গল্প : ইন্দ্রনীল সেন(গুপ্ত)

বিলাসিনীর কলিকাতা

এক

এ সবের অনেক দিন আগেই মন্মথ বিলাসিনীকে কথা দিয়েছিল। আজ ঠাকুরের পদপ্রান্তে, ওই দূরবর্তী পাহাড়শ্রেণী যে নীলাভ স্বচ্ছতায় চোখের সামনে, যেন এমন যে আঁকা হয়ে রয়েছে দুইদিন হল, ফলে কাগজের তুলোট বুননে সে ছবির চোখ এখনো সজল লাগে, তাকে বাতাস হেন তীব্র গতিতে পেরিয়ে মনে হবে এইতো, স্মৃতিতে ভর করেই যেন কুড়িটা বছর কেমন পেরিয়ে আসা গেল!
মন্মথ মিত্র জলের অনেকটা কাছে গিয়ে সিঁড়িতে বসে ছিল, ফলে উপলখণ্ডে বাধাপ্রাপ্ত জলের যে রেণু, জলকণার যে ক্ষুদ্র রেশ চোখে মুখে যেন হাত বুলিয়ে চলে যাচ্ছে, তাতে মন্মথর অসুবিধে না হলেও বিলাসিনীর হয়েছিল। তার পাতলা সাদা শাড়ি ক্রমে ভিজে ওঠার ফলে অনাবৃত শরীরে, নদীর জলের কাছে অনেকটা নীচ বরাবর যে সমস্ত মেঘরাশি খরস্রোতা জলের গতিতে পেরে না উঠে ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছিল, তাদের ঠাণ্ডা স্বভাব খানিক প্রশ্রয় পেয়ে থাকবে। বিলাসিনীর মধ্য বয়স সে কারণে উন্মনা হয়েছে এমন ভেবে নেওয়া যেতে পারে।
হৃষীকেশ শহরের অনতিদূরে বাঁধানো লনের দোতলা বাড়ির ছাতে সে সময়ে ভোর হচ্ছে বলে কুয়াশা ক্রমে কেটে যাচ্ছিল, মন্মথ দুই হাত ভাঁজ করে আকাশের সে সমস্ত আলোর দিকে তাকিয়ে থাকাতে বিলাসিনীর পাশে এসে দাঁড়ানো টের পায়নি…নীল আকাশ প্রাকারের কমলা বর্ণচ্ছটা ক্রমে নামহীন বর্ণনাহীন সে এক রঙে পালটিয়ে যেতে দেখে বিলাসিনী একরকম ফিসফিসিয়ে ওঠে মন্মথর কানে…‘আজ বাদে কাল যে স্বাধীন দেশের ওই, ওই স্বর্ণগোলোক, তাকে পুরোনো নামে ডাকা বোধহয় অনুচিত হবে,’…মন্মথ অগোছালো তাকিয়ে দেখেছিল বিলাসের প্রগলভতা তার মুখে সেই অগ্নিগোলকের আলোছায়া তৈরি করেছে…কিন্তু মন্মথর অন্যমনস্ক মন এহেন সকালকেও অপরিষ্কার বলে ভ্রম করলে পরে, স্মৃতির এলোমেলো সূত্র ধরে সে বিলাসিনীকে ফের খানিক দুঃখ দিয়ে ফেললে, ‘তোমরা সোনাগাছির মেয়েরা তো সেই সময়ে আন্দোলনে নেমেছিলে, তাই তোমার এই ইন্ডিপেন্ডেন্সের প্রতি ট্রু ফিলিং থাকলে তা অবাক করেনা, কিন্তু আমি! এই ইন্ডিপেন্ডেন্সে আমার অবদান কতটুকু?’ মন্মথ আরও বলে চলে কত কিছু…যেমন বয়স কিভাবে অগোচরে এতগুলি বছর কাটিয়ে দিলে যা সে টেরই পেলেনা, এছাড়া মন্মথ যেরকম উত্তর খুঁজে চলেছে, যে এই আনন্দঘন সময়ে কিভাবে অনায়াস প্রবেশ সম্ভব যখন তার নিজের শরীর থেকে সময়েরা সবাই জানান দিয়েছে, এবারে তো গেলেই হয়…কী লাভ এই দেশ এই সময়ের সাথে মনের এহেন গহিন উপস্থিতি, যখন শরীর এদেরকে চিনতে পারছেনা, আলাদা করতে পারছেনা কোনটা সুখ বা কোনটা দুঃখের অনুভূতি বলে!
