গল্প : শানু চৌধুরী
স্কেবিস: একটা গল্প
(১)
আফসানা সব আয়না ভেঙে ফেলতে চায় কারণ,আয়না শুধু চিত্র দেখায় চরিত্র নয়। আর সে নিজের চিত্র দেখতে ঘৃণাবোধ করে এখন। হয়তো চরিত্রের একটা মারাত্মক টান আজ বুঝতে পারছে সে।
দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরল একবার। আক্রোশে আফসানার মুখটা কঠিন দেখাচ্ছে। না জানার ভাণ করে শহিদুল জিজ্ঞাসা করল কী হয়েছে?
– তখন মাইটগুলো দৌড়চ্ছে আফসানার শরীরে। চাকা চাকা দাগ উঠেছে সমস্ত দেহে। শহিদুল আঁচ করতে পারে স্কেবিস হয়েছে তাঁর। যা এসেছে ওর শরীর থেকেই। যৌন সঙ্গমের ফলেই বয়ে গেছে আফসানার নরম দেহে। সেই অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে সে বিরোধটাকে জিইয়ে রাখতে চাইছে। আদতে সে জানেই না কিভাবে রোগ বাহন হয়ে যায় কামনার কাছে এলে।
শহিদুল বারান্দার জানালা থেকে দেখছে দুটো ট্রাক ড্রাইভার মদ খেয়ে খিস্তি দিচ্ছে। তার মনে নেই আফসানার সেই গোঙানি আর রাত বাড়লে চুলকানোর খচখচ শব্দ। সমস্ত খাবার বাড়া হয়ে পড়ে আছে। সে মদের বোতলের ছিপিটা খোলে এবং দু’চুমুক খেয়ে নেয়। সেইসময় হঠাৎ কারও গলার স্বর যেন প্রশ্ন করে-
‘তুমি খাওনি আজ?’ শহিদুল উত্তর দেয়-
আমার ভিতর দুঃখের তারাগুলো বেজে উঠলে খেতে ইচ্ছে করে না আমার। তখন আমি ঘুমিয়ে যেতে চাই সমস্ত হলাহল পান করে নিজের ইচ্ছেয় । অথবা আমার সংবেদন ছুঁয়ে দেখতে চাই।
স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো শহিদুল। এরপর চাপা ক্রোধে বলল- জানোয়ার কে নয়? সব পুরুষই মাংসলোলুপ পশু। বাকী কথা থমকে যায় এক টংকারে। সে ঢোক গেলে।
তারপর বলল- এক প্রবল শক্তি লুকিয়ে থাকে নারীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এই হল মনোরথ! এছাড়া কিস্যু নাই শালা। কিস্যু নাই। মানুষ শক্তের ভক্ত, তাই শক্তের হ্রাস টেনে ধরলেই শক্তির সৃষ্টি হয়।তাদের এক অদ্ভুত শক্তি আছে যে শক্তি বুকের ভিতর টাটায় অথচ কোমল! বাধ্য হওয়া আর সহিষ্ণুতার এক অপরূপ চিত্রে তাই এত দুর্ভোগ। তবু সে দুর্ভোগের ভ্রুণ থেকে জন্ম বিশ্বাসকে আত্মপ্রসাদ ভেবে নেই,যেখানে আঘাত করা সাজে না।
(২)
প্রতিটা পায়ে তার যেন বিপর্যস্ত দাগ। ঘষা লাগতে লাগতে ঘায়ের আকার নিয়েছে। সে কষ দেখতে দেখতে আফসানা মনে মনে শহিদুলকে খিস্তি দেয় খানকির পোলা বলে, যেরকম তার পায়ের তলার চিকিৎসাবিহীন চুলকানি তাঁর ভিতর নির্দ্বিধায় বেঁচে থাকতে থাকতে শীতল অথচ নির্মম হয়ে উঠেছে। অথচ সে দেখতে চায় পক্ষপাতদুষ্ট ক্ষমতা। আর চিৎকার করে বলে-
আমি শেকল দিয়ে বাঁধতে চাই এই পরজীবির হাড়।
শহিদুল হঠাৎ এসব হঠকারিতা ও উশখুশ দেখে বুঝে উঠতে পারে না কিছুই। তারপর বিরক্ত হয়।
– কী চাই?
