আয়না ভাঙা অক্ষর – নারী কলমে বিগত সত্তর বছরের যুদ্ধ-কাহিনি : অদ্বয় চৌধুরী

আয়না ভাঙা অক্ষর: নারী কলমে বিগত সত্তর বছরের যুদ্ধ-কাহিনি

গল্প নির্বাচন ,সম্পাদনা ও প্রাক-কথন: অদ্বয় চৌধুরী
গল্পের নাম: চকচকে জুতো
গল্পকার: লুইসা ভ্যালেনজুয়েলা
রাষ্ট্র: আর্জেন্তিনা
মূল ভাষা: স্প্যানিশ
অনুসৃজনের সোর্স ভাষা: ইংরেজি
বাংলায় অনুসৃজন: অদ্বয় চৌধুরী

প্রথম কিস্তি

এই ধারবাহিক অনুসৃজন নিয়ে দু-চার কথা

ফ্রেনি মানেকশ’র ‘Behold, I Shine’ (রূপা, ২০১৭) বইয়ের মুখবন্ধের শুরুতেই কাশ্মীরের সাংবাদিক দিলনাজ বোগা’র তৈরি ‘বডি কাউন্ট’ নামে একটি ক্যাটালগের কথা ফ্রেনি উল্লেখ করেন যেখানে ২০১০ সালে কাশ্মীরের হিংসায় যেসকল নিরস্ত্র অধিবাসী মারা গেছেন তাঁদের তালিকা রয়েছে। ইন্টারনেটে সার্চ করলে সেই তালিকায় দেখা যায় মোট তেত্রিশ জন সাধারণ মানুষ মারা গেছেন শুধুমাত্র সেই বছরেই। ইউনাইটেড নেশনস-এর একটি হিসেব অনুযায়ী সমগ্র বিশ্বের নিরিখে গত শতকে অসামরিক মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র পাঁচ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় নব্বই শতাংশে পৌঁছেছে। এর অন্যতম কারণ হল, যুদ্ধ, সে ক্যুপ, আপসার্জ, কনফ্লিক্ট, সিভিল ওয়ার, রেবেলিয়ন বা রেভোলিউশন যে রূপেই আসুক না কেন, এখন আর শুধুমাত্র নির্ধারিত যুদ্ধভূমিতে ঘটে না, তা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। এখন যুদ্ধে সাধারণ মানুষও, বিশেষ করে নারী (এবং শিশুরাও), প্রায়শই টার্গেট হয়ে ওঠে। এর প্রত্যক্ষ ফল হল যুদ্ধের কটূ স্বাদ ও গন্ধ নেওয়ার একচেটিয়া অধিকার এখন আর পুরুষদের, বা সেই পুরুষদের মধ্যেও শুধুমাত্র যুবকদের কুক্ষিগত নেই। সেখানে ভাগ বসিয়েছে সকলেই, বিশেষত নারীরা।
কিন্তু যুদ্ধ সম্বন্ধীয় সাহিত্যে, বা কনফ্লিক্ট লিটারেচারে চোখ বোলালে দেখা যায় সেই ক্ষেত্রটি মূলত পুরুষ লেখক বা অভিজ্ঞ বয়োজ্যেষ্ঠ লেখকের দখলে রয়েছে। সেখানে মহিলা লেখকরা ভীষণ রকম মার্জিনালাইজড এবং প্রনিধিতিত্বের নিরিখে অপ্রতুল। এই ধারা শুরু হয়েছে সেই ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’ থেকে। অথচ গোটা বিশ্বে প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়কালে সংঘটিত অসংখ্য সিভিল ওয়ার বা কনফ্লিক্টে মহিলাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া পরোক্ষে প্রভাবিত নারীর সংখ্যা তো অগুণতি। তাঁদের কি নিজস্ব কোনো বয়ান নেই? থাকলেও সেই কাহিনির রূপ ও রস কেমন? সেখানে কি শুধুই যুদ্ধের হাহাকার ফুটে উঠেছে, নাকি সেখানে আছে রেজিস্ট্যান্সের গল্পও? আছে শাসকের প্রতি স্যাটায়ারের চরম শ্লেষ, মাইগ্রেশনের যন্ত্রণা, বা লড়াইয়ের ব্যক্তিগত উপাখ্যানও? সেইসব গল্প কি শুধুই ডকুমেন্ট্রি-ধর্মী, নাকি সেখানেও আছে নান্দনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা?
গত শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিগত সত্তর বছরে পৃথিবীর বিভিন্ন ভৌগোলিক অংশের বিভিন্ন দেশে বা প্রদেশে অসংখ্য গণ অভ্যুত্থান হয়েছে। সেইসব অভ্যুত্থান বা কনফ্লিক্ট-এর ছাপ বিশ্বের বিভিন্ন মহিলা গল্পকারদের কলমে কীরূপে কী আঙ্গিকে ধরা পড়েছে তা কিছুটা হয়তো আঁচ করা যাবে এই ধারাবাহিক অনুবাদ কলামে। ঘরের আয়নায় কার্তুজের আদর ফুটে উঠলে সেই আয়নার নিজস্ব এক বয়ান জন্ম নেয়। তাকেই ধরার প্রয়াস রইল এখানে।