বেলা পড়ে এলে বিকালের চা’য়ের সময় হলে পর বিলাসিনী জলের ধারে বসে মনের ভিতরে যে দুঃখের অনুভূতিসকল, তাদের উপরে ভর দিতে দিতে মাঝে মাঝেই অনেক বছর আগের ছেড়ে আসা কমলাদিদির ভাড়া বাড়িতে পৌঁছে যাচ্ছিল…এভাবে যাতায়াতও চলেছিল বেশ…এখন বিকেল হয়ে এসেছে বলে হিম আর কুয়াসা, এরা সবাই পাহাড়ের উপর থেকে নীচে নেমে আসছে দ্রুত…আর এই যে মা গঙ্গা…তোমার কাছে নিয়ে আসবে বলে কথা দিয়েছিল সেই কত বছর আগে…আমরা সোনাগাছির মেয়েরা, সে কথা না হয় সে ভুলতে পারেনা, তাহলেও সে তেমন দোষের হয়না। কিন্তু মা, আমাদের পুরনো পাড়ার ভিতর দিয়ে স্যাঁতলা গলি ধরে তোমার যেই ঘাটে আমরা মেয়েরা চান করতে যেতাম, যে অন্য নামে তুমি বয়ে চলেছো মাগো, সেও তো তুমিই হলে…ওখানে ডুব দিয়ে শরীরের পাপ যদি না ধুয়ে যায়, মা গো, এখানেও কি সে মুছবে?
বিলাসিনী ঠাহর করলে ভালোভাবে নদীর ওপারে অন্ধ মহারাজ না জানি কিসের দিকে চেয়ে রয়েছেন নির্নিমেষ, যেন স্থির সে অবয়ব, পাহাড় আর বন ভেদ করে ধীরে অন্ধকার নামবে খানিক পরে, আবার আরেকটা দিন শেষ হয়ে আসলে বিলাস শরীর ও মন থেকে বিগত দিনের সমস্ত কিছু ধুয়ে ফেলার বিশ্বাসকে সেভাবে আঁকড়ে ধরতে অসমর্থ হয়। ইতিমধ্যে নদীর স্রোতে গাছের বড় বড় গুঁড়ি ভেসে চলে হরিদ্বারের দিকে। অনেকগুলি বাকল সমেত গাছের দেহাবশেষ স্রোত আর উপলখণ্ডের মাঝে ধাক্কা খেতে খেতে কুড়ি মাইল দূরত্ব পাড়ি দিতে থাকলে মনে মনে আমোদ পায় বিলাসিনী, মোটর পথে চার মাইল কম পাড়ি দিলেই যেখানে পৌঁছে যাওয়া যায়…
মন্মথ হিসেব কষে, এবারে তো ওপারে যেতে হয়, কারণ অন্ধকার এখানে আচমকা নেমে আসলে এদিকে আবার হাতির পাল মাঝে মাঝে জল খেতে আসে, বিলাসিনীর দিকে চাইলে, দেখলে সে তাকিয়ে আছে মন্মথর হাতে ধরা গুপ্ত প্রেসের পঞ্জিকার দিকে, মন্মথর কোলের উপরে সে বই খোলা থাকায় বাতাস এলে তার পাতাগুলি আওয়াজ করে করে উলটে যাচ্ছে এক এক করে, একে একে পূর্ণিমা, অমাবস্যা, নিশিপালন, উপবাস, একাদশী, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত সরে সরে গেল, ক্রমে দিনের আলো মরে এলে পর দুজনে মিলে ঘরে ফিরলে…
রাতে মন্মথ বিছানায় শুতে এলে বিলাসিনীর ছাতে যেতে মন করে, ‘চাদরটা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিও বিলাস, নাহলে ওশ লেগে ফের ব্যামোয় পড়বে…’ আকাশে বোধহয় চাঁদ ছিল কোথাও, চারিদিক থেকে আলো এসে পাহাড় রাজির ছায়া সুনিবিড়, আর দুচোখ ছাড়িয়ে যদি চাইলে, তবে ফার পাইনের বনের ভিতর থেকে বাতাস এসে ফিসফিসিয়ে গেলে, ফের পঞ্জিকার পাতা অন্যমনস্ক বিলাসিনীর চোখের উপর থেকে সরে সরে যেতে