গল্প : ফাল্গুনী ঘোষ

‘ছোকরা’ চিতের সংক্রমণ

ট্রাক্টরটাকে প্রায় গায়ের জোরে চালু করে এক নিঃশ্বাসে চালিয়ে এসে থামল ‘চিতে’। গাড়িটা বিগড়েছিল মাঝ রাস্তায়। তখন একদিকে শেষ চৈত্রের হাঁ করা দুপুর রোদে তরবারির শান বাঁধানো ঝলক, অন্যদিকে চিতের পেটে চোঁ চোঁ খিদের দমক। আবার ম্যানেজার শেয়ালের শ্যেন দৃষ্টি নিয়ে সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টার সাথে টাকার অঙ্কের ব্যাস্তানুপাতিক লুকোচুরি খেলায় রেফারির বাঁশি বাজিয়ে দিয়েছে। কেননা চিতে কর্মচারী আর নগেনবাবু ম্যানেজার। ফলত, চিতেকে পড়িমড়ি করে দৌড়াতে হয়! লোম ওঠা কুকুরের মতো ঘামঝরা সময়কে হারিয়ে দিয়ে রঙচটা শার্টের হাতায় উভয়ত তৃষ্ণা ও বিতৃষ্ণা মুছে নিতে হয়।
“কি রে চিতে! দশ কিলোমিটার রাস্তা আসতে এত সময় লাগে?”
বোকাসোকা চিতের তস্য বোকা হাসি উত্তর দেয়, “না দাদা! ট্রাক্টরট্যো মাঝ রাস্তায় বেগড়বাঁই করতে লাগল জ্যি! তাই খানিকট্যুন দেরী হঁইয়্যে জ্যালো!”
মধ্যগগনের শানবাঁধানো রোদ্দুরে তখন একটা চিল দূর আকাশে অবিরাম পাক খেয়ে যাচ্ছে। যেন ঝরে পড়া আগুনের মধ্যে ছোঁ মেরে কয়েক মুহুর্ত জীবন ঠুকরে নিয়ে উড়ে যাবে কোন নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে, অনেকটা চিতের মত! ম্যানেজার দাদা যদি দিনমজুরী থেকে টাকা কাটে ! ঐটুকুই তো সম্বল। ভয়ে ভাবনায় ভাবতে ভাবতেই রোদের ফলার থেকেও তীব্র তীক্ষ্ণ আওয়াজ বেরিয়ে আসে ম্যানেজারের গলাতে—
“বাহানা তোদের খুব। আর ন্যাকাবোকা মুখে ঢেকে রাখিস আসল শয়তানি! পয়সা আদায়ের কায়দা যত! এক পয়সা বেশি পাবি না!”
লেবার , খালাসিদের মাইনেপত্র বুঝিয়ে দিয়ে চিতে কড়কড়ে নোটগুলো দু চারবার বেশিই গোনে। তৃতীয় শ্রেণির বিদ্যা ঝালাই করে কড় ধরে ধরেও সে হিসেব মেলাতে পারে না। পঞ্চাশ টাকা কম। অত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে টাকা গুনতে দেখে ম্যানেজার চিতের কানের গোড়ায় চাপা বিরক্তির সুরে বলে—
“হ্যাঁ রে হ্যাঁ ! ঠিকই গুনেছিস! রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকবি তার গুণাগার দিবি না! আর শোন কাল থেকে আর আসতে হবে না।“
“পঞ্চাশ টাকা কেট্যে লিল্যেন ঠিক আছ্যে। কিন্তু সামান্য একট্যুন দেরীর লেগ্যে কাজ থেকে ছাড়িন্যে দিছ্যেন!”
একপ্রকার ভেঙচেই বলেন নগেনবাবু……” কাজ থেক্যে ছাড়িয়্যে দিছ্যেন!…… মুখ্যের দল! পৃথিবীর কোনও খবরই তো রাখিস না। আমার খাদান বন্ধ থাকলে , কোনো কাজ না হলে পয়সা গুনতেই বা যাব কেন তোদের পিছনে!”
ভাবনায় অস্থির হয়ে ওঠে চিতে। মালিক খাদান বন্ধ করে দিলে আবার কাজ খুঁজতে যেতে হবে। এদিকে মাস গেলে ছেলেটার প্রাইভেট টিউশনির খরচ! ক্লাস টেনে পড়ে যে!
চিতের ভাবনাক্লিষ্ট চেহারায় আশ্বাস দেয় ম্যানেজার—“ আরে বাবা! পৃথিবীতে একটা রোগ এসেছে। মানুষ মানুষের কাছে গেলেই রোগটা বেড়ে যাচ্ছে। তাই এখন কিছুদিন বন্ধ রাখতে হবে!”

