একালের রুমকোভস্কি, প্রণোদনা প্যাকেজ এবং কোভিডের গেটো : ইশরাত তানিয়া

দৃশ্য ১: লোডজ গেটো
সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। তীব্র শীত নেমেছে পোল্যান্ডে।
বাদামী রঙের পানীয়টাকে বলা যায় কফি। এক বাটি পানিকে স্যুপ। ভাগ্য ভালো হলে সেখানে ভাসে কয়েক দানা বার্লি আর মটরশুঁটি। সামান্য রুটি। সবজী বলতে সংরক্ষিত ছোট একটা ফ্রোজেন বীট। বেশিরভাগটাই যার নষ্ট। এই সামান্য পরিমাণ খাবার পেত লোডজ গেটোতে অবরুদ্ধ পোলিশ ইহুদিরা।
১৯৩৯ সালে পোল্যান্ড দখল করার পর নাৎসীরা লোডজ শহরে গেটো বানায়। ৪.৩ বর্গকিলোমিটারের ছোট্ট এই শহর জুড়ে বন্দি ইহুদির সংখ্যা তখন প্রায় ২,৩০,০০০। সেখানে চাইম রুমকোভস্কিকে ‘কাউন্সিল অফ এল্ডার্স’ এর প্রধান করে দেয় জার্মান প্রশাসন। রুমকোভস্কি ৬২ বছর বয়সী একজন পোলিশ ইহুদি। জার্মান প্রশাসন তাকে জানিয়ে দেয়, বন্দীদের কোনো সহায়তা দেয়া হবে না। তাদের নিজেদেরই ব্যবস্থা করে নিতে হবে। গেটোয় অবরুদ্ধ প্রায় আড়াই লাখ মানুষের দায়িত্বে নিয়োজিত হয় রুমকোভস্কি। রুমকোভস্কি গেটোয় খাবার রেশন, গৃহায়ণ, কল্যাণ ও স্বাস্থ্যসহ অভ্যন্তরীণ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রশাসনিক বিভাগ তৈরি করে। লোডজ গেটোতে শুরু হয় এক বিশাল কর্মযজ্ঞ।
স্বজাতি ইহুদিদের জীবন বাঁচানোর জন্য রুমকোভস্কি জার্মান প্রশাসককে একটা প্রস্তাব দেয়। সেটা হলো গেটোয় অবরুদ্ধ ইহুদিরা নাৎসী বাহিনীকে যুদ্ধ সরবরাহ বানিয়ে দেবে। বিনিময়ে পাবে খাবার। জার্মান প্রশাসন সে প্রস্তাবের অনুমোদন দেয়। এর ভিত্তিতে রুমকোভস্কি লোডজ গেটোকে দ্রুত একটি শিল্পাঞ্চলে পরিণত করে। নগণ্য পরিমাণ খাবারের জন্য পোলিশ ইহুদিরা জার্মান সৈনিকদের জন্য যুদ্ধ পোশাক বানায়। জুতা, টুপি বানায়। রুমকোভস্কি তখন ভাবছে, ইহুদিদের এই উৎপাদন দক্ষতাই জার্মান হলোকাথ থেকে ইহুদিদের রক্ষা করবে। ইহুদিরা নাৎসী বাহিনীর জন্য যত বেশি প্রয়োজনীয় সংখ্যক যুদ্ধ সরবরাহ বানিয়ে দেবে, ইহুদিদের বাঁচার সম্ভাবনা তত বাড়বে। ক্রমশ ইহুদিদের ত্রাতা হয়ে ওঠে রুমকোভস্কি। অন্যান্য জিনিসপত্তের সাথে নগদ মুদ্রাও বাজেয়াপ্ত হয়ে গেলে, নিজের নামে নতুন মুদ্রা প্রচলন করে। ‘রুমকিন’ নামের এ মুদ্রা শুধু গেটোতে লেনদেনের জন্য ব্যবহার করা হতো।

