গল্প : অভীক ভট্টাচার্য

মারী

এক মায়ালীন ঊষাকালে প্রথম যখন দয়াময়ের জলা থেকে তপ্ত এবং শুষ্ক এক বাতাস উঠে এসে জলার ধারে বাহ্য করতে আসা মৃণ্ময়ী বাগদীর বিধবা তথাপি অটুট যুবতী দেহটিকে লহমায় বেষ্টন করে তার সমস্ত মেদমাংস শোষণের পরে শুধুমাত্র পোড়া কঙ্কালটিকে ফেলে রেখে পুনরায় জলার মধ্যে ফিরে যায় তখন শিমুলপারুইয়ের বাসিন্দারা ভীতির পরিবর্তে প্রশান্তি অনুভব করে, কেননা তাদের মনে পড়ে যে, আজ থেকে প্রায় অর্ধশতক পূর্বে এমনই এক মায়ালীন ঊষাকালে যখন এক প্রজ্জ্বলন্ত উল্কা অনন্তলোক থেকে পৃথিবীব্যাপী অতন্দ্র বায়ুস্তর চিরতে চিরতে এসে শিমুলপারুইয়ের বুকে প্রচণ্ড শব্দে আছড়ে পড়ে এবং সন্ত্রস্ত গ্রামবাসীরা দৌড়ে গিয়ে ঘুমভাঙা গাণ্ডুচোখে বর্তমান জলার জায়গায় সৃষ্ট এক কালো এবং বিকট গহ্বর দেখতে পায়, তখন তাদের বিবিধ মন্তব্যের মাঝে একমাত্র মতু পাগলাই কপালে দু’হাত ঠেকিয়ে গহ্বরটিকে প্রণাম করে বলেছিল, “দয়াময়ের করুণা”। পরবর্তীকালে বর্ষার জল ক্রমাগত সেই গহ্বরে সঞ্চিত হয়ে এক জলার জন্ম হলে লোকমুখে তার নাম হয় দয়াময়ের জলা, এবং আরও অনেক পরে আজ থেকে মাসখানেক আগের এক ঊষালগ্নে সেই জলার ধারে নিয়মমাফিক বাহ্য করতে গিয়ে জল থেকে উত্থিত এক তপ্ত এবং শুষ্ক হাওয়ার লীলাখেলায় মেদমাংস-শোষিত পোড়া কঙ্কালে পরিণত হয়ে মৃণ্ময়ী বাগদী যখন ভূমিতে শুয়ে পড়ে তখন শিমুলপারুইয়ের বাসিন্দারা সেই ঘটনাকেও দয়াময়ের করুণা হিসেবেই গ্রহণ করে, কারণ স্বভাবজ স্নিগ্ধতার কারণে একে অভিশাপ রূপে গ্রহণ করতে হয়তো তাদের বাধে, কিংবা ভয় হয়, তারা ভাবে, অর্ধশত বৎসর পূর্বে মহাকাশ-প্রেরিত সেই উল্কা হয়তো নিরর্থক ছিল না, তার ভেতরে নিহিত ছিল দয়াময়ের কোনও গূঢ় অভিপ্রায় যা এতদিনে মৃণ্ময়ীর মৃত্যুর মাধ্যমে রূপায়িত হয়, কারণ তাদের মনে হয়, এভাবে দয়াময় মৃণ্ময়ী বাগদীর স্বামীহারা এবং শ্বশুর-শাশুড়ির নিত্য পীড়নে পীড়িত জীবনের সান্ত্বনামণ্ডিত ইতি ঘটালেন। তারা বলে, চক্ষুদ্বয়ের প্রার্থিত স্ফীতি এবং ওষ্ঠাধরের কাঙ্ক্ষিত বঙ্কিমতা সহযোগে, “বিটিটার কেউ আপনার ছিলেক লাই বটে,” এবং বলে, “সিদিন সকালে সি কি এক বাতাস উইঠল গো জলার থেইক্যে, পুরো সিঁদুরপারা রঙের যেন এক গোলা, মনে হলো যেন নরকের গভ্য থেকে উইঠছে, আমাদের পিতম আর বাসু সারা রাত পুকুর পাহারা দিইয়ে তুখন ঘর ফিরছে। উরা দেখ্যেছে, এক বাতাস উঠল জলার দিক থিক্যে, ধরিত্রী যেন কেঁপ্যে উইঠল, ঝোপের মইধ্যে মিন্ময়ীর মাথাটো তুখন দ্যাখা যেইনছিল গো, উরা দেইখল, হাওয়াটো এস্যে যেন বিটিটাকে এক্কেবারে গরাস কইরল।” অবশ্য এই বর্ণনায় দয়াময়ের করুণার তুলনায় পিতম আর বাসুর বদামির লক্ষণই বেশি এমনটা স্বভাবতই কারো কারো মনে হয়েছিল, তারা সন্দেহ করেছিল, মেয়েটার সঙ্গে পাপাচারের পরে পিতম আর বাসুই প্রমাণ লোপাটের জন্য তাকে পুড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু তারা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল প্রথমত, মৃণ্ময়ীর ভস্মসার দেহটির ময়নাতদন্তের রিপোর্টে, কেননা সেই রিপোর্ট মৃণ্ময়ীর সঙ্গে