গল্প : দেবজ্যোতি রায়

হাওয়া থেকে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে

উঠোনের দক্ষিণ প্রান্তে যে বিশাল ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছটা তারই মগডালের একটা সরু, ল্যাকপ্যাকে শাখায় যেটা অতি সামান্য হাওয়ায় উঠল কী উঠল না, দোলে, বসে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে ঘোষ উঠোনের একপ্রান্তে পড়ে থাকা নিজের একলা লাশটাকে দেখছিল আর ‘তুমনে পুকারা মুঝে ম্যায় চলে আয়ে’ পুরনো জনপ্রিয় হিন্দি গানটা গাইছিল বেসুরে।

ঘোষের কারবার ছিল দুধের। শুধু নবগ্রামই নয়, আশপাশের আরও দশটা গ্রামে এবং শহরের দু’চারটে মিষ্টির দোকানেও বাইকে দু’পাশে দুটো বড় দুধের ড্রাম বসিয়ে আর বাঁ পাশের হুক ও সামনের সেফ গার্ডের দু’দিকের হাতায় গোটা ছয়েক নানান মাপের দুধের বোতল ভর্তি ব্যাগ, রোজ একটু বেলার দিকে ঘোষের টহল ছিল ‘ও মাসি ও পিসি এই যে কাকু ও দাদা বৌদি কেমন আছেন গো কিরে তরা ডাংগুলি খেলস না বাচ্চারা’, প্রায় বিকেল পর্যন্ত।

আর সেই ঘোষ, দুধ-ঘোষ, হারামজাদা দুধে জল মেশানো ঘোষ, আশপাশের দশ গ্রামে অতি পরিচিত ‘ঘোষের বাচ্চা আইছে, দুধ রাখো’, ঘোষ, উঠোনের এক প্রান্তে মাটির ওপর নট নড়নচড়ন ঘোষ, কেবল বৌটাই ফুট তিনেক দূরে আছাড়িপিছাড়ি, সুর করে উচ্চগ্রাম কখনো-বা নিচু ‘এ তুমি কেমত কাণ্ডটি কইরা গেলা গো, ক্যারা দেখব অহন আমারে’, ঘোষ দেখছে উঠোনের দক্ষিণ প্রান্তে যে বিশাল ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছটা, যার তলা দিয়ে যেতে রাতে বাচ্চারা তো বটেই, বড়রাও অনেকেই, অই গাছে রাতে বেম্ভদত্যি বসে, জনশ্রুতি, ভয় পায়, তারই মগডালের একটা সরু, ল্যাকপ্যাকে শাখায় যেটা অতি সামান্য হাওয়ায় উঠল কী উঠল না, দোলে, বসে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে উঠোনের একপ্রান্তে পড়ে থাকা নিজের একলা লাশটাকেই আর ‘তুমনে পুকারা মুঝে ম্যায় চলে আয়ে’ পুরনো জনপ্রিয় হিন্দি গানটা বেসুরে গাইতে গাইতে, ততক্ষণে সকাল। আর গ্রামে গ্রামে বার্তা রটি গেল ক্রমে হলে যা হয় !

ওই গাইতে গাইতে আর বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে আর নিজস্ব মাগির ফুট তিনেক দূরে আছাড়িপিছাড়ি, মুড ভাল থাকলি ‘অগো হুনছো’ আর বিগড়ে গেলে ‘মাগি তরে কইতাছি রান্না চাপেবার, আমি খায়া বিরামু’, ‘ছিনাইল কোথেকার’, এসবও তো হরদম, ঘোষের মুডের খবর কেবা জানত, ঘোষস্য পরিবেদনা মানে উঠোনে নিজেকে একেলা নট নড়নচড়ন পড়ে থাকতে দেখে বেদনাও যেটুক জন্মিল ঘোষের চোখে, তাইতেই দু’ফোঁটা চোখের জলও ঝাঁকড়া বিশাল ওই তেঁতুল গাছের তলায় যেখান থেকে, ওই চোখের দু’ফোঁটা জল থেকেই তেঁতুল গাছটার গা ঘেঁষে, ভবিষ্যতে জন্মিলেও জন্মিতে পারে একটা সাদা শিউলির চারা, শিউলি ফুলের গন্ধে সে চারা বড় হতি হতি গাছ হলে, গোটা বাড়ি ম ম করবে সন্ধ্যায় শিউলির গন্ধে, তখন নাতি কোলে বসে ঘোষের বৌ সে ঘ্রাণ বুক টেনে নেবে, ঘোষের বিধবা, তবে সেসব তো ভবিষ্যতের, ভবিষ্যৎ বলবে। পাঠক, এই ফাঁকে আসুন, আমরা একটা তুমুল লাঠালাঠি, মারপিটের দৃশ্যে প্রবেশ করি অবশ্যই সেফ দূরত্বটুকু বজায় রেখে।

