লকডাউন-এর হাসি-তামাশা আর নারীবিদ্বেষের দু’চার কথা : সুদর্শনা চক্রবর্তী

যে সময়ে এই সংখ্যায় লেখার প্রস্তাব এসেছিল তখন চারপাশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক। কোভেড ১৯ সারা পৃথিবীতে আতঙ্ক ছড়ায়নি এতটাও। আর করোনা-র ভয় এভাবে গ্রাস করে নেয়নি আমাদের। গত এক মাসের মধ্যে মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ অচেনা, অন্য একটা পৃথিবীতে এসে পড়েছি আমরা সবাই। আর যখন এই চেনা অচেনার মাঝের সূক্ষ্ম রেখাটা ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যায় তখন অনেক বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায়। হয়তো তথাকথিত পরিশীলিত, নিছক মজার ছলে তুলে ধরা কোনও কথার মধ্যেও যে কতটা বিদ্বেষ, অবজ্ঞা, অপমান মিশে থাকে তআ এরকম পরিস্থিতিতে না পড়লে বুঝতেই পারা যায় না। তাই করোনা ভাইরাস-এর সংক্রমণ থেকে বাঁচতে যখন গৃহবন্দী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছি, তখন সেই দিনযাপনের মাঝের রাজনীতিটুকুও একটু বুঝে নেওয়া দরকার।
স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে লেখার বিষয় দেওয়া হয়েছিল – ‘ফ্যাসিবাদ ও নারী’। এখন ঠিক যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছি, সেখানে নারী তো বিষয় হিসাবে রইলই, শুধু তাকে কোন্‌ পরিপ্রেক্ষিতে দেখা হচ্ছে সেটুকু বদলে গেল। অবশ্য পুরোটা নিশ্চিতভাবে পূর্ব নির্ধারিত বিষয়-বিচ্যূত নয়। অনেকেই এটা ভেবে ভ্রূ-কুঞ্চন করতে পারেন যে এই আপদকালীন পরিস্থিতিতেও কীভাবে লিঙ্গ রাজনীতি, নারীর অধিকার ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কথা বলা যেতে পারে! গৃহবন্দী দশা তো সব ভেদাভেদ ভুলিয়েই দিল। তাহলে আর কেন বৃথা অভিযোগ। আসলে এই সময়টাই আরও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল কেন বিষয়টি নিয়ে এখনই কথা বলাটা জরুরি। অভিযোগ নয়, শুধু বাস্তবটা দেখতে চাওয়া।
আমাদের দেশে যেদিন থেকে লকডাউন ঘোষণা করা হল, যবে থেকে শুরু হল গৃহবন্দী দশা, তবে থেকেই অধিকাংশ আলোচনা, সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট, হোয়াটস্‌অ্যাপ-এ ঘুরতে থাকা জোক, মিম্‌ – এই সবেই বারেবারে উঠে আসতে লাগল পুরুষদের ঠিক কতটা দুর্দশা হতে পারে সেইসব কথা। কীভাবে তারা অনির্দিষ্টকাল ঘরে আটকে থাকবেন! এ তো অসম্ভব ব্যাপার। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, কাজের জায়গা, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা এইসব বন্ধ হয়ে গেলে তারা তো দমবন্ধ অবস্থায় পৌঁছে যাবেন। বাড়ির চার দেওয়াল কি তাদের আটকে থাকার জায়গা। না কি তা সম্ভব?
