অনুবাদ কবিতা : রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়
পিটার ভ্যালেন্টি ও তাঁর অক্ষাংশেরা
মার্কিন কবি পিটার ভ্যালেন্টি, যাঁর কাছে কবিতা হল মূলত ভাষা ও আপন সত্তার অজানা রহস্যের ভেতর এক অ্যাডভেঞ্চার, যার কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই বরং কবি ও পাঠককে ক্রমাগত ঠেলে দেয় প্রশ্নের দিকে উত্তরের জোগান না দিয়ে। আর এই প্রশ্নগুলোই জন্ম দেয় নিজের ও চারপাশের জগৎ সম্পর্কে নতুন ধারণা। তাঁর কাছে কবিতা সবসময়ই এক খোঁজ, নতুন গঠনের, নতুন পথের। যখনই কবিতা স্থিতিশীল বা পুনরাবৃত্তি হতে থাকে তখনই সে শক্তি হারায়। কবিতার নিজেকেই প্রশ্ন করা উচিত যাতে সে অস্থিতিতে নিয়ে যেতে পারে মূলধারা, পরীক্ষামূলক প্রবণতা ও প্রত্যাশাকে। তিনি মনে করেন কবিতায় কী বলা আছে যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি যা বলা নেই তাও সমান গুরুত্বপূর্ণ; শব্দ ততটাই গুরুত্বপূর্ণ যতটা নৈঃশব্দ্য। কবিতা ভাষ্যে পরিণত হওয়ার আগে সংগীতের টুকরোর মতো অনুরণিত হয় পাঠকের মাথার ভেতর। কিছু নিউরোলজিক্যাল ও ফিজিওলজিক্যাল প্রক্রিয়ার ফলে মস্তিষ্কের কিছু সিগন্যাল ও স্পার্কের জন্য যার উদ্ভব হয় তাকে আমরা ভাষা বলি। শব্দ দিয়ে তার দেহ। আমরা তাকে নির্মাণ করি। পোয়েট্রি শব্দটাই এসেছে গ্রীক শব্দ poiēsis থেকে যার মানে “কিছু নির্মাণ করা”। আর তাই দেখি মার্কিন কবি পিটার ভ্যালেন্টির কবিতায় ছাপ রেখে যায় তাঁর ফিল্ম, ফটোগ্র্যাফি, আর অনুবাদের অনুরণন। তাদের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় তাঁর কবিতাও হয়ে ওঠে নিরবচ্ছিন্ন সৃজন প্রক্রিয়ার এক অংশবিশেষ, যেখানে সমগ্রের সাথে সম্পর্ক ছাড়া কাউকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। তাঁর কবিতা নির্মাণে অনুবাদ ও জার্নালের টেক্সটগুলো এক কোলাজের রূপ নেয় যার ডায়নামিক্স ক্রমাগত পরিবর্তিত হতে থাকে। একটা স্পেস খুলতে থাকে কবিতার মধ্যে যা পাঠককে দেয় উপলব্ধির স্বাধীনতা; যা একধরণের ধ্যানের সম্মতি দেয় ভাষার প্রকৃতির ওপর ও সাধারণ ভাষ্যবহির্ভূত অর্থের ওপর। তাঁর কবিতা পাঠককে ততদূর নিয়ে যায় মাটিতে পা রেখে যতদূর যাওয়া যায়। আসুন পাঠক, এবারে পড়ি তাঁর সদ্য লেখা কিছু কবিতার অনুবাদ।
সন্ন্যাসীর অক্ষাংশেরা (MONK’S LATITUDES)
ঘুরপথে হেঁটে আসা রূপান্তর ফাটল ধরায়
ধারগুলো মসৃণ করে কোণ
জ্যা বরাবর নীলাভ ধাঁধা
উপড়ে ফেলা চাবি
আর ঝালাই করা অবরোধ, তারপর পরবর্তী বাধায় অভিযান আবার
সমস্ত স্পেস জুড়ে বিপদ সংকেত
সাথ দেয় বিভাজন আর অষ্টমুখী জলুস
কবজাগুলো কালো রঙে মোমায়িত হলে
মিশ্ররাগে বাঁধা পড়ে চিহ্ন
ঘণ্টাধ্বনি (TOLL)
রঙিন প্রান্তরেখার পরীক্ষা
উচ্চারণ করে ভেতরঘরের দূরত্ব
লিখে রাখে অন্ধকার মধ্যবর্তী পরিসরগুলো
না-বলা গ্রন্থির যোগফল
টানটান হৃদয়ের এই বিলম্বিত
কার কাহিনির মানচিত্রে
বইল এসব বার্তা
শরীর জুড়ে চৌবন্দী ফিউজ
গুণতিতে নেই কিছু অনুচ্চারিত সমাধান
একটা মুহূর্ত খুলে দেয় ফাঁকগুলো
খতিয়ে দেখার আয়নাগুলো মূর্ত করলে তুমি রইল পড়ে সব
ভাবনা যেমন আবছায়
ওই তো নির্মাণ করে দৃশ্য
গরহাজির অংশগুলোর কিছু দাগ আর চলনরেখা
গড়ে দেয় তোমার বাকদেহ
গুনগুনোনো স্মৃতি বাতিল করে দাগানো গুণগুলো