মৃত্যুপূর্ব কোনও ব্যভিচারের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে প্রচণ্ডে দহনে মৃত্যুর কারণকেই প্রতিষ্ঠিত করেছিল, এবং দ্বিতীয়ত, তথা হয়তো প্রধানত, মৃণ্ময়ীর মৃত্যু-পরবর্তী ঘটনাবলীর দ্বারা। কারণ মৃণ্ময়ীর মৃত্যুর ঠিক সাত দিনের মাথাতেই দয়াময়ের জলার উত্তর-পূর্বের কৃষিজমিতে আলু গাছের গোড়ায় মাটি দেওয়ার কাজে যখন কৃষকেরা নিযুক্ত হয়, এবং আলের দ্বারা বর্গাকারে বিভক্ত জমিতে সকলে অবনত অবস্থায় রত থাকে, তখন সেই আসন্নসন্ধ্যার পূর্বলগ্নে পুনরায় জলা থেকে একটি হাওয়া উঠে আসে বলে জানা যায়। বস্তুত কৃষকেরা বলে থাকে, সেদিন শুধু হাওয়াই ওঠেনি জলা থেকে সেই সঙ্গে একটি বৃহদাকার ছায়াকেও তারা শূন্যে উত্থিত হতে দেখেছিল। সেই ছায়া ছিল এক বৃহৎ বাদুড়ের মতো, তারা বলে, যেন সূর্যকে আচ্ছন্ন করে এক দানব-বাদুড় আকাশে পাখসাট মারছে। সেই ছায়া ক্রমশ জমিন বেয়ে কর্মরত ষাটোর্ধ্ব ভোলা হেমব্রমের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে, এবং কৃষিক্ষেত্রে নিরত অনেকে তা দেখতে পেয়ে হই-হই করে ওঠে। ভোলা তখনই সচকিত হয় এবং আতঙ্কিত হয়ে আকাশের দিকে মুখ তোলে, কিন্তু তখন তার আর কিছু করার ছিল না। “দেইখতে দেইখতে ছায়াটো ভোলাকে আস্ত খেইয়ে ফেলল গো।” খেয়ে ফেলল, না ছেয়ে ফেলল? “উ একই হল্যো বটে।” বেশ, তারপর কী হল? সেই ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখ ম্লান হয়ে আসে এক জতুগৃহজীর্ণতায়। তারা বলে, ছায়াগ্রস্ত হওয়ার পর ভোলার সমস্ত শরীর কাঁপতে শুরু করে, এবং কুঁকড়ে যেতে থাকে। মুখ বিকৃত করে এক পশুবৎ চিৎকারে গগন বিদারিত করে মাটিতে পড়ে ছটফট করতে থাকে ভোলা। পার্শ্ববর্তী কৃষকেরা তার দিকে দৌড়ে যেতে গিয়েও মাঝপথে থেমে যায়, কারণ তখনও জমির ওপরে নিজের অস্তিত্ব ভাসিয়ে রেখেছে সেই দানব ছায়া। তার আওতায় কেউ আসতে চায় না। তখন সকলে দূর থেকে দ্যাখে, ভোলার সমস্ত শরীর ভরে যাচ্ছে বড়ো বড়ো ফোস্কার মতো রসময় স্ফীতিতে, সেই ফোস্কা ক্রমশ আকারে বাড়তে বাড়তে ফেটে যায়, তার ভেতর থেকে গড়িয়ে পড়ে ধূম্রায়িত গরল, কুঁকড়ে যেতে থাকে ভোলার শরীরের চামড়া আর মাংস, যেন অপার্থিব দহনে তাকে কেউ পোড়াচ্ছে। মিনিট কয়েকের মধ্যেই সবকিছু নিঃশেষিত হয়ে কালো খটখটে কঙ্কাল পড়ে থাকে জমিতে। তারপর? তারপর আবার সেই ছায়া ফিরে যায় জলার দিকে। কিন্তু তাহলে ছায়া নাকি হাওয়া, ঠিক কে খেলো ভোলাকে? কৃষকেরা এর ওর মুখের দিকে তাকায়, এবং বলে, “উ হাওয়াই ছায়ার রূপ ধইরে আসছিল গো সিদিন।”

বস্তত হাওয়া সেদিন ছায়ার রূপ ধরেছিল, নাকি ছায়া এসেছিল হাওয়ার আকারে, তা শিমুলপারুইয়ের বাসিন্দারা কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারে না, কিন্তু এ কথা তারা নিশ্চিত করেই বলে যে, ভোলার মৃত্যুর পর তারা নিজেদের অন্তঃলোকে অবধারিত ভয় বোধ করতে শুরু করে, কারণ মাত্র সাত দিনের ব্যবধানে একই প্রকার শোচনীয় মৃত্যুর পুনরাবৃত্তি দয়াময়ের করুণা সম্পর্কে গ্রামবাসীদের সন্দিহান করে তোলে, তারা বুঝে পায় না, বিধবা মৃণ্ময়ী বাগদীর মৃত্যু