রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়-এর টেক্সট
আমি এই বৃষ্টিতে পুড়ে যাচ্ছি
ভিজে যাচ্ছি বৃষ্টির ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা আগুনে
১
তৃতীয়া
…এই দুটি মাত্রার দরজা ভেঙ্গে, জানলা ভেঙ্গে বেরোতে চাইছি
যে তুমি, অনন্যা, তৃতীয় মাত্রাটি এঁকে দেবে
তোমার তৃতীয় নয়ন থেকে…
২
চতুর্থী
তুমিই তো আসছো! তোমার ব্রাউন স্লিপার। ছড়িয়ে হাঁটছো, কতদিন পর রোববার। নখ থেকে রং তুলেছো, ছাপ ছাপ জামা পাজামা। সুতোর ভেতর থেকে মনে হয় গোলাপি হয়েছো বেশি।
কিছু নেই, কিচ্ছুটি না। অতিরিক্ত তোমার ব্যথার আনন্দের মতো করে তুমি আজ ঘরোয়া স্বভাবে। মাধবী আঙ্গুলগুলো জড়াই যেন বসন্ত জমা থেকে যাবে। সুডৌল পাতায় পাতায় রোদভাসি।
হে জীবন লোভী করে তোলো, তোমার চিবুকের মতো আগ্রাসী।
৩
পঞ্চমী
তোমাকে সব খালিতে ভীষণ ভালো লাগে। তাই ভিতর ছেড়ে আজ বাহিরে গেলাম। যা যা প্রথম করেছ দান, আজ তা তোলা থাক।
গোটা আকাশটাই দোয়াত দিচ্ছে যেন লিখে ফেলি জমাবিলি হয় নি এখনো যা, এখনো যে চোখ হয় নি আঁকা, সেই নির্বিকল্পের কাছে ছুটে যাই।
তোমার নদীতে সন্ধ্যে ভাসাই।
৪
ষষ্ঠী
…আমিই রচনা করি। আমাকে আর রচনা করে না কেউ…
পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে ধূপ ছায়া। একটা গ্রামের ওপর দিয়ে সকালের প্রথম মেঘটা উড়ছে।
পাইনের ওপর থেকে নেমে, নিচু হয়ে আসা টিনের চালের বাড়িটাকে ছুঁয়ে আবার ওপরে উড়লো।
আজ ষষ্ঠী। আজ মেয়েটার নতুন দোপাট্টা।
রোদ উঠবে তবে, তার আগে ও পরে, যেটুকু ভিজে যাবে জলো বাতাসে আর, তার থেকেও দ্রুত, বুকের ওম পেয়ে, মিলিয়ে যাবে, যা মেয়েটা টের পাবে এক ফালি স্বর্গ-ছেঁড়া নীলে তার মায়াটানা চোখ রেখে।
আর সুরঞ্জিত হওয়ার আগে আমাকে দেখে ফেলবে, আমি ওকে দেখছি আর প্রশ্ন করবে,
তপাই ঘড়িঘড়ি পাহাড় কিনো আহনু ভাকো?
আমি চেয়ে থাকবো।
– ইয়ো চীজ দেখদা দেখদা কইলে পনি থক দই নউ?
আমি আরো আরো চেয়ে থাকবো।
– তপই কো আখামা কে ছ?