· * * * * *

ওদিকে উত্তর পশ্চিম কোণে সিঁদুরে মেঘ লেগেছে। পূব থেকে বয়ে আসা পাকা রাস্তা ধরে জোরে জোরে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দেয় চিত্তরঞ্জন যাকে একডাকে সবাই ‘চিতে’ বলেই জানে। এলোপাথাড়ি হাওয়া ফুঁসে উঠে সাইকেলের প্যাডেলে ধাক্কা খেয়ে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। কেননা চিতের ভয় ভীতি নাই। চুপচুপে তেলে ভেজা ঘাড় ছাপানো এক মাথা চুল, যা টেনে আঁচড়ানো থাকে সে মুহুর্তে ফুঁসে ওঠা হাওয়ার সাথে পাঞ্জা লড়ছে, ফলত তার চেহারা এখন অনেকটা ঝোড়ো কাকের মত।
উত্তাল হাওয়ার সাথে আধঘন্টার ক্রমাগত অসম লড়াই, কাজ বন্ধ থাকার ভাবনা ধীরে ধীরে ছেয়ে গেছে চিতের সারা শরীরে। ঠিক যে মুহুর্তে উত্তর পশ্চিম কোণ ছেড়ে সিঁদুরে মেঘ সারা আকাশে ঘন কালি ঢেলে দিয়েছে, সে মুহুর্তে চিতে এসে দাঁড়ায় বাড়ির দরজায় ।
চিত্তরঞ্জনের পাকা রাস্তার পাশেই মাটির কোঠাপারা ঘর। ঘরের চারদিকে ছিটেবেড়ার ঘেরা দিয়ে কিছুটা একলা পরে থাকা জায়গায় শসা, লঙ্কা, শাক, টমেট্যো, এককোণে পেঁপে, লেবুর গাছ, পাশ থেকে কোঠাপারা ঘরের খড়ো চালে উঠে গেছে লাউ, কুমড়োর লতা। ছিটেবেড়া ছাগল, কুকুর, গোরু আটকালেও মানুষ আটকাতে অক্ষম।
চিতে সাইকেল থেকে নেমেই ছিটেবেড়া ডিঙিয়ে আঁতিপাঁতি দেখতে থাকে উঠোনের কোণে কোণে।