যদি তার যন্ত্রণাকর জীবনের অবসানের অর্থবাহী হয় তাহলে সম্পন্ন কৃষক এবং স্ত্রীপুত্রপৌত্র সমন্বিত পরিবারের কর্তা ভোলা হেমব্রমের মৃত্যু দয়াময়ের কোন অভিপ্রায়ের দ্যোতক? কেউ কেউ মনে করার চেষ্টা করে যে, আদপে ভোলা হেমব্রমের মানবলীলা এক অভীষ্ট অথচ ঋষিদুর্লভ পূর্ণতায় হয়তো পৌঁছেছিল, এবং সেই কারণেই দয়াময় তাকে ডেকে নিয়েছেন, কিন্তু তারাও তার এমন ভয়াবহ মৃত্যুর কোনও ব্যাখ্যা দিতে পারে না। মৃণ্ময়ীর মরণের পর থেকেই গ্রামে পুলিশের আনাগোনা এবং রুটিনমাফিক জিজ্ঞাসাবাদ লেগে ছিল, ভোলা হেমব্রমের মৃত্যুর পর তা বৃদ্ধি পায়, এবং দ্যাখা যায়, পুলিশ গ্রামবাসীদের জলা থেকে উঠে আসা হাওয়া সংক্রান্ত ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নয়, বরং তারা খোঁজে মৃত্যুর গূঢ়তর কারণ। তারা মনে করে, মৃণ্ময়ী এবং ভোলার মৃত্যু পরস্পর সংযুক্ত, এবং একই ব্যক্তি বা দলের কোনও সাধারণ জিঘাংসায় তারা উভয়েই নিহত, অথবা তারা মনে করে, তা হয়তো নয়, হয়তো কোনওই সংযোগ নেই মৃণ্ময়ী এবং ভোলার পরিণতির, বরং পুলিশের মনে সংযোগের বিভ্রম তৈরির কারণেই ভোলার হত্যাকারীরা মৃণ্ময়ীর কায়দাতে তাকে হত্যা করেছে। তারা লাঠি উঁচিয়ে সন্ত্রস্ত গ্রামবাসীদের মনে অধিকতর ত্রাস সঞ্চার করে ভোলা হেমব্রমের দগ্ধ কঙ্কাল তুলে নিয়ে যায় সুরহতালের জন্য। এদিকে গ্রামবাসীরা নীরবে পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে থাকে, যেন তারা জানতে চাইছে, এবার কী, কিংবা এবার কে? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য বেশিদিন তাদের অপেক্ষা করতে হয় না, কারণ ভোলার মৃত্যুর তিন দিনের মাথায় গ্রামের একমাত্র ব্রাহ্মণ পরিবার চিত্তরঞ্জন চৌধুরীদের বাড়িতে এক ভীতিকর পরিস্থিতির সূচনা হয়। সেদিন সন্ধেবেলা চিত্তরঞ্জনের বিধবা স্ত্রী কাশীদাসী মাথায় ঘোমটা টেনে তুলসী মঞ্চে প্রদীপ জ্বেলে দিয়ে ঘরের দিকে যাওয়ার সময়ে উঠোনের মাটি থেকে মাথা তোলা কোনও এক অজ্ঞাত বস্তুর অস্তিত্বে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় এবং তার ছেলেরা তড়িঘড়ি দৌড়ে এসে মাকে তুলে ধরার পর ইমার্জেন্সি লাইট নিয়ে এসে অনুসন্ধান করে দেখতে পায়, তুলসী মঞ্চের ঈশান কোণে মাটির ওপর জেগে রয়েছে সাদা মতো একটা কিছু। তারা হয়তো বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয় না, অথবা ভাবে পরবর্তী সকালে দিনের আলোয় ব্যাপারটা ভালো করে দ্যাখা যাবে, অথবা ঘাতক নিয়তি হয়তো সেই সময় স্থবিরতার মোহে তাদের আচ্ছন্ন করে রাখে, ফলত সেই সন্ধ্যায় এ বিষয়ে অধিকতর অনুসন্ধানের কোনও চেষ্টা তারা করে না। পরের দিন সকালে চিত্তরঞ্জনের ছেলেরা উঠোনের দিকে তাকিয়ে দ্যাখে, গত সন্ধ্যায় মাটির ওপর জেগে ওঠা জিনিসটা এই রাতের ব্যবধানে যেন মাটির ওপরে আরও একটু মাথা তুলেছে, এবং বস্তুটির অগ্রভাগ দেখে কোনও পরিচিত বিষয়ের সাদৃশ্য তাদের মনে আসে, কিন্তু বহু চেষ্টা করেও তারা নির্দিষ্টভাবে সেই সাদৃশ্যমূলক বিষয়টিকে স্মরণ করতে পারে না। তারা হয়তো কৌতূহলী হয়, অথবা ভীত, গ্রামে এক সপ্তাহের মধ্যে ঘটে