– আফসানার শরীরের মাইটগুলি একসাথে গণসংগীতের মতো বলে ওঠে ধর্ম চাই। চাহিদার খেলায় যেসব ছেনাল নিজের রোগ গোপন করে তাঁদের মেরে ফেলতে চাই।
– ও, তোমরা সেই বাজিকর?
শহিদুল তার রোগের বর্ণনা নিজেই দিয়ে ফ্যালে অজান্তেই।
বাড়ির উঠোনটা কুয়াশায় ঢাকা। রাতের একেকটা পর্দা পড়ছে খুব দ্রুতভাবে। শহিদুল সেই সিনেমাটার নাম মনে করতে পারে না, যেখানে চ্যাপলিন বাড়ির কাচ মেরামত করে আর ঠিক তার কিছুক্ষণ আগেই তার বন্ধু প্রাসাদোপম বাড়িগুলোর কাচ ভাঙে। সে মনে করে উঠতে পারে না… তবু সে তার ভাবনা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চায় না। সে মনে করে তার রোগ যেভাবে বয়ে যাচ্ছে অন্যের খাতে সেখানে আফসানা লড়াই করছে রুখে দিতে। আদৌ সে মিল খুঁজে পায়না। হতাশ হতে হতে সে তার ভার হারিয়ে ফেলে। স্কন্ধহীন ঘোড়ার মতো নুইয়ে পড়তে পড়তে তার জিজ্ঞাস্য ঠোঁট বেঁকে যায় আর বলে-
” আমার নদীর জল থেকে আমি নিজেই যৌনাঙ্গ ধুয়ে ফেলব, সমস্ত চোরাস্রোত কেটে মিশিয়ে দেব ছেনালি মাগিদের ধার” আফসানা তার চলার ছন্দ হারিয়ে ফেলে তৎক্ষনাৎ!
– একি স্বেচ্ছাচার তোমার?
– জেনে রাখো স্বাধীনতা আর যথেচ্ছাচারের মাঝে একটা বিরাট ফারাক থাকে। নিজেকে রক্ষা করো। তোমার হিংসা আজ কারণ খুঁজছে খাদ্য সংগ্রহের জ্বালায়! নিজেকে অন্ত্যজ করে আজ তুমি কেন মেয়ের শরীর বিষবৃক্ষ পুঁতে আসো।
এসব ভাবতে ভাবতে ভোর হয়ে আসে কয়েকটা কাক বাড়ির জানালার কাচে ঠোকর মারতে থাকে ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে। শহিদুল ও আফসানা আজ অনেকটা দূরে চলে যায় সময়কে হাতে নিয়ে। তবু দু’জনে দু’জনের দিকে বিহ্বলের মতো তাকায় এবং যথারীতি বুঝে উঠতে পারে না কি চায় তারা। স্বাভাবিকভাবে শোক উড়ে যায় অথচ তারা জানতো শোকের উচ্ছ্বাস কখনো একটানা প্রতিরোধ তৈরি করতে পারে না।
(৩)
সম্পর্কের তারাগুলো কেটে যায়। এভাবেই রোগে রোগে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তবু শহিদুল ভুলতে পারে না সেই রোগ ছোঁয়াচে হওয়ার কারণ ও আফসানার শরীরে ঢুকে যাওয়ার ফল। দু’জনেই ফুঁসতে থাকে চাহিদারেখা বরাবর। আফসানা লোকলজ্জা ভুলে এখন সমস্ত পুরুষের বুকে অশান্তির দানা সৃষ্টি করতে থাকে। মধ্যবিত্ত পাড়ায় একে বেশ্যাই বলা যায় বোধ হয়। সমস্ত শক্ত সমত্ত জোয়ান পুরুষ এখন ছিনিয়ে নিতে চায় তার দেহ নিঃসৃত পোকাগুলোকে। আফসানা এতে শান্তি পায় এবং পন্থা খুঁজে পায় একরকমের। যেখানে তার দেহের পোকাগুলোর বিনিময়ে সে পায় খা-বা-র।
আফসানার ভাত খাওয়ার ভঙ্গিমা অনেকটা বিকট ধরনের। উত্তেজিত অবস্থায় মানুষ যেমন দিশেহারা হয়ে ওঠে ঠিক সেরকমই তার ভাত খাওয়ার কায়দা। যেন সে ছিবড়ে করে ফেলতে চাইছে পৃথিবীকে চিবিয়ে চিবিয়ে।