চিত্তরঞ্জন লেট তার আদরের ডাক নামটি পেয়েছে ভাদু দলের সাঙ্গোপাঙ্গদের থেকে। এটি তার বড় সখের জায়গা আবার মায়ারও। চিত্তরঞ্জন বরাবরই নরমসরম শান্তশিষ্ট হলেও পারিবারিক জাঁতাকলের চাপে তৃতীয় শ্রেণির পাঠ চুকিয়েই বাবার দেখানো রাস্তায় উপার্জনক্ষম যন্ত্রে পরিণত হয় খুব অল্প বয়সেই। ফলত; রঙিন মেঘের জাদু বা অস্তগামী সূর্য কি ঢলঢলে লাজুক প্রকৃতির প্রেমে পড়ার আগেই সামাজিক নিয়ম এবং জৈবিক চাহিদার ভিত্তিতে বিয়ে করে ঘোরতর সংসারী হয়ে ওঠে সে। আর কে না জানে গাঁ গঞ্জে বিয়ে মানেই দু- তিনটি করে খিদের সংখ্যাবৃদ্ধি, যা মেটানোর দায় কর্তাকেই নিতে হয় প্রথানুসারে। সুতরাং চিত্তরঞ্জন পাথর খাদানের বোল্ডার তোলা লেবার হিসেবে যে পেশাগত যাত্রা শুরু করেছিল, গাড়ির খালাসি থেকে ড্রাইভার হয়ে সে যাত্রার সমাপ্তি ঘটে তার। আর পেশাগত উত্তরণের ফাঁকেফোকরে অসংখ্য ঋতু, মাস, বছর, বসন্ত, শরৎ ,বর্ষা, গ্রীষ্ম তাদের লাল-নীল- সবুজ- হলুদ রঙ ছড়িয়ে যাওয়া আসা করতে থাকে। আকাশে চাঁদ ওঠে, ছায়াছায়া অশরীরি আবেদন রেখে যায় চকিতে কিন্তু চিতে বা তার বউ-এর এসব দেখার ফুরসৎ কই! তাদের জীবন কাজ-খিদে-ঘুম আর খিদে-ঘুম-কাজের দোলায় চক্রাকারে আবর্তিত হতে থাকে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর।
একদিন সকালে ঘুম ভেঙে চিত্তরঞ্জনের মনে হয়, কই! তার বাড়িতে তো খিদের সংখ্যা বাড়ছে না! বছর পাঁচেক হতে চলল তাদের বিয়ে হয়েছে। অনেক ঠাকুর দেবতার আশীর্বাদে শেষ রক্ষা না হলেও বন্ধু রক্ষাকর্তার ভূমিকা নেয়। চিতে খোঁজ পায়, ভাদু নাচালে নাকি বাচ্চা হয়! ফলত, শুরু হয় চিত্তরঞ্জনের রূপান্তর। শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ আসে। আসে বল দেওয়া ব্রা। চুলের খোঁপা, মুখের রঙ, চোখের কাজল, ঠোঁটের লিপস্টিক, মাথার লাল উড়নিতে চিত্তরঞ্জন তখন পুরোদস্তুর লাজে রাঙা হলো কনে বৌ। ভাদুর দলে একে বলে ‘ছোকরা’ সাজা। ‘ছোকরা’ চিতে চিত্তরঞ্জনের পারিবারিক ইতিহাসে পালাবদলের ইঙ্গিতবাহী বলাই বাহুল্য।
প্রথম দিন সেজেগুজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চিত্তরঞ্জন নিজের বউকে ডেকে সোহাগ করে বলেছিল, “দ্যাখো কেনে, কেমন লাগছ্যে!”
বউ ঠোঁট টিপে মুখ বেঁকিয়ে উত্তর দিয়েছিল, “মরণ!’
ঠিক সেদিনই এক রাতচরা পাখির ডাকে নরম রাত নেমেছিল চিত্তরঞ্জনের মেটে ঘরে। পাড়া প্রতিবেশীর হাসি ঠাট্টা উপেক্ষা করে ভাদুর দলে ‘ভাদুমা’ কে কোলে নিয়ে গাঁয়ে গাঁয়ে নাচিয়ে বেড়ায় সে। তার বড় দায়, কেননা সে ভাদুর মা। কোলের ছেলের নাওয়া, খাওয়া, ঘুম পাড়ানো, ইস্কুল পাঠানো যাবতীয় কাজ সেরে রাত গেলে শুরু হয় বউ-এর সাথে রসের গপ্প। কেমন করে কোমরে ঠমক লাগিয়ে তাকে নাচতে হয় সেকথা শুনে তার বউ স্বামীর বুকে লুটিয়ে পড়ে হাসতে হাসতে। শেষ ভাদ্রের চটকা মেঘ চিত্তরঞ্জনের টিনের চালে ঝমঝমিয়ে হেসে যায়। পাড়া গ্রামে সবাই দেখে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই চিতের বউ গর্ভবতী।
আর পাঁচটা লোকের মতোই চিত্তরঞ্জনের প্রবল বিশ্বাস ভাদু মায়ের দয়াতেই তার ছেলে। সেই শুরু। আজ অবধি তারপরের দিনগুলোর বাঁধাধরা রুটিন ভাদুর আখড়ায় সান্ধ্য আড্ডা, গান, বাজনা, গল্প গাছা।

