সম্পাদকীয়
কোথাও একটা গুলির শব্দ নেই, কেউ কারও দিকে তাক করেনি, গুলি ছোঁড়ে নি …
তবু মৃত্যু !! এক দুই তিন নয়, শ’ নয় হাজার নয় … লাখ ছাড়িয়েছে। হাত আকাশের দিকে, পালিয়ে বাঁচবে মঙ্গলে সে বোধ হয় আর হয়ে উঠলো না! আশীর্বাদ শুষে নিয়ে অভিশাপ ছুঁড়ে দিল বাকিদের!
এতদিন যারা সভ্যতার সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে, শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই করেছে, পেশি ফুলিয়ে বোম্বেটেগিরি করেছে দুর্বলকে পিটেছে, লুটেছে পুটেছে, এই সেদিনও আমাজান জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিয়েছে অমৃতকুম্ভের সন্ধানে … সেখানে আজ মৃত্যুর ঢল … এখন আক্রান্ত তালিকার শীর্ষে!
ভাইরাস করোনা এক হুইসিলে সব নাচন কোদন থামিয়ে দিয়েছে … নিস্তব্ধ করে দিয়েছে সব – শব ছুঁতেও এখন ভয়!!
‘অপরজন’ স্থির করেছিল এপ্রিল সংখ্যায় ‘লকডাউন’কে ধরার চেষ্টা করবে নানা দিক থেকে। কতটা করা গেল সে সম্পর্কে পাঠক বিবেচনা করবেন। করোনা বা লকডাউনে উঠে আসছে অনেক ছবি। পাপ-পুণ্যের ছবি! দু’চারটের উল্লেখ করা যেতেই পারে।
এক:
ছত্তিশগড়ের বিজাপুর গ্রামের বাসিন্দা, বারো বছরের বালিকা, নাম জামলো মকদম। ‘ছোটজাতের’ হবে, নয়তো আদিবাসি! বাড়িতে খাবার জোটেনা, ইস্কুলে যেতে কেউ বলেনি। বৃত্তির অন্বেষণে বাড়ি ছাড়া। ১৫০ কিলোমিটার দূরে তেলেঙ্গানার এক গ্রামে পাড়ি। একা নয় অনেক অনেকে একসাথে। কাজ জুটে যায় এক লঙ্কা বাগানে। কাজ জুটে গিয়েছিল আড়কাঠির হাত ধরে। লঙ্কাকে দেখার জন্যে জামলোরা আছে। জামলোদের দেখার কেউ নেই। অথবা যাদব গগৈ। দু’পায়ে কতটা পথ হাঁটা যায়! কতটা পথ হাঁটলে পরে তাকে পথিক বা কতটা গতর খাটলে শ্রমিক বলা যায়! গুজরাট থেকে অসম—২৯০০ কিলোমিটার। অসমের নগাঁও-এর যাদব গগৈ ধান্দায় গিয়েছিলেন গুজরাটে। লকডাউনের সাথে সাথে ছাঁটাই হয়ে যান। বাড়ির দিকে রওনা দেন অন্যদের সঙ্গে বাসে ও পরে ট্রাকে চেপে বেশ কিছুটা, তারপর পায়ে হাঁটা… অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে। বিহারের মধুবনি জেলার বাসিন্দা মহম্মদ সামিরুল—সবার গন্তব্য বাড়ি, কিন্তু সমদূরত্ব নয়—যতটা সম্ভব একসাথে…বেঁধে বেঁধে থাকার অভ্যেসটা ছাড়েনি কেউ! এমন কত শত সহস্র কথা লুকিয়ে আছে এখানে-সেখানে বা লোপাট হয়ে গেছে তার হিসেব কোথাও নেই!!
