অর্ধেকের খোঁজে: নিজস্ব বুননে ভারতীয় নারীদের নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ – অমৃতা সরকার

নবম কিস্তি: তৃতীয় পর্ব

‘কৃষ্ণের রাধা’ থেকে ‘রাধার কৃষ্ণ’ হয়ে ওঠা : মুদ্দুপলানির ‘রাধিকা সান্ত্বনম’-এর নির্বাচিত অনুবাদ

তৃতীয় পর্ব

এই সংখ্যায় রইল ‘রাধিকা সান্ত্বনম’-এর তৃতীয় অধ্যায়ের নির্বাচিত অংশের অনুবাদ। দ্বিতীয় অধ্যায়ের রাধার সংকট এই অধ্যায়ে সুতীব্র হতাশা ও উন্মাদনার প্রান্তে এসে পৌঁছায়। ইলার কৃষ্ণের কাছে রাধাকে ত্যাগ করার অনুরোধ এবং কৃষ্ণের আপাত ভাবে তাতে সায় দেওয়া রাধাকে শুধুমাত্র ‘নারী’ হিসেবে বিধ্বস্ত করে না, আঘাত করে তার ‘শিক্ষক’ সত্তায়। রাধা হয়ে ওঠেন সেই ব্যক্তি যিনি নিজের অর্জিত গুণাবলী ব্যবহার করে নিজের অধিকার ছিনিয়ে আনতে চান। পিতৃতন্ত্রের নির্দিষ্ট করা ‘ত্যাগী’র ভূমিকায় না থেকে রাধা এখানে নিজ অধিকার বুঝে নেওয়ার সওয়াল করতে শুরু করেন। অপর দিকে কৃষ্ণ রাধাকে চিরতরে হারাবার সম্ভাবনা আঁচ করে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন রাধার সঙ্গে দেখা করার জন্য। কৃষ্ণ সখা ও ইলার ভাই শ্রীদামা কৃষ্ণের ও রাধার সম্পর্ককে বয়জেষ্ঠ্যা নারী, রক্তসম্পর্ক, বিয়ে ইতাদি বিবিধ ‘নর্ম্যাটিভ’ বিধি দিয়ে ‘অস্বাভাবিক’ প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করলে কৃষ্ণ ভারতীয় হিন্দু ঐতিহ্য দিয়ে দেখান যে ভারতীয় হিন্দু ঐতিহ্যে প্রেম ও যৌনতা সবসময় ট্রান্সগ্রেসিভ। কৃষ্ণ বলেন:

“ব্রহ্মা নিজে সৃষ্টি করেছেন যে কন্যাকে
সেই কন্যাকেই বিবাহ করেছেন-
 তাকে দুশ্চরিত্র বলা হয়?
চন্দ্রদেব গুরুপত্নী তারাকে হরণ করেছেন-
তাকে নষ্ট বলা হয়?
সূর্য তার মিত্রজায়ার সঙ্গে থাকেন-
তাকে লম্পট মনে করা হয়?
সমুদ্রদেব তার দৌহিত্রী গঙ্গার সঙ্গে প্রকাশমান
তাকে কি নীচ মনে করা হয়?
ব্যাস তার শ্যালিকার সাথে প্রমোদে বিভোর থাকেন-
তার পবিত্রতা নষ্ট হয় এতে?
তুমি বললে আমার এ সম্পর্ক বৈধ নয়
তাহলে যারা এই সকল সম্পর্কে লিপ্ত তারাও কি একই দোষে দুষ্ট?
ভূদেবী কি হরির সম্পর্কে খুড়ি নন?
নাকি গঙ্গা শিবের খুড়ি নন?
অহল্যা ইন্দ্রের খুড়ি নন?
কি করে তারা প্রেমের সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলেন?
তারা নিশ্চিতভাবেই তোমার চেয়ে জ্ঞানী!”
কৃষ্ণের এই উচ্চারণ মনুর সেই পিতৃতান্ত্রিক ‘হিন্দুত্ব’কে তছনছ করে যা ‘বিধি’ ও ‘নিষেধ’-এর ভিত্তিতে নির্মিত।

তৃতীয় অধ্যায়

ত্রিভুবনপতি, বরদা, সম্রাট শ্রেষ্ঠ
 রমণীহৃদয়স্বামী
  তরুণ কৃষ্ণকে প্রণাম!