যাওয়া দু’টি অত্যদ্ভূত মৃত্যু হয়তো তাদের মনে যে আশঙ্কার জন্ম দিয়েছিল তার আবহে নিজেদের উঠোনে ওরকম একটা জিনিসের অকস্মাৎ জেগে ওঠা দেখে হয়তো তারা বিষয়টিকে আর ঘাঁটাতে চায়নি, কিংবা ঘাতক নিয়তি হয়তো তখনও স্থবিরতার দ্বারা তাদের হাত-পা বেঁধে রেখেছিল, মোটের ওপর জিনিসটিকে নিয়ে তারা তখনও কিছুই করেনি, এবং একটি দিন পেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরের দিন সকালে উঠোনের দিকে তাকিয়ে তারা আহৃদয় শিহরিত হয়ে ওঠে, কারণ তারা দ্যাখে, এই একটি দিনে জিনিসটি প্রায় দু’ফুট মতো বেরিয়ে এসেছে মাটি থেকে, অঙ্কুরিত বৃক্ষ যেনবা, যার দৈনিক বাড়বৃদ্ধি ঘটে, এবং এবার তারা বুঝতে পারে, গতকাল যা তাদের বোধের অতীত ছিল, তা হলো, মাটি থেকে যা মাথা তুলছে তা আর কিছু নয়, একটি অবিকল সাদা মনুষ্য-হাড়। দেখে তাদের সমগ্র অস্তিত্ব কেঁপে ওঠে, তারা পরস্পরের মুখের দিকে তাকায় কিছু বলবে বলে, কিন্তু বলতে পারে না, তারা বুঝতে পারে না কী করবে, অথচ কিংকর্তব্য মানুষেরাই যেহেতু অঘটন ঘটাতে সক্ষম, সেহেতু চিত্তরঞ্জন চৌধুরীর বড়ো ছেলে নিত্যরঞ্জন সহসা ভীতিকে পদানত করার অভিপ্রায়ে “শালো, আমাদের পোঁদে লাইগতে এস্যেছে? উঠোনে হাড্ডি পুঁতে গ্যাছে বটে‌‌! ধরতে পাইরলে চামড়া ছাড়ায়ে লুব” বলে একটি কোদাল তুলে নিয়ে জিনিসটির চারধারে মাটি কোপাতে শুরু করে। কিন্তু ভীতি তাতে পরাস্ত হয় না, বরং সহস্র ফণা ধরে তা সমস্ত গগন ছেয়ে ফ্যালে, কারণ নিত্যরঞ্জন এবং তার পরিজনেরা বিস্ফারিত নেত্রে দ্যাখে, মাটি যত কোপানো হতে থাকে সাদা হাড়ের অবয়ব তত স্পষ্ট এবং দীর্ঘায়িত হয়, যেন মাটির গভীরে তার কোনও শেষ নেই। অনন্তমূল সেই হাড়ের উৎস কী তা তারা বুঝতে পারে না, নিত্যরঞ্জনের হাতের ভেতর কোদাল কাঁপতে থাকে, তার মা কেঁদে ওঠে, “বাছা, আর মাটি কোপাইস না রে, ওতে অনিষ্ট হবেক”, তবু নিত্যরঞ্জন থামে না। ক্রমশ খবর পেয়ে গ্রাম ভেঙে পড়ে চৌধুরীদের উঠোনে, ভীতি বিস্ময় এবং কৌতূহল নিয়ে সকলে তাকিয়ে থাকে মাটির দিকে, খোদিত গহ্বর ক্রমশ দীর্ঘ হতে থাকে, কিন্তু অস্থিবৃক্ষের কোনও শেষ দ্যাখা যায় না। শিমুলপারুইয়ের লোকেরা বলে, এর পরেই তাদের মর্মলোক তোলপাড়কারী সেই ঘটনাটি তাদের চর্মচক্ষের সামনে ঘটে যায়। নিত্যরঞ্জনের হাতের কোদাল মাটির পরিবর্তে অকস্মাৎ আছড়ে পড়ে হাড়টির ওপরেই, মড়মড় শব্দে তা বিদারিত হয়, তার শীর্ষদেশ ক্রমশ ফেটে গিয়ে অতিকায় হাঁ-মুখের আকার ধারণ করে, এবং রক্তজল করা হিসহিস শব্দ তুলে সেই হাঁ-এর ভেতর থেকে করাল জিহ্বার মতো বেরিয়ে আসে এক প্রকাণ্ড সাপ। যেন পৃথ্বীর কেন্দ্র থেকেই উঠে এসেছে সে, এমন ভঙ্গিতে কালো মুক্তচোখে সে সমবেত জনতার দিকে তাকায়, ভয়ে জনতা তিন পা পিছিয়ে আসে। নিত্যরঞ্জন, যেন খাদের কিনারে স্থিত মানুষ সে, স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই কালসর্প হাড়ের ওপরে ক্রমশ মাথা তুলতে থাকে, এক ফুট, দশ ফুট, পঞ্চাশ ফুট ওপরে উঠে যায় তার মাথা, মনে হয়, আকাশের চাঁদোয়ার ওপরে সে মাথা তুলে দাঁড়াবে। কিন্তু আদপে অতদূর সে ওঠে না, বরং একটা