মহিলাদেরও নিশ্চয় অসুবিধা হবে। কিন্তু তারা তো প্রাথমিক ও প্রধানভাবে ঘর, পরিবার, সংসার সামলাতে ভালবাসেন। সুতরাং বাইরে কর্মরত মহিলাদের সমস্যা হলেও, বাড়িতে থাকতে তারা বিশেষ পছন্দই করবেন, এমনটাই যেন ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দেওয়া। বা এমনটা বলতে চাওয়া কি যে – ভালোই তো বাইরের দুনিয়া থেকে ছুটি নিয়ে একটু ঘরে থাকো তো লক্ষ্মী মেয়েটি হয়ে। অথচ এমন অসংখ্য মহিলার উদাহরণ আমাদের আশেপাশেই রয়েছে যাদের পায়ের তলায় সর্ষে। আড্ডা হোক বা প্রয়োজন, বেড়ানো হোক বা কাজ যারা আজ এখানে তো কাল সেখানে। এমনিই বেশিদিন বাড়িতে আটকে থাকতে তাদের মোটেই ভালো লাগে না। তার উপরে এই অনির্দিষ্টকালের গৃহবন্দীত্ব তাদেরও যেকোনও পুরুষ যাদের নিজস্ব একটা বর্হিজগৎ আছে তাদের মতোই সমস্যায় ফেলতে পারে। এই ভালো না লাগাটা লিঙ্গবৈষম্যের বিষয়ই নয়। এই আতঙ্কের সময়ে এটুকু স্বচ্ছ চিন্তা থাকা বোধহয় দরকার। সবটাই সাদা-কালো হয়ে যায় না এভাবে।
একটি মিম্‌-এ দেখা যাচ্ছে স্ত্রী রান্না করছেন আর স্বামী সোফায় বিশ্রামরত। স্ত্রী বলছেন যে মোটেই স্বামী সাহায্য করছেন না, বরং তার কাজের প্রশংসায় হাততালি দিচ্ছেন। ইঙ্গিত স্পষ্ট। দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যেভাবে অত্যাবশকীয় পরিষেবা ও স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজের জন্য হাততালি দিতে বলেছিলেন তাকেই কৌতুকের আকারে ব্যবহার করা। তাহলে একদিকে যেমন মেনে নেওয়া যে বাড়ির মহিলাদের রান্না ও অন্যান্য কাজ অত্যাবশকীয় তেমনি এই মিম্‌-এ কৌতুকের ছলে বুঝিয়ে দেওয়া যে স্বামী-স্ত্রী-র মধ্যে আসলে খুব মধুর একটা রসায়ণ থাকে। মুখে রাগ দেখালেও মহিলারা মুখ্যত স্ত্রীরা এই যে স্বামীদের বাড়িতে থাকা, তাদের সঙ্গে খুনসুটি এগুলি উপভোগই করছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় যে মহিলারা এই মিম্‌টি শেয়ার করেছেন তাদের মধ্যে কোনও ক্ষোভ বা খেদ নেই বিশেষ, ভারি মিষ্টি একটি অনুযোগ রয়েছে, খানিকটা যেন স্নেহমিশ্রিতই। এই প্রতিটি মিম্‌ যে আসলেই নারীবিদ্বেষের পরতগুলি খুলে দিচ্ছে তারা প্রতিদিনের অভ্যাসের জীবনে সেটা হয় বুঝছেন না বা বুঝতে চাইছেন না। আরেকটি হাসির ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে মহিলা স্বামীকে অর্ধেক রুটি ডাল দিয়ে খেতে দিলেন, স্বামী রাগ দেখিয়ে বললেন খাবেন না। মহিলা চুপচাপ পোষা কুকুরটিকে বাকি রুটিটা খাওয়াতে বসলেন, সেও গাঁইগুই করায় চটি দিয়ে মেরে খাইয়ে দিলেন। ভয়ে পেয়ে স্বামীটিও এহেন মার খাওয়া এড়াতে থালা টেনে খেয়ে নিলেন। সমাজে এটাই তবে বাড়ির মহিলাদের ভাবমূর্তি। যারা অনেকেই এখনও বাড়ির অন্য সদস্যদের খাওয়ার যত্ন নিয়ে নিজের খাবার কথা ভাবেন, অনাহার-দুর্ভিক্ষ-আর্থিক অনিশ্চয়তার সময়ে সবটুকু ক্ষমতা ও দক্ষতা দিয়ে শেষ পর্যন্ত সকলের অন্ন সংস্থানের চেষ্টা করে যান, তার এরকমই একটি ভাবমূর্তি তৈরি