থাকে…মিথুন, তুলা, মেষ আর বৃশ্চিক রাশির ঘাতচন্দ্র তুলা, শেষে ক্ষত্রিয় বর্ণ, রাক্ষস গণজাত, অষ্টোত্তরী শনি আর বিংশোত্তরী কেতুর দশা নিয়ে নাড়ি,আদি, যোনি, নক্ষত্র, হাঁস এসবের পাতা উলটে গেলে সেই রাজহংস, শ্বেত রাজহংস বিলাসকে নিয়ে ভেসে চলে কমলাদিদির দোতলা কোঠাবাড়ির দিকে…বিলাস মেঘের পাশে কন্যা মীন তুলা রাশির নক্ষত্রদের দেখতে দেখতে ভাবে আমাদের মসজিদ বাড়ির রাস্তা থেকেও তো এদেরকে দেখা যেত…সে এক বয়স ছিল, বিলাস আরো ভাবে, এই নদী, এই জল আর তার স্রোত আর এই সমস্ত তারাদের যেই শহরে দেখে এসেছি..কী লাভ বলতো এদেরকেই আবার অন্য জায়গায় খুঁজতে গিয়ে…শ্বেত রাজহংস কোনও উত্তর দেয়না…সমস্ত নক্ষত্র দোষ কাটিয়ে সে উড়ে চলে…

দুই

অঘ্রান মাসের শুরু তাই শীত শীত ভাব লাগে। শহর কলকাতায় সে সময়ে বেশ শীত পড়ত। কমলাদিদি বলে আগে আরো ঠাণ্ডা দিত বলে শীতকালে বাবুদের কাছ থেকে রেট বেশি নেওয়া যেত, বলে কমলাদিদির সে কী হাসি, বলে ঘরে ঢোকার আগে বাবুদের ডন বৈঠকের ধুম লেগে যেত, শরীর আর গরম হয়না…তেমন ঠাণ্ডা তোরা দেখিসনি।
কালীপূজা বলে আগের দিন কমলাদিদিকে বলে বিলাস কোন বাবু নেয়নি। এছাড়া সকাল থেকে দুপুর পেরিয়ে গেলে বিলাসিনীর মন উচাটন হয়। বিনি এদিকে বেঁকে বেঁকে এসে ডেকে যায়, ‘ও লো সই বিলাস…তোর ফুলঝুরি ত একনো এলেনা…’ বিলাস কপট মুখে অন্যদিকে তাকায়…জানালা দিয়ে ম্লান এক ফালি রোদ এসে ঘরে ঢুকছিল, সেই রোদের ভিতরে কমলাদিদির মোটকা বিড়াল এক ফালি তোষকের মতো পড়ে আছে। বিলাস পাখাখানি দিয়ে গুঁতো দিতে সে ঈষৎ বিরক্ত হয়ে বিলাসিনীর দিকে তাকালে বিলাসিনী রেকাব খুলে দুটি লবঙ্গ মুখে ফেলে পান খাওয়া লাল ঠোঁট ফুলিয়ে বিনির দিকে চায়… ‘মন্মথবাবু ফুলঝুরি হবে কেন বিনি…’, ‘ভুল বলেছি সই, তোমার মন্মথসবাবু কি ফুলঝুরি হতে পারে, সে তো হাউই…’ বিলাসিনী কপট রাগে পাখাখানি হাতে নিয়ে বিনিকে মারতে উদ্যত হলে তার অলস খোপা খুলে আসে, তেল মাখা চুল বিলাসিনীর কাঁধের একপাশে খুলে পড়লে বিনি হাসতে হাসতে পালায়। বিলাসিনী কান পাতলে শুনতে পায় মসজিদ বাড়ির দিকে আজ সন্ধেবেলা তুবড়ি জ্বালানো হবে বলে রাস্তায় সবাই তাই নিয়ে কথা বলছে, থেকে থেকে টুকরো কথাবার্তা ভেসে আসছে।
আহিরীটোলার বাড়ি থেকে বেরোতে আজ একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল মন্মথর। স্ত্রী মানদাসুন্দরীর ব্যারামটা আজ আবার বেড়েছে। সকালে কালী কবিরাজের সাথে কথা বলতে গিয়ে অনেকটা সময় চলে যায়। ফেরার পথে কুমোর পাড়ায় ডাকিনীদের ভয়াবহ অযত্নে তৈরি মূর্তি দেখে এসেছে। ট্রাইএঙ্গেলের মতো তাদের বিকৃত স্তন আর