দৃশ্য ২: ডেথ ক্যাম্পের দিকে
১৯৪০ সালের জানুয়ারিতে জার্মান প্রশাসন এক নির্মম সিদ্ধান্ত নেয়। ১০ হাজার ইহুদিকে হলোকাথ ট্রেনে করে শেলমিনোর আসউইচ ও অন্যান্য গ্যাস চেম্বারে পাঠানো হবে। রুমকোভোস্কির মোহভঙ্গ হলো। জার্মানরা অবশ্য ইহুদি নির্বাচনের স্বাধীনতাটুকু রুমকোভস্কিকে দিল। সে চাইলে, যারা তেমন কাজ করতে পারে না অর্থাৎ শিশু আর বৃদ্ধদের আগে গ্যাস চেম্বারে পাঠাতে পারে। এপ্রিলে ৩৪ হাজার, মে’তে ১১ হাজার, সেপ্টেম্বারে ১৫ হাজার। ১৯৪২ সাল পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিল ৭১ হাজার।
এক সময় দশ বছরের কম বয়সী শিশুদের জার্মান বাহিনীর হাতে তুলে দেয়ার নির্দেশ আসে। রুমকোভস্কির অনুনয়ের স্বর ভাসে লোডজ গেটোর বাতাসে- আমার হাতে তোমাদের সন্তান তুলে দাও। ইতিহাসে এই সনির্বন্ধ মিনতি ‘গিভ মি ইয়োর চিলড্রেন’ নামে অভিহিত। রুমকোভস্কি সক্রিয়ভাবে জার্মান প্রশাসনকে সহযোগিতা করছিল। কারণ তখনও সে ভাবছে শেষ পর্যন্ত কয়েকজন হলেও ইহুদিকে বাঁচাতে পারবে। ইতিহাসের সূত্র ধরে জানা যায়, গেটো থেকে গ্যাস চেম্বারে যাবার শেষ ট্রেনের শেষ যাত্রী ছিলো চাইম রুমকোভস্কি। তবে গ্যাস চেম্বারে নয়, তার মৃত্যু হয় স্বজাতির হাতে। আসউইচ গ্যাস চেম্বারে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষারত পোলিশ ইহুদিদের গণপিটুনিতে।

দৃশ্য ৩: ক্ষুধা ভাইরাসে পথে পথে মানুষ
লকডাউনে থমকে গেছে পৃথিবী। শুনশান রাস্তা। পৃথিবীর চিত্র বদলে গেল কদিনেই। এ যেন প্রকৃতির এক বৈপরীত্যের খেলা! মানুষ হয়েছে ঘরবন্দী। ডলফিন খেলছে সৈকতে। জনশূন্য রাস্তায় নেমে এসেছে ক্যাঙ্গারু। বুনো হরিণ এসে দিব্যি দোকানে ঢুকে গেছে।
এদিকে পিল পিল করে মানুষ বেরিয়ে আসে রাস্তায়। হাঁটতে শুরু করে বঙ্গভূমির রাজধানী ঢাকা অভিমুখে। ৪ এপ্রিল, ২০২০। দেখা গেল পথ হাঁটছে লাখ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিক। গণপরিবহন বন্ধ। বাস, ট্রেন না পেয়ে নিজের পা দুটির ওপর ভরসা করে বেরিয়ে এসেছে। কারণ লকডাউনের মাঝখানেই কারখানা খুলে দেয়া হয়েছে। সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির সঙ্গে সমন্বয় রেখে গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ রাখার নির্দেশনা ছিল। সেটা বাতিল করেছে নিটওয়্যার মালিকদের সংগঠন। বিকেএমইএ। ফলে কারখানা খোলায় আর কোনও বিধি নিষেধ নেই।
মানুষ জানলো করোনার চেয়েও শক্তিশালী ভাইরাস আছে। সে হলো ক্ষুধা ভাইরাস, চাকরী-হারানোর-ভয় ভাইরাস। কোভিডে মৃত্যুভয় এসব ভাইরাসের কাছে পরাস্ত। ফজরের নামাজ পড়ে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা থেকে হাঁটা শুরু করে মানুষ। গন্তব্য গাজীপুর। ভিড় বাড়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে। শেরপুর থেকে মানুষ হাঁটে নারায়ণগঞ্জের দিকে। লাখো মানুষ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে। শত শত কিলোমিটার মানুষ হাঁটছে। কেউ একদিন, কেউ দুদিন ধরে। হাজার হাজার মা হাঁটছে ছোট শিশু কোলে নিয়ে। ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত আর অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তবু হাঁটার বিরাম নেই। পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাট ও মাওয়া ঘাটে পোশাক শ্রমিকদের ভিড়। সামাজিক দূরত্বের তোয়াক্কা করছে না প্রয়োজনের তাদিগেই। ৫ এপ্রিল, ২০২০ গার্মেন্টস খুলবে। সময় মতো না পৌঁছালে বেতন তোলা যাবে না। এমন খবর ছড়িয়ে পড়ে।
এটা কি তামাশার লকডাউন? সাধারণ মানুষের মাথায় ঢোকে না। করোনা ভাইরাসের বিস্তার আটকাতে সরকার সব ধরণের চেষ্টা করছে অথচ রাস্তায় মানুষের ঢল। গার্মেন্টস মালিক সংগঠনের সভাপতি জানালেন- রপ্তানীমুখী যেসব প্রতিষ্ঠানে অর্ডার আছে এবং উৎপাদন চলছে, কারখানার মালিকরা সেসব শিল্প কলকারখানা চালু রাখতে পারে। অবশ্যই শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার সাপেক্ষে। এ বক্তব্য শুনে তীব্র ক্ষোভ দানা বাঁধে সাধারণ মানুষের মনে। নানা প্রতিক্রিয়া, মত-অমতে ফেসবুকের নিউজফীড উপচে পড়ে। জল্পনা কল্পনার কারুকাজ চলতে থাকে টিভির টক শো আর নিউজে।