নির্দিষ্ট উচ্চতায় পৌঁছে মাথা স্থির করে তাকিয়ে থাকে নিত্যরঞ্জনের দিকে, এবং বিভক্ত জিহ্বা দিয়ে নিজের ওষ্ঠাধর লেহন করে নেয়। অতঃপর মুখ ব্যাদান করে সে হাহাকারের মতো এক নিঃশ্বাস ছাড়ে, সেই নিঃশ্বাসের উষ্ণতায় মনে হয় সৃষ্টি ছারখার হয়ে যাবে, তীব্র অগুরু-গন্ধে সকলের শ্বাস রোধ হয়ে আসে, সকলে আরও পিছিয়ে যায়, কিন্তু নড়তে পারে না শুধু নিত্যরঞ্জন, সর্পনির্গত বিষবাষ্প সরাসরি তাকে স্পর্শ করে। তার হাত থেকে কোদাল পড়ে যায়, তার দেহ কাঁপতে শুরু করে, তার চামড়া ফেটে শিরাউপশিরা জেগে ওঠে, তারপর শিরাসমূহও ফেটে যায়, আর লহুধারা তার দেহ ব্যেপে পূতজাহ্নবীর মতো বইতে থাকে। অতঃপর সকলের বিস্ফারিত চক্ষুদ্বয়ের সম্মুখে নিত্যরঞ্জন চৌধুরী, তার আমাথাপা অস্তিত্ব নিয়ে মেদমাংস বিসর্জিত একটি ভস্মসাৎ কঙ্কালে পরিণত হয়। মহাসর্প তা তৃপ্ত চোখে দ্যাখে, একবার ফিরে তাকায় বিমোহিত জনতার দিকে, তারপর ধীরে ধীরে পুনরায় ঢুকে যেতে থাকে হাড়ের মধ্যে। সে সম্পূর্ণ অস্থিভুক্ত হলে হাড়ের মুখ আবার আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে যায়, প্রলয়ের পরে ঘুমিয়ে পড়ে পৃথিবী।

নিত্যরঞ্জনের মৃত্যুর পর বহুক্ষণ পর্যন্ত শিমুলপারুইয়ের বাসিন্দারা তাদের নিজেদের জায়গা থেকে নড়তে পর্যন্ত পারেনি বলেই তারা জানায়, তারা বলে, এক অদৃশ্য শক্তি যেন মাটির সঙ্গে তাদের বেঁধে রেখেছিল, অতঃপর অনেকটা সময়ে কেটে যাওয়ার পর তারা স্বস্থিত হয় এবং প্রথমেই দলবদ্ধভাবে উদ্গত হাড়টিকে পুনরায় মাটি চাপা দিয়ে দেয়। এরপর নিত্যরঞ্জনের দেহটিকে নিয়ে তারা বিপাকে পড়ে কারণ তারা বুঝতে পারে না, তার যথাবিহিত সৎকার কীভাবে হওয়া উচিৎ, কারণ তাদের মনে হয়, যে ভৌমশক্তির অভিসন্ধিতে এমন অবিশ্বাস্য মৃত্যু এসে নিত্যরঞ্জনকে গ্রাস করে, তা আদপে মহাজাগতিক এবং তার সঙ্গে দয়াময়ের জলা থেকে উত্থিত হাওয়া কিংবা ছায়ার কোনও সংযোগ রয়েছে, এবং তাদের মনে হয়, যথাযথ সৎকার না হলে সেই শক্তি কূপিত হতে পারে, এবং তার পরিণামে গ্রামের বুকে নেমে আসতে পারে বৃহত্তর সর্বনাশ। কিন্তু এই যথাযথ সৎকারটি যে কীরূপ তা কিছুতেই স্থির হয় না, কারণ কেউ বলে, নিত্যরঞ্জনের দেহটিকে দাহ করা হোক, কেউ বলে তাকে সমাধিস্থ করা প্রয়োজন, কেউ বা মনে করে করে, সে যেহেতু কার্যত সর্পাঘাতে মৃত সেহেতু তাকে মান্দাসের ভেলায় করে ভাসিয়ে দেওয়াই বিধেয়। এই বিষয়ে ক্রমশ উত্তেজনা পুঞ্জীভূত হতে থাকে, এবং এমতাবস্থায় পুলিশ এসে অকুস্থলে হাজির হয়, কে তাদের খবর দেয় তা কেউ জানতে পারে না, কারণ পুলিশকে তথ্যসরবরাহকারী সর্বদা গুপ্তই থাকে, কিন্তু তারা এসে নিত্যরঞ্জনের কাঠকয়লা হয়ে যাওয়া কঙ্কালটিকে নিয়ে চলে যায়। এরপর গোটা গ্রামে এক স্পর্শযোগ্য আতঙ্ক বিরাজ করতে শুরু করে, এবং সেই আতঙ্ক শতগুণে বিবর্ধিত হয় যখন নিত্যরঞ্জনের মৃত্যুর পরের দিন সকলে এক পাগল-করা-ত্রাসের সঙ্গে দেখতে পায়, গতকাল তাদের চোখের সামনে মাটি চাপা দেওয়া হাড়টি এক দিনের অবসরে পুনরায় মাটির ওপর মাথা তুলেছে, এবং অতঃপর দিনে দিনে চন্দ্রকলার মতোই তা বিবর্ধিত হতে