মুখময় রক্ত। কবিরাজ আজ একরকমে বলেই দিলেন ঔষধি কাজ করছে না। পথ্য ছাড়া এখন আর কোনও উপায় নেই। রোগী কালকেও চলে যেতে পারে আবার দশ বচ্ছরকাল এভাবেই কাটিয়ে দিতে পারে। মানদাসুন্দরী গতকাল রাত থেকে ঘোরের মধ্যেই আছেন, মাঝে মাঝে মন্মথকে ডেকে উঠছেন, ‘ওগো শুনছো তোমার বিলাসবউয়ের বাড়ি গেলে না…পূজোগন্ডার দিনে…’ বলেই মুখ দিয়ে গেঁজলা তুলছে আর ফের একটু জ্ঞান হতেই, ‘ও লো বেণুর মা…কপালের সিঁদুরটা একটু ভালো করে এঁকে দে দিকি…পূজোগন্ডার দিন বলে কতা…’ বাড়ির বারন্ডায় খাঁচা থেকে বুড়ো ময়নাটাও চেঁচাচ্ছে, ‘ভালো করে এঁকে দে…পূজোগন্ডার দিন…’
নির্লজ্জতায় মন্মথর কোন সমস্যা নেই। মানদাসুন্দরীকে মনের গভীরে নিয়ে ভাবলেও বিলাসকে মনে করতে গেলে তা অসুবিধের হয়না। একটি লাল লংকা খাঁচা্র জালের ভিতর দিয়ে ময়নার মুখে দিয়ে মন্মথ বলে যায়, ‘বামুন ঠাকুর, বিলাসের কাছে যাচ্ছি, বাড়াবাড়ি হলে কাউকে দিয়ে খবর পাঠাস’। কাউকে কিছু না বলে রাস্তায় নেমে আসে মন্মথ। বুড়ো ময়না চেঁচাতে থাকে, ‘বাড়াবাড়ি হলে খবর পাঠাস, বাড়াবাড়ি হলে খবর পাঠাস…’
শীতের প্রারম্ভে অলস দুপুরে মন্মথ আজ হেঁটে যাবে বলে ঠিক করে। নীল আকাশে আজ মেঘের লেশ মাত্র নেই, কিন্তু রোদের হলুদকে অসুখের মত মনে হয়। মনে হয় সে যেন জ্বরের জন্য অপেক্ষা করে আছে, সন্ধেবেলা যার কিনা আসার কথা, সমস্ত উত্তাপ শরীরে নিয়ে যদি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাও, দেখবে অমাবস্যার কালো এক সন্ধেবেলা, কালীপূজো বলে আতসবাজি আর হাউই-এর কেরামতি সব, তুবড়ি ছুটছে এইসান একটা শেষ না হতেই আরেকটা, বাঁইবাঁই করে চরকা ঘুরতে লেগেছে আর এদের সবার শেষে গন্ধকের কটু গন্ধ নিয়ে সেইসব উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে দেহ আর মন জুড়ে, যেন এক কালজ্বর বলে মনে হবে একে।
আজ চিৎপুরের দিকে না ঘেঁষাই ভালো, বাজারের ভিড়ে ওইদিকটাতে আজ হাঁটার জো থাকেনা। ছোকরাদের দল রাস্তার বিভিন্ন যায়গায় জটলা করে ফানুসের খোলের উপরে রঙিন কাগজ লাগাচ্ছে। সেন্ট্রাল আভেনিউ ধরে এগিয়ে খানিক দূর হাঁটলে ফের মানদাসুন্দরীর কথা মনে আসে তার। এ রাস্তার নাম পালটে গেছে কয়েক বচ্ছর হল। দেশবন্ধু মারা যেতে কর্পোরেশন থেকে এ রাস্তা তার নামে করে দিয়েছে বলে হালে সক্কলে সি আর আভেনিউ বলার চেষ্টা করলেও ভুলে যাচ্ছে খালি আর রাস্তার নাম সেন্ট্রাল আভেনিউই রয়ে যাচ্ছে।