আমি ওকে কী করে বলি আসার সময়ে তিস্তার জলে কচি কলাপাতা রং আর তার ধারে ইতস্তত কাশ আমার চোখে ফুটে আছে।
আমি ওকে বলতে পারছি না আমার দেবী ওর মতই দৃশ্যত কুমারী, আমি তাকে ফেলে রেখে এসেছি নগর জঙ্গলে।
বোধনের রাত্রিটুকু বুকের ভেতর করে নিয়ে এসেছি।
ধান যব গম তিল আর নারকেলের মতই আমি এখানে ওকে যজ্ঞ বেদীতে আহুতি দিয়ে যাবো যাতে ও ফলে ওঠে উদ্গমের রীতিতে।
এ জীবন ধীরে ধীরে ফলবতী হবে।
আমি এসব কিছুই ওকে বলতে পারছি না, আমার কিছু এক্সপোসার কম্পেনশেশন দরকার।
এতো নীল চোখ ওর।
আমার ছিলা ছিঁড়ে যাবে একটি নতনীল পদ্ম ওর পায়ের কাছে রেখে যেতে।
শুভ ষষ্ঠী আজ। শুভ শুভ।
আমি সন্ধ্যারতিতে যাবো। তুমি আমাকে স্থলপদ্মের পাতা ছিঁড়ে দিও।
আমি বুকের মধ্যে রেখে দেবো।
আমাকেও আহুতি দেবে সে।
৫
সপ্তমী
…মরম মরমীতে মরমীয়া, বলে চলে গেলো সে…
আমি বললাম, ওই এক কাপড় দিয়ে বানানো, এক ধারে বোতাম, কাঠের। ওই রকম একটা কোথায় পাই?
-এতা পাউন দই ন।
আবার একটু থেমে, একটু ভেবে
-এম্পোরিয়ামমা গোএর খোঁজনু সকনু হুন ছ।
নতুন কাপড় চাই। এরকমই একটা। রোদেলা রঙের। তুলে রাখবো। যত্নে।
এবারই একটা আব্দার হলো। নিজের কাছে নিজের। নিজের একটা অনুমতিও পাওয়া গেলো। কিন্তু দশেরার ছুটি অনেকটা লম্বা। কোথাও কিছু নেই।
ফিরে আসছি, আসতে আসতে বেখেয়াল, পাহাড়ের দিকে মুখ করে ঝোলা বা স্রেফ দাঁড়িয়ে থাকা, জানলা দিয়ে মেলে রাখা সবুজ দৃষ্টি সব ছোটো বড় হোটেল আর হোম-স্টেগুলো দু পাশে ফেলে রেখে অনেকটা নিচে নেমে এসেছি।
হয়তো বা মনাস্ট্রী থেকে ক্ষীণ একটা ধাতব গং শব্দ উঠে আসছে। আর নিজে নিজেই থেমে থাকছে না আমার পা।
যখন টের পেলাম, শিঙা বাজছে একসাথে, অনেকগুলো। তাদের মিশ্র রাগানুলিপি। আর যেন দু পাশে পাইনের সারির মধ্যে দিয়ে রাস্তাটাও বেবাক আমাকে জড়িয়ে মড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে।
আজ রোদ। আজ সামান্য পাহাড়ের চূড়া ছুঁয়ে আলো। তার নিচে পাখিদের ছড়ানো সংসার, বিশেষত ঘাড়ে বুঁটি, গাল আর গলা ফোলানোরা, যারা প্রথমে একা এসেছিলো, পরে জোড়ায় বাসা বেঁধেছে।
আর তারও নিচে আমি। একা।
এইখানে আমি আসি। একা হতে আসি। এই বাঁকটার কাছে। পেরোই না।
দাঁড়াই। বুকের ভেতর থেকে পদ্মফুলের পাতা বের করি। যেখানে আঙুলে আঙুল লেগে আছে। ধুনোর গন্ধ আর প্রদীপের শিখা লেগে আছে।
শস্যদের, হলেও বা একদিনের, বেড়ে ওঠা লেগে আছে।
যাবে তো আজ? যজ্ঞ বেদির কাছে দাঁড়াবে তো?
