প্রমিথিউস ও মথ : অমিতাভ মৈত্র

“Little moths reel shudderingly out of the leech;
they will die this evening and never khow
that it was not spring.”

ঠিক একশো বছর আগে ডিসেম্বর ১৯২০ তে এই হাইকু লিখেছিলেন রিলকে। রিলকে একে বলেছিলেন (Hai´´- kai´´)। ছোটো মথগুলো সমুদ্রতীরের বাইরে ভয়ে শিহরিত হয়ে উড়ছে। আজ সন্ধ্যার তারা মরে যাবে আর তারা জানবে না এটা বসন্তকাল।
আর আজ ঠিক একশো বছর পরে জানলো মকদম, বারো বছর বয়সী একটি মেয়ে, দু’মাস আগে বিজাপুরে তার অভুক্ত অভাবের সংসার ছেড়ে তেলেঙ্গানার কান্নাইগুড়া গ্রামে লঙ্কার বাগানে পরিযায়ী শিশু শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে গিয়েছিল। লকডাউনের ঘোষণায় সেই ছোট্ট মেয়েটি গভীর সংকটে পড়ে যায়। কাজ নেই, উপার্জন নেই, খাবার নেই। তবু কান্নাইগুড়া গ্রামেই থেকে যায় সে। হয়ত ভেবেছিল কয়েকদিনের ব্যাপার। কিন্তু লকডাউনের মেয়াদ বেড়ে যেতে বারো বছরের শিশুটি বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নেয়। আশে পাশের কয়েকজন পরিযায়ী শ্রমিকের খোঁজ করে, যারা কয়েকজন বিজাপুরেই ফিরবে। বেরিয়ে পড়ে তারা। টাকা পয়সা নেই, খাবার নেই।
তেলেঙ্গানা থেকে বিজাপুর দেড়শো কিলোমিটার। হাইওয়েতে উঠলে পুলিশ ধরবে। তাই জঙ্গলের রাস্তা। ১৫ই এপ্রিল থেকে চারদিন ধরে খাবার ও জল ছাড়া বারো বছরের মেয়েটি হেঁটে একশো ছত্রিশ কিলোমিটার পথ পার হয়েছে। সে বিরাট কোহলি নয় যে প্রতিদিনের খবরের কাগজ তার অতুলনীয় শারীরিক/মানসিক শক্তির বন্দনা গান গাইবে। তেমন নেতাও সে নয় যার মাথায় অক্সিজেন কম যাওয়ার খবরে রাতের পর রাত বাধ্যতামূলক বিনিদ্র থাকতে হবে আমাদের। পঁচিশ বছর আগেই তো সারা দেশে শ্রম দপ্তর হন্যে হয়ে খুঁজে মাত্র কয়েকজন শিশু শ্রমিকের খোঁজ পেয়েছিল। সুতরাং শিশু শ্রমিক ব্যাপারটা আমি গুজব বলেই বিশ্বাস করব।
বারো বছরের শিশুটি তীব্র রোদের মধ্যে ঘুরপথে বাড়ি ফেরার চেষ্টা করেছে চারদিন দাঁতে কুটো না কেটে, এক ঢোঁক জল ছাড়া। বাড়ি থেকে যখন আর চোদ্দ কিলোমিটার, তীব্র ব্যথা শুর হয় শিশুটির পেটে। জঙ্গলে চিকিৎসার বন্দোবস্ত নেই। অনেক চেষ্টায় ওর সঙ্গীরা যখন একটা অ্যাম্বুল্যান্স জোগাড় করল, মেয়েটি তখন আর বেঁচে নেই। তার মৃতদেহ অ্যাম্বুল্যান্সে গ্রামে আনা হয়। হাসপাতালে তার করোনা পরীক্ষায় নেগেটিভ রিপোর্ট ছিল। বারবার বমির জন্য তার শরীরে জলের ঘাটতি আর ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
ক্ষীণ অনুভবের ক্ষমতা আর ক্ষীণতর কল্পনা নিয়ে আমি এই শিশুটির প্রত্যেকটি পা ফেল অনুভব করতে চাই আমার অস্তিত্বে। তার ক্ষতবিক্ষত পায়ের রক্তের ফোঁটা আমি শুকনো পাতা হয়ে, পাথুরে মাটি হয়ে একটু একটু মুছে দিতে চাই। এই ছোট্ট মৃতদেহটির দিকে আমাদের প্রাণবন্ত দেশ অবরোধ ও বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে।