মানদাসুন্দরীর কষ্টটাও ক্রমে মন্মথর নিস্তেজ রোদের মত লাগে। যে রোদের আঁচে আতপ্ত শরীরের অনুভূতি প্রবল হলে ভীষণ ভাবে নিজের বেঁচে থাকাটা অনুভব করা যায়, তা না হয়ে থেকে থেকে মৃত্যুর কথা মনে আসছে। মৃত্যুকে প্রবল অযত্নে বানানো ডাকিনীর মত মনে হলে মৃতকেও ট্রাইএঙ্গুলার স্তন নিয়ে বীভৎস এক ডাকিনীর মুখের মতো মনে হচ্ছে…মানদাসুন্দরীর স্মৃতি থেকে কুয়াসা আর শীতের মতো এক শীতল ঠাণ্ডা ভাব উঠে আসছে বলে মন্মথর এসময়ে দম বন্ধ হয়ে আসছে, আর তপ্ত সেই সমস্ত সন্ধেকালীন জ্বরকে অধিক প্রিয় বলে মনে হওয়ার দরুন বিলাসের কথা মনে পড়ছে। বিলাসকে আজ সন্ধেবেলা তুবড়ির খেলা দেখাতে নিয়ে যাবে বলেছে মন্মথ। বলেছে বড়বাজার থেকে হাউই কিনে আনবে। কিন্তু এই মরা মাছের মত দুপুর গড়িয়ে যেরকম ভাবে বিকেল আসছে সেই সময়গুলিকে ছুঁতে চেয়েও তারা যেন পাঁকের মাছের মত হাত থেকে পিছলে বেরিয়ে যেতে লেগেছে।
কমলাদিদির বাড়ি থেকে সেন্ট্রাল আভিনিউ দেখতে পাওয়া যায়। মন্মথও কমলাদিদি ডাকে তাই সে যে বয়সে মন্মথর থেকে বড় এমনটা নয়, আর সেভাবে হিসেব কষে দেখলে বেশ খানিক ছোটই হবে। কিন্তু এরকমই হয়, এরকমটাই দস্তুর।
কমলাদিদির বাড়ির রোয়াকে সকাল থেকে চণ্ডু টেনে ভোলা ঠায় শিবনেত্র হয়ে বসে আছে। মসজিদ-বাড়ির রাস্তায় ওদের পৈতৃক ভাঙের দোকান আছে কিন্তু দেখাশোনার অভাবে সে দোকান ঠিক উজিয়ে ওঠে না। ভোলাই মাঝে মাঝে বানিয়ে খায়। তবে কমলাদিদির পেয়ারের লোক। এটা সেটা কাজে কম্মে তো লাগেই, উপরে কোঠার নজরদারিও চলে। দিনকাল আর আগের মত নেই, ছেলে ছোকরারা বড় ফাজিল হয়েছে, দুদ্দাড় ঢুকে আসে, এ পাড়ায় এলে আগে অল্প বয়সীদের ভিতরে যে জড়তা বা লজ্জা থাকত তাও কেমন দিন দিন কমে যাচ্ছে, কমলার এমনটাই মনে হয়। ভোলা ঠায় বসে থাকে বলে কমলা বুকে বল পায়।
কমলাদিদির বাড়ির একতলা অন্ধকার লাগে, প্রথমে বাইরে থেকে ঢুকে দেখলে কিছুই দেখা যাচ্ছে না, ক্রমে চোখে সে অন্ধকার সয়ে গেলে মনে হবে হাড় আর শরীরের ভেতরে যেন নোনা লেগে গেছে, একমুহূর্তের জন্য এমনটাও মনে হতে পারে যেন এখান থেকে বেরিয়ে গেলেই ভালো।
কিন্তু আঁশটে এই দুপুর প্রায় শেষ হয়ে এসেছে বলে একতলার বাড়ির কোর্টইয়ার্ডে যে অতল এক চৌবাচ্চা রয়েছে, বিলাস তার জলে মুখ ঝুঁকিয়ে কিছু দেখছিল। দোতলার দেওয়ালের রঙ্গিন জাফরি কাঁচ ফেরতা রঙিন পানসে রোদ জলের উপরে এসে পড়ছে আর চৌবাচ্চার গভীর জলে যে মহাকাল মাগুর মাছ বাস করত, যার শ্যাওলা ধরা শরীরের উপর থেকে ঠাণ্ডা ভাপ উঠে এসে সেই চৌবাচ্চার জলকে থেকে থেকে আরও হিম শীতল করে তুলত, সেই মাছ একবার জল কেটে বেরিয়ে গেলে সে জাফরি রঙের আলোছায়া ভেঙে ভেঙে যেতে লেগেছে, এসময়ে বিলাসিনী মুখ তুলে চাইতে মন্মথকে দেখতে পেয়ে শুধোয়, ‘জানো এই চৌবাচ্চা নীচ দিয়ে আমাদের এই গঙ্গায় গিয়ে মিশেছে…’!