পরমুখাপেক্ষী হলেও সে বিষন্ন ও সজ্জাহীন হয়ে বসে থাকতে পারে না এমনকি সে প্রাচীন জীবনের দিকে তাকালেও ফিরে যেতে পারে না। তার চোখে শুধু জন্মায় প্রতিহিংসার এবড়োখেবড়ো পালক! তবুও তার মনের বাহানায় টিকিয়ে রাখতে চায় সম্পর্কগুলোকে।যে সম্পর্ক এনে দিয়েছে পেট ভরার উপাদান। এখন সে ধাক্কা দেয়। তাকে চেঁচিয়ে বলে উঠতে হয় না পেট খালি থাকবার কথা।
(৪)
শহিদুল আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। তার ঘন লোলুপতার ভিতর সায় দিচ্ছে আকাশের রঙ আর বিকারগ্রস্ত একটা চেহারা। তীব্র কাতরতায় সে নখ দিয়ে আঁচড় কাটছে নিজের দেহে। সে ভাবে লাভ নেই আর! আফসানার সেই সরলতা হারিয়ে গ্যাছে। এখন তারজন্য কেবল পাকা ঝানু শব্দগুলোই ব্যবহার করা যায়। সে হাতের বাইরে চলে গ্যাছে। এরকম একটা অবস্থায় আফসানা বারান্দায় আসে আর শহিদুলের বুকের দিকে বেঁকে যাওয়া তাবিজটার দিকে তাকায় উদাসীনভাবে। কিন্তু সে বুঝতে পারে ভিতরের ক্ষতগুলো কেমন লাল রক্তের দলা পাকিয়ে আছে শহিদুলের। তবু সে উৎকন্ঠায় শুনতে চায় শহিদুলের মুখের অসংলগ্ন কথাগুলোকেই। এক চটকেই তার মনের ভাবালুতাকে সে শেষ করতে চায়। পারে না। কারণ তার শরীর এখন ছায়ার শরীর, জড়ানো শরীর। মনের ঘেন্নাকে সে দূরে সরিয়ে রেখে বেরোতে চায় আরেক পৃথিবীর খোঁজে! যে পৃথিবী তাকে তার কাতরতা বা লিঙ্গের অসীম অপূর্ণতা অনুমান করতে অক্ষম! যে মাংস সে নির্বিচারে পেয়েছে এতদিন আজ তা সবার এমনকি মাইটগুলো ও।
(৫)
ঘরটা ফাঁকা পড়ে আছে। আফসানা আর খাটের তলায় রাখা সরবতি লেবুগুলো যেন একসাথে শুকোচ্ছে, গাল দুটো চেটে যাচ্ছে মাছির দংগল। এটা কি তবে পূর্ণতা? যা আসলে যৌনতা ফুরিয়ে গেলে ভয়ংকরভাবে স্বার্থপর হয়ে ওঠে। আফসানা জিইয়ে রাখা রোগ আজও খুঁজে পায় না। তার ক্লিটোরিস ঝরা পাতার মতো চেয়ে থাকে, যার কেবল মর্মর ধ্বনিটুকুই আছে। যেখানে এককালে দ্রুত পায়ে হেঁটে গ্যাছে ভণ্ড সমাজের স্বাভাবিক পুরুষেরা। খেতে পাওয়ার অপর পিঠে খাওয়ানো যে এক দায়িত্ব সে আজ আর মনে করতে চায় না।তার রোগ আজ অস্বাভাবিক!
আফসানা আর শহিদুলের সম্পর্কে আজ কোনো বন্ধন নেই। শুধু মাঝে এক শব্দ! মারণরোগ নয় তবে আনন্দ আর প্রতিহিংসায় দুমড়েমুচড়ে যাওয়া এক ধ্বংসের অহংকার যেন খুঁচিয়ে দিয়েছে অবহেলার নরম মাটি। শহিদুল এখন এক কালভার্টে দাঁড়িয়ে। গায়ের পোশাক ময়লা। প্যান্টের ভিতর দুধের প্যাকেট দিয়ে লিঙ্গটা মোড়া দেখলে মনে হতে পারে উত্থিত অবস্থায় রয়েছে, আসলে তা নয়। মৃত চামড়াকে আজ সে ধরে রাখতে চাইছে যা কালো হয়ে গ্যাছে বা নখের আঁচড়ে আঁচড়ে রক্তের বিষণ্নতা নিয়ে বসে আছে… শুধু আওয়াজ যা শুনতে পাচ্ছে শহিদুল। টপ্ ! টপ্ !
Posted in: March 2020, Story