থাকে। শিমুলপারুইয়ের রাস্তাঘাট এর পর থেকেই ক্রমশ ফাঁকা হয়ে যেতে থাকে, কৃষকেরা জমিমুখো হতে সাহস পায় না, গোয়ালারা মিষ্টির দোকানে দুধের সরবরাহ বন্ধ করে, সমষ্টি উন্নয়ন সমিতির আড্ডা উঠে যায়, পঞ্চায়েত বন্ধ থাকে, কেবল গোটা গ্রামের পথেঘাটে নীরবে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে একটাই প্রশ্ন—এরপর কী, কিংবা এরপর কে? এই প্রশ্নের কোনও সদুত্তর যেহেতু শিমুলপারুইয়ের বাসিন্দারা পায় না, সেহেতু পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে তারা ডেকে আনে সর্পতান্ত্রিক লোটেকে। লোটে হেঁটে হেঁটে ক্রূর চোখে গোটা গ্রাম নিরীক্ষণ করে, দয়াময়ের জলার ধারে গিয়ে মাটি শোঁকে, মাটির মালসায় পাটকাঠির আগুন জ্বেলে তার দিকে গম্ভীর মুখে তাকিয়ে থাকে, এবং সমষ্টিবদ্ধ গ্রামবাসীর দিকে চকিতে ফিরে বলে, “জলায় কে মাছ মেরেছিল গো?” গ্রামবাসীরা এই প্রশ্ন শুনে হতবাক হয়ে যায়, পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়, কেননা তারা জানে, দয়াময়ের জলায় কস্মিনকালেও কেউ মাছ মারে না, কারণ জন্মলগ্ন থেকেই সেই জলা পবিত্র বলে রক্ষিত, গ্রামের কেউ সেখানে মাছ মারার সাহস পাবে বলেই তাদের মনে হয় না, ফলত লোটের প্রশ্নে তারা স্তম্ভিত তথা অপমানিত হয়, এবং চুপ করে থাকে। লোটে হাসে এবং বলে, “তবে চিন্তা লাই গো, আমার কাছে এর ওষুধ আছে। দহের শক্তি রুষ্ট হইয়েছেন বটে, কিন্তু দহ বেঁধে দিলে তিনি আর কিছু কইরতে পারবেক লাই।” অতঃপর বহু আয়োজনের শেষে শুরু হয় সর্পতান্ত্রিকের জলা বাঁধার কাজ। নানা মন্ত্র-তন্ত্র এবং দক্ষযজ্ঞের কোনও অর্থই গ্রামবাসীরা করতে পারে না, তারা কেবল গাণ্ডুচোখে লোটের ক্রিয়াকর্মের দিকে তাকিয়ে থাকে, ঠিক যেমনটা অর্ধশতক আগে তারা তাকিয়ে ছিল উল্কা-সৃষ্ট এক বিকট গহ্বরের দিকে। বস্তুত লোটের দৌড়ঝাঁপের ফলে তাদের কম্পমান চিত্ত কোনও স্থিরতা পায় বলে মনে হয় না, কারণ তারা বলে, লোটের জলা বাঁধার কাজ যখন প্রায় শেষের দিকে তখনই পশ্চিমদেশে ম্লানিমার ভারে নত সূর্যকে সাক্ষী রেখে আকাশে অকস্মাৎ গুড়গুড় শব্দ উঠতে শুরু করে। লোটের মন্ত্রপড়া বন্ধ হয়ে যায় এবং সে আকাশের দিকে তাকায়। এরপর যা ঘটে তা বস্তুত বর্ণনারও অতীত, তথাপি বর্ণনা ব্যতিরেকে এক নগন্য গল্পকথকের যেহেতু কিছুই করার থাকে না সেহেতু বলতেই হয় যে, গ্রামবাসীদের জাগ্রত চোখের সম্মুখে সেই আসন্ন কালসন্ধ্যার প্রাক্কালে দয়াময়ের জলার জলস্তর ক্রমশ স্ফীত হতে থাকে। মুহূর্তের মধ্যে তা এক স্তম্ভের আকারে শূন্যে উঠে যায়, এবং এক লোল সাঁড়াশির মতো হাঁ হয়ে যায়। জলাকে বেষ্টন করে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রামবাসীরা তাদের কণ্টকিত সত্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তারা বুঝতে পারে না, এই সাঁড়াশির লক্ষ্য কে, এবং তারা দ্যাখে, সাঁড়াশি ক্রমশ নেমে আসে, এবং স্তম্ভিত লোটের ঘেঁটি চেপে ধরে তাকে শূন্যে তুলে ধরে। উত্থিত লোটে চিৎকার করতে পর্যন্ত ভুলে যায়, অথবা চিৎকার করার ক্ষমতা তার অন্তর্হিত হয়। তাকে নিয়ে জলসাঁড়াশি কিছুক্ষণ শূন্যে স্থির থাকে, তারপর যেমন চকিতে সে উঠে এসেছিল তেমনই চকিতে ফিরে যায় জলার গভীরে। দণ্ডায়মান গ্রামবাসীদের নত মস্তিস্ক অধিকতর অবনত হয়।