মন্মথ সারা শরীর দিয়ে হেসে উঠতেই যেন চারিদিকের অন্ধকার আর নিশ্চুপ থমথমে ভাব একটু সরে গেল, কিন্তু সেও ক্ষণিক। হাসি থামলে যেন থমথমে স্যাঁতলা ভাব দ্বিগুণ জ্বরের মত ফিরে এলো। ‘এতো হুগলী বিলাস…গঙ্গা সে কি জানো কোথায়…’ বিলাসিনী এত কিছু তো জানেনা, সে মাথায় হাত ঠেকায়… ‘কমলাদিদি বলে সব জলই যে এক…’ মন্মথ হাসতে হাসতে চৌবাচ্চার দিকে ঝুঁকে এলে বিলাসিনী বলে চলেছিল…‘গঙ্গা মা হয়…মাকে নিয়ে অমন কথা…ছি…তাও কিনা পূজোগণ্ডার দিনে…’ মন্মথ জলের উপরে আরও ঝুঁকে এলে সেই কালো জলের তলায় দেখতে পেলে মানদাসুন্দরী শুয়ে আছে, আর সে মহাকাল মাগুর ঠুকরে চলেছে মানদাসুন্দরীর ট্রাইএঙ্গুলার স্তন। মানদাসুন্দরী ধীরে ধীরে অতল চৌবাচ্চার তলা দিয়ে সেই মহামীনের সাথে যেই মাত্র নদী উজিয়ে সমুদ্র, সমুদ্র উজিয়ে সাগর, সাগর উজিয়ে নক্ষত্রমণ্ডলীর দিকে যাত্রা করবে বলে প্রস্তত হয়েছে কী হয়নি, মন্মথ ছিটকে চৌবাচ্চা থেকে সরে আসে। বিলাসিনীর হাত ধরে টেনে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে থাকলে অষ্টাদশীর কব্জিতে লালচে ছাপ পড়ে যায়। বিলাসিনী এ আকস্মিকতায় একটু হতচকিত হলেও অনায়াস ভঙ্গিতে তাকে লুকিয়ে ফেলে। নীচের তলার ঘর থেকে বিনির খিলখিলিয়ে হাসি ভেসে আসে… ‘কি ভুল করেছি লো…এত সত্যি হাউই বাজি…আসল রে সই…’।
ঘরের জানালা দিয়ে রোদ সরে গেছে, এখন শুধুই ম্লান দিনের আলো দেখা যাবে…মন্মথ যে সময়ে বিলাসকে বিদীর্ণ করেছিল সে অনুভূতি অন্য দিনের মত ছিল না, যা কিনা বিলাসিনী আর মন্মথ দুজনেই বুঝতে পারছিল। মনের আকস্মিক অনুভূতির তারতম্য, শারীরিক দৃঢ়তায় তার ছাপ রেখে যাচ্ছিল, ফলে বিলাসিনীও বুঝতে সক্ষম হয়েছিল আজকের এই শারীরিক নৈকট্য আর পাঁচটা দিনের মত নয়। মন্মথ আজ বিলাসিনীর ঘরে দিগভ্রান্তর মতোই আচরণ করেছে। এখন একটু খেয়াল হতে বুঝতে পারলে, সে বিলাসিনীর উপরে শুয়ে আছে, দরজার দিকে মুখ করে, এ উল্লেখযোগ্য, কারণ মন্মথ এ সমস্ত সময়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে পছন্দ করে। কিন্তু আজ, সময় এগোতে থাকলে বিলাসিনীর বোধহয় এবারে ব্যথা লাগে, সে আঃ করে উঠে মুখ কুঁচকে অস্ফুট স্বরে বলে একটু আস্তে, সে ভালো লাগার না সত্যি ব্যথার মন্মথ বুঝতে চেষ্টা করেও পারে না… কমলাদিদির বেড়াল আলনার সামনে