ধর্মবিশ্বাস এবং ধর্মনিরপেক্ষতার সহ-অবস্থান : গার্গী চক্রবর্তী

আজকের জনজীবনে এই বিষয়টি খুবই প্রাসঙ্গিক, কারণ ধর্মবিশ্বাস ধর্মান্ধতায় পরিণত হচ্ছে এবং দ্বিতীয়ত: রাজনীতির মধ্যেও ধর্মোন্মাদনা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনকে অশান্ত করে তুলছে।

ধর্ম আমাদের ব্যক্তিজীবনে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। অনেকের মতে ধর্ম অর্থাৎ ঈশ্বর, ভগবান, আল্লা, God একপ্রকার Illusion অর্থাৎ মোহ বা মায়া। আমি দার্শনিক তত্ত্বে যেতে চাই না। কিন্তু আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ধর্ম একটা support system অর্থাৎ অবলম্বন হিসাবে কাজ করে। ধর্ম এক ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বস্তু। তাই সুখে এবং বিশেষ করে দুঃখে অথবা সংকটের সময় মানুষ তাদের নিজ নিজ আরাধ্য দেবতাকে স্মরণ করে, প্রার্থনা করে। নিরাকার ঈশ্বরের ভাবনা সাধারণ মানুষের পক্ষে সহজ নয়। তাই কোনো না কোনো দেব বা দেবী মূর্তির শরণাপন্ন হতে হয়। নানা শাস্ত্রের নানা মন্ত্রের সাহায্যে প্রার্থনা করে থাকেন। অনেকক্ষেত্রে পুরোহিতের মাধ্যমে ঈশ্বরের সঙ্গে যোগ স্থাপনা হয়। ভগবানের সঙ্গে এই যে monologue স্বগতোক্তি তার মূল আধার হল বিশ্বাস। আমাদের দেশের বহু বরেণ্য মানুষ ধর্মকে দেখতেন এক আধ্যাত্মিক চেতনা নিয়ে, আত্মোৎসর্গ মনোভাব নিয়ে; total surrender।

ধর্মের একটা দিক আধ্যাত্মিকতা। ভগবানকে বিশ্বাস না করেও মানুষ আধ্যাত্মিক হতে পারেন। এই বিষয়ে সম্প্রতি Peter Hechs নামে এক আমেরিকান ঐতিহাসিক তার বই, “Spirituality Without God”-এ বলেছেন, বেশির ভাগ লোকের ধারণা যারা ভগবানে বিশ্বাস করে না, তারা আধ্যাত্মিক হতে পারে না। নাস্তিক লোকেদেরও সেই ভাবনা জাগ্রত হতে পারে একাকী সমুদ্রতীরে বা অরণ্যে হেঁটে। যোগাসন বা tai-chi ইত্যাদির মাধ্যমে মানসিক উন্নতিসাধন (enlightenment) সম্ভব। গৌতম বুদ্ধ বলেছেন, ঈশ্বর বাইরে নেই। তোমার অন্তরের মধ্যে রয়েছে। তাকে প্রকাশিত কর। রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই নিরাকার ঈশ্বরের সন্ধান উনি পেয়েছেন প্রকৃতির মধ্যে। অনন্ত আকাশে নীরবে সে কী বিপুল অনুভূতি!

আধ্যাত্মিক চেতনা হল ধর্মবিশ্বাসের মূল কথা। আমাদের মত সাধারণ মানুষ আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আত্মশুদ্ধির প্রয়াস করি। কিন্তু ধর্মবিশ্বাসের আরেকটা দিক হল নেতিবাচক—অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, ছোঁয়াছুঁয়ি, জাতপাত ইত্যাদি। আমরা ভুলে যাই ধর্মের ভুল ভাবনা। ঐ সব উপসর্গ নিয়ে প্রাত্যহিক জীবনে ভগবানকে যান্ত্রিকভাবে (mechanically) স্মরণ করি। সেই যান্ত্রিকতায় আপাতত দৃষ্টিতে ধার্মিক মনে হলেও অনেক অন্যায় মানুষ করে, মিথ্যাচার, হিংসা, কুটিলতা, ঘৃণা ইত্যাদি। পারিবারিক জটিলতা থেকে শুরু করে জাতপাতের ব্যবধান এবং সর্বোপরি অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি দূরত্ব স্থাপনা। সর্বদা শোনা যায় ‘ওরা’ এবং ‘আমরা’, শোনা যায় তেলে জলে মিশ খায় না প্রবাদ।

ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতি জড়িয়ে। ভিন্ন ধর্মের সংস্কৃতি তার নিজের স্বকীয়তায় প্রস্ফুটিত। দুর্গাপুজো যেমন বাঙালীর উৎসব, যার মধ্যে রয়েছে সর্বজনীনতা। শরতের এই উৎসবকে শারদীয়া উৎসবও বলা হয়। পাড়ায় মুসলমান বা খ্রিষ্টান পরিবারের মানুষেরা, শিশু বৃদ্ধ নির্বিশেষে প্যান্ডেলে ভিড় করতো। এখনও নিশ্চয় হয়। ২৫শে ডিসেম্বর শিশুদের সান্তা ক্লজ-এর বিস্ময় এবং বড়দিনের কেকে ধর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। পার্ক স্ট্রিট অঞ্চলে ভিড়, আলোয় সজ্জিত কলকাতায় সবার মিলনস্থান। ঈদের দিনে সিমাই পায়েস বা বিরিয়ানির নিমন্ত্রণ শুধুমাত্র নিজের সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমিত থাকে না। এই হল আমাদের cosmopolitan, সর্বজনীন সংস্কৃতি।

সমস্যা হয় যখন ধর্মের গণ্ডী শুধু শাস্ত্র বা scripture-এর মধ্যে আবদ্ধ থাকে। নানা নিয়ম অনুষ্ঠানের পারস্পরিক রীতি রেওয়াজ থেকে আমরা বেরোতে পারি না। আমাদের সংবিধান রচয়িতা ড: বি আর আম্বেদকার মনুস্মৃতির কঠোর সমালোচনা করেছেন। কারণ ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য অন্যজাতের মানুষদের দূরে সরিয়ে রাখে। অব্রাহ্মণ কেন পুরোহিতের কাজ করতে পারবেন না, সংস্কৃত বিশারদ ও ধর্মপ্রাণ হয়েও। এখনও ধর্ম মেয়েদের নিম্নস্থানে রেখেছে। মেয়েদের জন্য নানা নিষেধ সর্বধর্মেই। শবরীমালা মন্দিরে এক বিশেষ বয়সের মহিলাদের যাওয়া নিষিদ্ধ। তার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে নিয়ে কত বিরোধ। আসল কথা, ধর্মের অন্দরে আমরা যাই না। বাইরের নানা যুগের রীতিনীতি নিয়ে এতই আবদ্ধ, যে ভগবান, আল্লা বা গড-এর সঙ্গে মানসিক যোগাযোগ স্থাপনা সম্ভব হয় না। পথে ঘাটে ছোট ছোট মন্দির, কালী, শীতলা, মনসা। আসা যাওয়ার পথে একটু পয়সা ছুঁড়ে ঢপ করে মাথা ছুঁইয়ে চললাম। এ কোন ধরণের প্রার্থনা, কোন ধরণের সমর্পণ? এ কী কেবলমাত্র সংস্কার বা কুসংস্কার, বিশ্বাস না অযৌক্তিক অন্ধবিশ্বাস? শিক্ষার হার বাড়লেও মানসিক ভাবে যুক্তিবাদী এবং প্রকৃত ধার্মিক অর্থাৎ আধ্যাত্মিক হতে পারছে কি এ’যুগের প্রজন্ম?

এই প্রসঙ্গে বাঙালীর গর্ব রবীন্দ্রনাথের কাছে যাই। উনি ছিলেন গান্ধীজীর মতই সর্বধর্মের সাধক। ধর্ম চেতনা যখন ধর্মান্ধতায় রূপান্তরিত হয় রবীন্দ্রনাথ তীব্র নিন্দা করেছেন। একটি চিঠিতে লেখেন — ‘এই মোহমুগ্ধ ধর্মবিভীষিকার চেয়ে সোজাসুজি নাস্তিকতা অনেক ভালো। … আজ মিছে ধর্মকে পুড়িয়ে ফেলে ভারত যদি খাঁটি ধর্ম, খাঁটি নাস্তিকতা পায়, তবে ভারত সত্যিই নবজীবন লাভ করবে।’ চারপাশে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা হিংসা এবং ধর্মের নামে রাজনীতি দেখে উনি বীতশ্রদ্ধ হয়ে কলমের মাধ্যমে সোচ্চার হলেন। ‘ধর্মমোহ’ কবিতায় উনি লিখলেন –

“ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে
অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে
নাস্তিক সেও পায় বিধাতার বর
ধার্মিকতার করে না আড়ম্বর।”

