ্র মাণ্ডে বাঁধা সেই বাঁশি আর সেতারের সুরটাকে আমার রিংটোন করে নিই …
দেখা হবে বলে। রাস্তায় আবার

Facebook Comments

Leave a Reply