ঠায় বসেছিল, বিলাসিনীর গলার কাতরানিতে সে অলস ভাবে চাইতে গিয়ে মন্মথর দিকে তাকিয়ে ফেলে। মন্মথ চোখ সরিয়ে নিয়ে আলনার পাশে দেওয়ালে ঝোলানো গুপ্ত প্রেসের বাংলা ক্যালেন্ডারের দিকে চোখ রাখলে। কিন্তু চোখের দৃষ্টির বাইরের অংশ যেন দরজায় কোন এক ধরনের চলাচল অনুভব করে খেয়াল করলে নীচের চৌবাচ্চার একটি কাছিম কী উপায়ে গুটি পায়ে উপরে উঠে এসেছে, ঘরের ভিতরে যে আলো আঁধারি ধীরে ধীরে নামবে বলে মনস্থির করেছিল তারাও যেন এক অনুপলের জন্য থমকে দাঁড়াতে, কাছিমটি মুখ তুলে ওদের দুজনের দিকে চেয়ে আছে, এমনটা মন্মথর মনে হল।এক ঝটকায় বিলাসিনীর শরীরের উপর থেকে নিজেকে নামিয়ে এনে হাঁপাতে থাকলে বিলাসিনী কী হল কী হল বলে উঠতে উঠতে, চৌবাচ্চায় পোকা খেয়ে ফেলার জন্য পোষা কাছিমটিকে দেখতে পেতে আরে গোবিন্দ, তুমি কী দেখতে এসেছ শুনি…খালি খালি বিরক্ত করা…এমন বলতে বলতে তাকে হাতে তুলে নিয়ে দরজা খুলে বারণ্ডা উজিয়ে সিঁড়ির কাছে গিয়ে বিনি…এই বিনি…বলে ডেকে উঠতে থাকলে মন্মথ চোখ বন্ধ করে…
বারন্ডা থেকে হাসির শব্দ আর ফিসফিসিয়ে কথার ফাঁক দিয়ে দূরদূরান্ত থেকে মাঝে মাঝে দু চারটে শব্দ বাজির আওয়াজ কানে আসে…চোখ বন্ধ করে থাকতে গিয়ে ধীরে ধীরে ঘুম নেমে আসে মন্মথর চোখে…যদিও সে সময়ে তাকে তন্দ্রা বলে…সেই আধো তন্দ্রার অতল থেকে জ্বর আর অস্বস্তির বুননে যে ভালবাসার অভিব্যক্তি প্রকাশ পেল না, সেই সমস্ত ভীষণ শারীরিক উপস্থিতি শরীরকে আতপ্ত করে তুলতে লাগলো। তন্দ্রা ভাঙতে সে এক ভীষণ টেম্পারেচার, মাথা ভারী লাগে, তাও ঘাড় ঘুরিয়ে জানালায় চোখ রাখলে আকাশের দিকে তাকায় মন্মথ। বিলাসিনী অস্ফুটে গান গেয়ে মাথার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিল। বিলাসের চুল থেকে যে তেলের গন্ধ ভেসে আসছিল সেই গন্ধ মৃত্যুর মত মনে হয় মন্মথর। না না এ সেই মৃত্যু নয়, বরং এই সমস্ত দিন, যারা চলে যাচ্ছে কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে, সবাই পাল্লা দিয়ে পালটে যাচ্ছে পা মিলিয়ে আর এইভাবে বারোয়ারী দিনগুলি, এই শহর কলকাতা, সমস্ত ভাবনাকেই একটা তেতো শেষ বলে মনে হয় মন্মথর, যেন কোন গ্র্যাঞ্জার থাকার কথা কোনদিন ছিলও না।
‘এটা কি গান গাইছ বিলাস…’ বিলাস বলে পুরনো দিনের একটা গান…গেল হপ্তায় যে ছোকরা এসেছিল…এমন ভর সন্ধেতেই তো…বলে কী মনে হতে থেমে যেতে…বাকি গানখানি গাইতে লেগেছে…