এ আমার ভিতরের সাথে কথা বলা। কেউ কখনো আসে। তার স্থান ও কালে দাঁড়িয়ে উত্তর দেয়। কেউ নিরুত্তর।
তবে কথাগুলো থাকে। এই সব রঙীন ধ্বজায় লেখা স্তোত্রগুলোর মতো করে থেকে যায়। জল আলোয় যতক্ষণ না মিলিয়ে যায় আক্ষরিক বাতাসে, ততক্ষণ থাকে।
তুমি মাস বছর যুগ পেরিয়েও তাদের তরঙ্গে তরঙ্গে খুঁজে নিতে পারো।
আমি বসে থাকি। আজ রোদে পা মেলে বসেই থাকা। মনে পড়ে, ছাং আর পোড়া মাংস।
মাঝে মাঝে হাত ফেরত তামাক।
যারা চলে যাচ্ছে দূরে, দিয়ে যাচ্ছে কাছেদের।
আর কোথা থেকে উঠে আসছে ও।
– আজু পানি পরছ।
বৃষ্টি হবে আজ? তাই তো। কৃষ্ণ কালো হয়ে এসেছে চার পাশ।
আর আমার দেবী দৃশ্যত কুমারী সাযুজ্যে তার নগর নিবেশ ছেড়ে কাজল চোখ পাতাটিপের নিচে ভ্রমরের মতো ফুটেছে।
কতক্ষণ বসে আছি থেকে আজ বৃষ্টি হবে।
হবে বুঝি? ঠোঁট থেকে রং গড়িয়ে পড়বে।
বুক হয়ে হাতের পাতা বেয়ে নাভি হয়ে পায়ের পাতা পর্যন্ত যজ্ঞ-র আলো থেকে পবিত্র লাম্পট্য এই খুঁটে নেবো আমি আজ সব।
আজ সপ্তমী। শুভ সপ্তমী।
৬
অষ্টমী
তুমি চিকন শাদা মিহি তাঁতে সেজে উঠছো। একটা বড় সেফটি পিন খুঁজছো। আসলে অনেক দিন শাড়ি পড়ার অভ্যাস ছেড়েছো তারপর তোমার গেরস্থালী পেরিয়ে নেমে আসছো সিঁড়ি বেয়ে। অঞ্জলির ফুল কুড়িয়ে রেখে গেছি জেনেও ঈষৎ অবজ্ঞা করছো।
আমি তো অনেক দূরে একা একা হেঁটে যাচ্ছিলাম রাবডাংসের দিকে। তুমি জানতে চেয়েছো কী চাইবো আজ মণিপদ্মে বসে আছে যে, তার কাছে। ভোর রাত থেকে বৃষ্টি ধোয়া পাখিদের উদ্বেল সঙ্গম অথবা, পোকাদের খুঁটে খাওয়া এই আজীবন যা কিছুই আমি চেয়ে নিতে পারি।
আপাতত, একটা মৃদু নীল অর্কিড এই মাত্র যে ফুলের জন্ম দিলো, তার ভূমিষ্ঠ হওয়ার সূত্র ধরে আমি টের পাচ্ছি একটি আত্মজা ও তার গর্ভকেশরে রক্তপাত।
তুমি খেয়াল রেখো শাদা মিহি তাঁত পড়েছো আজ।
– তিমি কসোরি জান দা ছউ?