করা বোধহয় এই জরুরি অবস্থাকালীন সময়ে খুব প্রয়োজন ছিল। নিজের পোষ্যর গায়েও এরকম হাত তুলতে খুব সহজে দেখা যায় কি? এই মহামারি, আতঙ্ক, খাবারের টানাটানির দিনে একজন নারী ও পুরুষের চিন্তাটা একইরকম, তাদের উদ্বেগো একই। মেজাজ হারিয়ে কোনও মহিলা এরকম করবেন, এটা ভাবাটা সমাজের দৃষ্টভঙ্গিরই প্রকাশ। আর আরেকটা কথা খাবারের থালাটা মহিলাটিকেই কেন নিয়ে আসতে হল? এ কাজটা বাড়ির পুরুষটিও করতে পারেন কিন্তু। এভাবে দায়-দায়িত্বের ক্ষেত্রেও যে লিঙ্গবৈষম্য প্রকট, তা এই সময়েও বদলাল না। হাসতে হাসতে এটুকুও একটি ভেবে দেখা যাক।
এই জোক, আলোচনা, পোস্ট এগুলো থেকে একটা বিষয় উঠে আসে পরিস্কারভাবে আর তা হল, এখনও স্বাভাবিকভাবে ধরেই নেওয়া হয়েছে যে বাড়ির কাজ মানেই তা মুখ্যত মহিলাদের কাজের জায়গা। পুরুষদের মধ্যে ব্যতিক্রম অবশ্যই রয়েছেন। সেই সংখ্যাটাও অনেকটাই। তবু মহিলাদেরই দায়িত্ব রান্না, বাসন মাজা, কাপড় কাচা, ঘরদোর পরিস্কার ইত্যাদি। যে পুরুষেরা এগুলি পারেন বা স্বেচ্ছায় করেন তাদের দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকাতে হবে, কারণ ‘এই কাজগুলি তো তাদের করার কথা নয়, তবু তারা পারেন, করেন। দারুণ ব্যাপার!’ এই গৃহবন্দী দশায় পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর ভালো উপায় বলে যে ছবি বা পরামর্শগুলি সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে সেখানে যুগলে মিলে বাড়ির নানা কাজ করার উদাহরণ চোখে পড়ে। পুরুষ সদস্যটিই সেখানে নতুন। কারণ এই কাজগুলি তো হয় বাড়ির মহিলা সদস্য বা গৃহ পরিচারিকা করে থাকেন। সুতরাং সত্যিই তো পুরুষ সদস্যটি পরিবারের বাধ্যতামূলক কিছু কাজ বাদে এই যে ঘরের কাজে সাহায্য করছেন এ তো ছবি হয়ে ওঠারই যোগ্য। যারা আবার কিঞ্চিৎ প্রগতিশীল তারা এই কাজ করে তাদের যে বিশেষ আত্মোপলব্ধি এই সময়ে হচ্ছে সে বিষয়ে আরও সব চমকপ্রদ পোস্ট করছেন। বছরের পর বছর ধরে মহিলাদের (তিনি পরিবারের সদস্য, বান্ধবী, স্ত্রী, গৃহ পরিচারিকা যিনিই হন না কেন) কাজের উপর নির্ভরশীলতা বুঝতে একটি মহামারীর জন্য যে অপেক্ষা করতে হল তা সত্যিই আশ্চর্যের।
যদি এই সময়ে একটি সমীক্ষা চালানো যায়, তাহলে দেখা যাবে মহিলাদের বাড়ির কাজে পরিশ্রম কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। যতই কাজ ভাগ করে নেওয়ার কথা বলা হোক না কেন, বাড়ির কাজের একটা বড় অংশ এই মূহূর্তে মহিলাদেরই করতে হচ্ছে। বিশেষত রান্নার মতো কাজ, যা শেষ পর্যন্ত তাদের উপরেই এসে পড়ে। বাড়ির কাজের বেশিটাই করার পাশাপাশি যারা ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছেন সেই মহিলাদের পেশাগত সময়টাও দিতে হচ্ছে। ফলে সব মিলিয়ে শারীরিক, মানসিক চাপ বেড়ে যাচ্ছে বহু গুণ আর বিশ্রামের সময় কমে যাচ্ছে অনেকটা। গৃহবন্দীত্ব তাই তাদের শরীর, মনের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতেই পারে এ আর নতুন কি। আর এই যে লকডাউন-এর