হোমোফোবিয়া, রাষ্ট্র ও সমাজ : অপূর্ব ঘোষ
বিভিন্ন সময়ে সুশীল সমাজ তথা সমাজের তথাকথিত প্রগতিশীল ব্যক্তিবর্গকে বিভিন্ন সামাজিক ব্যাধি, অনাচার, অসাম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে বা কলম ধরতে দেখা যায়। প্রান্তীয় মানুষদের অধিকারের জন্য আওয়াজ তোলা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বা ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষদের উপর নেমে আসা রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার বিষয়েও সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে ছাত্র সমাজের ভূমিকা অত্যন্ত ইতিবাচক ও আশাব্যঞ্জক। ছাত্রসমাজকে রাজপথে স্বৈরাচারী শাসকের রক্তচক্ষুর সামনে দাঁড়িয়ে ‘আজাদী’র স্লোগান দিতেও দেখা গেছে। তবে অদ্ভুতভাবে সংখ্যালঘু যৌনতার মানুষদের, বিশেষ করে সমকামিদের অধিকার তথা ‘আজাদী’র পক্ষে আওয়াজ তোলার প্রশ্নে অধিকাংশ-ই কেমন আড়ষ্ট, সাবধানী হয়ে যান। এক আশ্চর্যজনক নীরবতা যেন গ্রাস করে। এই নীরবতা, আড়ষ্টতা ও সাবধানতা-ই হোমোফোবিয়া।
ভারতবর্ষে যদিও ভারতীয় দন্ডবিধির ধারা ৩৭৭ প্রয়োগ করে সমকামিতা ও এর সাথে সম্পর্কিত পায়ুকাম,পারস্পরিক হস্তমৈথুনের মত যৌনক্রিয়া সমুহকে “প্রকৃতি বিরুদ্ধ” প্রতিপন্ন করে নিষিদ্ধ করেছিল ঔপনিবেশিক সরকার, কিন্তু এদেশে হোমোফোবিয়ার এক দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন গ্রন্থ যেমন বাৎসায়নের কামসূত্র, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, মনুস্মৃতি, নারদপুরাণ ইত্যাদি তে হোমোফোবিয়ার নিদর্শন পাওয়া যায়। যেমন অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে শাসক বা রাষ্ট্রের উচিত সমকামিতার মতো সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াই করা। আরো বলা হয়েছে “অযোনি” বা যোনি বহির্ভূত যৌনক্রিয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মনুস্মৃতি তে বলা হয়েছে যে দুজন পুরুষ পরস্পরের সাথে যৌনতায় লিপ্ত হলে তারা জাতিগত ভাবে জাতি ব্যবস্থায় নিচু শ্রেণিতে নেমে যাবে। একজন পুরুষ তার বীর্য যোনি ব্যতীত অন্য কোথাও স্খলন করলে কি শাস্তি হবে সে সম্পর্কেও বলা আছে মনুস্মৃতিতে। এখানে আরো উল্লেখ আছে যে, যদি কোন প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা জোরপূর্বক অন্য কোনো ভার্জিন যুবতীর সাথে লেসবিয়ান