***

ব্যাসপুত্র শুক যিনি ঈশ্বরকে অনুভব করেছেন,
তিনি তুলনাহীন মধুরতায় রাজা জনককে বলতে লাগলেন
“মন দিয়ে শুনুন”

***

“নাছোড় কামনায়
তার বুকদুটি মানে না কাঁচুলির শাসন
  পদ্ম আভা ফুটে ওঠে মুখে
পান আর আতরে সুগন্ধিত
ইলা ছলায় আর লাজে
  কৃষ্ণের প্রশস্ত বুকে
নিজেকে বারবার মথিত করে”

***

কৃষ্ণের উপর রাধার প্রভাব, অন্তরঙ্গতা শিশুকাল থেকেই ইলাকে করেছে ঈর্ষান্বিত কিন্তু সুচতুর ভাবে সে লুকিয়ে রেখেছে তার মন।
কৃষ্ণ আর রাধার কথায় আড়ি পেতে যখন শুনেছে কীভাবে কৃষ্ণ তাকে খারিজ করেছে অনভিজ্ঞ বলে, সয়েছে সে। বিয়ের পর নতুন স্বামীকে খুশি করতে বাদ রাখেনি কোনো কলা, কোনো কৌশল, যাতে কৃষ্ণ তাকে রতিকলার রাণী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, এমনকি কোনো দুর্বল মূহুর্তে রাধাকেও ত্যাগ করতে রাজি হয়।

***

অনুপুঙ্খ রতি খেলায় মত্ত সেই পদ্মাক্ষী
সুতীব্র আনন্দ ক্ষণে প্রিয়তম প্রভুকে বলে,
“প্রিয় আমার, কথা দাও, সত্য করে,
রাধাকে ত্যাগ করবে চিরদিনের তরে”
আর মাধব, সুখে আত্মহারা মাধব
সম্মতি দেন, তিল বিলম্ব না করে।

***

“আহ! কিন্তু পুরুষের প্রতিশ্রুতি কি চিরকালীন?
তাদের কথায় সত্যতা কীইবা?
প্রতিজ্ঞা রাখতে জানে তারা?
প্রিয়া, মৃগনয়না
যদি তুমি জানতে পারো, তবে
জানবে শুধু তোমার ভালোবাসাই
বাড়ছে দিন প্রতিদিন”

***

যেমন বজ্রের ধ্বনি শুনে রাজহংস
যেমন শার্দুল হুংকারে মৃগ

যেমন মার্জার শব্দে শুকপাখি
যেমন সিংহের গর্জনে বারণ
তেমনি শুকের কথা শুনে রাধার শরীর থরথরায়
বুক ধড়ফড়ায়, ধ্বস্ত চিন্তিত রাধা বোঝে নন্দলালার প্রেম শুধু তার
অনন্ত যন্ত্রনা, মাথা ঘুরে যায়, রাধা জ্ঞান হারায়।
এই দেখে ছুটে আসে দাসীরা, উদ্বেগে ঘিরে ধরে তাকে। তার ভুরুর উপর থেকে ঘাম মুছে দেয়
সুগন্ধী জল ছিটিয়ে দেয়, বাতাস করে, দেয় শীতল কর্পূর, জ্ঞান ফিরলে পরামর্শ দেয়, “তোমার কৃষ্ণকে আর বিশ্বাস করা যায় না”

***

দুপুর গড়ালে রাধা চোখ খোলে
গোপন করে দীঘল শ্বাস, সাপের মত হিসহিসায়
নাকের পাটা ফুলে ওঠে, চাঁদপানা মুখ জ্বলে ওঠে রাগে
ঠোঁট কাঁপে, যেমন বাতাসে দোলে নতুন কুঁড়ি
রাগে দুঃখে লাল হয়ে আসে চোখ
শোকের মুরতি যেন
ক্লান্ত অবসন্ন রাধা
শান্ত সংযমে
কাঁপধরা স্বরে শুধায়
শুককে:

***

“যা শুনেছি তা সত্য?
ইলা নির্ভয়ে বলেছে তাকে এ কথা?
আর সেই নিঠুর গোপাল মেনেছে তা?
ওহ রাম! তাহলে আর কি বাকি আছে প্রকাশের?
তারা চিরসুখী হোক, এই কি যথেষ্ট নয়?”

***

“সে কি ভুলে গেছে আমার কাছেই কোকিলের মত গাইতে শিখল?
ভুলে গেছে কবিতা লিখতে শিখল আমার থেকেই?
ভুলে গেছে কি আমার কাছে শিখল বাদ্যযন্ত্র বাজাতে?
রতিখেলাও সে শিখল আমারই কাছে, ভুলে গেছে সে?”

***

সে যখন আমার শিষ্য ছিল, তাকে যে শাসন করেছিলাম
সব কি সে ভুলে গেল?
এখন তার মুরারি আছে,
তাই সে সকলে সবারে ভুলেছে?”

***

“শুধু কিছু কবিতা আওড়ানোই যথেষ্ট?
অনুপম কাব্য রচনা করতে পারবে?
বীনার তারে ঝংকার তোলাই যথেষ্ট কি?
পাথর গলাতে পারবে তার সঙ্গীত?
কিছু রাগ গাইতে পারলেই হয়?
কৃতি রচনা করতে পারবে সে?
নৃত্যের কিছু মুদ্রা জানাই কি যথেষ্ট?
তাকে নবরস নির্মাণ করতে দাও তো?
রতিখেলার কিছু কৌশল জানাই কি যথেষ্ট?
সে কৃষ্ণের অতল মনের থই পাবে?
ফুঃ ! এই নাদানের জন্য
কেশব আমাকে ছাড়তে রাজি, বল আমার ছোট্ট টিয়ে,
আমাকে?”

***

“ ওহ! আর কোনো কথা নয় এখন
ওই কৃষ্ণকে এখনো আমি আমার শাড়ির আঁচলে বাঁধতে পারি
যদি আমি সৌরির ইলার কাছে যাওয়া বন্ধ না করতে পারি
যদি আমি ওর গুমোর না ভাঙতে পারি
যদি আমি ওকে আমার পায়ের তলায় না দলতে পারি
যদি আমি এর শোধ তুলতে না পারি
তবে আমার নাম রাধা নয়,” শপথ নেয় সে।

***

“যা কিছু আজ সে জানে
সকলই আমার শিক্ষা!
‘যশোদাকে বোলো না কিন্তু,’
ষড় করতাম খিলখিল করতে করতে আমোদে আহ্লাদে
কচি খোকা ছিল সে!
এখন আমি নিজের কৃত কর্মেরই ফল ভোগ করছি”।

***

“দাসীকে দিয়ে কিছু বলে পাঠালে
টুঁ শব্দটি না করে অক্ষরে অক্ষরে পালন করত সব
অন্য কেউ তার সময়ে ভাগ বসাতে এলে
রাগে জ্বলত তার দুচোখ।
নির্দ্বিধায় সে লড়ে যেত পৃথিবীর সঙ্গে, আমার জন্য,
ওহ ফুলেল তনু!
চলতে ফিরতে সতর্ক করেছি যাতে
অবহেলা করে সে নিজেরই বিপদ ডেকেছে
যা কিছু গ্রহন করেছে সে
প্রথমে তুলে দিয়েছে আমার হাতে।
নিজের প্রেমিক যখন এমন অন্যায় করে
তখন আর কী করে বাঁচি
হে মেঘবরণ কেশ?”

***

“প্রতি কথা মানত আমার
রাগ দেখালে তোষামোদ করে মান ভাঙাত
সেটা কি প্রেম নয়?”

