চিঠি, যা নরম ছিলনা, মাংস ছিলনা.. : স্বপন রায়
দ্বিতীয় পর্ব
[ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) শুধু যুদ্ধ ছিলনা। মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্যতম অপরাধও সংঘটিত হয়েছিল নাৎসি পার্টির নেতৃত্বে। হিটলারের ‘ন্যাশনাল সোশালিজম’ খাঁটি আর্য রক্তের বাইরের সবাইকে চিহ্নিত করেছিল হীন জাতি হিসেব। প্রথমে আক্রান্ত হয়েছিল ইহুদিরা। তারপর কমিউনিস্টরা। সোশালিস্টরা তারপর। ডেমোক্র্যাট , লিবারেল একে একে সবাই। পোল্যাণ্ড আক্রমণের ভেতর দিয়ে শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আর ইওরোপ জুড়ে ইহুদি নিধন যজ্ঞ। প্রায় ছয় লক্ষাধিক ইহুদিদের হত্যা করা হয়েছিল। এর মধ্যে লক্ষাধিককে মেরে ফেলা হয়েছিল গ্যাস চেম্বারে। সরাসরি হত্যা করা হয়েছিল তিন লক্ষাধিক সোভিয়েত যুদ্ধবন্দীদের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সারা দুনিয়ায় প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় এক কোটি মানুষ। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল ইওরোপ এবং এশিয়ার বহুদেশ। অর্থনীতি ভেঙে পড়েছিল। ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ নেমে এসেছিল দুনিয়া জুড়েই। আর এরফলে মারা গিয়েছিল আরো কয়েক লক্ষ মানুষ। এরপরেও যুদ্ধ থামেনি। হত্যালীলা চলেছেই। আমাদের দেশেও যুদ্ধবিলাসী লোকের অভাব নেই। যাইহোক, যুদ্ধ তো কাউকে ছেড়ে কথা বলেনা। ব্যক্তিমানুষ, যতই অরাজনৈতিক বা নিরপেক্ষ হোক না কেন, যুদ্ধ তাকেও ছাড়েনা। তার ব্যক্তিজীবন, সাংসারিক জীবনে গভীর ছাপ ফেলে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যা চূড়ান্তভাবে হয়েছিল। এই লেখাটা ওই যুদ্ধে নিয়োজিত দু’ জন কাল্পনিক কবিকে নিয়ে , একজন জার্মানির আরেকজন সোভিয়েত । একজন কবি যখন তার প্রেমিকা বা বন্ধুকে চিঠি লিখতো, কী থাকতো সেই চিঠিগুলোয়? এরকম কিছু চিঠির নমুনা আছে ইন্টারনেটে। তবে সেগুলো চিঠিই, কবিতা নয়। আমি একটু গভীরে গিয়ে ভেবেছি একজন তরুন কবির প্রতিক্রিয়াগুলো। আর লেখার চেষ্টা করেছি তাদের কাল্পনিক প্রেমিকা আর বন্ধুর সংগে, তাদেরই বয়ানে চিঠি আর কবিতার আদানপ্রদান । হ্যাঁ, পুরোটাই আমার বানানো। তবে যুদ্ধটা নয়। যেদিন আমরা বুঝতে পারবো যুদ্ধ কাদের বানানো সেদিন সারা দুনিয়ায় আর যুদ্ধ হবেনা।]
কাল্পনিক চরিত্রলিপি:
স্কোল ফিশার – কবি। জার্মান যুবক। প্যানৎজার ডিভিশন-৬ এর সদস্য। এই ডিভিশন পোল্যাণ্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্সে যুদ্ধ করার পর ১৯৪১-১৯৪৫ অবধি ‘ইষ্টার্ণ ফ্রন্টে’ নিযুক্ত হয়। এই গোটা ডিভিশন যখন স্তালিনগ্রাদে ‘রেড আর্মি’র কাছে ঘেরাও হয়ে পড়ে ‘হিটলার’ এই বাহিনীর প্রধান ‘ফ্রেডরিখ উইলহেলম এর্নেস্ট পাউলাস’কে আত্মসমর্পন করার নির্দেশ না দিয়ে লড়াই জারী রাখতে বলে। ‘পাউলাস’কে ফিল্ড মার্শাল করে দিয়ে অপ্রত্যক্ষভাবে বলা হয় আমৃত্যু লড়াই করে যেতে অথবা আত্মহত্যা করতে। ‘পাউলাস’ হিটলারের নির্দেশ না শুনেই ১৯৪৩ সালের ৩১ জানুয়ারি ‘রেড আর্মি’র কাছে আত্মসমর্পন করেন। আমার কাল্পনিক চরিত্র স্কোল ফিশার এই এই হতভাগ্য ডিভিশনের সদস্য ছিল।
সোফিয়া ওয়াগনার – স্কোল ফিশারের প্রেমিকা।
স্কোল ফিশারের কাল্পনিক চিঠি / কবিতা
সোফিয়া,
শাসক আমি। পোল্যান্ড আমার জুতোর ফিতেয় লটকানো। ফ্যুরারকে দেখো ‘we er la chelt’( কিভাবে তিনি হাসেন), ডানহাত কাঁধের ওপরে উঠে যায়। হাত নয়, শাসনের হাত। আমি হাতের ব্যবহার কত কম জানতাম। পোলিশ মেয়েদের চাইলেই….আমি হাত ভালবাসি। তোমার আর আমার। পপলার গাছগুলো আমাদের হাতে ছায়াময় স্মরণ মেখে দিত। রোজই। আমি লিখতাম হাতের ভিন্ন ছায়া গুলো। বেকার কবি। গ্রেট ডিপ্রেশন চলছে। ইহুদিরা কিন্তু বেশ। রাইখসমার্কের দেমাক। আমি ভালবাসার কাছে ঘৃণাকে বসালাম। হাত, একই হাত। ফর্সা আর উদ্যত, তোমায় ছুঁয়ে। ফর্সা আর উদ্ধত, ফ্যুরারের জন্য। ১লা সেপ্টেম্বর,১৯৩৯। ভোর চারটে। জার্মানি জানিয়ে দিল চুক্তি সাময়িক। ভার্সেই আজ থেকে অতীত। ‘স্কেলসউইগ হোলসস্টেইন’, আমাদের যুদ্ধজাহাজ কামান দাগলো, কেঁপে উঠল দেনজিং-এর পোলিশ গ্যারিসন। জার্মানির বারুদিয়ানায় ঘুম ভাঙবে এবার। চমকে উঠবে দুনিয়া। ভাল থেকো।
-তোমার স্কোল। ১১ সেপ্টেম্বর/১৯৩৯
……..
প্রিয় বেন,
কেমন আছিস? তুই তো গেস্টাপোতে? আমি এখন ‘উইজনা’য়। কবিতা লেখার সময় পাস? আমি কবিতা হারিয়ে ফেলছি। সেপ্টেম্বর সাত থেকে দশ এখানে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হল। আমাদের বেয়াল্লিশ হাজার আর পোলদের হাজারের নিচে। ওরা তিনদিন আমাদের বুট খুলতে দেয়নি। আমাদের সাড়ে তিনশো ট্যাঙ্ক, ছশোসাতান্নটা মর্টার আর হাউইৎজার। সঙ্গে যুদ্ধবিমানের লাগাতার সাহায্য। ওদের ছশোছিয়াত্তরটা এম.এম. গান, বেয়াল্লিশটা মেশিনগান, দুটো অ্যান্টিট্যাঙ্ক রাইফেল। সাড়ে তিনশো ট্যাঙ্ক দিয়ে ওদের সরিয়ে দেওয়ার আগে আমাদের নশো জনের প্রাণ গেছে। ওদের সাতশো ষোলো। জানিনা ফিরে আসবো কিনা। আমার আর বেঁচে থাকার ভেতরে অজস্র বুলেট উড়ে যাচ্ছে। আমার নাম লেখা আছে কোনও একটায়। যাইহোক ফ্যুরারের জন্য প্রাণ গেলে যাবে। এই যুদ্ধে এসে রোজই কিছু না কিছু হচ্ছে যা আগে কখনো হয়নি। দ্যাখ সোফিয়া আসার আগে আমি মেয়েদের ছুঁয়ে দেখিনি এমনতো নয়। দেখেছি, শুয়েওছি। কিন্তু সোফিয়ার পরে সোফিয়াই শুধু। গতকাল সব কেমন