যৌনতা বা বিকল্প রতিক্রিয়ায় লিপ্ত হন তবে শাস্তিস্বরূপ ঐ প্রাপ্তবয়স্ক মহিলার দুটো আঙুল কেটে দেওয়া হবে। আবার নারদ পুরাণে বলা হয়েছে যে যদি কেউ (পুরুষ) বীর্য স্ত্রী যোনি বহির্ভূত অন্য কোথাও স্খলন করে তবে তার নরকে ঠাঁই হবে মৃত্যুর পরে। এই সমস্ত বক্তব্য তো হোমোফোবিয়ার প্রতিই দিক নির্দেশ করে। আসলে হোমোফোবিয়ার বীজ নিহিত থাকে পুরুষতন্ত্রে জঠরে, কারণ সমকামিতার মতো বিকল্প যৌনতা পুরুষতন্ত্র নির্মিত পরিবার, বংশবিস্তার ইত্যাদি ধারনা গুলোকে চ্যালেঞ্জ করে। আর যেহেতু ভারতবর্ষে পুরুষতন্ত্র পরবর্তী বৈদিক যুগ থেকেই শক্তিশালী, তাই হোমোফোবিয়াও বরাবরই তিব্র এদেশে। তবে একটা বিষয় অবশ্যই বলতে হয় যে রাষ্ট্রের বন্দোবস্তে হোমোফোবিয়া প্রথম ব্রিটিশ শাসন কালেই ভারতবর্ষে পরিলক্ষিত হয় যা স্বাধীনতা পরবর্তী কালের ভারত সরকার বা সংবিধান প্রণেতারা সানন্দে গ্রহণ করেছিলেন।
রাষ্ট্রীয় নীতির কি সত্যিই কোন বদল ঘটেছে? মনে তো হয় না তেমনটা। কারণ ৩৭৭ ধারার অবলুপ্তিকরণে রাষ্ট্র কোনও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেনি। ভারত সরকার নিজে থেকে যেচে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। বহুদিন ধরে নাজ ফাউন্ডেশন ও অন্যান্য বিভিন্ন সংগঠন এবং অ্যাক্টিভিস্ট দের আইনি লড়াইয়ের ফলস্বরূপ সুপ্রিম কোর্ট এই শতাব্দী প্রাচীন ঔপনিবেশিক আইন সরিয়ে ঘোষণা করে যে পারস্পরিক সম্মতিতে সমকামিতা তথা সমলৈঙ্গিক যৌনতা অপরাধ নয়। যখন সুপ্রিম কোর্ট তার চূড়ান্ত রায়দানের আগে ভারত সরকারের মতামত জানতে চাইলে, তখন প্রথমদিকে এক অদ্ভুত নীরবতা দেখিয়ে শেষমেশ সরকারপক্ষ জানায় যে এ ব্যাপারে কোনো মতামত নেই তাদের, বরং মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত সরকার মেনে নেবে। অবশেষে ৬ সেপ্টম্বর, ২০১৮তে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ভারতবর্ষে সমকামি সম্পর্ক বৈধতা পেল। সমকামিতা কেবলমাত্র বৈধতা পেয়েছে কিন্তু এখনও তো অনেক মৌলিক অধিকার থেকে সমকামিরা বঞ্চিত, যেমন বিবাহের অধিকার, সন্তান দত্তক নেওয়া ইত্যাদি। কিন্তু রাষ্ট্র এই সব ব্যাপারে নিশ্চুপ। অথচ রাষ্ট্রের কাজ হল জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষা করা, সমানাধিকার প্রদান করা। রাষ্ট্র সেটা করছে না। এর পরেও কি বলা যায় যে রাষ্ট্রীয় নীতিতে বড় কোন মৌলিক বদল হয়েছে?