দৃশ্য ৪: ‘এতক্ষণে’, অরিন্দম কহিলা বিষাদে…
ঢাকার কাছাকাছি চলে আসা শ্রমিকরা ফের হাঁটা শুরু করে। এবার কারখানার সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে। তাদের ফেরত পাঠানোর ঘোষণা আসে ৪ এপ্রিল রাত ১০টায়। পুলিশকে নির্দেশ দেয়া হলো শ্রমিকদের যেন রাজধানীতে ঢুকতে না দেয়া হয়। ঢুকে যাওয়া শ্রমিকরা ৫ তারিখ কারখানায় পৌঁছে দেখে কারখানা বন্ধ। খুলবে ১২ এপ্রিল। এ যেন সার্কাসের তাঁবুতে ‘আসা-যাওয়া’র আজব খেলা চলছে।
পথের ধারে খোলা ট্রাক, পিকআপে শ্রমিকরা যে যেভাবে পারছে হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়ছে। সেখানে সবাই সামাজিক নৈকট্যে। হাইওয়ের কয়েকটা পয়েন্টে পুলিশ ট্রাক থেকে শ্রমিকদের নামিয়ে দিল। ভাইরাল হওয়া ছবিতে পরদিন দেখা গেল, শ্রমিকরা পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ভয়ে ট্রাকের ওপর একেকটা ড্রামের ভেতর নিজেদের লুকিয়ে গ্রামে ফিরতে বাধ্য হচ্ছে। এ যেন সত্যি এক যুদ্ধ পরিস্থিতি।
কারখানা খোলার নেপথ্যে শোনা গেল- ৫ হাজার কোটি টাকার ইনসেনটিভ প্যাকেজ। গার্মেন্টস মালিকরা সরকারের কাছে চেয়েছিল প্রণোদনা, কিন্তু আসলে দেওয়া হচ্ছে ঋণ। এই টাকা গার্মেন্টস মালিকদের শোধ করতে হবে। ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জসহ। প্রণোদনা প্যাকেজ আসলে সহজ শর্তে ঋণের প্যাকেজ। এমন সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি গার্মেন্টস মালিকরা। তাই সরকারের কাছ থেকে ফের অফেরতযোগ্য প্রণোদনা নেওয়ার কৌশল ঠিক করা হয়। সেটা হলো সাধারণ ছুটির মধ্যেও গার্মেন্টস কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত।
নজিরবিহীন অব্যবস্থাপনা আর সমন্বয়হীনতার শিকার হলো লাখ লাখ শ্রমিক। সাধারণ ছুটির ঘোষণায় একবার তাদের ঢাকা থেকে গ্রামে পাঠানো হলো। কারখানা খোলার ঘোষণা দিয়ে, চৈত্র মাসের গরমে শত শত কিলোমিটার হাঁটিয়ে, ঘাম ঝরিয়ে ফের ঢাকায় আনা হলো। বেতন না দিয়ে আবার গ্রামে ফেরত পাঠানো হলো। অথচ প্রণোদনা প্যাকেজ দেয়া হয়েছিল শ্রমিকদের বেতন দেয়ার জন্য।
এই প্রণোদনা প্যাকেজে (ঋণে) অগ্রাধিকার পাবে কারা? সে প্রশ্নে না গিয়ে দেখা যাক, প্যাকেজের টাকা পাবার পর বাস্তবে কী কী হতে পারে। এখন দুটো ব্যাপার ঘটতে পারে। এক, মালিক যদি প্যাকেজের টাকা নিয়ে শ্রমিকদের বেতন দিয়ে দেয়। সেক্ষেত্রে মালিক ঋণগ্রস্ত হবে। ফলে শ্রমিকদের লে-অফ করা হবে। দুই, প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা নিয়ে মালিক যদি শ্রমিকদের বেতন না দেয়। এ অবস্থায়ও শ্রমিকদের লে-অফ করা হবে। কারণ, আইন অনুয়াযী সঙ্কটকালীন অবস্থায় শ্রমিকদের অর্ধেক বেতন আর সম্পূর্ণ বাড়িভাড়া দিয়ে লে-অফ করে দেয়া যায়। প্যাকেজে বলা হয়নি, যেসব মালিক শ্রমিকের বেতন দেবে এবং লে-অফ করাবে না, শুধুমাত্র তারাই প্যাকেজের সুবিধা পাবে।
যা হয়ে থাকে সবসময়, বাস্তবে তাই হবে। প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা নিয়ে মালিক শ্রমিকের বেতন দেবে না। আগের ঋণ রিশিডিউল করবে। সহজ সমীকরণ। প্রশ্ন হলো শ্রমিকের সাথে এ অন্যায়ের দায় কে নেবে?

