বিলেতে করোনাকাল:বেঁচে থাকা সময়ের একটুকরো গল্প – এ কে এম আব্দুল্লাহ
পৃথিবী ভালো নেই। আমরা ভালো নেই। করোনার করালগ্রাসে সবকিছু যেন স্তব্ধ হয়ে আছে। আর এই স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার পেছনে হয়ত মানুষেরা-ই অনেকভাবে দায়ি। পেশি আর ক্যামিকেল শক্তির রাজনৈতিক শোডাউনে আমরা যেন ভুলে গেছি— শুধু মানুষ নয়; পৃথিবীরও একটি ইমুনি সিস্টেম আছে। মানব দেহে যেভাবে রোগের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে ইমুনি সিস্টেম কাজ করে থাকে; তেমনি স্বার্থপর মানুষের দ্বারা সৃষ্ট দুষণ-এর আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য প্রকৃতিরও ইমুনি সিস্টেম কাজ করে থাকে। কিন্তু আমাদের অনাকাঙ্খিত-কর্মের মাধ্যমে প্রকৃতির সেই ইমুনি সিস্টেম অকার্যকর হয়ে পড়েছে। উৎপন্ন হচ্ছে সার্স, মার্স বা ইবোলার মতো রোগ। তাইতো প্রবল ক্ষোভে হয়তো প্রতিশোধ নিতে প্রকৃতি যেন এবার ছেড়ে দিয়েছে করোনার মত ভয়ানক বিষাক্ত সৈন্য। আর অদৃশ্য ঐ সৈন্যের সাথে যুদ্ধ করতে করতে আমরা ক্লান্ত। আমরা ভয়ার্ত। চিনের উহান থেকে শুরু হয়ে, প্রায় সব দেশের মতো যুক্তরাজ্যও আজ করোনার ভয়াল আক্রমণে জর্জরিত।
ভয়ানক করোনার সংক্রমণ রোধে গত ২৪ মার্চ ২০২০ থেকে অন্যান্য দেশের মতো যুক্তরাজ্যেও চলছে লকডাউন। এ যেন এক নতুন অভিজ্ঞতা। প্রায় ত্রিশ বছর থেকে যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরে বাস করছি। দেখেছি অনেক পরিবর্তন। কিন্তু এরকম পরিবর্তন বা পরিস্থতি কখনও দেখিনি। বিশ্বযুদ্ধ কিংবা বিগত প্লেগ,কলেরা বা স্প্যানিশ ফ্ল্যু’র মত মহামারির কথা ইতিহাসে শুধু পড়েছি। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক করোনা সংক্রমিত রোগটিকে ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১২০ কোভিড-১৯ নামকরণ এবং ১১ মার্চ ২০২০ মহামারি ঘোষণার পর এ যেন এক নতুন পৃথিবীতে স্তব্দ হয়ে আছি। এ যেন নতুন আরও এক ইতিহাসের জন্ম। পুরো পৃথিবীকে যেন ঘিরে ধরেছে আতঙ্কের খ্যাপলা জাল। ভেতরে মানুষ থেকে মানুষে, রাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়েছে কোভিড-১৯। সময়ের পরিবর্তনে ট্যাকনোলজির সুবাদে পুরো পৃথিবী এখন চোখের সম্মুখে ভেসে ওঠে। ভেসে উঠছে মানুষের কাতর মুখ। এসব দেখে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত না হয়ে পারে না। নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করে দৌড়-ঝাপ একটুকরো আত্মবিশ্বাসের ছায়াতলে। চারদিকে শুরু হয় প্যানিক শপিং। খাদ্যের চেয়ে টয়লেটটিসু হয়ে ওঠে লিস্টের প্রধান। ক্লিনিং প্রডাক্ট সহ সুপার স্টোরগুলোর শেল্ফ খালি হতে থাকে। মিডিয়া আর প্যানিক শপিং এর কারণে পুরো শহরগুলো যেন এক যুদ্ধের দীর্ঘ প্রস্তুতি নিতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। সুপারস্টোরের সাথে সাথে গ্রোসারি দোকানগুলোতে উপচে পড়া ভিড়ে কিছু অসাধু ব্যাবসায়ি বাড়িয়ে দেয় পণ্যের দাম।