রাষ্ট্র নির্মিত আইন প্রয়োগ বা অবলুপ্তি করে সবসময় কোন প্রথা বা সিস্টেম কে টিকিয়ে রাখা বা তার অবসান ঘটানো যায় না। বরং ভারতবর্ষের মত দেশে আইনের থেকেও কোথাও যেন সমাজ বেশি শক্তিশালী। উদাহরণ দেওয়া যাক। সতীদাহ প্রথা আইন করে রদ করা হয় ১৮২৯ সালে, কিন্তু যেদিন আইন কার্যকর হয় তার পরদিন থেকেই কিন্তু সতীদাহ বন্ধ হয়ে যায়নি। বহুদিন এই প্রথা কার্যকর ছিল। এমনকি ১৯৮০র দশকে রাজস্থানে সতীদাহের একটি ঘটনা শোনা যায়। অর্থাৎ, মূল বক্তব্য হল যতক্ষণ না সামাজিক চিন্তাধারায় পরিবর্তন আসে ততক্ষণ সামাজিক ব্যাধির অবসান ঘটে না। তাইতো সমকামিতা অপরাধের তকমা থেকে আইনের মাধ্যমে মুক্ত হলেও তা সর্বজনীন সামাজিক স্বীকৃতি পাওয়া থেকে বঞ্চিত। এ-প্রসঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের এস.গুরুমূর্তি নামক একজন কার্যকর্তার মতামত বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৯ সালে যখন দিল্লি হাইকোর্টের রায় আংশিকভাবে সমকামিদের পক্ষে যায় সে সময় গুরুমূর্তি আর.এস.এস এর ইংরেজি মুখপত্র অর্গানাইজারে লেখেন, “ভারতবর্ষের নিয়মানুবর্তিতা বরাবরই অ-বিধিবদ্ধ সামাজিক ও পারিবারিক আদর্শ বা নিয়ম দ্বারা পরিচালিত হয়ে এসেছে; রাষ্ট্র নির্মিত আইনের দ্বারা নয়। রাষ্ট্র, পুলিশ বা আদালত নয়, বরং আত্মনিয়ন্ত্রণ ও লজ্জাবোধই ছিল প্রাচীন ভারতবর্ষে সামাজিক বিপথগামীতা ও খারাপ আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করবার প্রধান অস্ত্র। এমনকি এই আজকের সময়েও অ-বিধিবদ্ধ নৈতিক আদর্শই সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে, কোন রাষ্ট্র বা রাজ্য আইনসভার আইন তা পারে না… কোন আইন বা আাদালতের রায় সমকামিতাকে বিশুদ্ধ বলে দিতে পারে না।” এই বক্তব্যের ভেতরকার গোঁড়ামিকে বাদ দিলে ভদ্রলোক খুব একটা ভুল বলেননি। পণ প্রথা থেকে শুরু করে বাল্য বিবাহ সবই তো আইন দিয়ে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এসব কি পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে? বা খোলাবাজারে অ্যাসিড বিক্রি আইন দিয়ে বন্ধ করার চেষ্টা করেছে রাষ্ট্র, কিন্তু তা সত্ত্বেও তা গোপনে বিক্রি হচ্ছে। হ্যাঁ তবে রাষ্ট্রীয় আইনের গুরুত্বকে অস্বীকার না করেও বলা যায় যে ভারতবর্ষে যেকোন ধরনের সামাজিক ব্যাধির অবসানের জন্য সবার আগে দরকার সামাজ ব্যবস্থার জড়ত্বে আঘাত করা। আইনই যদি শেষ কথা হত, তবে সমকামিতা বৈধতা পাওয়া সত্বেও অসংখ্য সমকামিদের এই ভাবে নিজেদের সত্তাকে লুকিয়ে রাখতে হত না।
সাম্প্রতিক কালে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা দিলেও সমাজের হোমোফোবিয়ার ভয়ংকর চিত্র কিন্তু খুব একটা কমেনি। এমনকি খাস কলকাতার মতো আধুনিক শহরের হোমোফোবিক চরিত্রও খুবই আশঙ্কার। কখনও বাবা-মা তার সন্তানকে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছেন বা বাড়িতেই পরিবার পরিজনের দ্বারা সমকামি মানুষরা সামাজিক ভাবে বয়কটের সম্মুখীন হচ্ছেন প্রতিনিয়ত, কেবলমাত্র সমকামি হবার অপরাধে। সাক্ষাৎকারে একজন সমকামি পুরুষ জানান যে পরিবারে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রশ্ন