ঋষি সৌরক অরণ্য-এর কবিতা
ক্ষীতিজাকে লেখা চিঠিগুলো কেউ অনুবাদ করে দেয় না-১
প্রতিটি হতাশার খবর। তার ঝলকের সাথে সাথে একটি দূরপাল্লার ট্রেন চলে যায়। থ্রু ট্রেন। থামে না। তার দিকে আমরাও তাকাই না। শুধু ধুলো উড়িয়ে চলে যাওয়া। আর পরোয়াবিহীন ঝড়। আমাদের অবজ্ঞায় নুনের মত এসে লাগে। সেই নুন যা গভীরতম দহনকে অনতিকালের জন্য মূর্ত ও অনিবার্য করে তোলে। রক্তে তখন পোড়াকাঠের তন্দুর। উস্কোখুস্কো মৌমাছির মত ওড়ে। কী ভীষণ ফ্যাকাশে। রক্তশূণ্য। এসব আমরা দৃশ্যে দেখি না। শুধু হতাশার ঢেউ কলকল শব্দে তীরে ছিটে লাগে। আমরা দেখি না পালিয়ে যাওয়া ট্রেনে। তার উইণ্ডো সিটে খুব কাছের কোনও আত্মীয়। যেন আমায় চেনে না। যেন ট্রেনভর্তি অনেক কাছের আত্মীয়। আমাকে কেউ চেনে না। আমাকে কেউ দেখে না। তারা চেনে না নিজেদেরও। সমস্ত ট্রেন জুড়ে আলোকিত অন্ধকার আর হিমেল তীক্ষ্ণ বাতাসের এক মর্মান্তিক মাখামাখি। ধাতব ছায়ায় চাপা পড়ে যাচ্ছি আমরা, আমাদের বোধের মধ্যে সাজানো গোছানো আদিবাসী গ্রাম। লক্ষ লক্ষ সাঁওতাল রমণীর জোছনা উগরোনো কুচকুচে স্তন। যেন পুড়ে যাচ্ছে দাবানলে। পুড়ে যাচ্ছে নিশুতি অরণ্যের প্রাগৈতিহাসিক বৃক্ষগুলির একান্ত স্তব। একটা ছবির মত মেলা – কোনও অলৌকিক অভিশাপে থেঁতলে গিয়ে ডুবে যাচ্ছে লালারক্ত মাখামাখি মাটির যোনির স্থবিরে। এইসমস্ত আর্তনাদ হকারের মত ফেরি করতে করতে চলে যায় দূরপাল্লার ট্রেন। আমরা দেখি না। যেটুকু ধুলো আবছা করে দিতে পারে না দৃশ্য, অথচ দৃশ্যের নরম বিঁধে যায়। সেই হতাশার চলমানতায় বসে থাকে প্রিয় প্রিয় সব নীচুমুখ। এরা কোথায় যায়। এরা কথা বলে না কেন। এদের দৃষ্টি কেন এত স্থির। এসব প্রশ্ন যতক্ষণে জিজ্ঞাসা চিহ্ন আহরণ করে আনে, জীবনের কোনও না কোনও ছুতো। কী ভীষণ নির্মম আরামে একটু একটু করে ছেয়ে যেতে থাকে। ট্রেন ক্রমশ অদৃশ্য হয়। তার রেশ শেষ বিকেলের আলোয় বিকীর্ণ হতে হতে ঝিঁঝিঁপোকার মত অবিশ্রান্ত হয়ে পড়ে। অনুভবের সমস্ত লণ্ঠন নিভে গেলে। সমস্ত ফলের দৈব নির্যাসটুকু রক্তে মিশে গেলে। একা একা অন্ধকার তুলে দেখি। আমিও তাদেরই একজন।
ক্ষীতিজাকে লেখা চিঠিগুলো কেউ অনুবাদ করে দেয় না-২
প্রলুব্ধ স্মৃতির মত ফ্যান ঘোরে। যেন সমস্ত উষ্ণতাকে নিভিয়ে দেবে। সমস্ত জ্বরকে করে তুলবে আরো উদাসীন। স্নিগ্ধ। যেন খাওয়ার মত হাওয়া, এখনো লোক রয়েছে প্রচুর। রক্তিম আলোকে বিদীর্ণ করে তার একরোখা ঘ্যানঘ্যান ঘ্যানঘ্যান। একটা দোলগতি তৈরী হয়। সাইকাডেলিক ছন্দে।চোখ বুজে আসে। বৈরাগী নৌকোর পাটাতনে নিশ্চিন্তে ঠেকনা দেওয়া মাথা। মাঝিকে বোঝা যায় না। শুধু চাঁদ খোবলানো কালোজলে। বিরতিতে বিরতিতে কলকলধ্বনি। আর ভেজা বাতাসে মৃদু মৃদু দুলে ওঠা। মাথা ভারী লাগে। পাথরের মত। নির্জীব। অথচ সে হাওয়ার গন্ধ এমন। দাঁড় বাই। দাঁড় বাই। শরীর শুইয়ে বেরিয়ে আসি মাঝির ভিতর।
Posted in: March 2020, Poetry