গুলিয়ে গেল। ঘোলা হয়ে গেল। ‘উইজনা’ দখলে আসার পরে আমরা বাড়ি বাড়ি সার্চ করছিলাম ইহুদিদের ধরে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠাবার জন্য। এক্ষেত্রে, তুই জানিস আমার উৎসাহ বরাবরের। ইহুদিরাই আমাদের, জার্মানদের দুর্দশার জন্য দায়ি। ওদের দেখলেই আমি জ্বলতে থাকি। অনার্য, অসভ্য। ওদের ধর্মটাই হীন। আর মাথায় ওই বদখত টুপি। ফ্যুরার ওদের সম্পত্তি ক্রোক করে ওদের ঘেটো আর কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠাচ্ছে। ওদের টাকায় আমাদের অবস্থা ফেরাচ্ছে, আর কি চাই! যাইহোক, একটা দরজা টান মেরে খুলে ফেলতেই দেখলাম…বেন, আমি এমন মেয়ে জীবনে দেখিনি। ও মাই গড। মুখে শস্যশ্যামলা ইওরোপের ছাপ। শরীরে রাইনের ঈশারা। চোখের পাতায় ফারখেলানো পলক। বুকের তীব্র ফলদুটো পাখির ছটফটানি পুষে রেখেছে। মেয়েটি আমার পায়ে পড়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, তুমি আমায় নাও, নিয়ে আমার বাবা, মাকে বাঁচিয়ে দাও। এরকমই কিছু বলছিল। অধস্তন একজন চোখ টিপে বলল, স্যর নিয়ে নিন। আমি, বিশ্বাস কর বেন, সোফিয়াকে ভুলে গেলাম। ভুলে গেলাম মেয়েটা ইহুদি। ওর শরীরে হীন রক্ত বইছে। আমি বললাম, ভেতরে চলো। আমি নিলাম ওকে। ও দিল আমায়। ইতস্তত করেনি কোথাও। দারুণ। আমি বহুদিন পরে শরীরের সাফল্য দেখলাম। সব হয়ে যাওয়ার পরে মেয়েটি বলল, নিচে একটা বাঙ্কার আছে। বাবা, মা ওখানেই। আমি ভাবলাম, দেখা যাক যদি বাঁচাতে পারি। নিচে এলাম। বাঙ্কারের দরজা খোলা। মেয়েটি ছুটে ভেতরে গিয়েই চিৎকার করে উঠল। আমি উঁকি মেরে দেখলাম দুটো নিথর শরীর। বয়স্ক পুরুষ আর মহিলা। মেয়েটি ওর মায়ের শরীরের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ নীরব হয়ে গেল। অদ্ভুত নৈস্তব্ধ। ভেঙে দিল আমার অধস্তন সেই তরুন অফিসার। বলল, স্যার, এবার আমি নিই। খাসা জিনিস….আমি ফিরে এলাম বেন। ঘৃণা, ইহুদিদের প্রতি চরম ঘৃণাও কি হেরে গেল আমার অসহায়তার কাছে? আমি জানি ওখানে আর একটি লাশ পড়ে থাকবে। মেয়েটিকে ভোগ করার পরে সেই তরুন অফিসার ধন্যবাদ লেখা একটা বুলেট ঠুঁসে দেবে মেয়েটির মাথায়। একদম পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে।
বেন, আজ যখন তোকে চিঠি লিখছি, মনে হচ্ছে কবিতা লিখি বলেই এত ভাবালো মেয়েটা। যুদ্ধ চলছে। সেখানে এসব তো জলভাত। না, আমি সোফিয়াকে জানাইনি এসব। যুদ্ধ আমায় বিশ্বস্ত থাকতে দিচ্ছেনা, সোফিয়া জানলে কষ্ট পাবে। বিকেলের মরা আলোর দিকে তাকিয়ে হয়ত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠবে। এই আমার খবর। তোর খবরাখবর জানিয়ে উত্তর দিস। আজ রইলাম।
-স্কোল। ১১ মার্চ, ১৯৩৯।
……..