উঠলে তার মতামতকে গ্রাহ্য করা হয় না এবং যদি তিনি মতামত দিতে যান তবে তাকে বলা হয়, “তুমি তো গে, তুমি আবার কী বলবে?” শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার কখনও কখনও পৌঁছে যায় চরম সীমায়। আশ্চর্যজনক ভাবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ধরনের নির্যাতন কিন্তু বাড়ি থেকেই আসে। একজন যুবতী বাড়িতে তার উপর হওয়া নির্যাতনের বিবরণ দিতে গিয়ে জানায় যে তাকে তার দাদা বাবা-মায়ের সম্মতিতে ধর্ষণ করেছে। কারণ এক্ষেত্রে তাদের মনে হয়েছিল যে এর ফলে হয়তো মেয়েটি ‘স্বাভাবিক’ হয়ে যাবে। হোমোফোবিয়া কিন্তু কলকাতার মত শহরে তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও রয়েছে। সম্প্রতি (২০১৯ সাল) আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষায় (সমীক্ষাটির শিরোনাম হল “পলিটিক্স এ্যান্ড সোসাইটি বিটুইন ইলেকশন”) প্রকাশ পেয়েছে যে কলকাতা তথা বাংলাতে বেশির ভাগ মানুষ সাক্ষাৎকারের সময় সমকামিতা নিয়ে কথা পর্যন্ত বলতে চাননি। এ চিত্র বড় আশঙ্কার।
সমকামি যৌনতার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ হল এটি নাকি অ-প্রাকৃতিক, কারণ এক্ষেত্রে সন্তান জন্ম হয় না। প্রশ্ন হল বিষমকামি যৌনতায় কি সন্তান উৎপাদন করাটাই একমাত্র উদ্দেশ্য থাকে? এক বিষমকামি দম্পতি তাদের দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে অসংখ্য বার মিলিত হন। কিন্তু প্রতিবার যৌনতায় লিপ্ত হবার সময় কি তারা সন্তান উৎপাদনের কথা মাথায় রেখেই মিলিত হন? যদি তেমনটাই হত তবে প্রতিটি দম্পতির অসংখ্য সন্তান-সন্ততি থাকত। কিন্তু বাস্তবে তো তেমনটা হয় না। যৌনতা হল “কামের শিল্পকলা”। যৌনতার ভেতরকার আনন্দই আসল। তাই সন্তান উৎপাদন না হওয়ার যুক্তি দিয়ে সমকামি যৌনতা কে “অস্বাভাবিক” বলে দাবি করাটা ভুল। আরো একটি অভিযোগ হল পুরুষ সমকামিরা পায়ুকাম করে। অথচ পায়ুকামে কিন্তু অনেক বিষমকামিরাও অভ্যস্ত। আসলে যৌনতা বিষয়ক এই সব “স্বাভাবিকত্ব” ও “অস্বাভাবিকত্ব”-এর ধারণা দিয়ে গেছে ভিক্টোরিয় নৈতিকতা। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটেছে বহু বছর হয়ে গেল। এখনও কি সমাজ ঔপনিবেশিক ধ্যান-ধারণাকে বয়ে নিয়ে চলা উচিত? এই ঔপনিবেশিকোত্তর যুগেও? পোস্ট কলোনিয়ালিজম্ কিন্তু শুধুমাত্র একটি রাজনেতিক বিষয় নয়, বরং চিন্তার জগতে এটি একটি দর্শন। এই দর্শনের মূল কথা হল ঔপনিবেশিক শক্তি কর্তৃক প্রদত্ত চিন্তা-চেতনা, নিয়ম কে নতুন ভাবে প্রশ্ন করা, তাকে যাচাই করা। কিন্তু এখনও সমাজের একটা বড় অংশের মানুষ সেটা না করে জীর্ণ-পুরাতন কে আঁকড়ে বসে আছেন। আর কত পিছিয়ে থাকবে সমাজ?
শেষ করা যাক ঋগ্ বেদের একটা বাক্য দিয়ে। বাক্যটি হল, “বিকৃতি এবম্ প্রকৃতি”। এর অর্থ বিকৃতিও একধরনের প্রকৃতি। অর্থাৎ আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে, রামের কাছে যা “বিকৃতি” তা শ্যামের কাছে “প্রকৃতি” বা স্বাভাবিক হতেই পারে। এই ভাবে ভাবলে কেমন হয়?
[লেখক কল্যানী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে গবেষক।]
Posted in: April 2020, prose
তথ্য সমৃদ্ধ ও যুক্তিনিষ্ঠ বিশ্লেষণ।