***

“যে দুঃস্বপ্নেও কখনো আমায় ছেড়ে দূরে যাওয়ার কথা ভাবতে পারত না
সে আজ এক বালিকার জন্য
আমায় ঠকাচ্ছে!
কী আর বলব?
পুরুষের প্রেম শুধুই ভ্রম!”

***

“সাশ্রুনয়না রাধাকে দেখে শোকে অধীর শুক বলে,
“তুমি জানো না প্রভুর লীলা খেলা?
সে তো ভরতের গল্পকেও হার মানায়!”

***

“আজকাল ওই মেয়ের শাড়িই হয়েছে তার উত্তরীয়
ঘাগড়া হয়েছে ধুতি
ওর মুখ তার আয়না, ওর মেহেদী তার তিলক
ওর ললিত জঙ্ঘা তার শিরাধার,ওর স্তনদুটিতে তার গাল
ওর স্বেদ তার সুগন্ধী জল, ওর ত্বক তার অঙ্গমার্জন
ওর শয়নকক্ষ তার দরবার,ওর কটাক্ষে তার পৃথিবী
এর বেশি কে কীইবা বলতে পারে?
ইলার সঙ্গে সৌরি যেন প্রকৃত ঈশ্বর হয়েছেন”

***

“শোনো গো মেয়ে
আরেকটা কথা বলি তোমায়
রতির রানি বলে ডাকেন তিনি ইলাকে
যেভাবে বলেন, তা আমি মুখেও আনতে পারব না”।

***

“সে রঙ্গিনী কানের ভিতর ফিসিফিসিয়ে বলে, ‘কে বেশি সুন্দর?’
জোর করে, ‘বল, বল, বলতেই হবে, কে? রাধা না আমি?’
উনি উত্তর করেন, বেশিরভাগ বিষয়ে তোমরা সমান
কিন্তু আমাকে বাঁধতে তোমার চেয়ে ভালো কেউ পারে না”।

***

শুনে রাধা চিৎকার করে কাঁদে, নিজ নিয়তিকে শাপশাপান্তে ভরে।

***

“তোমার কি কোনো উপায় জানা নেই
যাতে সৌরি ওকে ছেড়ে আমার কাছে আসে?
ওহ মা! আমি এসব বলছি কী করে?
আমি কি পাগল হয়ে গেছি?
প্রিয় শুক এ সবই কর্মদোষ!”

***

শোকে উন্মাদিনী রাধার ঠোঁট কাঁপে
হাঁটতে গিয়ে ঢলে পড়ে সে
শাড়ি খসে পড়ে, চুল খুলে যায়
মুখ অন্ধকার
কামনা তার হৃদয় কুঁড়ে খায়
স্বরভঙ্গ, রক্তিম আঁখি
কামের বাণে বিদ্ধ
রাধা ক্রুদ্ধ ভীষণ কৃষ্ণের উপর।

***

সে কখনো চুল বাঁধে, কখনো দেয় খুলে
মাথার ফুল কোথায় উড়ে যায়
গয়না ছুঁড়ে ফেলে
মেখলা খুলে ফেলে
কুমকুম লেপ্টে দেয়, কাজল চন্দন মুছে ফেলে
কাপড় খুলে ফেলে শরীরে জড়ায় ছিন্ন শাড়ি
নিয়তিকে শাপ দেয়, জীবন ক্লান্ত রাধা
নিজেকে টেনে নিয়ে যায় শয়নকক্ষের দিকে
আছড়ে পড়ে অপমানিত শয্যায়,
শুক তার সঙ্গ নেয়…

***

আকুল, একাকী, শোক কাতর
বাতিল, বিধ্বস্ত রাধা
বারে বারে জ্ঞান হারায়
অভিশাপ দেয় ইলা আর হরিকে

***

একাকীত্বের ক্লান্তিতে, বিরক্তিতে,
কাঁপে রাধা
বিড়বিড় করে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
অভাবিত ঘটনা সকল
তাকে স্তম্ভিত করে দেয়।