এরপর শিমুলপারুইয়ের বাসিন্দারা বোঝে যে, গ্রামে যা ইচ্ছে তাই ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে, অন্তত ঘটা অসম্ভব নয়। তারা গৃহবন্দি অবস্থায় ঈষ্টনাম জপ করতে থাকে। শুধু মাঝে মাঝে ঘরের মধ্যে দরজা-জানলা বন্ধ অবস্থায় তারা অনুভব করে, দয়াময়ের জলার দিক থেকে একটা হাওয়া ঘুরে উঠে গ্রামে ত্বরিত পদক্ষেপে হেঁটে যাচ্ছে, বুঝতে পারে, নিমগাছের ওপরে ঝুলে রয়েছে এক দানবিক বাদুড়-ছায়া, তারপর জানলা ফাঁক করে দ্যাখে, আকাশ থেকে টুপটুপ করে খসে পড়ছে মৃত কাক আর শালিক-চড়ুইয়ের দগ্ধ দেহ। পুলিশি আশ্বাস তাদের কিছু করতে পারে না, কারণ তারা নিজেদের চারপাশের স্বরচিত বন্ধনে অধিকতর আবদ্ধ হয়, ত্রস্ত হয়, নিঃশ্বাস নিতেও তাদের ভয় লাগে, কেননা তারা বাতাসকেও অবিশ্বাস করতে শেখে। শুধু ইতিমধ্যে সেনাবাহিনীর জওয়ান যুবক অক্ষয় রুইদাস ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে এলে তার দিকে তারা ভুরু কুঁচকে তাকায়, কেননা অক্ষয় হাসিমুখে বাড়ি-বাড়ি ঘোরে, বলে, “তোমাদের এত্ত ডর লাগে কেনে? কাকে ভয় পাও তুমরা? হাওয়াকে?”, এবং পুনরায় হাসে। তার স্থিরচিত্ততা গ্রামবাসীদের সন্দিহান করে, তথাপি তারা ঘর ছেড়ে বেরোতে পারে না, এবং অক্ষয় রুইদাস তখন বিধবা জুলি হেমব্রমকে ফোন করে। বলে, “কত্তদিন তুকে দেখি লাই, আইজ আয় না কেনে?” ত্রস্ত জুলি অধিকতর ত্রস্ত হয়, সে বলে, “কুথা গো?” অক্ষয় রুইদাস গলা খাটো করে বলে, “জলার ধারে।” জুলি ভয় পাওয়ার শক্তিও হারায়, সে বলে, “তুমার কি মাথা খারাপ হইয়ে যেইনছে! জানো না তুমি কিছু?” অক্ষয় রুইদাস বলে, “জানি বলেই তো বুইলছি। ওখানে এখন কেউ আসবেক লাই।” কিন্তু জুলি রাজি হয় না। তখন অক্ষয় বলে, “তুর জইন্য লতুন মোবাইল আইনছি, ভিডিও কলিং ওয়ালা, লিবি না?” এবং বলে, “আমার কাছে লকেট আছে, লোকনাথ বাবার, কিছু হবেক লাই।” তখন জুলি বলে, “আমি কেরেস্তান, লোকনাথ বাবা কি আমাকে বাঁচাবে?”

তথাপি সে অক্ষয়ের আকাঙ্ক্ষা মতো জলার ধারে আসতে সম্মত হয়। হয়তো সে ব্যভিচারিনীর স্বভাবে নতুন মোবাইলের প্রতি প্রলুব্ধ হয়, অথবা তার প্রণয়িনী চিত্ত দয়িতের আকাঙ্ক্ষায় উন্মুখ হয়, অথবা সে ভাবে তার সেনাকর্মী পুরুষ তাকে যে কোনও শক্তির বিরুদ্ধে রক্ষা করতে সমর্থ, অথবা সে-ও ঘাতক নিয়তির বশবর্তী হয়ে বোধবুদ্ধি হারায়, অথবা সে হয়তো কিছুই ভাবে না, মোট কথা সে মধ্যরাত্রের কিছু পূর্বে দয়াময়ের জলার ধারে এসে উপনীত হয়। আকাশে চাঁদ ওঠে, পূর্ণিমার চাঁদ, এবং সেই পূর্ণায়ত চন্দ্রপ্রেক্ষাপটে দিগন্তের ওপরে ছায়ার মতো এসে দাঁড়ায় অক্ষয় রুইদাস। দু’জনে পাকুড় গাছের নিচে বসে, হাতে হাত রাখে, এবং কথা বলে। জুলি হেমব্রম বলে, “গোটা গ্রামটা যেন ভয়ে সিঁটিয়ে যেইনছে”, অক্ষয় রুইদাস বলে, “হ্যাঁ, আর কারো মুখে কথা লাই কুনো।” জুলি বলে, “কী হইনছে বলো তো গ্রামে?” অক্ষয় হাসে এবং বলে, “তরাস কারা পায় বল