ঘোষের ছিল লম্বা দালান আর ততোধিক লম্বা একটা গোয়ালঘর যেখানে হরেক কিসিমের দেশি-বিদেশি-ভিন রাজ্যের-ক্রস ১৫টা গাই তৎসহ বাছুর। দালান আলো করে থাকত ঘোষ, ঘোষের বৌ, দুই ছেলে, তাদের বৌ, তাদের ছেলেমেয়ে, ঘোষের এক বিধবা পিসি, তার ছেলে, ছেলের বৌ, দুটো বাচ্চা, একটা ক্লাস নাইন, অন্যটা ফোর, আর ঘোষের মেয়ে-জামাই, ওদের এখনো কোনো বাচ্চাকাচ্চা হয় নি। রোজ সকালে বালতি হাতে ঘোষ দুইতো, ঘোষের দুই ছেলে, জামাই, পেছনে তেলের ছোট ছোট বাটি হাতে ঘোষের বৌ, ঘোষের ছেলের বৌরা, ঘোষের মেয়ে, ঘোষের বিধবা পিসির ছেলের ছিল হাটে হাটে কাপড়ের ব্যবসা। ঘোষের বিধবা পিসির ছেলে দুধ দুইতো না।

দুধ খেয়ে খেয়ে আর দুধ বেচে বেচে ঘোষের ছেলে-জামাইও, কেউ সাইকেলে, কেউ বাইক, ঘোষের বড় ছেলের ছিল হন্ডা, ছোট ছেলেকে ঘোষ তখনো বাইক কিনে দেয়নি, বেজায় বদমেজাজি ছিল বলে, কোথায় কী করে বসবে, তবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল মেজাজকে রাজা না ভাবি প্রজা ভাবির পালে ‘তরেও দিমু, একটা সুপার বাইক, সামনের বছর’। ঘোষের বিধবা পিসির ছেলেরও কোনো বাইক ছিল না, হাটে হাটে ক্যারিয়ার ও সামনের রডে কাপড়ের গিট্টি বেঁধে সাইকেলেই ঘুরত। তবে সবচেয়ে বেশি দুধ বেচার দায়িত্বটা ছিল ঘোষের আশপাশের দশটা গ্রামে, নবগ্রামেও কয়েক ঘর, এবং শহরের দু’চারটে মিষ্টির দোকানে নিজের লরঝরে পালসারে। ঘোষও হন্ডা কিনতেই পারত, কেনেনি, আর জামাইকে কথা দিয়েছিল ‘মন দিয়া দুধ বেচ, তুমি বুলেট পাইবা। ছেমড়িরে লইয়া ঘুরতে যাইতে পারবা দূরে, দূরে’, ঘোষের জামাই মন দিয়ে দুধ বেচত।

‘দুধে কইল সোনা আছে, বুঝছনি’, ফটিক ঘোষের ঢের আগে খেতে বসে ঘোষ একথা বলেছিল তার দুই ছেলে আর জামাইকে পাশে বসিয়ে, ‘আমি এই যে যা কিছু কইরেছি সব দুধ বেইচা’।