সোফিয়া,
আমরা জিতেছি। ‘উইজনার’-এ স্বস্তিক উড়ছে, পাশের হাওয়ায় ফ্যুরারের হাসিয়ানা। আকাশ এক বিগলিত ব্যাটালিয়ন। বিউগল আর শ্যাম্পেনের হাই হেলো চারদিকে। আমরা গাইছিঃ
রাস্তা এখন মুক্ত , বাদামি সেনারা, এগিয়ে চলো
রাস্তা এখন ফাঁকাই ঝটিকা বাহিনী এগিয়ে যাচ্ছে
লক্ষকোটি ক্ষুধিত মানুষ স্বস্তিকাকে চাইছে
সেই শুভ দিন শুরু হল সাথী, রুটিরুজি আর মুক্তির
গান হয়ে গেল ওড়ার ভঙ্গী, একাকী স্কাইলার্কের। নাকি অন্য কিছু, পুড়ে যাওয়া গমের খেতের উপরে ধোঁয়ার অলস উড়ে যাওয়া। আরো ওপরে একটা ফাইটার প্লেন। ফাইন আর্টস মিশে যাচ্ছে এয়ারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং-এ।জাগছে জার্মানি, সোফিয়া যখন তুমি হাসছ, তখন। যখন ভাবছ আমায় তখন। যখন একটা এলোমেলো রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছ তখনও। জার্মানি একটা মৃত চুক্তির জেগে ওঠা। ভার্সেই। আমরা ছাই করে দেবো ওই চুক্তি। ছাই, পুড়লে হয়। আমরা সবে আগুন লাগাচ্ছি। পুড়বে সব। ছাই হবে। শুধু তোমার শাদা লেস বসানো ছাই রঙের গাউনটা বাদে।তুমি আর তোমার গাউন, এই আমার পৃথিবী সোফিয়া। আমি পুড়তে পুড়তে একদিন ঠিক শুদ্ধ হয়ে ফিরে আসবো, তোমার কাছে।
-ভালবাসা হানি, তোমার স্কোল। ১৩ মার্চ, ১৯৩৯
……..
প্রিয় বেন,
রোদ সামলে ওঠার আগেই, কফি। জেতার আনন্দে হাওয়াও আজ ঘুরঘুরে। ‘কিয়েলবাসা’ একধরণের ‘পোলিশ’ সসেজ, আর স্যান্ডউইচ। জীবনঘন সেবা, চলছে। টেবিলের ওপরে রাখা ‘মাউজার’ পিস্তলটা চোখ মারল, শেষ ওকে টিপেছি তিনদিন আগে। তাই অভিমান, তাই ওর রঙ আরো কালো হয়ে উঠছে। আর আমার ‘কারবাইনার’ রাইফেলে ঠিকরে উঠছে তৃতীয় রাইখ।তিনদিন ধরে খুব চলল ওর সঙ্গে। কার্তুজ এক উদাসীন আত্মঘাতী ছোকরা, খুব মুক্তমনা। বেরিয়েই মৃত্যুপাত্র খোঁজে। শরীর, শরীর। ঘিলু, হৃদপিণ্ড, পাকস্থলি, কিডনি, খুব প্রিয় জায়গা কার্তুজের। জানি, আমারও আছে। একদিন ওর হবে….বেন, দ্যাখ যেন কবিতা লিখলাম। তোর খবর কি? তুই এক পেন্টারের কথা লিখেছিলিস। ‘কমি’। ক্যানভাসে শুধু কয়েকটা কালো বিন্দু ছিল। নাম দিয়েছিল জার্মানি। দেশদ্রোহী! তোরা ওকে মেরে ঝুলিয়ে দিয়েছিস। গ্রেট! হারামির বাচ্চাকে এবার বাতাস আঁকবে। শকুন রঙ দেবে, ঠুকরে ঠুকরে। আইনস্টাইনকে ধরতে পারলি না? বেজন্মা ইহুদি। তোর কাজটা বেশ। রিমলেস চশমা যেন। অভিজাত। ‘প্রিন্স অ্যালবার্ট স্ত্রাবে’র -এর ঠাণ্ডা ঘরে বসে নির্দেশ দিস। ধরার, মারার। তোর চশমায় ঘাম জমেনা। ঠিক আছে দোস্ত, আমাদের রাস্তা আলাদা, লক্ষ্য এক। হাইল হিটলার!
-তোর প্রিয়বন্ধু, স্কোল। ১৩ মার্চ, ১৯৩৯।
Posted in: March 2020, Prose