জন্য গৃহ পরিচারিকাদের বাধ্য হয়ে ছুটি দিতে হয়েছে, যারা অবশ্যই মহিলা তাতেও যে সকলেই খুশি মনে রাজি হয়েছেন আদপেই নয়। এই ছুটি দিতে পারার মধ্যে এক ধরনের দেখনদারিও কাজ করছে না কি! নাহলে তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দেওয়ার যৌক্তিকতা কি? এই ছুটি একদিকে যেমন তাদের প্রাপ্য, তেমনি সবেতন না হয়ে তা যদি আচমকা হয়ে যায়, তাহলে যে চূড়ান্ত অসুবিধার মধ্যে তাদের ফেলতে পারে তাও আমাদের অনেকের কাছে অকল্পনীয়। কারণ এই মহিলাদের অনেকের অধিকাংশের পরিবারেই তারাই একমাত্র বা মুখ্য উপার্জনকারী। তাদের স্বামী বা পুত্ররা রোজগার করেন না (বা হয়তো করতে পারেন না)। কাজে না বেরোলো এই পরিবারগুলির অন্ন সংস্থান অনিশ্চিত। তার উপরে গৃহ হিংসা, সামাজিক বঞ্চনার প্রশ্ন তো না হয় নাই তুললাম। গৃহ পরিচারিকা বা যারা বিভিন্ন বাড়িতে আয়ার কাজ করেন তাদের অনেকের কাছেই এই কাজের জায়গা, কাজের বাড়িগুলি অনেক ক্ষেত্রেই প্রচুর পরিশ্রমের মধ্যেও খানিক নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা, কোনও কোনও বাড়ির মহিলাদের সঙ্গে তাদের এক ধরনের সখ্যতাও তৈরি হয়, সুবিধা-অসুবিধায় তারা পরস্পরের পাশে থাকেন। এই লক ডাউনে এই খেটে খাওয়া মহিলাদের প্রতিদিনের জীবন যে সবক্ষেত্রে খুব স্বস্তিদায়ক, সুখকর হবে তেমনটা আদৌ নয়। একটু ভেবে দেখা দরকার।
একটি ছবি হোয়াটস্‌অ্যাপ সূত্রে পাওয়া যাচ্ছে – একুশ দিনের লকডাউন উঠে গেলে গৃহ পরিচারিকা যখন ফের কাজে আসছেন তখন তিনি স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠেছেন এবং গৃহকর্ত্রী প্রায় জিরো ফিগারের মডেল হয়ে উঠেছেন। কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায় ছবিটিকে? প্রথমত মহিলাদের শরীরের মাপ বিষয়ে যে অনধিকার চর্চা তা ছবিটির পরতে পরতে স্পষ্ট। দ্বিতীয়ত, কিছু নির্দিষ্ট মাপই যে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য তাও ফুটে উঠছে এবং তৃতীয়ত সামাজিক অবস্থান ও শ্রেণীবৈষম্যের দিক থেকেও ছবিটি মারাত্মক অর্থবহ। মানে, গৃহ পরিচারিকার ওজন বেশি হতে পারে না, তিনি হবেন শীর্ণকায়। উল্টোদিকে গৃহকর্ত্রী মানেই তিনি ওজনে ভারি, তার সুখের জীবনের প্রমাণ তার স্থূলতা কারণ তাকে তো কোনও কাজই করতে হয় না। ২১ দিন পরে এই সুখের অদল-বদল ঘটে যাবে আর তাই ওজনও বদলে যাবে। কি আশ্চর্য! গৃহ পরিচারিকাদের বাড়ির জীবন যদি এতটাই সুখকর হত তাহলে নিশ্চিতভাবেই তার শারীরিক প্রকাশ আগেই থাকত। আর গৃহকর্ত্রীর জীবনও তুলোয় মোড়া কি না (কিছু অতি ধনী, ধনী পরিবার বাদে) তার ছবিও তো চারপাশে দেখাই যায়। অবশ্য এই ছবিতে পোশাকের দিক দিয়ে শ্রেণী বৈষম্য স্পষ্টই রেখে দেওয়া হয়েছে।