ঘোষের শোবার ঘরে সিমেন্টের বুক সমান উঁচুতে যে লম্বা তাকটা ছিল সেখানে ১৫টা বোতলে ১৫টা দেশি-বিদেশি-ভিন রাজ্যের-ক্রস গরুর মূত্র রোজ সকালে দুধ দুইতে গিয়ে ভরে ঘোষ সাজিয়ে রাখত রোজ রাতে ঘুমোতে যাবার আগে প্রত্যেক ক’টা বোতল খুলে গন্ধটা নাকে না নিলে ঘোষের ঘুম হত না, সেসবও ঢের আগে থেকে। ঘোষের বৌয়ের এতে প্রবল আপত্তি জন্মিত আর তখন মেজাজ বিগড়ালে তখনই, ওই রাতেও গোটা গ্রাম-পাড়া জাগিয়ে বৌকে ‘মাগি, ছাগি, তুই মায়ামানুষ, তুই বুঝতস কী’, যেন চণ্ডীপাঠ থেকে রামায়ণ শোনানো আর এখন ঘোষের পড়ে থাকা দেহের তিনফুট দূরে সেই বৌয়েরই আছাড়িপিছাড়ি, সুর করে কখনো উচ্চগ্রাম কখনো নিচু, ‘অগো, আমারে অহন ক্যারা দেখব গো, এ তুমি কেমত কাণ্ড কইরা গেলা গো’। উঠোনের দক্ষিণ প্রান্তে ঝাঁকড়া বিশাল তেঁতুল গাছটার মগডালের একটা সরু, ল্যাকপ্যাকে শাখায় বসে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে আর ‘তুমনে পুকারা মুঝে ম্যায় চলে আয়ে’ গাইতে গাইতে ঘোষ দেখছে নিজেকে আর বৌকেও উঠোনের এক প্রান্তে।

ঘোষের দুই ছেলে, ছেলেদের বৌ-বাচ্চা, মেয়ে-জামাই, ঘোষের বিধবা পিসি আর বিধবা পিসির ছেলে, তার বৌ, তাদের দুটো বাচ্চা, একটা ক্লাস নাইন, অন্যজন ফোর, আর গ্রাম ভেঙে আসা লোকজন, সবাই, প্রত্যেকেরই যেন পাছায় গু আটকে আছে এমত, অনেকটা দূর থেকে, যতটা দূর থেকে সম্ভব, ডেড বডির ধারেকাছে বেশ খানিকটা দূর পর্যন্ত তখন ভয়, শুধুই বৌ, ঘোষের, তাও ফুট তিনেক দূরত্বে, দেখছে ঘোষের পড়ে থাকা দেহ, উঠোনের এক প্রান্তে, আর ঘোষের বৌয়ের সুর করে কখনো উচ্চগ্রাম কখনো নিচু,আছাড়িপিছাড়ি দেখছে বাকিরা।

দেখতে দেখতে দেখতে দেখতে রোদ্দুর ক্রমে চড়া, তাতছে মাটি, মানুষের দেহ, ঘোষের দুই ছেলে, তাদের দুই বৌ, মেয়ে-জামাই, ঘোষের বিধবা পিসি, বিধবা পিসির ছেলে, ছেলের বৌ, ওই অত গ্রামবাসীর চোখের সামনে, মগডালের একটা সরু, ল্যাকপ্যাকে শাখায় যেটা অল্প হাওয়াও উঠল কী উঠল না, দোলে, বসে বসে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে ওই জনপ্রিয় পুরনো হিন্দি গানটা গাইতে থাকা ঘোষের চোখের সামনে, ঘোষের সুর করে আছাড়িপিছাড়ি বৌয়েরও চোখের সামনে আচমকা, আচমকাই শুরু করে দিল তুমুল লড়াই, এ-ওর চুল টেনে মাটিতে পেড়ে ফেলে তো ও-এর, এর নাকে বদাম তো ওর ঠ্যাং ধরে আছাড়, প্রত্যেকেরই মুখ ফেটে রক্তারক্তি, বৌদের কারো কাপড় খুলে গেছে কারো ছেঁড়া চুল উড়ছে হাওয়ায়, চিৎকার, গালিগালাজ, শনশন ছুটছে কখনো লক্ষ্যভ্রষ্ট কখনো লক্ষ্যভেদ, তিরের ফলার মত, গ্রামসুদ্ধ লোক হা হা হি হি, উৎসাহ দিচ্ছে কখনো এদিকে কখনো ওদিকে, মজার পোয়াবারো।