সই সেই কালো চোখে সজল তরীখানি
যদি ছাড়িয়া দিলেম আমার চোখের জলে
তবে শ্রাবণ উজানে আজ এ দিবসে সই
কেমনে আঁখি রাখি সে জলে মন বেঁধে…

ঘরে সে সময়ে নিভৃত অন্ধকার নেমে এসেছিল, বিলাস ডান হাতে ভর দিয়ে বাম তর্জনীর অগ্রভাগে মন্মথর বাম বাজুতে ঢেউ খেলান আঁকিবুঁকি কেটেছিল বোধকরি, কারণ মন্মথ বিলাসিনীর চুল মুঠো করে তীব্র সে কেশতৈলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে জিজ্ঞেস করলে…বিলাস তোমার নদী খুব প্রিয় তাই না…তোমায় আমি গঙ্গা নদী দেখাতে নিয়ে যাব…সেই হরিদ্বারে…যেখানে দেখবে উপলখণ্ডে জল কেমন আটকা পড়ে থাকে, তারপর সেই প্রবল গতিপথে উড়িয়ে নিয়ে যায় সবকিছু, সমস্ত কিছু ভেঙে তছনছ করে দিয়ে অবশেষে শান্ত হয়ে সে অন্য নাম নিয়ে আমাদের শহরের পাশ দিয়ে বয়। মন্মথ আকাশে চোখ রাখলে দেখতে পায়, শহরের সন্ধে আকাশের বুকে একটার পরে একটা ফানুস উড়ছে…
মন্মথর চোখের সামনে দিয়ে শুধু তার নয়, বিলাস, কমলাদিদি আর তার বিড়াল, কাছিম, এই সোনাগাছি, মানদাসুন্দরী, ও বাড়ির বুড়ো ময়না, কলকাতা শহর সব্বার, সব্বাইকার বয়স যেন ছুটতে লেগেছে…কেউ যেন এই পৃথিবীর বাসিন্দাই নয় এমন, তাই সবাই মিলে স্যাজিটেরিয়াস, ক্রাক্স, উরসা মেজর, গামা পেগাসি আর ওরাইঅন, আলফা অ্যানড্রোমেডির পাশ দিয়ে ছুটে চলেছে…কে আগে বয়স্ক হয় তার কম্পিটিশন যেন, একে এমন মনে হবে…বিলাসিনী শুধোয়… ‘ও তো শুনেছি দেবস্থান…আমাদের কে থাকতে দেবে সে শহরে…’ মন্মথ কথার উত্তর দেয় না। শুধু ঘরের ভিতরে অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসে, বিড়ালটা ঘর থেকে বেরোবে বলে মাঝে মাঝে ডেকে ওঠে, চারিদিকে আতসবাজির রোশনাই আর অঘ্রান মাস তাই শীত আসছে বলে সমস্ত কুয়াসা টুয়াসা হিম গন্ধক বাষ্প এদেরকে সরিয়ে নিভতে নিভতে একটি ফানুস অনেক অনেকটা উপর থেকে ধীরে ধীরে আমাদের শহর কলকাতায় নেমে আসছে…

[লেখক – ব্যাঙ্গালোর প্রবাসী, পেশায় উচ্চতর গণিতের কনসালট্যান্ট ও তথ্যচিত্র নির্মাতা, সম্পাদক।রাবণ প্রকাশনা থেকে পূর্ব প্রকাশিত বই ‘শহরে অনুপস্থিত দৃশ্যাবলী’ (২০১৬) ও ‘শহরবিলাস’ (২০১৯)।]

Facebook Comments

Posted in: March 2020, Story

Tagged as: ,

Leave a Reply