সম্পাদকীয়
‘গণতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদ’—শব্দ দুটি সাম্প্রতিক সময়ে খুবই প্রাসঙ্গিক এবং চর্চিত। ফ্যাসিবাদ শব্দটি কদাচিৎ শোনা যেত। ইদানীং মানে গত ছ’সাত বছরে, লক্ষ্য করা যায়, ‘গণতন্ত্র’র পরিসর গেরস্তের কাপড় হাঁটুর ওপরে ওঠার মত কিঞ্চিৎ খাটো হয়েছে এবং খোল-করতাল বাদ্য ও ধ্বনি সহকারে ‘ফ্যাসিবাদ’-এর উচ্চারণ অনেক বেশি শোনা যাচ্ছে। সেই সাথে উঠে এসেছে অনেক অনেক প্রশ্ন। গণতন্ত্র একচুয়ালি কী এবং তার পরিণতিই বা কি দাঁড়িয়েছিল এবং ফ্যাসিবাদই বা কোন প্রেক্ষিতে কোন প্রয়োজনে উঠে এলো, এটা উত্তরণ না অবতরণ? বা সে উত্তরণ অবতরণ কি গুণগত – এমন সব প্রশ্নও আলোচনায় উঠে আসবে স্বাভাবিকভাবেই।
গ্রামে গঞ্জে সাধারণ্যে চলিত ধারণা হল ‘মেজরিটি মাস্ট বি গ্রান্টেড’। পঞ্চায়েতের ফলে অনেকটা শক্তপোক্ত এই ধারণা। নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত দশকর্ম – পরিশেষে জয়, পরাজয় এবং প্রাপ্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধির ভিত্তিতে ‘সরকার’ গঠন এবং শাসন পরিচালনা – তত্ত্বগত ভাবে যা হল জনগণের, জনগণ দ্বারা, জনগণের জন্যে শাসন পরিচালনা। এই ধারণার পশ্চাদ্দেশ, বিদ্রোহ নৈরাজ্য ইত্যাদি সব উল্টেপাল্টে নেড়েচেড়ে দেখার প্রশ্ন আলোচনায় আসতে পারে। ১৮৬৩ সালে আব্রাহাম লিঙ্কন বিষয়টিকে সূত্রায়িত করেছিলেন এই বলে – ‘গভর্নমেন্ট ইজ অব দ্যা পিপল, বাই দ্যা পিপল, ফর দ্যা পিপল।” অর্থাৎ জনগণের, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের স্বার্থে পরিচালিত হবে সরকার। তাই কী হচ্ছে বা হতে পারছে? এর অনেক আগে গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছিলেন যে ব্যবস্থায় প্রত্যেকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত নয় তা কুলীনতন্ত্র এবং যেখানে প্রত্যেকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে তা গণতন্ত্র। এতকাল পরে বলা যাবে তো বর্তমান ব্যবস্থায় প্রত্যেকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত? নাকি আজও ‘কুলীনতন্ত্র’র রকমফের চলছে? নাকি আরও নিকৃষ্ট — প্লেটো ‘গণতন্ত্র’কে মূর্খের শাসন বলে চিহ্নিত করেছেন। অধিকাংশ মানুষ মূর্খ, গণতন্ত্রের অছিলায় এই মূর্খরাই রাজত্ব কায়েম করে। আজকের আশপাশ কি তার চেয়েও ‘নিকৃষ্ট’?! একথা সোচ্চারে বলার, চ্যালেঞ্জ করার সাহস আছে? আজকের ফলিত ‘গণতন্ত্র’ কি তার নিশয়তা দেয়? হ্যাঁ গুরু প্লেটোর সঙ্গে শিষ্য অ্যারিস্টটলের তফাৎ আছে বা নেইও। নেই এ কারণে, যেখানে দারিদ্র্য সেখানেই অজ্ঞতা। লোকে শখ করে মূর্খ হয় না, বাধ্য হয়েই হয়, দারিদ্র্যই তাদের বাধ্য করে। গরিব বলেই মূর্খ হয়। মূর্খ বলে গরিব নয়। মূর্খরা সকলকে মূর্খ রাখতে পছন্দ করবে বৈকি! অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মার্কণ্ডেয় কাটজু বলেন “নাইন্টি পারসেন্ট ইন্ডিয়ানস আর ইডিয়টস। ইট ইজ ইজি টু টেক দেম অ্যা রাইড।”