ঘোষের দু’চোখ থেকে ওই মগডালের একটা করুণ ল্যাকপ্যাকে শাখায় বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে আর গান গাইতে গাইতে ফের দু’ফোঁটা অশ্রু তেঁতুল গাছের নিচে, মাটিতে, যেখান থেকে ভবিষ্যতে বেরলেও বেরতে পারে ওই ঝাঁকড়া বিশাল গাছটার গা ঘেঁষে যেখানে রাতে বেম্ভদত্যি বসে থাকে বলে জনশ্রুতি, যার তলা দিয়ে বাচ্চারা তো নয়ই, অনেক বড়রাও রাতে যাতায়াত করতে ভয় পায়, একটা ছোট্ট সাদা শিউলির চারা, যেটা বড় হয়ে গাছ হলে ঘোষের গোটা বাড়ি মায় গ্রামেরও অনেকখানিটা ম ম করত শিউলি ফুলের গন্ধে সন্ধ্যায়। শুম্ভ-নিশুম্ভদের এই লড়াই, মারপিট, আকছা আকছি, রক্তারক্তি কাণ্ড সবটুকুই এবং যে খিস্তিখেউরগুলো শনশন তিরের ফলার মত কখনো লক্ষ্যভ্রষ্ট কখনো লক্ষ্যভেদ, হচ্ছিল সম্পত্তির দখল নিয়ে, ঘোষের ১৫টা দেশি-বিদেশি-ভিন রাজ্যের-ক্রস গরুগুলি কার ভাগে কোনটা ও ক’টা ! ঘোষের বডি তখনো পড়ে উঠোনের এক প্রান্তে একা আর তেঁতুল গাছের মগডালের ওই সরু, ল্যাকপ্যাকে শাখায় তখনো ঘোষ।

সূর্যিদেব তখন ঢলছেন, আর একটা হাল্কা বদ গন্ধ ভাসতে শুরু করেছে হাওয়ায়, ওই অত উঁচুতে ঢুকে যাচ্ছে ঘোষের নাকেও, একটা তীব্র হাহাকার, ঘোষের গলা চিরে, ‘তরা কি শান্তিতে যাবারও দিবি না আমারে ! তদেরই আমি পালছি, বড় কইরেছি ! দাহ করবি না আমারে? করবি না দাহ? নাকি আহুক শকুন, আহুক কুকুর-শিয়াল? হায় আল্লা! আল্লা ক্যামনে আহে!’ ঘোষ জিভে কামড় দিয়ে ফের, ‘এই ডাক তো আমাগো ডাক না। রাম রাম শিব শিব জয় মা রণচণ্ডী, খ্যামা দাও মা, আক্কেল দাও মা’, বেরিয়ে আসে আর ভেসে বেরায় আকাশে, হাওয়ায়।

হাহাকারটা ভাসতে ভাসতে ক্রমশ দূরবর্তী হলে গাছ থেকে নেমে পড়ে ঘোষ, ‘দাহ নিজেরোই নিজেরে করন লাগব’। বৌয়ের নিকটে যায়। ‘গালি দিছি তোমারে কত! ভালও কি বাসি নাই? দেই নাই আদর?’ বৌয়ের মাথায়, কপালে হাত বুলোতে থাকে ঘোষ আর ঘোষের বৌ তখন ভ্যাবলানো মুখে হাঁ করে ছেলেদের, ছেলে-বৌদের, মেয়ে-জামাই, ঘোষের বিধবা পিসি, পিসির ছেলে, ছেলের বৌকে দেখছিল।