গল্পকার ও গল্প

আর্জেন্তিনার লেখিকা লুইসা মার্সিডিজ লেভিনসন-এর মেয়ে লুইসা ভ্যালেনজুয়েলা ১৯৩৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নিরীক্ষামূলক কলমের মাধ্যমে আর্জেন্তিনার ১৯৭০ দশকের রক্তক্ষয়ী ‘ডার্টি ওয়ার’-এর বিরুদ্ধে তিনি সরাসরি প্রশ্নচিহ্ন রাখেন। ১৯৭৬ সালে লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাফায়েল ভিদেলা মিলিটারি ক্যুপের মাধ্যমে আর্জেন্তিনার শাসন ক্ষমতা দখল করেন। শুরু হয় জুন্টা শাসন। অন্যান্য আরও কয়েকজন শাসকের হাত বদল হয়ে এই সামরিক ডিকটেটরশিপ শেষ হয় ১৯৮৩ সালে। এই সময়কালে প্রায় ন হাজার অসামরিক মৃত্যু ঘটে দেশে।

ইংরেজিতে ‘দ্য বেস্ট শড’ নামাঙ্কিত নিরীক্ষামূলক ছোটোগল্পটি ‘স্ট্রেঞ্জ থিংস হ্যাপেন হেয়ার’ নামক ছোটোগল্প সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয় আমেরিকা থেকে। আর্জেন্তিনায় তখনও জুন্টা সরকার শাসন ক্ষমতায়। যদিও লুইসা তখন আর্জেন্তিনার বাইরে। গল্পটির স্যাটায়ারধর্মী আঙ্গিকে তীব্র শ্লেষ ফুটে ওঠে আর্জেন্তিনার তৎকালীন ‘ন্যাশনাল রিঅর্গানাইজেশন প্রসেস’-এর বিরুদ্ধে। মূল গল্পটি স্প্যানিশ থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন হেলেন লেন। ‘দ্য বেস্ট শড’ গল্পটি সম্বন্ধে ‘BOMB’ পত্রিকায় ১৯৯১ সালে দেওয়া সাক্ষাৎকারে লুইসা নিম্নলিখিত বক্তব্য রাখেন—
“They were doing a video two months ago in Argentina, and they asked me to read any story. I started reading “The Best Shod”. And suddenly, I realized I couldn’t read that one. Not because it would be censored, but because it’s so painful. So much of it had really happened. Seen from a distance it’s a metaphor, but at the other end, it’s no longer a metaphor.”