এই ধর্মের আড়ম্বর দেখে প্রাসঙ্গিকতার নিরিখে অনেক প্রশ্ন এসে মনের মণিকোঠায় ভিড় করে। ভারতবর্ষ নানা জাতি, নানা ধর্মের, নানা ভাষার, নানা সংস্কৃতির দেশ। প্রাচীন ইতিহাস থেকেই দেখে এসেছি ঘৃণা, যুদ্ধ, হিংস্রতা এমনকি প্রতারণা। রামায়ণে সীতার প্রতি রামের ব্যবহার, অগ্নিপরীক্ষা বার বার, গর্ভ অবস্থায় সীতাকে না জানিয়ে বনবাসে পাঠিয়ে দেওয়া থেকে সেই রাবণের ছেলে মেঘনাদকে প্রতারণা করে হত্যা করা—এই সব নিয়ে কত লেখা আমরা পড়েছি। বিদ্যাসাগরের ছোটোদের জন্য লেখা সীতার বনবাস মনের মধ্যে চিরকালের মত সীতার জন্য করুণা সহমর্মিতা জাগিয়ে তোলে। উত্তর ভারতে রামচন্দ্রকে যতই ‘মর্য্যাদা পুরুষোত্তম’ বলে পুজো করে, বাঙালীর মনে সেই সীতার করুণ মুখখানিই ভেসে ওঠে। মহাভারত সেই যুগের কাহিনী। অর্জুনকে উপদেশ শ্রীকৃষ্ণের সেই ভগবদগীতা। মনে পড়ে কর্ণ-কুন্তীর কথোপকথন। মনে পড়ে অভিমন্যুকে কেমন করে বধ!

যুগে যুগে যুদ্ধ। মধ্যকালীন ইতিহাসে আরব ব্যাপারীদের আগমন। লড়াই সর্বদা ধর্মের জন্য নয়। বহুক্ষেত্রে ধনসম্পদের জন্য। যে কারণে মন্দির আক্রান্ত হয়েছে, কারণ সবাই জানেন মন্দিরে ভরা থাকতো ধনসম্পদ। এখনও বড় বড় মন্দিরে অর্থভাণ্ডার প্রচুর। সে আরেক ইতিহাস। আরব, তুর্কী, মোঘল, আফগান সবাই এলো। যেমন সারা পৃথিবীতে সর্বদা এই পরিক্রমা চলেছে। আমেরিকায় কারা এসেছে, কোথা থেকে? ব্যাপারীদের সঙ্গে এসেছে ইসলাম ধর্ম, এসেছে সংস্কৃতি, স্থাপত্যকলা, সঙ্গীত, চিত্র শৈলী, ভাষা। এই সমন্বয়ে আমাদের সংস্কৃতি হয়েছে সমৃদ্ধশালী। মধ্যযুগে লড়াই হয়েছে — কৃষকে জমিদারে, আদিবাসীদের সঙ্গে এমনকি রাজা নবাবদের মধ্যে। শিবাজীর সেনাপতিরা ছিলেন হিন্দু, ওদিকে আকবরের সেনাপতি হিন্দু। মুসলমানরা বিদেশী নয়। এই মাটিতেই তাদের জন্ম। ব্রিটিশদের মত উপনিবেশ স্থাপন করে ধননিষ্কাষণ (drain of wealth) ও মানুষদের মধ্যে ‘বিভাজন ও শাসনের’ (divide and rule) রাজনীতি করেনি। বরঞ্চ এক ঐতিহ্যময় সংস্কৃতির রসদ দিয়ে এই দেশের অঙ্গীভূত হয়েছেন। যদি জানতে চাওয়া হয়, ভারতের মূলবাসী কারা? তারা হলেন আদিবাসী, যেমন আমেরিকার ক্ষেত্রে রেড ইন্ডিয়ানরা।

এই ইতিহাসের পাতাগুলো ওল্টানোর প্রয়োজন ছিল। কারণ ‘আমরা’ এবং ‘ওরা’র রাজনীতি নিয়ে আসে ব্রিটিশরা। যদিও খ্রিষ্টান মিশনারিদের অবদান ভুললে চলবে না। সে আরেকটা অধ্যায়। কেরালা দিয়ে তাদের প্রথম আগমন। ব্রিটিশরা ১৯৩৭ সালে Muslim Personal Law তৈরি করে, কোরান-এর ভিত্তিতে নয়, শরিয়তের উপর নির্ভর করে। হিন্দুদের মনুস্মৃতিই হোক, Muslim Personal Law এবং Christian Personal Law – সবই কিন্তু মহিলাদের পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোয় পিছিয়ে রেখেছে। যদিও মহিলারা মূলত: ধর্মপ্রবণ, কিন্তু কোন ধর্মই তাদের উচ্চ স্থানে বসায়নি। Wendy Doniger ইতিহাসকার, তার বই ‘On Hinduism’-এ সঠিক বলেছেন—“women never found favour with any of the world’s religions, or with their priests and prophets.” (Wendy Doniger, ‘On Hinduism’, Rupa, New Delhi, 2013, P. 59) যাইহোক মহিলারা শিকার হয়েছেন ধর্মগুরুদের প্রতারণার। সবচেয়ে ভুক্তভোগী হয়েছেন ধর্ম নিয়ে রাজনীতির লড়াই বা খেলায়। স্বাধীনতা আন্দোলনে বহু বহু মানুষের সক্রিয় ভূমিকা, বলিদান, মহিলাদের আত্মত্যাগ সবই বৃথা হল যখন দেশভাগ হল ধর্মের রাজনীতির জন্য। দেশভাগে সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সর্বধর্মের মহিলারা।