এক ঝটকায় নিজের লাশ কাঁধে তুলে নিল ঘোষ। হাঁটতে শুরু করল শ্মশানের দিকে।

ঘোষের বড় নাতনিই প্রথম ঘোষের দিকে ফিরে তাকাতে গিয়ে দেখল ঘোষের জায়গায় ঘোষ নেই। তার তীক্ষ্ণ চিৎকারে সমস্ত যোদ্ধা ও দর্শক এতক্ষণ গ্রামবাসীদের, এমনকী ঘোষের বৌয়েরও সম্বিত ফিরলে তারাও ফিরে তাকাল সেই জায়গাটার দিকে যেখানে এতক্ষণ একেলা পড়ে ছিল ঘোষ। এবং অবাক ও হতভম্ব হল। কোথায় গেল ঘোষ! কারও প্রথম নজর যাবে, আমরা জানি না এতলোকের মধ্যে সে কে, এবং সেই আঙুল তুলে শ্মশানের দিকে দেখিয়ে চিৎকার করে বলবে, ‘দ্যাখো তোমরা, ওই তো শ্মশানের দিকে শুন্যে ভেসে যাতিছে ঘোষ’, আর ঠেলে বেরিয়ে আসা চোখগুলি ভয়ে, হতবাক হয়ে সেদিকে।

একটা বিরাট ‘গণের দঙ্গল যেমনে নিশির ডাকে নাকি, তেমনি কিম্বা হ্যামলিনের সেই বাঁশিওলা যে বাঁশির মায়াবী সুরে শহরের সমস্ত ইঁদুরগুলিকে সমুদ্রের দিকে, আর এই গ্রাম্যজনতাও, আচ্ছন্নের মত, কিন্তু অনেকটা দূর থেকে তখন চলমান শ্মশানের দিকে। অনেকটা দূর থেকেই তারা দেখল শ্মশানে যে জায়গায় মৃতদেহগুলিকে পোড়ান হয়, তার পাশেই ঘোষের দেহটা শুন্য থেকে নেমে এল আর খড়ি ও গাছের মোটা লগগুলি শুন্যে ভেসে এসে কিয়ৎক্ষণের মধ্যে সাজিয়ে ফেলল একটা চিতা যেখানে ঘোষের লাশটা শুন্যে উঠে গিয়ে শুয়ে পড়বে।

না, কোনো পরিযায়ী শ্রমিক, পরিযায়ী শ্রমিকদের পরিবার, তারা তো তখন কোন তেপান্তরের মাঠে অথবা পিচ ঢালা উত্তপ্ত অচেনা রাস্তায় ধুঁকছে, মরছে, রাষ্ট্র আশ্রয় দেয় নি তাদের, দেয়নি খাদ্য তুলে তাহাদের মুখে, তাহাদের শিশুদেরও মুখে, পুলিশ লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে বরং, পুলিশের লাঠির সপাং সপাং, তারা কেউই ১৫০,৩০০,৫০০,২৫০ মাইল হেঁটে এখনো ঢোকেনি এই গ্রামে শিশু ও নারী সহ। তবু ঘোষ ম’ল ! আর এখন নিজেকে এক ঝটকায় নিজের কাঁধে তুলে, আজীবন দুধ খাওয়া ঘোষ, আজীবন দুধ বেচা ঘোষ, নিজের তাগদে ও তাগিদায়, নিজেকে পোড়াচ্ছে শ্মশানে। একা। অনেক দূরে দাঁড়িয়ে ঠেলে বেরিয়ে আসা চোখগুলি সেদৃশ্য দেখছে, দেখছে ঘোষের ছেলেরা, তাদের বৌ-বাচ্চা, ঘোষের মেয়ে-জামাই, ঘোষের বিধবা পিসি, বিধবা পিসির ছেলে, ছেলের বৌ, দুটো বাচ্চা, একটা ক্লাস নাইন, অন্যটা ফোর, গ্রামশুদ্ধ লোক, এমনকী ঘোষের বৌ-ও, আর থরথরি কম্পমান সকলেই।