চকচকে জুতো

দলা দলা থুতু-কফের মতো শহরের রাস্তার যেখানে-সেখানে লেগে আছে ভিখিরিরা। একটাই রক্ষে— তাদের সবার পায়েই জুতো রয়েছে। কফ-থুতু লাগবে না পায়ে। আসলে জুতোর জোগান এখন তুমুল।
কিছু জুতো ঝোপে-ঝাড়ে পড়ে থাকা একপিস কাটা পা থেকে টানা। ঠিকই। একটা পা বলে একটাই জুতো। সেগুলো যেসব ভিখিরি পরে তাদের দুটো জুতো ঠিক ম্যাচিং হয় না। এটা আমাদের মতো শহরের রাস্তায় খাপ খায় না। দেখতে বাজে লাগে। তবে এরম একপিস কাটা পা খুব কম আছে। মোটামুটি সব বডিতেই দুটো জুতোই আস্ত থাকে। কিন্তু তাদের কাপড়-চোপড় ইউজ করার লায়েক থাকে না। তাতে বুলেটের ফুটো থাকে। নাহলে টানাটানির ফলে ছেঁড়া-ফাটা হয়। আবার তাতে ইলেকট্রিক রডের পোড়া দাগও থাকে। ওই বদখত দেখতে দাগগুলো ঢাকা দেওয়া যায় না কিছুতেই। সেটাও ম্যাচিং যায় না শহরের সাথে। ওইজন্যেই আমরা জামাকাপড়ের দিকে চোখ দিই না। কিন্তু জুতোগুলো একদম ফ্রেশ থাকে— চকচকে। আসলে জুতোঅলাগুলোকে জীবনে খুব বেশি দূর তো এগোনোর সুযোগ দেওয়া হয় না। তারা একদিন মাথাচাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায় আর তারপরেই মাথা খাটাতে শুরু করে। আমাদের সুবিধে হচ্ছে, তারা যতই মাথা খাটাক, জুতোয় তার ছাপ পড়ে না! জুতোয় ছাপ পড়বে হাঁটতে শুরু করলে। কিন্তু তারা যেই মাথা খাটিয়ে কয়েক কদম এগোয়, তাদের থামিয়ে দেওয়া হয়। আর কোনো নড়ন-চড়ন নেই।
তাই আমরা ভালো ভালো জুতো পেয়ে যাই। কিন্তু সব জুতো সবার সাইজে হয় না। উপায় একটা বেরিয়ে যায় ঠিক। আমরা শহর ছাড়িয়ে গিয়ে কোনো ফাঁকা মাঠে জুতো বদলা-বদলির হাট বসাই। কয়েকটা পেসো ফেললেই জুতো বদলে নেওয়া যায়। ওটা আমাদের সার্ভিস চার্জ।। ভিখিরিগুলো এর বেশি আর কী দেবে? কিন্তু ওতেই বিস্কুট আর মাগির খরচ উঠে যায় আমাদের। ওই দুটো খিদেই তো শুধু আছে আমাদের। আর কী চাই? তবে আমাদের সত্যিকারের ইনকাম হয় যখন বড়ো কোনো দাঁও মারতে পারি। মাঝেমাঝে ডেডবডির বাড়ির লোকজন চলে আসে আমাদের কাছে। আমাদের হদিশ কোত্থেকে পায় কে জানে! তারা আমাদের থেকে ডেডবডির জুতো চায়। এঁটে থাকে আমাদের পিছনে। জবরদস্ত দামও দেয় শেষে। অফিসার বাবুরা তো তাদের হাতে ডেডবডি দেবে না! তাই ওই জুতোটুকুই পেতে পারে তারা। কবর দেওয়ার মতো।
দুটো ভালো জুতো চলে গেলে মন কেমন করে। কিন্তু আমাদের তো বাঁচতে হবে! মাগনা বাঁচা যায় না! একটা ভালো কাজও করা হয়ে গেল এদিকে! ভালো কাজ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া উচিৎ নয় আমাদের। মাঝেমাঝে নিজেদের সাধু-সন্ত মনে হয়। সত্যিকারের সাধু-সন্তের কাজ করছি আমরা! পুলিশও আমাদের নিয়ে তাই মনে করে মনে হয়। নাহলে তারা কোনোদিন আমাদের জ্বালায় না কেন? আমরা যখন শুনশান জায়গায়, নালা-নর্দমায়, পড়ে থাকা ফাঁকা জমিতে, ঘন ঝোপঝাড়ে বা কোণা-ঘুপচিতে ডেডবডি খুঁজে বেড়াই, তারা আটকায় না। আসলে তারা আমাদের কাজের কদর করে। আমাদের ধক আছে। আমাদের হক-ও আছে এই কদরের। আরে ভাই, আমরাই তো এ শহরকে এক নম্বর বানিয়েছি! এ শহর হল দুনিয়ার এক নম্বর শহর যেখানে সব ভিখিরিদের পায়ে জুতো আছে— সবচেয়ে চকচকে জুতো!
***

অদ্বয় চৌধুরী:
দিনের বেলা মহানগরের সেইসব গলিপথে হেঁটে বেড়াতে ভালোবাসেন যেখানে অমলকান্তিরা রোদ্দুর হতে পারে না। আর রাতের বেলা ভালোবাসেন উচ্চতায় খাটো নিজের বাড়ির একতলার বারান্দা থেকে চাঁদের উচ্চতর অবস্থানের নিরিখে বাকি শহরের উল্লম্ব বিকাশ জরিপ করতে।

Facebook Comments

1 thought on “আয়না ভাঙা অক্ষর – নারী কলমে বিগত সত্তর বছরের যুদ্ধ-কাহিনি : অদ্বয় চৌধুরী Leave a comment

  1. বাঃ! সুন্দর অনুবাদ। উদ্যোগটাও খুব ভালো লাগলো। অপেক্ষায় থাকছি।

Leave a Reply