তাই আগামী অধ্যায়ে বলতে চাইবো সংক্ষেপে কেন এমন হল এবং তার পরিণাম কী হলো।

আমাদের রাষ্ট্রনেতারা গান্ধীজী, মৌলানা আজাদ, সুভাষচন্দ্র বসু, চিত্তরঞ্জন দাশ, জওহরলাল নেহেরু, সর্দার প্যাটেল এবং বি. আর. আম্বেদকার এবং রাষ্ট্রনেত্রীরা এ্যানি বেসান্ত, সরোজিনী নাইডু, কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়, নেলী সেনগুপ্তা, অরুণা আসফ আলী প্রত্যেকে আমাদের সাম্প্রদায়িক একতার জন্য লড়াই করেছেন, হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করেছেন। হিন্দু-মুসলমান একতা ছিল মূল মন্ত্র। তবু আবাদের জাতীয় আন্দোলনের মূলধারার সঙ্গে একটা ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক ধারা ছিল, একদিকে মুসলিম লীগ অন্যদিকে হিন্দু মহাসভা ও আর এস এস। এই ধারায় একদিকে হিন্দু মহাসভার সাভারকরের ‘হিন্দুত্ব’ পুস্তিকা, যা প্রকাশিত হয় ১৯২৩ সালে এবং অন্যদিকে মুসলিম লীগের ধর্মীয় চেতনার উন্মেষ। রাজনীতিতে ধর্মকে নিয়ে এসে প্রচারিত হল দ্বিজাতীয় তত্ত্ব (Two Nation Theory)। সাংগঠনিক ভাবে এর প্রথম উপস্থাপনা হয় ১৯৩৭ সালে হিন্দু মহাসভার ১৯তম অধিবেশনে আহমেদাবাদ শহরে। সাভারকর দ্বিজাতীয় তত্ত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে যা বলেন তার কিছুটা উদ্ধৃত করছি – “India cannot be assumed today to be a unitarian and homogenous nation, but on the contrary there are two nations in the main the Hindus and the Muslims in India.” (Collected Works of Savarkar, 1963, p. 296)। জিন্নাহ ও মুসলিম লীগের নেতাদের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর ভারতবর্ষ হিন্দুরাজ হবে এই আশঙ্কা দৃঢ়বদ্ধ হল। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে পাকিস্তান প্রস্তাব পাশ হয়। সাভারকর এবং জিন্নাহ একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠলেন। স্বাধীন সংগ্রামের মূলধারা কংগ্রেসের মুসলিম সদস্যরা পাকিস্তান প্রস্তাবের তীব্র প্রতিবাদ করেন। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে সাধারণ মুসলমান মহাসভা হিন্দু এবং কংগ্রেস হিন্দুর মধ্যে পার্থক্য করতে পারত না। গান্ধীজী ও জিন্নাহ আলোচনার জন্য বার বার বসলেন। কিন্তু কোন সুরাহা হল না। ১৯৪০ সাল থেকে RSS ও হিন্দু মহাসভার ‘Militias the Hindus’ ইত্যাদি কার্যকলাপে মুসলমানরা আতঙ্কিত হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকায় হিন্দুদের হিন্দু স্বাভিমান এবং তাদের identity-এর প্রশ্নে হিন্দুরাষ্ট্রবাদীরা জোরদার বলেন। এরা মনে করতেন, কংগ্রেসের অহিংস নীতি হিন্দুদের ভীরু করে তুলছে ইত্যাদি।

অবশেষে দেশভাগ হল। স্বাধীন ভারতের সংবিধান তৈরি করবার দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী নেহেরু দিলেন Dr. B R Ambedkar-এর হাতে। প্রথম মন্ত্রীসভার সদস্য হিসাবে, যদিও তিনি কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন না, এই বিরাট দায়িত্ব সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর RSS ও Hindu Mahasabha আশা করেন ভারত হিন্দু রাষ্ট্র হবে যেমন পাকিস্তান Islamic State হল, শুধুমাত্র গরিষ্ঠতার সুবাদে। RSS-এর মুখপত্র Organiser ১৪ই আগস্ট ১৯৪৭ নিজেদের বক্তব্য রাখে সম্পাদকীয়তে, যা থেকে পরিষ্কার যে হিন্দু রাষ্ট্রবাদীরা স্বাধীন ভারত হিন্দু রাষ্ট্র হয় তাই চেয়েছিলেন — “Let us no longer allow ourselves to be influenced by false notions of nationhood. Much of the mental confusion and the present and future troubles can be removed by the ready recognition of the simple fact that in Hindusthan, only the Hindus formed the nation and the national structure must be built on that safe and sound foundation … the nation itself must be built up of Hindus, Hindu traditions, culture, ideas and aspirations.”