জামলো, যাদব, সামিরুলরা পরিযায়ী। পরিযায়ীর সংজ্ঞা ওরা জানেনা। পাখি পরিযায়ী হয়। সেই সাইবেরিয়া থেকে লাখে লাখে পাখি উড়ে আসে দু’ডানায় ভর করে। আশ্রয় নেয় সাঁতরাগাছির খালে। সাইবেরিয়া থেকে সাঁতরাগাছি দূর তো কম নয়! সময় হলেই আবার উড়ে যায়, ফিরে যায়। পাসপোর্ট ভিসার বালাই নেই! মানতে হবে দু’ডানায় জোর আছে। জামলোরা ওই পাখিদের মত। এক দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যেতেই হয়, নইলে কারও চলে না, তবে পাসপোর্ট ভিসা লাগে, আড়কাঠিরা বাকিটা ম্যানেজ করে। ওরা গতর দেয়, কেবল বেঁচে থাকার দাম পায়, কখনও কখনও তাও জোটে না, লাশসুদ্ধ গায়েব হয়ে যায়। পরিযায়ী মানে দাঁড়াল ঘর যেখানে কাজ নেই, কাজ যেখানে ঘর নেই—এরাই। সরকারি হিসেবে আছে কি নেই সেটাও কেউ জানে না। বাড়ি ফেরার পথে এলিয়ে পড়া। সেই শেষ।
দুই:
এখন লকডাউন। সব বন্ধ। কল থেকে মল সব। কাজ নেই কম্মো নেই। পেছনে কাঠি দেওয়া নেই। লকডাউনের ক্রোনলজি—ঘরে থাকুন, বাইরে বেরোলে মাস্ক, নিদেনপক্ষে গামোছা বাঁধুন, দুজনের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখুন, পাঁচবার সাবান দিয়ে হাত ধোবেন, উপসর্গ দেখা দিলেই হেল্পলাইনে ফোন করুন ইত্যাদি..প্রভৃতি। গোমূত্রে কাজ দেবে ভেবে এই কাজটা শুরু হতে দেরি হয়ে গেছে, এখন অনেকটা ছড়িয়েছে। সব বিধি মেনে চলছে এমনটা নয়, ছ’বছর ধরে ছড়ান বিষ মাথাচাড়া দিচ্ছে কোথাও কোথাও। মহারাষ্ট্রের পালঘরে দুই সাধুসহ তিনজনকে উন্মত্ত জনতা পিটিয়ে মারল। বা বাদুরিয়ায় পুলিশকর্মীর মাথাভাঙ্গা, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রহার যার জেরে অর্ডিন্যান্স জারি হল। ক্রোনলজিতে এসেছে সকলকে বেতন দেবার কথা—মানছে না যাদের মানার কথা—গড়ে উঠেছে এমন ধরনের অসভ্যতা বর্বরতা। এসেছে রাষ্ট্রপুঞ্জের হুঁশিয়ারি। দুনিয়ায় নিদেনপক্ষে ৮২ কোটি মানুষ খিদে পেটে নিয়ে ঘুমোতে যান। রয়েছেন তাঁরা যাঁদের পদবি ক্ষুধার্ত—মাথা গুণতিতে ১৩ কোটি ৫০ লক্ষ ইত্যাদি। শোনা যাচ্ছে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি। স্বভাবতই ত্রাণের প্রশ্ন উঠেছে। কে পাবে ত্রাণ? অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে নোট ছেপে বিলি, সম্পত্তিকরে ১.৫ % কর প্রস্তাব ক্রোনলজিতে থাকলেও জমা সম্পদে হাত দেবার সাহস কোথায়? এরই মধ্যে ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে সেই সংখ্যা যারা এখন কবরে যাচ্ছে ঠিক, কিন্তু কবর খননকারীর কাজটাও হাতে কলমে শিখে নিচ্ছে। করোনা সেই সুযোগ মেলে ধরেছে।
করোনা অনেকটা সেই ‘শেক দ্যা বটল বিফোর ইউজ’-এর মতো। ‘লাভ আর লোভ’-এর সন্তলন রক্ষার ব্যর্থ চেষ্টা, সভ্যতার বিড়ম্বনা মাত্র। নিশ্চিত ‘টেন ডেজ দ্যাট শুক দ্যা ওয়ার্ল্ড’-এর পূর্বশর্ত গড়ছে…অবশ্য এখনও অনেকটা দূরে। “অরোরা”র মাস্তুল মাথা তুলছে…
এপ্রিল ২০২০
Posted in: April 2020, Editorial