দৃশ্য ৫: কোভিড গেটো থেকে গ্যাস চেম্বারে
শুরুতে বলেছিলাম রুমকোভস্কির কথা। সে ভেবেছিল উৎপাদনে দক্ষতা অর্জন করলেই ইহুদিরা বেঁচে যাবে। নাৎসী বাহিনী ইহুদিদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। এ যুগের গার্মেন্টস মালিকরাও রুমকোভস্কির মতো ভাবছে শ্রমিকরা উৎপাদনক্ষম থাকলেই দেশের আর দশের গতি। শ্রমিকের উৎপাদনশীলতাই রক্ষাকবচ। প্রণোদনা প্যাকেজ পাওয়া যাবে সরকারের কাছ থেকে। দরিদ্র শ্রমিকরা পঙ্গপালের মতো মরলেও আন্তর্জাতিক দাতাদের আর্থিক এবং অন্যান্য সহযোগিতা পাওয়া যাবে।
আপনারা ভুলে গেছেন কোভিডের গেটোতে আমরা সবাই অবরুদ্ধ। এ মুহূর্তে অর্থনৈতিক ঝুঁকির চেয়েও গুরুত্বপূর্ন খাদ্য সঙ্কট এবং গণস্বাস্থ্য ঝুঁকি। শ্রমিকদের দিয়ে উৎপাদন বাড়ালেই টিকে থাকা যাবে না। পুঁজি আর মুনাফার দাপটে ভুলে যাবেন না, সেলাই মেশিন চালানো এই শ্রমিকরাও ‘মানুষ’। কোভিড সঙ্কট মোকাবেলায় এই মুহূর্তে সরকারকে হতদরিদ্র শ্রমিক-মজুরদের সরাসরি অর্থ সাহায্য দিতে হবে। ন্যূনতম চিকিৎসা সেবা আর খাবার বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে। মালিক-শ্রমিক সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে জরুরী ভিত্তিতে।
মানুষ যদি বেঁচে থাকে কারখানা চলবে। রক্ত সঞ্চালন হবে অর্থনীতির শিরায়, ধমনীতে। অন্যথায় অদূর ভবিষ্যতে টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে পড়বে। সামনে সাক্ষাৎ হলোকাথ ট্রেন।

Facebook Comments

2 thoughts on “একালের রুমকোভস্কি, প্রণোদনা প্যাকেজ এবং কোভিডের গেটো : ইশরাত তানিয়া Leave a comment

    1. ধন্যবাদ শ্রাবণী। এ এক অনিশ্চিত কাল। এ দুঃসময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সাহস করে বাঁচতে হবে।

Leave a Reply