কিন্তু আম্বেদকার ধর্মনিরপেক্ষ ভারত – এই সংবিধান তৈরি করলেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের মূলধারা ছিল ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে। আমাদের সকল রাষ্ট্রনেতারা ধর্মকে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের অঙ্গ মনে করতেন। আমাদের যুগযুগের ইতিহাস দেখিয়েছে — আমরা বহুজাতিক, বহুধর্মীয়, বহুভাষিক দেশ। তাই সংখ্যা গরিষ্ঠতার অজুহাতে দেশের রাষ্ট্র হিন্দু রাষ্ট্র হতে পারে না। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূলধারার ভাবনার সম্পূর্ণ বিরোধী ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র।
জানতে হবে আম্বেদকার কী বলেছেন। আম্বেদকার স্বাধীনতার অনেক আগে ওনার Pakistan or The Partition of India পুস্তকে হিন্দু রাষ্ট্রের ভাবনাকে সম্পূর্ণ ভাবে নাকচ করেন। তিনি লেখেন: “If Hindu Raj does become a fact, it will no doubt be the greatest calamity for this country. No matter what the Hindus say, Hinduism is a menace to liberty, equality and fraternity. On that account it is incompatible with democracy. Hidu Raj must be prevented at any cost. (পৃ: ৩৫৮) হিন্দু ধর্মের প্রাধান্যের উপর বিরক্তির কারণ ব্রাহ্মণদের আধিপত্য, জাতপাতের ক্রমোচ্চ শ্রেণীভাগ — এর উনি কঠোর বিরোধী ছিলেন। তাই সমান অধিকার হবে কি করে? সেই জন্য গণতন্ত্রের কার্য্যকারিতায় ধর্মনিরপেক্ষতা অপরিহার্য্য। নানা জায়গায়, বিভিন্ন parliamentary debate-এ উনি এই মত বার বার প্রকাশ করেছেন। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের পরিভাষা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে উনি বলেন : “It (secular state) does not mean that we shall not take into consideration of the religious sentiments of the people. All that a secular state means that this Parliament shall not be competent to impose any particular religion upon the rest of the people. That is the only limitation that the constitution recognizes.” (উদ্ধৃতি in Shyam Chand, Dr. Ambedkar on Democracy, Mainstream, December 11, 2007) উনি নানা লেখায় বলেছেন, গণতন্ত্রে সংখ্যালঘু যেন সংখ্যাগরিষ্ঠ অত্যাচারের শিকার না হয়। In democracy, minority does not become the victim of the tyranny of the majority.
গণতন্ত্রের অর্থ সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন নয়। গণতন্ত্রের অর্থ সকল জনতার শাসন, তার মধ্যে বিরোধীর বা যারা সংখ্যাগরিষ্ঠের মত পোষণ করেন না, তাদেরও স্থান আছে। এ শুধু ধর্মভিত্তিক নয়, মতবাদভিত্তিক। সেইখানে দুটো বিষয়ে আলোচনা প্রয়োজন। এক, সরকারের বক্তব্যের সঙ্গে একমত না হলেই, দেশবিরোধী anti-national ইত্যাদি বলা আমাদের সংবিধানবিরোধী। সংসদীয় গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আম্বেদকার বলেন: “…in the working of democracy there must be no tyranny of the majority over the minority. The minority must always feel safe that although the majority is carrying on the government, the minority is not being hurt…” (Balchandra Mungekar edited ‘The Essential Ambedkar’, p. 297) অর্থাৎ সংসদীয় রাজনীতিতে সংখ্যালঘু মত বা যাকে বলে বিরোধীমত তাকেও মর্য্যাদা দেবার কথা বলছেন। বিরোধী মতবাদের বা ভিন্ন মতবাদের একটা জায়গা থাকবে গণতন্ত্রে। আম্বেদকারের গলায় মালা দেন বা তাঁকে নিয়ে সব রাষ্ট্রনেতারা অনুষ্ঠান করেন। কিন্তু আম্বেদকারের বক্তব্যের মর্য্যাদা করেন না।

দুই নম্বর, ঠিক এই ভাবে ধর্মের ভিত্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও সংখ্যালঘুর উপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া যায়না। ভারতবর্ষে বর্তমানে প্রায় ৮০% হিন্দু এবং ১৪% মুসলমান, ৪% খ্রিস্টান ইত্যাদি। তাই আমাদের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের প্রশাসনে, রাজনৈতিক জীবনে কোনো বিশেষ ধর্মের প্রাধান্য অনুচিত। প্রথম কথা হিন্দু হয়ে জন্মালেই যে হিন্দুরাষ্ট্রবাদী হতে হবে, তা নয়। মুসলমান হয়ে জন্মালেই মুসলিম রাষ্ট্রবাদী হতে হবে, তা নয়। এক জায়গায় সবার মিল রয়েছে — তা হল ভারতের জাতীয়তাবাদে। সেখানে ধর্মের স্থান নেই। অনেকে ভাবেন ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থাৎ ধর্মের অনুপস্থিতি। তা নয়, এটা হল শাসন প্রশাসন এবং রাজনীতির পরিষ্কার নিরপেক্ষতা।