বৃটেন একটি গণতান্ত্রিক দেশ। কমিউনিস্ট দেশের মত সহজে যে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে না। কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে কিছু সময় লাগে। কিছুটা দেরিতে হলেও প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ২৪মার্চ থেকে লকডাউনের ঘোষণা দেয়ার পর,বন্ধ করে দেয়া হলো স্কুল কলেজ সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বাচ্চাসহ করোনার ভয়ে এখন সবাই ঘরে বন্দী। বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকালে অনেক কষ্ট হয়। ঘর থেকে বাইরে বের হতে পারছে না। প্লে-স্ট্যাশন, এক্সবক্স, টেবলেট সঙ্গী। মাঝেমধ্যে অনলাইনে হোম ওয়ার্ক। অথচ এই সময়টাতে বিলেতের আকাশ ঝলমল করে ওঠে। গাছে গাছে ফুল ফোটে। রাস্তা-ঘাট পার্ক মানুষের কোলাহলে ফিরে পায় প্রাণ। মানুষের মুখে ফোট ওঠে রোদমাখা হাসি। এই সময়ের জন্য সবাই অপেক্ষা করে রৌদ্রস্নানে একটু ভেসে যেতে। কিন্তু ঘর থেকে বের হওয়া এখন আর নিরাপদ নয়। যদিও বলা হয়েছে দৈনিক একবার সসিয়েল ডিস্টেন্স মেনে ব্যায়াম করা যাবে। জরুরী কাজেও বের হওয়া যাবে। একসাথে দুজনের বেশি দেখলে পুলিশ ধরিয়ে দিচ্ছে হাতে ফাইন। সুপারস্টোরগুলোতে ছয়ফিট দূরত্ব মেনে দীর্ঘ লাইন। কিন্তু অজানা আতঙ্কে ঘর থেকে বের হওয়া এক যুদ্ধ মনে হয়। কখন কিভাবে যে ঐ ভয়াল ভাইরাস সঙ্গ নেয় বলা মুশকিল। প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। এ মিছিলে আছেন এশিয়ান কমিউনিটির প্রায় ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ। এ মিছিলে রয়েছেন বৃদ্ধ থেকে তরুণ। রয়েছেন এমপি, ডাক্তার, ব্যারিস্টার,ব্যাবসায়ী,হেলথ- প্রফেশনালস। রয়েছেন অনেক পরিচিতজন। ইতোমধ্যে প্রাইম মিনিস্টার বরিস জনসন করোনা আক্রান্ত হয়ে ইন্টেনসিভ কেয়ার ছিলেন। এখন সুস্থ হয়ে বাসায় বিশ্রামে আছেন। তাঁর অসুস্থাতায় বৃটেনের জনগন মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিল। বিরোধী দল থেকে শুরু করে দেশের সবাই তার সুস্থতা কামনা করে প্রমাণ দিয়েছেন জাতির এই দুর্যোগ সময়ে বরিস জনসনের মতো নেতা এখন বৃটেনে প্রয়োজন। সরকারের কঠোর ব্যাবস্থায় অনেকে ঘরে বসেই কাজ করছেন। ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কার বাহিরে কাজে যাচ্ছেন। বাস,ট্রেন সীমিত ভাবে চলছে। যারা কাজ করতে পারছেন না, সবাইকে বাৎসরিক আয়ের আশি পারসেন্ট প্রদানের প্যাকেজ ঘোষণা সহ বিভিন্ন সহযোগিতা ঘোষণা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সকলের কাছে চিঠি লিখেছেন। বার বার অনুরোধ করেছেন ঘরে থাকার জন্য। এন এইচ এস এবং জীবন বাঁচানোর জন্য। ভাবতে অবাক লাগে যে শহর চব্বিশ ঘন্টা সজাগ থাকে ; আজ সে শহর অনেকটা ভূতড়ে মনে হচ্ছে। ঘরের ভেতর মানুষের মন ভেঙে পড়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ি ইতোমধ্যে ডমেস্টিক ভায়োলেন্স প্রায় পঁচিশ শতাংশ বেড়েছে। কমেছে রাস্তা-ঘাটে সাধারণ ক্রাইম।
