হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়-র কবিতা
মুছে গেল পূর্ণচ্ছেদ
বটপাতার মতো ছড়িয়েছিল সকাল
জানলার দুয়ার খুলে আলোর রেণুর বর্ণমালা
হঠাৎ করেই একদিন ঢুকে পড়েছিল গুরুমশাইয়ের
পাঠশালা ঘরে
তখন গাছ ছিল, নদীর জলের মতো ছিল অবাধ কথা
হাত ধরে এনে পরিচয় করিয়েছিল
হাজার বছর ধরে না ঘুমিয়ে থাকা ঘোড়ার অগ্রজ
নদীর গায়ের সঙ্গে শরীর বেঁধে মন্ত্র পড়িয়েছিল
ফুলের সকালে পুবের বাতাসে ভেসে আসা জলজ হৃদয়
গাছের পাতায় হাতেখড়ির দিন
যাবতীয় লোভনীয় উৎসবিন্দু পরিত্যাগের পর
প্রস্ফুটিত সূর্যবিন্দুর ঘোষবর্ণগুলি পরিচয়ের মুহূর্তে
পায়ের শিরদাঁড়া স্থির রাখার কাঠামো এঁকেছিল অগ্রজ
একটু একটু করে এগিয়ে যেতে যেতে
চারদেয়ালের মধ্যেকার জায়গা নির্দিষ্ট হলো
গোবর জল ছড়িয়ে আসন পাতলাম
বাসনের কলহ ভুলে অতি আহ্লাদে এক থেকে দুই
দুই থেকে তিন চার পাঁচ ——- আরও কত কিছু
অগ্রজের অভ্যস্ত হাতে
অতি জটিল সমীকরণের দাবদাহও সহনীয় হলো
ফুল পাতায় জড়িয়ে জড়িয়ে
যে পথ তৈরি হয়েছিল আমাদের ঘরে ঘরে
কেউ খুঁজি নি তার উৎসবিন্দু
একদিন হঠাৎ করেই বিকেলবেলা বাস ধরে
কোথায় যেন চলে গেল রোজের সকাল
একটা সুঠাম বাক্যবন্ধ থেকে মুছে গেল পূর্ণচ্ছেদ
বাক্য গড়িয়ে চলে এখনও
একঘেয়ে রঙের বিরামহীন পদচারণা
সামনে দাঁড়িয়ে প্রাত্যহিক হাতের অভাবে
দুদণ্ডের বৈঠকখানা একা পড়ে থাকে ।
সবুজ পৃথিবীর সমাহার
ফাটা বাঁশের মধ্যে থেকে যে আওয়াজ বেরিয়ে আসে
তা দিয়েই একটা গোটা জাতিকে সম্পূর্ণ চেনা যায়
চোখের সামনের সব মানুষ হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছিল
একটার পর একটা ইতিহাসের পাতা
হাতের দূরত্বে তৈরি করে ফেলেছিল
রঙবেরঙের মন্দির মসজিদ গির্জা
আর নিজেরাও ছড়ানো হাতের ওপর শুয়ে পড়ে
একটার পর একটা বস্তাপচা বাতিল লাইন
তোতাপাখির মতো অবিশ্রাম আউড়ে যাচ্ছিল
শিশুদের চিৎকার মুখের হাঁগুলোকে
গোপন গর্তের মধ্যে ডুবিয়ে দেওয়া হচ্ছিল
আর মানুষের যাবতীয় চাহিদা এক ফুঁয়ে উড়িয়ে
সকলের চোখের সামনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছিল
এক একদিনের জয়স্তম্ভ
আঙুলের চাপেই বদলে বদলে যাচ্ছিল দিন রাত
সারা পৃথিবীতে উড়বে নিজের পতাকা ——–
এই ভেবে যারা সমুদ্র সমান কাপড় কিনেছিল
তারা এখন নিজের শরীর আর মুখ ঢাকতেই ব্যস্ত
দিনের ঘন্টা মিনিট সেকেন্ড সব শেষ
হৃদয়ে এখন বাতাস নেই, মাংস গজগজ করছে
কোন কালে মানুষ শুনেছে মাংসের কথা বলা
তিনদিনের টকে যাওয়া বাসি গোলা রুটির মতো
ধর্ম এখন ছাঁচতলা পেরিয়ে উঠোনের এক কোণে শুয়ে
সকালে জমাদারের তুলে নিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়
উপাসনালয় আজ কোনো নির্জন স্টেশনের
বিশ্রামঘরের আদলে
সবাইকে চমকে দিয়ে ইতিহাসের শিশু মুখ তুলেছে
তাদের মুষ্টিবদ্ধ হাতের তালু সবুজ ধানক্ষেত
শতাব্দী প্রাচীন দুঃখের বাষ্পে ঘনীভূত মেঘ
আরও একটু ভারী হয়ে বৃষ্টিগান শুরু হলেই
পৃথিবীর উঠোনে সকাল নিয়ে নামবে চড়াই
শস্যক্ষেত্রের ধানের জ্যামিতি কুঁদে নেবে
সবুজ পৃথিবীর সমাহার ।
Posted in: April 2020, Poetry