***

“এখানে এসো”
“কিছু আজব কথা শুনে যাও
দেখে যাও, আমার প্রেম আমার সঙ্গে কী করেছে?
এখন আমি লোকের ঘৃণা আর করুণার পোড়া দাগ বয়ে বেড়াব?
যাও, চলে যাও, থাকো ওর সঙ্গে,
আনন্দে মাতো! যাদবকুলপতি”।

***

ওহ! আমি শুধু সেই যাদব রাজার কাছে পৌঁছতে চাই
হাতছানি দিয়ে ডেকে নিয়ে
তীব্র চুম্বন করতে চাই
যতক্ষণ না আমার শরীরে তার শরীরে মিশে যায়
দীর্ঘ আলিঙ্গনে বেঁধে ফেলতে চাই তাকে”।

***

অনঙ্গ পুষ্প বাণে বিদ্ধ করে রাধাকে
মধু মাখা তিরে দু’খান হয় তার বুক
শরীর শিউরায়
ঠোঁট কাঁপে
কোমর থরথরায়
বুক উথলায়
চুল খুলে যায়
চোখ বুজে আসে
জ্ঞান হারায়।

***

রাধার বুক থেকে উঠে আসে সুবাস
যেন মন্মথের নিঃশ্বাসের মত
তারই দেহকে পোড়ায়।
যেন দুহাত বাড়িয়ে অনঙ্গকে বলে
“এই দীপ জ্বলছে সলতে আর তেল ছাড়াই,
এই দীপ তোমার”

***

যেমন লেবুর গাছে কীটনাশক কাজে দেয় না,
দাসীদের সান্ত্বনা বিফলে যায়।
এ শুধু বাড়ায় তার বাসনা
চিন্তিত, বিষণ্ণ দাসী হতাশায় মন্মথকে ডাকে:

***

ওহ! রতিপতি
পদ্ম যার অস্ত্র
গতি যার রাজহংস তুল্য
টিয়া যার বাহন
যিনি সঙ্গে নিয়ে আসেন মলয় বাতাস
তার রূপে ত্রিভুবন মোহিত
মন্মথ, কমলসুত,মহাজ্ঞানী,
কৃষ্ণের পুত্র সখা দিশারী,
যার ইক্ষু ধনুকে মৌমাছি ভিড় করে আসে
সকল শৃঙ্গারের আধার
ব্রহ্মার মানসপুত্র
আমার প্রার্থনা শোনো!”

***

প্রার্থনা শেষে রমণীগণ
ফুলের পাপড়িতে প্রভুনাম লিখে
পবিত্র লাল সুতোয় গেঁথে
রাধার কোমরে পরিয়ে দেয়।

***

পদ্মমুখী সুন্দরীরা
চিন্তায় অধীর হয়ে
সান্ত্বনা দেয় তাকে:
কেঁদো না, রাধিকে,
প্রভু নিশ্চয়ই আসবেন,
চারিদিকে তারই শুভ লক্ষণ”।

***
এই মধুর কথা শুনে ,
প্রভুকে দেখার আশে রাধিকা চোখ মেলে,
না দেখে তাকে, হতাশায় ডুব দেয় আবার।

***

“যদি শেষ বারের মত সেই রমনীমোহনের দিকে চাইতে পারতাম,
জিজ্ঞেস করতাম, কী পাপ করেছি?
আমার দশা দেখেও দয়া হয় না কেন তার?”

***

রাধাকে বিলাপ করতে দেখে
দাসীরা কেঁদে কেঁদে প্রার্থনা করে
কৃষ্ণের যেন ফিরে আসেন।

***

“ওই তো তিনি
ওই তার রথ!”