তো? যাদের হাতে অক্ত লেগে থাকে। তাদের মনের ডর রাইক্কসের মতো রূপ লিয়ে তাদের খায়।” এবং সে জুলির বুকের আঁচল সরায়। জুলি কেমন যেন কুঁকড়ে যায়, সে বলে, “অ্যাই, শোনো না, আমি যখন ইদিকে আইসছিলম, তখন না আমাদের ঘরের পুবদিকের নিমগাছটার লিচে কেমন একটা গুমোট ঝাঁক বেইনধে ছিল।” অক্ষয় শোনে না, সে জুলির দু’কাধ ধরে তাকে মাটিতে শুইয়ে দেয়। জুলি বলে চলে, “নিমগাছটার তলা দিইয়ে যখন আইসছি, তখন নিঃশ্বাসের সঙ্গে যেন কেমন একটা গরম বাতাস শরীলে পোবেশ কইরল।” অক্ষয় জুলির ব্লাউজের হুক খোলে। জুলি বলে, “তারপর থেকে শরীলটা কেমন যেন আছাড়ি-পিছাড়ি কইরছে।” অক্ষয় জুলির শরীর বেয়ে ক্রমশ নিম্নগামী হয়, এবং পেটিকোটের দড়ি ধরে টান দেয়। জুলি কোনও অজ্ঞাত কারণে তাকে বাধা দিতে চায়, কিন্তু বাধা দিতে পারে না, চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে দ্যাখে, জ্যোৎস্নায় যেন ঊর্ধ্বলোক টগবগ করে ফুটছে। সেই গগনমধুরিমা জুলির সর্বাঙ্গে প্রতিফলিত হয়, আর অক্ষয় রুইদাস তার নিচে শায়িত নারীটির পেটিকোট নামিয়ে তার আনন্দউৎসটির দিকে তাকায়, এবং তৎক্ষণাৎ তার সর্ব অস্তিত্ব যেন এক বরফস্পর্শে হিম হয়ে যায়। কেননা সে দ্যাখে, জুলির ধরিত্রীর মতো উদ্বেল দুই উরুর অন্তঃস্থলে জেগে উঠছে চাকা চাকা ফোস্কার মতো স্ফীতি। সেই গরলস্ফোটকসমূহের আকার অক্ষয়ের চোখের সামনে ক্ষণে ক্ষণে বিবর্ধিত হতে থাকে, কয়েকটি তাদের সর্বোচ্চ আকারে পৌঁছে ফেটে যায় এবং তপ্ত তরল অক্ষয়ের চোখেমুখে এসে লাগে। উন্মাদ চোখে জুলির ঊর্ধ্বাঙ্গে তাকায় অক্ষয়, দেখতে পায়, গোটা শরীর তার ঢেকে গিয়েছে রসভরা অজস্র স্ফোটকে, যারা বিদারিত হওয়ার পূর্বমুহূর্তে কাঁপে। নিজের অস্তিত্ব নিংড়ে এক শব্দহীন চিৎকারে দয়াময়ের জলাকে প্রমত্ত করে তোলে অক্ষয়, তার মনে হয়, যে মারী গোটা গ্রামকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে বলে সে, এক অহংনত মানুষ, এযাবৎ শুনে এসেছিল, অথচ হৃদয়ের গভীরে যার ভদ্রাসন অনুভব করেও যাকে সে বারবার অস্বীকার করতে চেয়েছে, প্রার্থিত নারীর আকারে সে অবশেষে তার সম্মুখে এসে উপনীত হয়েছে। সে দু’হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতে চায়, কিন্তু পারে না, কারণ জুলি তার মায়াময় বাহু দু’টি বিস্তার করে তাকে পেঁচিয়ে ধরে। অক্ষয় বুঝতে পারে, ও দু’টি বাহু নয়, প্রগলভ সাপ, যাদের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার আশাও তার আশাতীত মনে হয়। জুলি হাসে, অক্ষয় দ্যাখে, তার মুখের মধ্যে খেলা করছে একটি জ্বলন্ত অঙ্গার, তার ওপর দিয়ে নিজের জিহ্বাকে প্রসারিত করে দিয়ে জুলি বলে, “আমাকে লেবে না গো, বাপ?” যেন মাতৃত্বপ্রয়াসী নারীর আকস্মিক ব্যাকুলতায় সে তার বিষপয়োমুখ দু’টি চেপে ধরে অক্ষয়ের বিস্ফারিত মুখবিবরে। অতঃপর অর্ধশতাব্দী পূর্বে দয়াময়ের করুণা রূপে প্রকাশিত এক জলার জল চাঁদের সাম্রাজ্যের অধীনে আদিগন্ত শ্মশানস্তব্ধতার গর্ভে ইচ্ছা-অনিচ্ছার এক পাশব সঙ্গমের আন্দোলনে তালে তালে আন্দোলিত হতে থাকে।

Facebook Comments

Leave a Reply