মহিলাদের শারীরিক সৌন্দর্য নিয়ে এই সময়ে বেরিয়েছে আরও মিম। হিন্দি চলচ্চিত্রের একজন সুপরিচিত খলচরিত্রের অভিনেতাকে বানানো হয়েছে এর চরিত্র। বিউটি পার্লার-এ ২১ দিন না গেলে মহিলাদের সৌন্দর্য কতটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে, চুল বড় হয়ে, ভ্রূ প্লাক না করে, শরীরের রোম না তুলে এবং এরফলে তারা কতটা রেগে যেতে পারেন তাই তুলে ধরে হয়েছে এই মিম্। এই যে সৌন্দর্যের নির্দিষ্ট মাপকাঠি তা এই সমাজনির্দিষ্ট। পণ্য সংস্কৃতির মোড়কে প্রতিনিয়ত মহিলাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে সুন্দর থাকাটা বাধ্যতামূলক করে দেওয়ার যে প্রতিযোগীতা চলে তাতে স্বেচ্ছায়, অনিচ্ছায় মহিলারা জুড়ে যান। আর এই আতঙ্কের সময়ে তাই নিয়ে বানানো হয় নিছক মজা করার উদ্দেশে মিম্‌। এর মধ্যে মহিলাদের প্রতি যে অবজ্ঞাসূচক মানসিকতা রয়েছে, তা কি লুকিয়ে রাখা যায়? যে পরিমাণে এই মিম্‌ হোয়াটস্‌অ্যাপ-এ ছড়িয়ে পড়ছে তাতেই সংখ্যাগুরুর মানসিকতাও উঠে আসে।
এই যে শ্রেণীচরিত্র বেরিয়ে আসা – এটাও বিপদের সময়েই সবচেয়ে ভালোভাবে বোঝা যায়। এখন মানুষকে লকডাউন-এর সময়ে বাধ্যতামূলকভাবে বাড়িতে থাকার জন্য কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্য সরকারের প্রশাসন থেকে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তাতে দিন আনা দিন খাওয়া মানুষেরা বা অত্যন্ত প্রয়োজনে রাস্তায় বেরোনো মানুষেরা কতটা সমস্যায় পড়ছেন তাও আমরা দেখছি। কারণ রাষ্ট্র তাদের জন্য কোনও ব্যবস্থাই নিতে পারেনি। এবার রাষ্ট্রের পুলিস গরিব ও দুর্বল মানুষদের উপর নির্বিচারে লাঠি চালিয়ে এই নিয়ম প্রণয়ন করতে চাইছেন। এমনকি তাতে প্রাণও গেছে একজন মানুষের। এই লাঠি চালনার পরেই শুরু হয়ে গেছে মহিলাদের কেন্দ্র করে জোক। তার মধ্যে একটি – ‘প্লিজ ডোন্ট পোস্ট ভিডিওস অন হোয়াটস্‌অ্যাপ অফ পুলিস বিটিং পিপল অন দ্য রোড। আফটার ওয়াচিং দিজ ভিডিওজ ওয়াইভস্‌ আর পারপাসফুলি সেন্ডিং দেয়ার হাজব্যান্ডস্‌ টু গেট ভেজিটেবলস্‌/গ্রসারিজ’ (দয়া করে হোয়াটস্‌অ্যাপ-এ রাস্তায় পুলিসের মানুষকে মারার ভিডিও শেয়ার করবেন না। এই ভিডিওগুলি দেখার পরই স্ত্রীরা ইচ্ছে করে স্বামীদের সব্জি বা মুদি বাজার করতে পাঠাচ্ছেন)। আরেকটি – ‘ঘরে বউ ঝাড়ছে/বাইরে পুলিস মারছে/তবুও পুরুষরা মুখ বুজে সব সহ্য করে যাচ্ছে শুধুমাত্র সবাইকে ভালো রাখার জন্য।’ এই যে বাড়ির মহিলা বিশেষত স্ত্রীদের নিষ্ঠুর, মারকুটে, ঝগড়াটে দেখিয়ে তা নিয়ে ঠাট্টা করা এবং বিশেষত এহেন জটিল ও আতঙ্কের পরিবেশে তারজন্য শুধু একটিই শব্দই ব্যবহার করার কথা মনে হয় – ‘অসংবেদনশীল’। এবং মনে রাখা দরকার এই পুলিসি নির্মমতার শিকার সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষ, কোনওভাবেই সবরকম সুবিধা পাওয়া পুরুষরা নন, যারা স্রেফ ঘরের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে বসে এরকম মিম্‌ বা জোক বানিয়ে পিঠ চাপড়ানি পেতে পারেন। ফলে শুধু নারী নয় এই তুলনায় কমজোরি মানুষগুলোও আপনার কৌতুকের চরিত্র হয়ে উঠল।