জানি তো আমি।
– মেরো বাইরপনি রাত ভিতরপনি রাত তর কুরা এউটাই হ।
আমি জানি না।
শুভ অষ্টমী। শুভ শুভ।
৭
নবমী
পাহাড়মুখো ঘর আমার
সকাল থেকেই জানলারা উড়ছে
পর্দার পেছন থেকে মথেরা
দিন আরো নিজেকে ছোটো করে নিলো
আলো কেটে দিলো
এই তো মেঘ ভেসে আসবে
পিছু নেবে কুয়াশা
তারও পিছু পিছু একটা দুটো গ্রাম ঢুকে পড়বে
ডেকে আনবে একটা ঝোরা
একটানা জলের শব্দ ভাসবে
কে যেন তারই মধ্যে দিয়ে হেঁটে গেলো
কার আজ ফেরার তাড়া
রঙীন বর্ষাতিতে লিখে এনেছে
মথেরা মজা পেলো
আমি বারান্দাটা দৈর্ঘ্যে একটু বাড়াবো
আর প্রস্থে কমাবো বলে
গা ঘামালাম
হাঁপিয়ে উঠলাম
নেশাকে সঙ্গে করে স্নানঘরে ঢুকলাম
শেষ বাসটা কোথা থেকে আসবে
কোথায় যাবে
মনে করতে থাকলাম
মনে করারা কিছু বিষণ্ণ হলো
এই তো ছাদ খুলে গেছে
কে যেন বলে বসলো
এবার জানলাগুলোকে ধরে আনতে হবে
মথগুলোকে পর্দায় বসাতে হবে
বারান্দাটাকে ঠেলেঠুলে আবার সোজা
মোদ্দা কথা রাত ফুরনোর আগে
আমাকে লিখে ফেলতে হবে
পলায়নপর ছুটি শেষের ঘোষণা
আর এই নির্দয় দয়াময়ীর কথা
৮
দশমী
….এই বৃষ্টিতে পুড়ে যাচ্ছি
ভিজে যাচ্ছি আগুনে….
একটা ঘনঘোর এলো। এসে ঢুকে পড়লো মাথার ভেতর। মুহুর্মুহু বাজ। ঝলসে যাচ্ছে নদী ও তার খুলে রাখা স্লুইস গেট। কষ্ট পাচ্ছো মেয়ে। এতো নগ্ন ও নির্জন। চলো পাড় ভাঙি। এই অবাক জলসত্র ভাঙি। নিশি ডাকুক। আজ তো তাদেরই দিন। তাদেরই রাত।
চাঁদ থেমে আছে। ব্রীজের ওপর ভারবাহী শকট। আমি টানছি, না, আমাকে টানছে এই মন্দ মধুর। তুমি ঝুঁকে পড়ছো যেখানে ঝিঁঝি ডাকছে। আমি দেখতে পাচ্ছি তোমার এক গালে বিলীয়মান আলো। আর এক গালে টোল পড়ছে আর ধরে রাখছে নিটোল বৃষ্টির এক বুঁদ।
তুমি ভাবছো, ভাবতেই থাকছো তোমার জাম রঙা শাড়ি বেয়ে উঠে আসছে ঢেউ। তোমার হাতের পাতায় ছায়া খেলছে। পায়ের পাতায় মুখ লুকোচ্ছে মথ।
আমি জানি এই নষ্ট নদীর কথা। তোমার ব্যথার কথা। তাই নিজেকে নিজের আগে জুতে নেবো। গুণ টেনে নিয়ে যাবো যেখানে বুড়ো কাছিম অনন্ত শুয়ে আছে।
দেখো ও পাড় ভাঙছে আর নিত্য সূত্র বলছে
এ পাড়ে পলি রূপ উঠছে জমে। অথচ, যা কিছু জমাট সন্নিবদ্ধ খুলে পড়ছে তোমার। নিশি ডাকছে। নিশি ডাকছে। তুমি বেরিয়ে পড়ছো তোমার ভেতর থেকে এক অপূর্ব বাহিরে। এই ডাক যেন শিশ দিয়ে উঠছে আর তুমি ফেরত যাচ্ছো তোমার শিশুকাল, কিৎ কিৎ খেলা। যেন ডিং মেরে ছুঁয়ে ফেলবে অনন্য এক রাধা চূড়ার বসন্ত। যেন ইন্দ্রিয় প্রীতি তোমাকে ঘিরে থাকবে চিরকাল।
আমার সামান্য আসা ও যাওয়ার মাঝে এই অসামান্য তুমি, তুমি হয়ে উঠছো।
নিশি ডাকছে, নিশি ডাকছে। তুমি শুনতে পাচ্ছো?
আমি এই বৃষ্টিতে পুড়ে যাচ্ছি আর ভিজে যাচ্ছি বৃষ্টির ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা আগুনে।
Posted in: March 2020, Poetry