পরদিন রাজ্যের সবকয়টি দৈনিকে যে খপর বেরল, ‘নবগ্রামে রহস্যজনক মৃত্যু’। লিখছে দৈনিক, মৃতকে নবগ্রাম তো বটেই আশপাশের দশটা গ্রামেরও লোকে ‘ঘোষ’ বলেই জানে, চেনে। বয়স ৫৫। দুধের ব্যবসা ছিল ঘোষের। নবগ্রাম সহ আশপাশের দশটা গ্রামে এবং শহরেরও দু’চারটে মিষ্টির দোকানে ঘোষ, ঘোষের দুই ছেলে, ঘোষের জামাই দুধ বেচত প্রতিদিন। ঘোষের গোয়ালে ছিল দেশি-বিদেশি-ভিন রাজ্যের-ক্রস ১৫টা গাই যাদের থেকে প্রতিদিন ৮০ লিটার দুধ দুইত ঘোষ, ঘোষের ছেলেরা, ঘোষের জামাই, ঘোষের বিধবা পিসির ছেলে দুধ দুইত না, কাপড়ের ব্যবসা ছিল তার।

ঘোষের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা না গেলেও গ্রামের ও আশপাশের লোকেদের মুখে মুখে রটছিল নানান কথা। কেউ বলছিল অতিরিক্ত দুধ খেয়েই মৃত্যু হয়েছে ঘোষের। গলায় দুধের সোনা আটকে গিয়েছিল। কারও মতে, মদে, তাও বাংলা, দুধ মিশিয়ে যেমন মদ্যপায়ীরা মদে জল মেশায়, কেউ কেউ বরফ, ফ্রিজ থেকে বের করে, কেউবা নিট, খেত বলে ঘোষ ম’ল। তাদের মতে গিলাসে মদ ঢেলে তাও বাংলা, পরিমাপ মত তাতে দুধ মিশিয়ে নিত্য সন্ধ্যায় ছিল ঘোষের আকণ্ঠ মদ্যপান যদিউ ঘোষের পা টলতে কোনোদিন দেখেনি কেউই। এমনকী ঘোষের বৌ, ঘোষের ছেলেরা ও তাদের বৌয়েরা, ঘোষের নাতি-নাতনি, ঘোষের মেয়ে-জামাই, ঘোষের বিধবা পিসি, বিধবা পিসির ছেলে, ছেলের বৌ, তাদের দুটো বাচ্চা, একটা ক্লাস নাইন, অন্যটা ফোর, তারাও দেখেনি টলতে ঘোষের পা, আকণ্ঠ মদ্যপান নিত্যদিন সন্ধ্যায় সত্ত্বেও। ঘোষ নাকি বুক ঠুকে বলতই, ‘কেউ মদ বেইচা দুধ খায়, কেউ দুধ বেইচা মদ। আমি ঘোষের ব্যাটা ঘোষ, দুধ বেইচা মদ আর দুধ দুয়োটাই খাই বইলা বাচুম দীর্ঘদিন’। আর এখন ৫৫ বছরের ঘোষ, মৃত, তার মৃত্যুর কারণ নানান ভাবে ব্যাখ্যা করছে লোক। কেউ কেউ এমতও বলছে যে, ঘোষের শোবার ঘরের বুক সমান উঁচু তাকে যে ১৫টা বোতল সাজান থাকত, যাতে প্রতিদিন সকালে দুধ দুইবার আগে গাইগুলিকে মুতিয়ে যেগুলোর কোনোটা দেশি, কোনো কোনোটা বিদেশি কিংবা ভিন রাজ্যের এবং ক্রস, সেই মুত তুলে রাখত ঘোষ আর রাতে শুতে যাবার আগে প্রতিটা বোতল খুলে গন্ধ শুঁকত আর বৌ আপত্তি করলে বৌকে গোটা গ্রাম জাগিয়ে চণ্ডীপাঠ থেকে রামায়ণ শোনাত ঘোষ, হতে পারে অত মুতের গন্ধ, হোক না সে মুত গাইয়ের, হোক না গাইগুলি দেশি-বিদেশি-ভিন রাজ্যের কিংবা ক্রস, প্রতি রাতেই শুঁকত বলে সেই অত মুতের গন্ধ গলায় আটকে মারা গেছে ঘোষ।