সোশ্যাল মিডিয়ায় আবার এরই পাশে চলছে কোয়ারান্টাইন/লকডাউন/গৃহবন্দী দশাকে কীভাবে একটু মশলাদার করা যায়, স্পার্ক আনা যায় তার টিপস্‌ দেওয়া। অবশ্য সেটার জন্য আপনাকে বিবাহিত পুরুষ হতে হবে। যদি হন তাহলে কী কী উপায়ে স্ত্রীদের রাগিয়ে দিতে পারেন, তার বেশ অনেকগুলি উদাহরণ দেওয়া রয়েছে। যাতে আপনার বাড়িতে থাকার সময়ের ‘বোরডম’/একঘেয়েমি সব চলে যাবে একবার যদি আপনার স্ত্রী রেগে যান। ব্যস। এ তো নেহাতই নিষ্পাপ মশকরা। লকডাউন-এর সময়ে এটুকু হাসিঠাট্টাও করা যাবে না? ফলে এরকম পোস্ট-এও লাইক ও হাসির ইমোজি হতে পারে। আর যে টিপস্‌গুলি দেওয়া হচ্ছে সেগুলি বিবমিষা উদ্রেককারীভাবে নারীবিদ্বেষী। যিনি করছেন তাঁর ভেতর হয় এই ভাবনা এতটা গভীরে প্রোথিত যে তিনি এর নেতিবাচক দিকটা বুঝতেই পারছেন না নতুবা আধুনিকতা, মজা ইত্যাদির আড়ালে ঠিক এভাবেই তিনি পুরুষতান্ত্রিকতার চেনা ধ্বজাধারী।
গৃহবন্দী দশা সবে শুরু। কতদিন এই অবস্থা চলবে তা অনিশ্চিত। তবে এটা নিশ্চিত যে এরকম লিঙ্গবৈষম্য, নারীবিদ্বেষ উসকে দেওয়া আলোচনা, মিম্‌, ছবি, জোক সবই বাড়বে। কারণ? এ তো নিছক মজা। আর মহিলাদের নিয়ে এরকম মজা করা মানেই কি তাদের অসম্মান করা না কি? আসলে হ্যাঁ, ঠিক তাই। কারণ এরকম সব কিছুর একটি প্রেক্ষিত থাকবে। যা রাজনৈতিক। আরও স্পষ্টভাবে বললে যা লিঙ্গ রাজনীতির। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবে, গম্ভীর সময়ে বন্ধুদের মুখে একটু হাসি ফোটানোর জন্য যে ছবি, জোক, মিম আপনি শেয়ার করছেন, ভুললে চলবে না তার শিকড় ছড়িয়ে আছে অনেক গভীরে। এখন সম্ভবত কোনও কিছুই আমরা আর সরলভাবে করে ফেলতে পারি না। কারণ তার সামাজিক, রাজনৈতিক গুরুত্ব বোঝাটা সময়ের দাবী।
ভারতে এই মুহূর্তে যে ফ্যাসিস্ট শক্তি ক্ষমতায় রয়েছে তারা তো এভাবেই নারীদের দেখতে চায়। হাসি-মশকরার পাত্র হিসাবে, হেনস্থার পাত্র হিসাবে, অসম্মানের পাত্র হিসাবে। বিশেষত যে হিন্দুত্বের প্রচার চলছে সেখানেও তো নারী পুরুষতন্ত্রের হাতের পুতুল হয়ে থাকলে বা পুরুষের ক্ষমতার প্রচারক হলেই মিটে যায়। সুতরাং এই লকডাউন, মহামারী ইত্যাদিকেও কেন না তা আরও উসকে দিতেই প্রচার করা যাক? সুতরাং আমাদের বোধহয় নিছক ঠাট্টার সময়েও অন্তত এখন আরও একটু সচেতন হওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কারণ বহু ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে যাওয়া বাক্যবন্ধই আবার বলতে হয় – ‘যা কিছু ব্যক্তিগত তাই রাজনৈতিক’। এই দুঃসময় নিশ্চয়ই কেটে যাবে। মহামারী পেরিয়ে আবার সুসময়ের হাত ধরব আমরা। পুরুষতন্ত্র, সমাজের শ্রেণীচরিত্র কিন্তু তখনও বদলাবে না। ফলে এই লড়াইটা চলবেই। তবে ব্যতিক্রম বা বলা যেতে পারে লিঙ্গবিদ্বেষহীন পুরুষও তো আমাদের চারপাশেই থাকেন। হয়তো তাদের থাকাটা এই লড়াইগুলোকে কিঞ্চিৎ সহনীয় করে তোলে।

[লেখক – স্বাধীন সাংবাদিক ও তথ্যচিত্র নির্মাতা।]

Facebook Comments

1 thought on “লকডাউন-এর হাসি-তামাশা আর নারীবিদ্বেষের দু’চার কথা : সুদর্শনা চক্রবর্তী Leave a comment

Leave a Reply