গ্রন্থ আলোচনা : সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়
লড়াইয়ের অস্ত্র-শস্ত্র
ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই । লড়াইটা গণতন্ত্রের। গণতন্ত্রের লড়াই মানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই। প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র বিপন্ন হলে তা ফিরে পাওয়ার লড়াই। সে লড়াইয়ে অস্ত্র কী হবে? কী হতে পারে? আক্রমণ করার জন্য আক্ষরিক অর্থে অস্ত্র নয়, গণতান্ত্রিক পরিসর তৈরির জন্য দরকার বই । ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চাই ফ্যাসিবাদের মুখোশ খুলে দেওয়া বই । এ দেশে ফ্যাসিবাদ ভীষণভাবেই ধর্মীয় অনুষঙ্গে যুক্ত। স্পষ্ট করে বললে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা । আরও স্পষ্ট করে বললে সংঘের সাম্প্রদায়িকতা।
এর বিরুদ্ধে লড়তে গেলে আপনাকে তো জানতে হবে সংঘ পরিবারের স্বরূপ। সেই জানানোর কাজে সহায় হতে পারে একটা সদ্য বেরোনো বই ।
বইয়ের নাম সংঘ পরিবার ও হিন্দুত্ববাদ ভিত্তি উদ্ভব বিকাশ। ঠিক কোন একজনের লেখা নয় এই বই । অনেকে মিলে দল বেঁধে
যেমন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই তেমনই এই বই একটা জোট বেঁধে তৈরি । জোটের নাম আপডেট স্টাডি গ্রুপ । প্রকাশক সেতু প্রকাশনী।
ভূমিকা (প্রাথমিক কথা), উপসংহার (উপসংহারের পরিবর্তে) আর গ্রন্থপঞ্জি বাদ দিয়ে বইয়ের তিনটে বড় ভাগ। প্রথম ভাগে সন্ধান করা হয়েছে ঐতিহাসিক সত্য । ভারতবর্ষ, হিন্দু আর আর্য জাতি নিয়ে মিথ আর মিথ্যার স্বরূপ সন্ধান সেখানে।
তার পরের ভাগে প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগ থেকে আর ঔপনিবেশিক শাসন জুড়ে এক বড় সময়কালের বিশ্লেষণ । ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’-এর উদ্ভবের গল্প। গল্প প্রদীপের সলতে পাকানোর। প্রদীপ প্রজ্জ্বলনেরও। উনিশ শতক। সংস্কার আন্দোলন। জাতীয়তাবাদের সঙ্গে হিন্দু অনুষঙ্গ জড়িয়ে যাওয়া । এ পর্ব শেষ হচ্ছে বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশী আন্দোলনে এসে। হিন্দু জাতীয়তাবাদী আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর্ব।
পরের পর্ব পুরোপুরি ফ্যাসিবাদের বিকাশের ইতিহাস। এই পর্যায়েই তো হিন্দু জাতীয়তাবাদ ফ্যাসিবাদী হিন্দুত্ববাদে রূপান্তরিত । এ জি নুরানি সংঘ পরিবারের বিভিন্ন সংগঠনের দায়িত্বর ভাগাভাগি নিয়ে বই লিখেছিলেন । আর এই বইতে সেই ভাগের ভাগ নেওয়ার বিস্তৃত কাহিনী । হিন্দু মহাসভা। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ । ভারতীয় জনতা পার্টি । ক্ষমতার রাজনীতি। রাজনৈতিক ক্ষমতার আঙিনায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন । আর সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাবনার জগত দখল করা। হিন্দুত্বর সংকীর্ণ ধারণা সংখ্যাগরিষ্ঠর মত বলে সংখ্যালঘুর ওপর ছাপিয়ে দেওয়া। ফ্যাসিবাদ এখানেই। গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতায় আসা। আর আসার পথে হিন্দুত্ববাদী পথের নির্মাণ । সেই পথ ক্ষমতায় এসে তার মতটাকেই একমাত্র পথ বলে প্রচার করে। সেই প্রচারকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আর এখানেই দেখা মেলে ফ্যাসিবাদী কার্যক্রমের । তার প্রকাশ সংঘের ইতিহাস বীক্ষণে । তার পরিচয় সংঘের বিজ্ঞান ভাবনায়। অবিজ্ঞান । অপবিজ্ঞান । এর সঙ্গেই, এই অবিজ্ঞান আর অপবিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতবাদ ব্যবহার করে ‘অন্য’ আর ‘অপর’ করার কাজ। ফ্যাসিবাদ যেমন করে। সংখ্যালঘু হয়ে নিপীড়নের শিকার হন নিম্নবর্গ, নিম্নবর্ণ, জনজাতি, নারী । ফ্যাসিবাদ যেমন চায়। গণতান্ত্রিক পথেই তার ক্ষমতার উত্থান । আর ক্ষমতা প্রাপ্তির পর সেই গণতান্ত্রিক পরিসরই বিপন্ন। বিপন্ন দেশের মানুষ। রুদ্ধ মুক্ত ভাবনা। এই কন্ঠরোধের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে গেলে হতে হবে ফ্যাসিবাদী নিপীড়নের শিকার। যে নিপীড়নের প্রমাণ একের পর এক হত্যা। অবিজ্ঞান আর অপবিজ্ঞানের বিরুদ্ধে যুক্তি আর মুক্তির পক্ষে কথা বলায়, কথা লেখায় প্রাণ দিতে হয়েছে নরেন্দ্র দাভোলকর, গোবিন্দ পানসরে,কলবুর্গি আর গৌরী লঙ্কেশকে। তবু আওয়াজ তো তুলতেই হবে। আর সেই আওয়াজ তোলার জন্য চাই তথ্য। শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে হলে শত্রুকে চিনতে হবে । জানতে হবে শত্রুর স্বরূপ । সেই স্বরূপ সন্ধানের জন্যেই জরুরি এই বই ।
গ্রন্থপঞ্জিতে চোখ বোলালে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের লড়াইয়ের আরও অস্ত্র-শস্ত্রের খোঁজ মিলবে। সেই তালিকায় না থাকা দুটো বইও একই সঙ্গে পড়তে বলব।
প্রথমটা গৌতম চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ইতিহাস চর্চা জাতীয়তা ও সাম্প্রদায়িকতা ।
পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদের এই বই কে পি বাগচী থেকে প্রথম বেরিয়েছিল 1985তে। এখন মেলে পরে প্রকাশিত সেতু প্রকাশনীর সংস্করণ ।
দ্বিতীয় বই অঞ্জন গোস্বামীর লেখা ইতিহাসচর্চা: বিষয় সাম্প্রদায়িকতা ।
অন্য নামে এই বই প্রথম বেরিয়েছিল 1995তে। এই নামে পরিবর্তিত সংস্করণ বের হয় 2003এ। প্রকাশক চিরায়ত প্রকাশন।
এই অস্ত্রগুলো হাতে তুলে নিন। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াইতে এগুলোই তো আপনার ঢাল- তলোয়ার ।
[লেখক – ড: সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়। এ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, ইতিহাস বিভাগ, কল্যানী বিশ্ববিদ্যালয়।]
Posted in: Criticism, March 2020
মুখোশের আড়ালে নয়, মুখোমুখি দাঁড়ানোর রসদ।