তবে ঘোষের বৌ, ঘোষের ছেলেরা বা তাদের বৌ, মেয়ে-জামাই, ঘোষের বিধবা পিসি, বিধবা পিসির ছেলে, তার বৌ, ঘোষের মদে, তাও বাংলা, দুধ মিশিয়ে খাবার কথা স্বীকার করলেও এবং রোজ রাতে শুতে যাবার আগে গো-মূত্রের ওই ১৫টা বোতল থেকে গন্ধ শুঁকবার কথা, মৃত্যুর কারণ নিয়ে তাদের কোনো ব্যাখ্যা, মতামত ছিল না, কথা বলবার মত, ব্যাখ্যা-মতামত দেবার মত অবস্থাতেই তো ছিল না তাহারা যেহেতু।

শুধু ঘোষের বৌ, গ্রামেরই এক কাছতুত মহিলাকে নাকি, মহিলাটি নাম না প্রকাশ করবার শর্তে জানিয়েছে, গত রাতে ঘোষের সংগে তার ভোররাতে সংগমের যাবতীয় কথা। মহিলার দাবি, ঘোষের বৌ নাকি তাকে বলেছে, গত ৩০বছরের বিবাহিত জীবনে যতবার সংগমকালীন তার জল বারবার ফেটেছিল বলে তার স্মরণ আছে,গত রাতেরটা ছিল সেগুলির অন্যতম। সংগম শেষে ভোর রাতে হাতে বিড়ি নিয়ে ঘোষ নাকি মুততে বেরিয়েছিল আর ফেরেনি। অনেক্ষণ অপেক্ষার শেষে ঘোষের বৌ বাইরে বেরিয়েছিল ঘোষ গেল কোথায় দেখতে আর আবিষ্কার করেছিল ওকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা অবস্থায়, উঠোনের এক প্রান্তে, যেটা ছিল ঘোষের প্রতিরাতে মুতবার জায়গা, হাতে না জ্বালান বিড়ি আর লাইটারসহ।

তবে মৃত্যুর কারণ নিয়ে যত বিতর্ক আর রহস্যটুকু থাক, একটা বিষয়ে প্রত্যেকেরই একমত যে ঘোষের বডিকে তারা শুন্যে ভেসে শ্মশানের দিকে যেতে দেখেছিল এবং দূর থেকে হলেও তারা স্পষ্ট দেখেছিল খড়ি ও গাছের মোটা লগগুলিকে শুন্যে ভেসে এসে চিতাটাকে সেজে উঠতে ও শেষতক পুড়ে ছাই হতে ঘোষের দেহটা। একটা অতি ছোট আলোর ফুলকি যা অত দূর থেকেও তারা দেখছিল, যেমনটা অন্ধকার রাতে কেউ বিড়ি জ্বালালে দূর থেকে মনে হয়, চিতাটার চারদিকে ঘুরে ঘুরে ঘুরে আর চারদিকেই আগুন জ্বলে উঠছিল চিতায়। আর চিতা নিভন্ত যখন, একটা উত্তুরে দমকা হাওয়া এসে চিতার ছাইগুলিকে ছড়িয়ে পড়তে দিচ্ছিল চারদিকে ভাসতে ভাসতে। তারা তখনই পালিয়েছিল।

Facebook Comments

1 thought on “গল্প : দেবজ্যোতি রায় Leave a comment

  1. তোমার নতুন লেখার জন্য অপেক্ষায় থাকি।
    গল্পটা ভালো লেগেছে। মানুষের মৃত্যু মিছিল, তা নিয়ে রহস্য, পরিযায়ী শ্রমিকের ঘরে ফেরার মিছিল, মৃত্যু, গো-মূত্র, ঘোষ বেটার দুধে জল মেশানোর রাজনীতি — সবকিছুই প্রাসঙ্গিক, এসময়ে।

Leave a Reply