সারি সারি শরীর ধ্বনি তোলে দেয়ালে
ওইখানে নিজেকে পড়ো
নগ্ন সূত্রে
যমজ শ্বসনের বয়নে
প্রতিদানের মাপে
পথচিহ্নে আর ইন্টারফিয়ারেন্স
স্টেশন থেকে স্টেশনে
ডাকাডাকিতে বয়ে যাওয়া সময়
ত্বরায় আনে তরঙ্গ
তোমার নিয়ত কাহিনিসূত্রের নীচে, বলার মতো একটা গল্প
প্রকাশ্য ঝড়ের পরিসর
রঙিন ভাঙন
সমাপ্তিহীন এক আবরণ, তারপর
একটু তাপ
ভঙ্গুর ধ্বনিত জাল
সুতোর বুননে থাকা মণি
ঢলে পড়ে সাদা পাতায়
আর্টিমিস (ARTEMIS)
এক নাগপুচ্ছ
ছোটে এই শব্দের সিংহাসন জুড়ে
এমন আকাঁবাঁকা
যেন মনপথ
পরিহাসিত অক্ষর
ঠোঁট থেকে
আলো আঁধারি ধ্বনি থেকে
ঢুকে পড়ি জঙ্গলে
আমরা শুনি আমাদেরই প্রতিধ্বনি
ঝিলমিল বন্ধ হয়
ধ্বনি মৃদুলায়
আমরা ঘুরে মরি আধোজাগরণে
সকালের সমর্পণে
ভাবনাবেলা (DURATION OF THOUGHT)
দিশা রেখে যায় দেয়ালে
আয়না যেমন প্রতিফলনে
আধোবুলি
সংঘাতে
যেন ভেঙে পড়ল সাদা শিখায়
অন্ধকারকে খুশি করতে শান দিল খিদে
মুখের ওপর, চোখের ওপর এমন এই হাত
যেন আলোবাঁধা
বালিলিত দ্বীপে ভেসে যায় স্বয়ং
এমন অবাস্তব যেন ওই কল্পলোক
অস্থানে রাখা, আধোস্মরণে
পাতা উল্টিয়ে
চাবি ঘুরিয়ে
অন্ধকারে ডোবে মন
মুখ ফিরিয়ে
জ্বলন্ত সেতু
জ্বলন্ত সেতু
শূন্যস্থানে লাল অক্ষরগুলো সুরে বাঁধছে জমাট ছায়ারা
কবি পরিচিতি
কবি পিটার ভ্যালেন্টি ১৯৭০ সালে ইতালির সালের্নোতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়া্রিং এবং ইংরেজি ও মার্কিন সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছেন স্টিভেন্স ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে। ২০১৪ সালে তাঁর বই A Boy Asleep Under the Sun: Versions of Sandro Penna প্রকাশিত হয় Punctum Books প্রকাশনী থেকে। বইটি ২০১৪ সালে Spuyten Duyvil থেকে মনোনীত হয় Lambda award, The Artaud Variations পুরস্কারের জন্য। তাঁর অন্যান্য বইগুলোর মধ্যে আছে Let the Games Begin: Five Roman Writers (Talisman House, ২০১৫), The Catullus Versions (Spuyten Duyvil, ২০১৭), ফটোগ্র্যাফির দুটো বই Blue (Spuyten Duyvil) এবং Street Level (Spuyten Duyvil, ২০১৬), ইতালি ভাষায় অনূদিত দুটো বই Blackout by NanniBalestrini (Commune Editions, ২০১৭) এবং Whatever the Name by Pierre Lepori (Spuyten Duyvil, ২০১৭), Two Novellas: Parthenogenesis & Plague in the Imperial City প্রকাশিত হয় Spuyten Duyvil থেকে ২০১৭ সালে। ঐ বছরেই blazeVOX থেকে একটি কোলাবরেশান প্রকাশিত হয় Kevin Killian ও Ekstasis -এর সঙ্গে। ১৯৯৮ সালে Jensen Daniels থেকে একটি চ্যাপবুক Forge of Words a Forest প্রকাশিত হয়। ২০১৪ সালে Portable Press at Yo-Yo Labs থেকে প্রকাশিত Selected Late Letters of Antonin Artaud, এবং ১৯৪৫-১৯৪৭ চ্যাপবুক দুটির তিনি সহ-অনুবাদক। তিনি Gérard de Nerval, Cesare Viviani, এবং Pier Paolo Pasolini সহ বহু গ্রীক ও ল্যাটিন লেখকের অনুবাদ করেন। বর্তমানে তিনি Semiotext(e) এর জন্য বই এর ওপর কাজে নিযুক্ত আছেন। ২০১০ সাল থেকে তিনি জড়িত হয়ে পড়েন সিনেমা জগতের সঙ্গে এবং প্রায় ৬০ টি শর্টফিল্ম তৈরি করেছেন যা Anthology Film Archives এ প্রদর্শিত হয়।
Posted in: March 2020, Translation