রোমেল রহমান-এর কবিতা

ঈশ্বর বাঁচে নি, পারেনি বাঁচাতে নিজেকে!

আমি এখনো কেঁপে কেঁপে উঠছি
সেইদিনের স্মৃতি মনে করে।
আর তোমাদের মুখ দেখে অবাক হচ্ছি!
কি চমৎকার মুখোশ পরে থাকো তোমরা সবাই
ছিমছাম শান্ত নীরব যেন কিছুই ঘটেনি,
কি চমৎকার নাটক জানো তোমরা সবাই;
ক্যামেরায় তোমরা যা, ক্যামেরার পেছনের তোমরা তা না!
যেন সকল সত্য আজ তুমুল গুজব!

আমি এখনো কেঁপে কেঁপে উঠছি।
সেইদিনের স্মৃতি মনে পড়লেই আমার কেবল মনে হচ্ছে,
খুনিদের দঙ্গল নেমে আসবে এক্ষুনি …হই হই চিৎকার দিয়ে,
ঈশ্বরের নাম শ্লোগানে নেমে আসবে উন্মত্ত খুনির দল,
দাবানল করে ফেলবে পাড়া- মহল্লার নিকষ রাত,
দিনকে যারা করে ফেলে ধোঁয়াচ্ছন্ন;
জমিনকে যারা ভরিয়ে ফেলে ফিনকি দেয়া রক্তের দাগে,
কান পাতলে আমি এখনো শুনতে পাই,
সেই প্রতিভাবান ধর্মান্ধেরা নেমে আসছে মিছিল করে
আর
বোবা ঈশ্বর অথর্বের মতো দেখছে বান্দার রক্তে লাল হচ্ছে তারই জমিন!

ঈশ্বরের নাম জপে ঈশ্বরের ঘরে আগুন দিচ্ছে ঈশ্বরের বান্দারা।
ঈশ্বর ভাগ হয়ে যায় ধর্মের দোহাই নামে।
ঈশ্বর বোবা হয়ে যায়,
খুনি হয়ে যায়,
বাদী আর বিবাদিও হয় হত্যার উন্মাদনায়;
ঈশ্বর কি হামাগুড়ি দেয়া ঐ নাজুক বাচ্চাটা
আগুন দেখলে যে হেসেখেলে এগিয়ে ঝাঁপিয়ে নেমে যায়?
ঈশ্বর কি ঐ মজলুম যার ঘর আজ আগুনে ভস্ম?
ঈশ্বর কি ঐ নাবালিকা যার জরায়ুতে যন্ত্রণার ক্ষত?
আগুন যে দেয় সে কোন ঈশ্বরের বাহিনীর??
আগুন যার লাগে সে কোন ঈশ্বরের বাহিনীর??

ঈশ্বর আসলে কে যাকে নিয়ে এতো হইচই???

এখন তো আমার হৈচৈ শুনলেই মনে হয় ঈশ্বর আসছেন দাবানল জ্বালাতে,
ঈশ্বর আসছেন রক্ত ঝরাতে।
ঈশ্বর কি বুটজুতো?
ঈশ্বর কি রাইফেল, টিয়ারসেল?
ঈশ্বর কি দাঙ্গা?
ফুলের বাগান মাড়িয়ে যাওয়া অন্ধ হন্তারকবাহিনী?
ঈশ্বর কি দলে দলে ভাগ হয়ে ওঠা এক বিশ্বাস?
ঈশ্বর কি রাষ্ট্র, নেতা, রাজনীতি?
আমি কোন পক্ষে তবে?
কোন দলে আমার জন্ম, আমার ঈশ্বর কে তবে?
সবুজ,
গেরুয়া,
লাল,
সাদা,
ঈশ্বরের রঙ কি?
নাকি মসনদে অটল মূর্তি তিনি,ক্ষমতার রঙে তীব্র রঙিন!