অপরদিকে গরিবরা, রুটি রুজির অন্বেষণ এবং সঙ্গে গণতন্ত্র চায়। কারণ সাধারণ জনগণ মনে করে যে গণতন্ত্র তাদের স্বাধীনতা, সাম্য, সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় ক্ষমতা দেবে। ধনীরাও গণতন্ত্র চায়। ক্ষমতা ও শাসন প্রণালীর উপর নিয়ন্ত্রণ, সম্পদ আরও কুক্ষিগত করার জন্য ধনীরা ‘গণতন্ত্র’র পাঠ চায়। তাই ধনীদের ‘গণতন্ত্র’ আর গরিবদের গণতন্ত্র এক নয় — দ্বন্দ্ব, বিরোধ, সংঘর্ষ, অনিবার্য। ক্ষমতাবৃদ্ধি ধনীদের স্বৈরতন্ত্রী এমনকি ফ্যাসিস্ট করে তোলে। আবার বিপরীতে দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ ও দার্শনিক কার্ল মার্ক্স গণতন্ত্রকে “ডেমোক্রাসি ইজ দ্যা রোড টু সোশ্যালিজম” বলে অভিহিত করেন এবং ধনতন্ত্রের বিকল্প উন্নত আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা হিসেবে উপস্থিত করেন, বিপ্লবের তত্ত্ব খাড়া করেন। দ্বন্দ্বের অবধারিত পরিণতিতে বিপ্লব – নতুন ব্যবস্থা, গণতন্ত্রের নতুন পাঠ, প্রত্যয়, রেকর্ড সাফল্য, বিপুল শক্তি অর্জন, এমনকি আগ্রাসী ফ্যাসিবাদী শক্তিকে পরাস্ত করা সম্ভব হয়। অনেক সাফল্য সত্ত্বেও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপর্যয়ে গণতন্ত্র নতুন পরিসর খোঁজে ।
নতুন শতকে ‘গণতন্ত্র’ অনেক প্রশ্ন নতুন চ্যালেঞ্জ উপস্থিত করেছে। গণতন্ত্র সম্পর্কে পুরনো ধারণা অকার্যকর হয়ে পড়ছে। আবার নতুন পথের সন্ধান মেলেনি। এই দোদুল্যমান অবস্থায় বিভিন্ন দেশের গণতন্ত্রে কোথাও স্বৈরাচারী ঝোঁক কোথাও বা ফ্যাসিস্ট প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আমাদের চারপাশ এখন যেমন। সংখ্যার গরিষ্ঠতা বিনা কোন আয়াসেই গণতন্ত্র নিধন করতে সক্ষম, কোনও আয়াস লাগে না। কিন্তু সত্য লঘিষ্ঠ-এর সাথেও বসত করে। গণতন্ত্র’র একমাত্র মূল শর্ত স্বাধীনতা, সাম্য, সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা। এই শর্ত পূরণ জনগণের লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জন পূরণ ও প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম অনিবার্য সত্য। এই চলমান সংগ্রামের পাশে থাকার দায় ‘অপরজন’ পরিবার অনুভব করে।
যখন আমরা এই সংখ্যার পরিকল্পনা করছি, তখনও পর্যন্ত করোনা ভাইরাস জনিত বিশ্বব্যাপী অতিমারী আমাদের দেশকে সঙ্কটগ্রস্থ করেনি। বা হয়ত সেই সঙ্কটকে অবজ্ঞা করা হয়েছিল। ডিসেম্বর মাস থেকে এই ভাইরাস বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের দেশে বিরোধী রাজনৈতিক দল, বিশেষজ্ঞরা ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই আন্তর্জাতিক উড়ান বন্ধের দাবি জানাচ্ছেন—সরকার সেই দাবি শোনেননি। আজ কয়েক হাজার মানুষ উজাড় হয়ে গেছে বিশ্বে, আমাদের গরীব দেশ তার দূর্বল স্বাস্থ্য পরিকাঠামো নিয়ে গভীর সঙ্কটের আবর্তে। দেশ জুড়ে লক ডাউন চলছে। সাধারণ দিন-আনি-দিন-খাই মানুষদের সঙ্কটের ব্যাপকতা অচিন্তনীয়। সরকারগুলো প্যাকেজ ঘোষণা করছে। কিন্তু সেই মানুষগুলোর কাছে প্যাকেজ পৌঁছবে তো? না কি করোনার অজুহাতে ভেঙ্গে পড়া অর্থনৈতিক অবস্থাকে আড়াল দেওয়া হবে। সে প্রশ্ন থাকবেই আমাদের, নজর থাকবে সাধারণ মানুষের। আর প্যাকেজ তো থাকলো, করোনা চিকিৎসার পরিকাঠামো, উপযোগী উপাদান—সে’সবের কী হবে? মানুষকে ঘরের বাইরে যেতে বারণ করেছেন সরকার। সকলেই বলছেন, ‘অপরজন’ পরিবারেরও আবেদন—ঘরের বাইরে যাবেন না। আর আবেদন, বাড়ির পাশে, মহল্লায় যে দরিদ্র মানুষগুলি আছেন তাঁদের খোঁজ রাখেন অন্তত, পাশে গিয়ে দাঁড়ানো সম্ভব না হলে প্রশাসনকে জানান। সুস্থ থাকুন, সুস্থ রাখুন পরিবার, পাড়া, সমাজ, দেশকে …
মার্চ ২০২০
Posted in: Editorial, March 2020