এবারে প্রশ্ন ভারতবর্ষ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, কিন্তু সংখ্যালঘুদের কেন তোষণ করা হয়েছে? সেটা অন্যায়, যেমন, রাজীব গান্ধীর সময় শাহবানো মামলায় Muslim Personal Board-এর সঙ্গে যাওয়া। কিন্তু গত সত্তর বছরের ইতিহাসে সংখ্যালঘু তোষণের চাইতে সংখ্যাগরিষ্ঠ তোষণ হয়েছে অনেক বেশি। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের সেটা চোখে পড়ে না। যেমন, অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয় কোন উচ্ছৃঙ্খল জনতার রোষে ভেবে চিন্তে পরিকল্পিত ভাবে রাজনৈতিক নেতাদের উৎসাহে, তাদের উপস্থিতিতে। সেইসব রাজনৈতিক নেতাদের শাস্তি হয়েছে কি? Archeological Act 1958 অনুযায়ী প্রাচীন ও ঐতিহাসিক সৌধ রক্ষা করতে বাধ্য। ইতিহাসের তথ্য (fact) এবং পৌরাণিক কাহিনীর (myth) এর মধ্যে তফাৎ করতে শেখানো হয় না। এই রকম ভাবে ইতিহাসের পাতায় বহু Buddhist Stupa ভেঙ্গে মন্দির হয়েছে। মন্দির ভেঙ্গে মসজিদ। সে তো ইতিহাস। ১৯৫৮-এর আইন অনুযায়ী যথাবস্থা থাকবে। তাজমহলের নীচে শিবমন্দির ছিল, সত্য হোক মিথ্যায় হোক, সেই গুজবে তাজমহল ভাঙা যায় কি?

সরকারী অনুষ্ঠানে কত হিন্দুধর্মীয় রীতিতে অভ্যর্থনা করি, সংস্কৃতির নামে। নারকেল ভাঙ্গা, সরস্বতী বন্দনা, নানা পুজো সরকারী অনুষ্ঠানে প্রচলিত। সেটা কি সংখ্যাগরিষ্ঠ তোষণ নয়? দেশের বড় বড় মন্দিরে সরকারী অর্থসাহায্য, অনেক ক্ষেত্রে আয়কর কমানো ইত্যাদি কি সংখ্যাগরিষ্ঠ তোষণ নয়? বহু বছর ধরে পুজো মণ্ডপগুলিতে রাজনৈতিক নেতারা সক্রিয় অংশ নেন শুধু ধর্মবিশ্বাসে নয়, অনেকক্ষেত্রে জনতার সঙ্গে যোগস্থাপনের অভীপ্সায়। ফুটপাথে কয়েক গজ দূরে দূরে ছোট ছোট মন্দির—মনসা, শীতলা। এমন কি রেল লাইনের ধারে। অনায়াসে অনুমতি পেয়ে যায়। কারণ ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করাই ভাল! কিন্তু মুসলমানদের ক্ষেত্রে কোন সুবিধা দিলে সংখ্যালঘু তোষণ মনে হয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতের মত ধর্মনিরপেক্ষ দেশে কোন ধরণের তোষণ রাজনীতি করা উচিত নয়। সংখ্যা হিন্দুরা ৮০% হওয়ায় তাদের প্রতি তোষণ কিংবা হিন্দুধর্মীয় মন্ত্রকে রাজনৈতিক স্লোগানে পরিণত করা যে অসাংবিধানিক তা বলা বাহুল্য। সরদার প্যাটেল, নেহেরু বা আম্বেদকাররা যদি জীবিত থাকতেন, তাহলে সংসদে শপথ নেবার অনুষ্ঠানে সদ্য নির্বাচিত সাংসদরা জয় শ্রীরাম, জয় মা কালী, আল্লা হো আকবর প্রভৃতি স্লোগান যখন দিলেন, ওনারা স্তম্ভিত হতেন। সংসদে যাবার আগে অন্তত: গান্ধীজী, আম্বেদকার, নেহেরু ও সরদার প্যাটেলের লেখা পড়ে যাওয়া উচিত। অজস্র উক্তি রয়েছে যে ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার, রাজনীতিতে যেন না আনা হয়। গুজরাতে সরদার প্যাটেলের বিরাট ‘Statue of Unity’ স্থাপিত হয়েছে কত কত কোটি টাকা খরচ করে। সেই সরদার প্যাটেল বলেছিলেন — “Religion is a matter between man and his maker and its mixing with politics would be a dangerous business.” (Patel’s speech at Travancore, dated May 13, 1949, quoted in Neerja Singh, Patel, Prasad, Rajaji: Myth of the Indians Right, Sage Publications, New Delhi, 2015, p. 82) সরদার প্যাটেলকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য মূর্তি নয়, তাঁর চিন্তা ভাবনাকে প্রচার করা এবং পালন করা প্রয়োজন।