শোভাবাজার লেনের আটাত্তর বছর বয়সের বংশীধর মল্লিক চারদিন আগে তাঁর পঁয়তাল্লিশ বছরের মূক ও চলচ্ছক্তিহীন ছেলে কৃষ্ণেন্দুকে প্রতিদিনের মতো বাইরে কিছুক্ষণ বেড়াতে নিয়ে গেছিলেন। মাস্ক পরতে বারবার বলেছিলেন ছেলেকে। প্রাণ দিয়ে তাঁর এই একমাত্র সন্তানকে ভালবাসতেন তিনি। উদ্বিগ্ন থাকতেন তাঁর এই ছেলে আর আঠারো বছর ধরে শয্যাশায়ী স্ত্রীর জন্য। একা হাতে বহু বছর ধরে তিনি সেবা করে যাচ্ছেন তাঁদের। যখন ছেলে মাস্ক পরতে অস্বীকার করে, বাড়ি ফিরে তিনি গলায় কাপড়ের ফাঁস দিয়ে মেরে ফেলেন ছেলেকে তারপর থানায় আত্মসমর্পণ করে বিস্তারে ঘটনাটি জানান। তাঁর অশক্ত স্ত্রীর কিছু করার ছিল না। আদালতে বংশীধরবাবু প্রার্থনা করেন তাঁর ছেলের সৎকার করার জন্য প্যারোলে মুক্তির। তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর হয়। পরদিন নিমতলা শ্মশানে তিনি আর তাঁর পোস্টমর্টেম হওয়া ছেলের দেহ একসঙ্গেই ঢোকে। ঘাটের কাজ শেষ করে আবার তিনি হাজতে ফিরে যান। আটাত্তর বছরের এই বৃদ্ধ মানুষটি যখন আমাদের এই অন্তহীন সিঁড়ির মত বিচারব্যবস্থায় বাকি জীবনটা গরাদে কাটিয়ে দেবে, তখন তার সত্তর বছরের আড়ষ্ট অনড় শরীরের স্ত্রী একা তার বাড়িতে পড়ে আছে “pressing lidless eyes / And waiting for a knock upon the door.”। সে আর ভাবছে না তার মৃত সন্তান বা তার স্বামীর কথা। সে অপেক্ষা করছে অনির্ণীত কোনো পায়ের শব্দের জন্য। যে তার জন্য কিছু খাবার আনছে হয়ত।
এভাবেই হয়ত প্রমিথিউস ককেশাস্‌ পাহাড়ে শৃঙ্খলিত শরীরে ঝুলতে ঝুলতে অপেক্ষা করত ঈশ্বরের শান্তিদূত সেই ঈগলের জন্য, যারা তার ক্রমজায়মান যকৃৎ ঠুকরে ঠুকরে রেখে যায় রোজ।
যাপন যাদের কাছে মর্মন্তুদ, অবর্ণনীয় যন্ত্রণার তারা সবাই প্রমিথিউস। তাদের চিৎকার নেই, প্রতিবাদ নেই, প্রতিরোধ নেই। শুধু দাঁত চেপে সহ্য করে যাওয়া আছে। রক্ত ক্লেদ ঘামে ভেজা সেরকম দুটো মুখ এই লেখায় এল।
সময়ের সাথে সাথে সব প্রমিথিউস বদলে যায়। ঈগলের ঠোঁটের ধারাবাহিক আঘাত গভীর থেকে গভীরতর এক যন্ত্রণার মধ্যে কেন্দ্রীভূত করে দেয় তাদের। বেঁচে থেকেও একভাবে শূন্যতার হয়ে যায় তারা। অনস্তিত্ব হয়ে যায়। তখন আর দেখা যায় না, অনুভব করা যায় না তাদের। মাটির সঙ্গে নিঃশব্দে মিশে যায় তারা তখন। আর আমরা সমুদ্রতীরে অসংখ্য মথের ওড়াউড়ি দেখতে দেখতে চমৎকৃত আর পূর্ণ হয়ে যাই। আমাদের জানার দরকার হয় না আসন্ন মৃত্যুর ইঙ্গিত অনুভব করেই ভয়ে শিহরিত হচ্ছে তারা।

Facebook Comments

Leave a Reply