এরপরও,লকডাউনের এই সময়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হয় এখনও পৃথিবীতে ইংল্যান্ড একটি দেশ যেখানে মানবতা আর মানুষকে এখনও অগ্রধিকার দেয়া হয়। একটি মানুষও যেন না খেয়ে মরে, সে জন্য সরকার দ্রুত নিয়েছে বেশ কিছু পদক্ষেপ। সরকারের সিদ্ধান্তে জনগণ যেমন খুশি ; তেমনি মানবতার সেবায় জনগণও প্রস্তুত। তাইতো NHS ( National health service) এর জন্য আড়াই লক্ষ ভলন্টিয়ার চাওয়া হলে— সেচ্ছায় রেজিস্ট্রি করেছেন ছয়লক্ষেরও বেশি। সদ্য রিটায়ার্ড নার্স- ডাক্তার ইচ্ছাকৃতভাবে ফিরে গেছেন করোনা রোগীদের সেবা দিতে। অনেক এমপি যারা কখনও পেশায় ডাক্তার কেউ নার্স ছিলেন করোনায় আক্রান্ত রোগীর সেবায় ফিরে গেছেন সে পেশায়। জাতির এই দুর্যোগময় মুহূর্তে শুধু সরকারি দলের (কনজারভেটিভ পার্টি) নয় লেবার পার্টির এমপি’রাও নিজেদের পদমর্যাদা ভুলে স্থানিয় হাসপাতালে অন্যান্য ডাক্তার-নার্সদের সাথে মিলে কাজ শুরু করছেন। নেই কোনও রাজনৈতিক মতপার্থক্য। সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ দুর্যোগ মোকাবেলায় কাজ করছেন। আমার বাসার মাত্র আট-দশমিনিট দূরত্বে এক্সেল ইক্সিবিউশন সেন্টারকে নাইটেঙ্গল নামে তৈরী করা হয়েছে চারহাজার শয্যার অস্থায়ী হাসপাতাল। দেশের অন্যান্য স্থানেও তৈরী করা হয়েছে অস্থায়ী হাসপাতাল। নাইটেঙ্গল। পুরো নাম ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গল। ছিলেন একজন সেবিকা। যিনি প্রায় আড়াই বছর চলমান ক্রিমিন যুদ্ধে আহত সৈনিকদের সেবা দানের মাধ্যমে নার্স হিসেবে আইকন হয়ে ওঠেন। তাঁরই নামানুসারে হাসপাতাল তৈরী হচ্ছে, যাতে নার্সরা উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন। ইন্সপায়ার্ড হন।পাশেই লন্ডন সিটি অ্যায়ারপোর্ট। সব ফ্লাইট বন্ধ। আগে প্লেনের শব্দ শোনে ঘুমুতে যেতাম আবার ভোরে প্লেনের শব্দ শোনো ঘুম ভাঙত। এখন অ্যায়ার অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ কানে ভেসে আসে। জানালার কাচের মত কেপে ওঠে বুক। হতাশা আর আতঙ্ক ঘিরে ধরে এক অজানা আশঙ্কায়।
করোনাকাল, লকডাউন, শেলফ আইসোলিশন কিংবা কোয়ারেন্টিন যা-ই বলি না কেন,সময় আমাদেরকে কল্পনা জগত থেকে নিয়ে এসেছে বাস্তবতায়। আমাদেরকে নতুন করে ভাবতে শিখাচ্ছে প্রকৃতি আর মানুষের ভ্যালু। পুরো পৃথিবীর মানুষ এখন এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। এরপরও মানুষ স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নই মানুষকে বাঁচার পথ দেখায়।
পরিশেষে কামনা করি— করোনা পরিস্থিতি নিয়ে, বৃটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ জাতির উদ্দশ্যে দেয়া ঐতিহাসিক ভাষনের লাইনগুলো যেন দ্রুত বাস্তব হয়।
“আমাদের স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করা উচিত যে,আমাদের আরও সহ্য করার মতো আরও ভালো দিন ফিরে আসবে। আমরা আবার আমাদের বন্ধুদের সাথে থাকব ; আমরা আবার আমাদের পরিবারের সাথে থাকব ; আমরা আবার দেখা করব”…
Posted in: April 2020, Cover Story