***

গুঞ্জন বেড়ে উঠতে,
রাধার কানে তা পৌঁছয়,
কৃষ্ণের জন্য তার প্রেম শুধু বেড়ে ওঠে
সৌরির কামনা হৃদয় ছাপিয়ে যায়
আশান্বিত, সে উঠে দাঁড়ায়।

***

ওই তো প্রিয় সখা অর্জুনের সঙ্গে
বসে আছে কৃষ্ণ, বলছে,
অলক্ষ্যে সে রাধার শুকের পিছু নিয়েছিল,
নিঃশব্দে সেখানে পৌঁছে সবার অগোচরে ফিরে এসেছে।
হঠাত নিশ্চুপ হয়ে যায় সে
ভেবে পায় না কী দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে পাখি?”

***

“পোষা পাখির কাছে কী সংবাদ পাঠিয়েছিল সে?
আমাকে এভাবে দেখে না জানি কীইবা বলেছে সেই পাখি?
সেই সুন্দরী রাগে নিশ্চয়ই বাঘিনীর মত ফেটে পড়েছে!
দাসীরা নিশ্চয়ই এই সুযোগে আগুনে ঘি ঢেলেছে
না জানি কী ভেবেছে সে আমার বিষয়ে?
ভগবান জানে কী হবে?
আমার রাশিতে কি শনি প্রবেশ করেছে?”

***

“কেন? হায় কেন আমি শুককে অবহেলা করেছি?
কেন আমি তাকে ছেড়ে এখানে এলাম?
কী নির্বোধ আমি!”

***

কী ভেবেছে সে?
কী যন্ত্রনায় না জ্বলেছে
কী করে ফেলেছে সে?”
আমাকে জড়িয়ে ধরে বলত, “ তোমাকে ছেড়ে এক মূহুর্ত বাঁচব না”
আমার হাত ধরে বলত, “তোমার থেকে দূরে থাকে পারব না”
দ’চোখে জল নিয়ে বলত, “বল, আমাকে সংবাদ পাঠাবে”
আমার বুকে লেপ্টে থেকে বলত, “তার লীলা খেলায় আমাকে ভুলে যেও না যেন”

***

কেঁদে কেঁদে গলা ভেঙ্গে গেছে,
বিদায় দিতে মন সরেনি
তবু শুভেচ্ছা জানিয়েছে আসার কালে
কীভাবে আমি তাকে ছেড়ে এলাম?
উচিৎ হয়েছে আমার?
চাঁদ দেখতে ইচ্ছে হলে আমি তার সুন্দর মুখ দেখতাম
কোকিলের ডাক শুনতে চাইলে আমি তার কথা শুনতাম
সুতীব্র কামনা শীতল করতে আমি তার শরীর স্পর্শ করতাম”

***

“এখন যদি একবার তার সদ্য ফোটা কুঁড়ির মত স্তনদুটি ছুঁতে পারতাম
সেই সুন্দরীর উজ্জ্বল গালদুটিকে চুম্বন করার সুযোগ কি আর হবে?
তার কোমল কর্পূরের মত শরীর ছোঁয়ার বাসনা মিটবে কি আর?”

***

“অনেককে দেখেছি
কথা বলেছি অনেকের সঙ্গে
রতিখেলায় মেতেছি অনেকেরই সঙ্গে
কিন্তু তার ভঙ্গী, তার সৌন্দর্য, তার প্রতিভা
অতুলনীয়।
অন্য কারুর সঙ্গে মিলনের সে আনন্দ পাইনি
সে-ই যোগ্যতমা”।

***

“তার ভিতর প্রবেশ করা মাত্র তার চোখ বিস্ফারিত হত
ভ্রূ উঠত বেঁকে,
ছদ্মরাগে মুখ হয়ে উঠত রাঙা,
তৃপ্তিতে চোখ বুঁজে এলেও, ছলা করত,
“ওঃ! নিঠুর পুরুষ,
নিশ্চয়ই নির্মম হয়েই ঈশ্বর আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়েছে”।

***

যখন বারে বারে, প্রচণ্ড কামচ্ছ্বাসে রমণে মেতেছি
সে তার পদ্মনয়ন আধেক মেলে মধুর হেসেছে, জাগিয়েছে আমায়,
“অসম্ভব সুন্দর…হ্যাঁ এভাবেই…
অসাধারণ …চমৎকার… থেমো না…”
এই সব শব্দ দিয়েই আমাকে বাঁধত সে,
কী করে ভুলি আমি সেই মধুর স্বর?”