ধর্মনিরপেক্ষ মানুষদের সেযুগের নেতারা কখনও নকল ধর্মনিরপেক্ষ (pseudo-secular) বলেননি। বরঞ্চ ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার স্বরূপ বোঝাতে গিয়ে সরদার প্যাটেল তৎকালীন গৃহমন্ত্রী হিসাবে ১৯৫০-এর ৭ই অক্টোবর হায়দ্রাবাদে বলেন— “Ours is a secular state. We can not fashion our politics or shape our conduct in the way that Pakistan does it. We see that our secular ideals are actually realized in practice… Here every Muslim should feel that he is an Indian citizen and has equal rights as an Indian. If we cannot make him feel like this, we shall not be worthy of our heritage and country.” (Neerja Singh, ap, cit, p.78)।
ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কাউকে জোর করে কোন ধর্মীয় স্লোগান বলতে বাধ্য করা উচিত নয়। পর পর অনেক ঘটনা হয়ে গেছে দেশের নানা প্রান্তে। সংখ্যালঘুদের হিন্দুধর্মীয় স্লোগান বলিয়ে কোন ধরণের হিন্দু তোষণ নীতি চালাচ্ছে। যারা ঐসব লিঞ্চিংয়ে জড়িত, তারা আইনে কারারুদ্ধ কখনও হলেও মুক্তি পেয়ে যান। সবচেয়ে বড় কথা বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সভা মঞ্চে প্রথম সারিতে বসার সুযোগ পায়। এ’বিষয়ে অনেক কিছু বলা যায়, তবে Islamophobia’র আতঙ্ক ছড়িয়ে বলা হয় মুসলমান সংখ্যাবৃদ্ধি ভারতের হিন্দুদের পক্ষে বিপদ। এই যে আমরা এবং ওরা’র রাজনীতি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের পক্ষে লজ্জাকর।

ছোট ছোট শিশুদের মধ্যে এর প্রভাব পড়ছে । ইন্দোরে ছয় বছরের মুসলমান বাচ্চা ফয়জনকে হিন্দু ছেলেরা খেলবার সময় পাকি, আতঙ্কবাদী ইত্যাদি গালি দেয়। মনের দুঃখে মাকে বলে। নিজেকে অসম্মানিত বোধ করে। এই ধরণের অনেক ঘটনা নিয়ে Nazia Erum, ‘Mothering a Muslim’ নামে একটি মর্মস্পর্শী বই লিখেছেন। ২০১৭তে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি পড়ে বোঝা যায় শুধুমাত্র উচ্ছৃঙ্খল জনতার রোষ বা দাঙ্গাকারীদের হিংসা নিচের স্তরে নয়, উচ্চবিত্ত তথাকথিত শিক্ষিত মানুষদের মনে বিষক্রিয়া করে এই ধরণের ‘আমরা’ এবং ‘ওরা’র রাজনীতি। শিশুরা বাড়িতে যা শোনে, না বুঝে তারই বহিঃপ্রকাশ হয় স্কুলে বা খেলার মাঠে। শিশুরা ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ জানে না। এইসব যা দেখছি, আমার শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্যে দেখিনি। বার্ধক্যে এসে দেখতে হচ্ছে।