জানি এই সব বাকোয়াজি,
জানি আমার জবান পৌঁছাবে না দেয়াল টপকে;
আমাকে নেবে না কেউ,
শুনবে না আমার লাব্‌জ,
আমার ক্ষতে কেউ চিৎকার করে উঠবে না।
আগেও এমন হতো, এখনো হচ্ছে; আর আগামীতেও হয়তো হবে।
আসলে সকল সমস্যার মূল ঐ ঈশ্বর।
যিনি মুচকি হাসেন,
যিনি চাঁদের আলো ঢেলে দিয়ে দুনিয়া দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েন,
যিনি ফুল ফোটাবার পর পতঙ্গ হয়ে ওটাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খান,
আর আমাদের মধ্যে অধিষ্ঠিত হতে যিনি রক্ত ঝরান।
আমি কার নামে মামলা করবো?
ঈশ্বরের নামে আমি মামলা ঠুকলে কি মুক্তি পাওয়া যাবে?
যদি ঈশ্বরকে হাজত বন্দি করা করা যায়,
যদি তাকে গুম করে ফেলা যায়,
কিংবা ক্রসফায়ার দিয়ে শেষ করে দেয়া যায়;
তবে কি মুক্তি মিলবে?
রাষ্ট্র তো এইভাবে আমাদের দমন করে,
আমারা কেন ঈশ্বরকে গুম করে দেবো না?
কেন আমরা সেই খবর মিডিয়া থেকে গায়েব করে দিতে পারবো না?

আমি এখনো কেঁপে কেঁপে উঠছি,
যখন আমার মনে পড়ছে সেদিন আমার মতন মুখগুলো
ঈশ্বরের নাম নিয়ে নেমে এলো
আগুন বারুদ আর রক্ত ঝরানো ধারালো অস্ত্রের ঝনঝনানিতে ভরে উঠলো মহল্লার প্রতিটা ইঞ্চি,
আমি কাকে দোষ দেবো?
ফরিয়াদ করবো কার দরবারে?
ঈশ্বর নামক শব্দের জজবা আমার জানা হয়ে গেছে,
ঈশ্বরের নামে ঈশ্বর প্রতিষ্ঠার জোস আমার চেনা হয়ে গেছে,
ঈশ্বর মেরে ঈশ্বর প্রতিষ্ঠার এই রাষ্ট্রকে আমি ঘেন্না করি!
এই রাজা রাজা খেলাতে আগুন দিতে চাই আমি,
পিশাচ শাসকের দাঁত আমি ভেঙে দিতে চাই,
আমি খাকি পোশাক আর অন্ধ কানুনকে ঘেন্না করি;
আমি ঘেন্না করি যারা মানুষকে হত্যা করে ঈশ্বরকে বাঁচায়।
আমি বিহ্বল হয়ে ভাবি
ঈশ্বরপ্রবণ আমাদের মন ও মননে মানুষ কোথায়?

আমি কেঁপে কেঁপে উঠছি সেই রাতের স্মৃতি মনে করতেই,
আমাকে বাঁচাতে যে নেমে এসে পুড়ে গেলো
সে তার ঈশ্বরকে ফেলে আমাকে বাঁচালো এই কথা ভেবে।

ঈশ্বর আমার কাছে দণ্ডিত এক শব্দ হয়ে উঠছে ক্রমশ।
আমি টের পাচ্ছি এই রাষ্ট্র ঈশ্বরকে বাঁচাতে পারবে না,
কিংবা রাষ্ট্র ঈশ্বর হয়ে উঠলেও বাঁচাতে পারবে না নিজেকে,
লুকোতেও পারবে না সে তার বিরাট দেহ!
আমাদের ক্ষত গুলো,
আমাদের হারানোর শোক,
আমাদের ক্রন্দন,
আমাদের সন্ত্রস্ত মন আজ না-হোক কাল সাক্ষী দেবে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে!
কেননা তার শরীর ভরা ক্রোধ,
অন্ধ তার চোখ,
ঘৃণা তার অন্তর কুঠুরিতে;
যেহেতু সে দাবি করে এইসব মানুষেরা সকলেই তারই অনুরণন।

আমি টের পাচ্ছি ঈশ্বর ভূলুণ্ঠিত হবে,
কারণ, এখনো ঈশ্বরের সন্তানদের মাঝে এমন মানুষ আছে
যারা ঈশ্বরকে না বাঁচিয়ে মানুষকে বাঁচায়!

যারা বলে,
আমি আজ মানুষকে ভালোবেসে ঈশ্বরকে কুরবানি দিতে চাই।

Facebook Comments

Posted in: March 2020, Poetry

Tagged as: , ,

Leave a Reply