· * * *

ঘরের ভিতর ছোটো ঘুলঘুলি জানলা থেকে চিতের বউ দেখে তার স্বামী খাদান থেকে ফিরে হুড়মুড়িয়ে বাগানে ঢুকে গাছপালা, শাকপাতা ঘেঁটে বেড়াচ্ছে। হাঁক পাড়ে সে—

“ কি খুঁজছ তুমি? এই অবেলাট্যোতে হ্যাঁ গো………”

ছিটেবেড়া ডিঙিয়ে অদ্ভুত চাউনিতে স্ত্রীকে দেখে সে। কালবৈশাখীর ঝড়ে উড়ে আসা রাজ্যের ধুলো তেল চুপচুপে চুলের সাথে জোট পাকিয়ে জটিল হয়ে উঠেছে। ঠোঁট খরখরে শুকনো, অস্থির দৃষ্টি কি যেন আঁকড়ে ধরতে চাইছে। বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে মালতীর । কি হলো মানুষটার! গ্রামে গঞ্জে খারাপ বাতাসে অনেকের কুনজর থাকে। এসব নজর লাগলে মানুষকে শুষে ছিবড়ে করে দেয়! তেমন কিছু হল নাকি! জ্বর এল নাকি!

হঠাৎ ঝাঁঝিয়ে ওঠে চিতে, “হাঁ করে দাঁড়িন্যে কি সঙট্যো দেখছ! প্যাট জ্বলে যেছ্যে ! চাট্টি ভাত দেবা না এখানে দাঁড়িন্যে থাকবা!”

এরপর ঝপাং করে পুকুরের ঘোলা জলে ডুব দিয়ে এসে দু চার গ্রাস মুখে তুলে যখন দৌড় দেয়, তখন ঘরে ঘরে শাঁখের আওয়াজ। আকাশের ঘন মেঘের সঙ্গে শলা করে সন্ধে একটু তাড়াতাড়িই অন্ধকারের পর্দা টেনে দিয়েছে যেন। সেই ক্ষণে দাওয়ার আবছায়া অন্ধকারে কুন্ডলীপাকানো ফোঁপানির পাশে ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ায় চিত্তরঞ্জনের একমাত্র সন্তান।

“আজকে বাপ এত মেজাজ করল্যে কেনে বলত! নিশ্চয়ই খাদানে কুনো ঝামেলা হঁয়েছ্যে মা!”

বাপ নেওটা ছেলেটাকে দেখে মালতী। ছেলেটার জন্য হাতে করে চমচম, গজা, মদন কটকটি কিছু না নিয়ে বাড়ি ঢোকে না যে লোকটা, আজ তার এত মেজাজ দেখে হকচকিয়ে গেছে মালতী। যে নরম সরম চিত্তরঞ্জন ‘ছোকরা’ সাজা ইস্তক আরও লাজুক হয়েছে দিনেদিনে , পেটের খিদের জন্য তার এত মেজাজ!