বহু বছর আগে দিল্লীতে দেশভাগ পড়াতে গিয়ে গান্ধীজীর দেশভাগ সম্পর্কে কি অবস্থান ছিল, বলছি … স্বভাবতই গোড্‌সের নাম এলো গান্ধীজীর হত্যা প্রসঙ্গে। একজন ছাত্রী বলল, হ্যাঁ গোড্‌সে ছিলেন দেশভক্ত। কারণ জানতে গিয়ে বলল, বাড়িতে এমনটাই শুনেছে। আমি চমকে গেলাম। কিন্তু আজ যখন বহুমতে নির্বাচিত সাংসদরা, যেমন, উত্তরপ্রদেশের সাক্ষী মহারাজ এবং মধ্যপ্রদেশের সাধ্বী প্রজ্ঞা গোড্‌সেকে দেশভক্ত বলেন, তখন আমার আর কিছু বলার নেই। গোড্‌সের নামে অনেক মন্দির তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে। আসলে স্বাধীনতার জাতীয় আন্দোলনে দুটি ধারা ছিল, ইতিহাসের দুটি আখ্যান—narrative। মূলধারা রাষ্ট্রবাদী বা জাতীয়তাবাদী ধর্মনিরপেক্ষ। অন্যটি ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক। সেই সংঘাত এখনও চলছে।
শেষ করছি আমাদের জাতির পিতা গান্ধীজীকে স্মরণ করে। উনি প্রাণ হারালেন এক দীর্ঘ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে। প্রথম প্রচেষ্টা হয় পুনাতে ২৫শে জুন, ১৯৩৪। দ্বিতীয়বার পঞ্চগনিতে। তৃতীয়বার ১৯৪৬-এ পুনে যাবার পথে ট্রেনে, এটা রেল দুর্ঘটনার প্রচেষ্টায়। পঞ্চমবার ১৯৪৮-এর ২০শে জানুয়ারি বিড়লা ভবনে। এবং অবশেষে ১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারি নাথুরাম গোড্‌সে সামনে থেকে গুলি করে হত্যা করেন। কারণ গান্ধীজীকে হিন্দুরাষ্ট্রবাদীরা মুসলিমদের প্রতি পক্ষপাতপূর্ণ মনে করতো। গান্ধীজী শুরু থেকে হিন্দু-মুসলমান একতার কথা বলেছেন। গান্ধীজী দেশভাগের সিদ্ধান্তের প্রবল বিরোধী ছিলেন। তাই তিনি সত্তা হস্তান্তরণের অনুষ্ঠানে দিল্লিতে উপস্থিত ছিলেন না। কলকাতায় বেলেঘাটায় মৌনব্রত নিয়ে ছিলেন। সাংবাদিকরা এলেও কিছু বলতে চাননি। বলেন “There is no message at all. If it is bad, let it be so.: (D G Tendulkar; Mahatma, Vol 8, p. 80)

হিন্দু রাষ্ট্রবাদীরা ক্ষুব্ধ ছিলেন, কারণ গান্ধীজী কাশ্মীরে পাকিস্তান আক্রমণ হওয়া সত্ত্বেও ভারত সরকারকে পাকিস্তানের ৫৫ কোটি টাকা ন্যায্য পাওনা দেবার জন্য ভারত সরকারকে বলেন। গান্ধীজী দেশভাগের বিপক্ষে ছিলেন। তাই বলেন, সবাই অধৈর্য স্বাধীনতার জন্য। তাই অন্য কোন রাস্তা নেই। (“everybody is today impatient for independence. Therefore there is no other help.” (D G Tendulkar, ‘Mahatma’, Vol. 7, p. 415) ইতিহাসকার উমা দাসগুপ্ত Andrews, Tagore এবং Gandhi’র চিঠিপত্র সম্পাদিত করে যে মহার্ঘ্য প্রকাশিত করেছেন যার নাম ‘Friendships of Largeness and Freedom’, তাতে লিখেছেন— “Gandhi clearly lived with a normal loneliness throughout his leadership … he increasingly felt helpless over the longstanding problem of Hindu-Muslim unity … It was an agony that he could not ‘move’ the Congress over something as essential for the country’s future as Hindu-Muslim unity.” (Uma Dasgupta, edited, ‘Friendships of Largeness and Freedom: Andrews, Tagore and Gandhi: An Epistolary Account, 1912-1940’, OUP, 2018, p. XXXV) ।

গান্ধীজীর অন্তিম অনশন শুরু হয় ১৯৪৮-এর জানুয়ারি মাসে। কারণ হিসাবে যা বলেছিলেন, তা এখনও প্রাসঙ্গিক— “My fast as I have stated in plain language is undoubtedly on behalf of the Muslim community in the Indian Union and therefore, it is necessarily against the Hindus and the Sikhs of the Union and the Muslims of Pakistan. It is also on behalf of the minorities in Pakistan, as in the case of the Muslim minority in the Union.” (D. G. Tendulkar, ‘Mahatma’, Vol. 8, p. 259) এর অর্থ হল, গান্ধীজী মনে করতেন সংখ্যালঘুদের রক্ষা করবার দায়িত্ব রয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠদের ওপর। একে সংখ্যালঘু তোষণ বলা যায় না। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ, এর সাংবিধানিক মর্য্যাদা এখনকার প্রজন্ম যেন না ভোলে। গান্ধীজীর মত একজন একনিষ্ঠ ধার্মিক তার ব্যক্তিজীবনের বাইরে দেশের স্বার্থে, রাষ্ট্রের স্বার্থে কতখানি ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন, সেটা গভীর ভাবে আত্মস্থ করা প্রয়োজন। তাহলেই হবে গান্ধীজীর ১৫০তম জন্মবার্ষিকীতে ওঁর প্রতি প্রকৃত সম্মান।

[লেখক – অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, মৈত্রেয়ী কলেজ, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় সহ: সভানেত্রী, এন এফ আই ডব্লিউ]

Facebook Comments

Leave a Reply