***

“আমি কি দেখিনি অন্য নারী?
রমণের আনন্দে মাতিনি?
সহজেই তাদের থেকে নিইনি বিদায়?
কিন্তু এই বিচ্ছেদ,
এই সর্বগ্রাসী বেদনা
এই বাঁধনছেঁড়া শোক
আজকের আগে কখনো অনুভব করিনি”।

***

“যতক্ষণ না তার চাঁদমুখ দেখব
শান্ত হবে না কামনা
যতক্ষণ না সে মধুরের স্পর্শ পাব
মিটবে না প্রেমের পিয়াস
অনঙ্গ রেহাই দেবে না আমায়
যতক্ষণ না হাতে নেব তার ফুলের মত হাত
মুখের কালিমা ঘুচবে না
যতক্ষণ না দেখব তার উজ্জ্বল ললাট।
যতক্ষণ না সে তার স্তনদুটি মেলে ধরবে
তৃপ্ত হবে না আমার রাক্ষুসে প্রেম…
কীভাবে সইব ?
কী ভাবে বোঝাব আমার যাতনা?
কাকে পাঠাব তার কাছে?
কখন দেখব তাকে?”

***

শোকের মুরতি হয়ে বসে ছিলেন
পদ্মপলাশনেত্র কেশব।
তার বিলাপ শুনে
শ্যালক, ইলার ভাই , শ্রীদামা এসে
টিপ্পনি কাটেন।

***

“আমায় নাও, আমায় নাও”
বলে হাজার নারী কাঁদে যার জন্য
সেই কৃষ্ণ রাধার শোকে এ হেন কাতর!
ছুঁড়ে ফেল শোক, হে পদ্মনেত্র!”

***

“এই ভয়ঙ্কর দজ্জাল রাধা ,
এ কি আমার বোনের চেয়ে বেশি ভাল?
যদি তাই হয়, কীভাবে, বল আমায়?
যদি বয়সের দিক থেকেই তুলনা কর
তাহলে একজন রাজা আর অন্য জন ভিখিরি!”

***

জ্ঞানীজন বলেন, না সঠিক বয়স,
না প্রতিজ্ঞায় বাঁধা সম্পর্ক,
না অবৈধ প্রেম, না তার পরিহার,
না চতুর অভিজ্ঞ রমণী
চিরন্তন সুখ এরা কেউ দিতে পারে না।
এই সম্পর্ক? এ কি উচিৎ?
দুঃখ ভিন্ন আর কিছুই দেবে না ।
তুমি কি সে কথা জানো না?”

***

শ্রীদামের কথা শেষ হলে,
যাদবকুল পতি প্রত্তুত্যরে বলেন,
“কামশাস্ত্র, রতিখেলা,শৃঙ্গার
এ সকল জানে সুপটু প্রেমিক,
গোপালকের এ কথা জানার নয়,
তুমি গরু চরানো আর গরুর দেখভাল করা ছাড়া আর কী জানো?”

***

ব্রহ্মা নিজে সৃষ্টি করেছেন যে কন্যাকে
সেই কন্যাকেই বিবাহ করেছেন-
তাকে দুশ্চরিত্র বলা হয়?
চন্দ্রদেব গুরুপত্নী তারাকে হরণ করেছেন-
তাকে নষ্ট বলা হয়?
সূর্য তার মিত্রজায়ার সঙ্গে থাকেন-
তাকে লম্পট মনে করা হয়?
সমুদ্রদেব তার দৌহিত্রী গঙ্গার সঙ্গে প্রকাশমান
তাকে কি নীচ মনে করা হয়?
ব্যাস তার শ্যালিকার সাথে প্রমোদে বিভোর থাকেন-
তার পবিত্রতা নষ্ট হয় এতে?
তুমি বললে আমার এ সম্পর্ক বৈধ নয়
তাহলে যারা এই সকল সম্পর্কে লিপ্ত তারাও কি একই দোষে দুষ্ট?”