সেদিন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে ভাদু দলের মূল গায়েন, দোহার, বাজনদার, ছোকরা। অন্যদিন দু দফা চা আসে। ঠাট্টা ইয়ার্কির সাথে মিশে যায় পাশের ঘরের মেয়েদের হাসির গিটকিরি। আজ পরিবেশ থমথমে । হাসি, গান- বাজনার হুল্লোড় নেই। সবার কানে পৌঁছে গেছে খবর। কি এক জ্বর এসেছে! মানুষ মানুষের কাছে যেতে আসতে পারবে না— এই জ্বরই বাধা!

“কিন্তু তুমি বুল্যোতো দুলালদা, আমার শরীলের জ্বর কি করে তুমার শরীরে যাব্যে?” ফালতু কথা যত—- রাগে গসগস করে ভাদুর মা।

দলের অধিকারী একটু শাসন করে বকে ওঠে, “না ছড়ালে কি এমনি বলছে! ডাক্তার , বড় বড় মানুষরা নিশ্চয় বুঝেছে যে এট্যো ছড়ায়……”

“তা আমাদের ইখান্যে কার হঁয়েছ্যে…… যি কাজ বন্ধ কর‍্যে দেবে!……”

সবাই ঘাড় নাড়ে। দলের অধিকারী নিজ দায়িত্ববোধে বিড়বিড় করে সান্ত্বনা দেয়,

“দ্যাখো দিন সাতেক – দশেক পরে নিশ্চই আবার সব খুলে দেবে।”

· * * * *

রাত্রেবেলা খেতে বসে হঠাৎ কলকলিয়ে ওঠে চিতে, “ বিষ্ণু বুলল্যে বটে দিন দশেক! চালে দেখলাম একখ্যান কুমড়ো ঝুলছ্যে, দু খ্যান লাউ মাচার ফাঁকে। কাঁচকলা, লঙ্কা, লেবু, গাবার পাড়ের হিঞ্চে, শুসনি, কলমি শাক সব লিয়্যে দিন দশ কেনে দিন পনেরোর খোরাকি হঁয়্যে যাবে লয় গিন্নি!”
আকাশে তখন ছেঁড়া ছেঁড়া কালো মেঘ দিগন্তের আবছা আলো মুছে ছড়িয়ে দিচ্ছে আরো মিহিন অন্ধকার। যে অন্ধকারে এক চিলতে প্রশান্তি নাড়া দিয়ে যায় পরিবারটিকে। সব শুনে বৌ আরো ঘন হয়ে মাটির খুপরিতে এসে বলে,
“এর লেগ্যে এত্ত মেজাজ! ক’দিন খাদান না জেল্যির কি হয়! নাহয় আমার ঘরের খাদানে কাজ কাম করবা, দুটি ভাত বেশি খেতে দুবো……… হি হি …… হি হি হি ……”
পাশের কুঠুরিতে ছেলে বই নিয়ে বসে। মাধ্যমিকটা ঠিক করে পাশ দিতে হবে তাকে । মাষ্টার হওয়ার খুব ইচ্ছা তার, ঠিক তার ইশকুলের পার্থ মাষ্টারের মতো।
তারপরের দিন দশ বারো শাক, সেদ্ধ, পোড়া, নুন, ভাত, খাল-বিলের কচি বুড়ো মাছ সহ ভাগাভাগি করে এদের দিন রয়ে বসে গড়িয়ে যায়। সন্ধেয় জমে চিরাচরিত ভাদুর ঠেক। সাধারণত কোনো বিশেষ কারণ বা ভাদুর শো না থাকলে অত ধরাচূড়া পড়ে এরা সাজে না। কিন্তু চিতের জেদাজেদিতে কোমর দুলিয়ে দু- একদিন নাচতে হয়েছে সবাইকে। সেকারণে খিদের বৃদ্ধি আরো তীব্র হয়ে উঠেছে। রাতের দিকে একাই দেড়জনের ভাত খেয়ে নিয়েছে চিতে।

দেখতে দেখতে দিন কুড়ি হল কাজ বন্ধ। ভাগ্যিস ছেলেটার টিউশনি খরচটা এখনই দিতে হবে না! — মাটির দাওয়ায় সকালের রোদে বসে বিড়বিড় করে মালতীর বর। দুদিন ধরে চিতে নজর করেছে, বৌটা তার সামনে খেতে বসে না! মাঝে মধ্যেই ছেলেটা থালায় কিছু ভাত ফেলে রেখে উঠে যায়। এরকম অপচয় দেখলে গা জ্বলে যায় চিত্তরঞ্জনের। আবার মা এসে ছেলের দোষ ঢাকে, থালা উঠিয়ে নিয়ে চলে যায়! গতকাল তো দাঁতে দাঁত পিষে বলেই দিল,
“নবাবপুত্তুর! এই আক্রার বাজারে ভাত ফেলছেন !”—- বৌকে সুযোগ না দিয়ে এক খাবলায় ক্ষুধার্ত কুকুরের মতো ভাত ক’টা নিজের থালায় তুলে নিয়েছিলো সে। বাইরে গিয়ে তাকেই তো পেটের ভাত জোটাতে হবে! তারই পেট ভরুক।
কদিন তাও ভাদুর আখড়া নিয়ে সব ভুলে থাকা যাচ্ছিল। কিন্তু পুলিশের গাড়ি যমদূতের মতো সাবধানবাণী শুনিয়ে গেছে—‘ এক জায়গায় ছ সাত জন জড়ো হওয়া যাবে না।‘ পাড়ায় কারো টিভি নামক যন্ত্রটি না থাকার দরুন দূর দেশের খবর অত রাখে না সে। সবার মুখে এক রা। ‘সামনে না কি খুব ভয়ানক দিন আসছে।‘
সকালের রোদে ঝিমিয়ে বসে থাকে চিতে। একেবারে বারোটার সময় বেশি ফ্যানসহ নুন ছেটানো একবাটি ভাত তার সামনে নামিয়ে দেয় বৌ। চিতে জানে না তার ছেলে বৌ কি খায় না খায়! মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় তাকে লুকিয়ে নিশ্চয় দু চার গাল মুড়ি চিঁড়ে খায় নাহলে এত খাটে কিকরে! দুপুর বারোটার পর একবাটি নুন ছেটানো ফ্যানভাতের বরাদ্দ আবার রাত্রি ন’টায়। গায়ের শক্তি এক জায়গায় করে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে মাঝে মধ্যে পুকুরের গাবায় গিয়ে বসে। দু এক আঁজলা ঐ জল খায়। পুকুর থেকে কলমি, শালুক তুলে তুলে জল এখন প্রায় টলটলে। পাশেই টিউবওয়েল থাকলেও সে কলের হাতলে হাত ছোঁয়ায় না । নাহ, রোগের ভয়ে নয়! কল থেকে জল বের করতে গেলে বড্ড ক্ষিদে পেয়ে যায়।
ঘটনা ঠিক তার দু একদিন পরের । ভোর থেকে শুরু হল ছেলের বমি। আগের দিন নাকি ভাত না খেয়ে আদাড়ে বাদাড়ে টকো আম, কুল খেয়ে বেরিয়েছিল। নিজের হাত কামড়াতে না পেরে বউ এর মাতৃত্বে আঘাত দিতে খিঁচিয়ে ওঠে ছেলের বাবা,
“মা হয়ে ছেলেটাকে চাট্টি খেতে দিতে পারো নি! নিজে আগে খেছ!…………”
“আর তুমি বাপ হয়্যে জানো নি কেনে , যি হাড়ি কুড়িতে চাল নাই! খোঁজ নিইছিলা ছেলেট্যো খেয়েচে কিনা! আমি কি খেছি বাড়িতে! নিজে তো খুব হাউহাউ করে গিলছিলা!……”
আঙারপারা বাক্যের ছ্যাঁকা সারা অঙ্গে মেখে মুখে রা’টি না কেড়ে তালগাছের ঝোপের কাছে দুমদুমিয়ে এসে দাঁড়ায় চিতে। সাথে মরা রোদে চিড়বিড়ানি জ্বলন নিয়ে প্রকৃতি যথার্থ সঙ্গত করে। সারা মুখ চোখ জ্বলছে চিতের। টকটকে লাল দুটো চোখ। জিভ শুকিয়ে খরখরে । গায়ে জ্বরের জ্বলন পোড়ন। নাড়িভুঁড়ি খিদের জ্বালায় জ্বলছে। থাকার মধ্যে সম্বল শুধু ঐ মোবাইল ফোন। বারবার ম্যানেজারের নাম স্ক্রিনে উজ্জ্বল ফুটে ওঠে। হাত চলে যায় কলিং বাটনে।