***

“ভূদেবী কি হরির সম্পর্কে খুড়ি নন?
নাকি গঙ্গা শিবের খুড়ি নন?
অহল্যা ইন্দ্রের খুড়ি নন?
কি করে তারা প্রেমের সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলেন?
তারা নিশ্চিতভাবেই তোমার চেয়ে জ্ঞানী!”

***

“সীতা রামের চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন
রেবতীও ছিলেন বলরামের চেয়ে বড়
বলা হয়, রতিও মন্মথের চেয়ে বয়সে ছিলেন বড়
আর তুমি বলছ, সে আমার চেয়ে বড়!”

***

মম্মথকে আস্তে দেখে
ক্ষুব্ধ কৃষ্ণ
সমস্ত উদ্বেগ ক্রোধ ঢেলে দিলেন:

***

ওহ চাঁদ, তোমার ক্ষয় আর বৃদ্ধি চলুক
যতক্ষণ আমার চাঁদমুখ না আসে।
ওহ মলয় বাতাস! আমার প্রেমিকার দীর্ঘশ্বাসই তোমাকে
সুন্দর করে।
ওহ মাতাল শুক! তার গলার স্বর শোনা পর্যন্ত অপেক্ষা করো।
ওহ ময়ূর! যখন সে চুল আঁচড়াবে
তোমার কেকা থেমে যাবে।
ওহ কোকিল! সে কথা বলতে শুরু করার আগে অব্ধি তোমার গান সুরেলা
ওহ রাজহংস! সে আমার দিকে হেঁটে আসার আগে পর্যন্ত তোমার ভঙ্গি সুন্দর।
ওহ মৌমাছি! সে আমার দিকে চোখ তুলে চাওয়ার আগে অব্ধি তোমার গুনগুণ সুরেলা।
ওহ কামদেব! তার আসার আগ পর্যন্ত তোমার যত দেমাক”।

***

“তোমরা সকলে মিলে যেভাবে জ্বালাতন করছ আমায়
সব সইছি ,
শুধু তাকে আসতে দাও,
সে-ই শোধ নেবে আমার”

***

অনঙ্গকে শাপশাপান্ত করে, বন্ধু পরিজন সমাবৃত সৌরি
শয্যা নেয়, গভীর শোকে ডুবে যায়,
আশায় নিরাশায় দোলে, চিন্তা ক্ষওয়াতে থাকে তাকে…

***

অশান্ত, অস্থির, দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
ছটফট করে সে ডুবে যায় গভীরতর চিন্তায়।
কখনো হাসে, কখনো কাঁদে,
কখনো গাল দেয় নিয়তিকে,
অলীক কিছু চেয়ে বসে,
ঘর আর বাহির করে, অস্থির পায়ে,
হঠাৎ থেমে যায়।

***

ফুলেল বিছানায় শুয়ে থেকেও হরি
শান্তি পান না,
যন্ত্রনার সঙ্গে লড়তে দেখে,
তার বন্ধুরা সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন

***

তার দু’চোখে আর ভুরুতে,
কপালে, ঠোঁটে, হাতে ও আঙুলে,
তার পাদপদ্মে, পেটে ও সর্বাঙ্গে
তারা লেপে দেয় সুগন্ধী তেল।

***

তাদের সমবেত চেষ্টায়
শান্তি ফিরে আসে।
শ্রীনিবাস কিছু স্থির হন।
উদয় পর্বতের পিছন থেকে উঠে আসে সূর্য
যেন উজ্জ্বল ললাটে তিলক!

***

রাধিকা সান্ত্বনমের তৃতীয় অধ্যায় সমাপ্ত হয় এই ক্ষণে । লিখে চলেন মুদ্দুপলানি সাহিত্য সঙ্গীত এবং নৃত্যে যার দক্ষতা কৃষ্ণের আশীর্বাদে প্রশ্নাতীত।

Facebook Comments

Leave a Reply