খিদেয় টলতে টলতে ট্র্যাক্টর নিয়ে নদীর ধার বরাবর হাঁটতে থাকে চিতে! ম্যানেজার বলেছে এক ট্র্যাক্টর বালি তার খাদানে আজ পৌঁছে দিতে পারলেই বাকি জীবনের মত তার নিশ্চন্তি। খাদানে নাকি একটা বড় স্টোর রুম তৈরি হবে। তাছাড়া এখন চুরি করে বালি তোলা ব্যাপারটাই নেই। জনমনিষ্যিহীন পথ! খাঁ খাঁ মাঝ দুপুর যেন তার করালগ্রাসে গিলে নিতে চাইছে সে পথের ছায়াটুকুও। হুশহাশ বালি তুলছে চিতে। পাহারাদার হিসেবে অসুস্থ ছেলেটাকে এনেছে। বসিয়ে রেখেছে ড্রাইভারের ছাউনিতে। এখন একটু কষ্ট কর বেটা! খাদানে পৌঁছাতে পারলেই শান্তি। নগেনবাবু ভালোমন্দ যদি কিছু খেতে দেয় ছেলেটা পেট পুরে খাক! বাবা হয়ে এটাই মনেপ্রাণে চাওয়া তার!
সব সেরে প্রায় শেষ বিকেলে খাদানে পৌঁছে, ছেলেকে বালি পাহারা দিতে বলে নগেনবাবুর সামনে দাঁড়ায় বুক চিতিয়ে। হাত কচলে কচলে বলে, “ভুল্যি নাইখ দাদা, ভুলি নাই ………”
“মনে রেখেছ , সারাজীবন মনে রেখ কথাটা…… “ হেঁ হেঁ ছন্দে ম্যানেজারের মাথা তাল মিলিয়ে দুলতে থাকে।
উত্তর- পশ্চিম কোণে সেদিনের মতো আজও মেঘ লেগেছে খুব। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সারা আকাশে ছড়িয়ে যাবে তা। গুমর দেখে মনে হচ্ছে খুব ঝড়ও উঠবে। সব লেনদেন শেষে জোরে পা চালিয়ে হাঁটতে থাকে চিতে। আজ বাড়ি গিয়ে গরম গরম ভাত খাবে। খুব খিদে পেয়েছে তার।
তার ছেঁড়া ব্যাগে ম্যানেজারের দেওয়া পঞ্চাশ হাজার টাকার কড়কড়ে নোট। সেই টাকায় সে সারাজীবন গোগ্রাসে ভাত খাবে। তার খুব খিদে…… তার বৌয়ের খুব খিদে……নগেন ম্যানেজারের খুব খিদে… অনেক বড় খাদান করবে…… আরো স্টোর রুম হবে…… সস্তায় বাঁধা লেবার কিনতে চায় সে…… অনেক বড় খাদানের মালিক হবে নগেনবাবু…… চিতের ছেলেটা সারাজীবন খেয়ে পরে বাঁচবে, কেননা তারও যে খুব খিদে………।

Facebook Comments

Leave a Reply