গণতন্ত্রের ভিটেয় : দেবাশিস দত্ত
আবার একটা খুঁটি নড়ে গেল !! নড়ল বটে তবে কিঞ্চিৎ নাড়িয়েও ছাড়ল।
এখন কেবল আশঙ্কা আর আতঙ্ক নয়। বিপরীত অবস্থান প্রতিবাদী স্বর স্পষ্ট। ফলিত গণতন্ত্রের অন্যতম পীঠ বিচার-ব্যবস্থা ও বিচারক উপঢৌকনে সজ্জিত এবং আক্রান্ত, ঘোর ‘করোনাক্রান্ত’ – এটাই সৃষ্ট স্বর্গের শেষ সিঁড়ি! হয়তো নয়ও। আরও কিছু সিঁড়ি হয়তো ভাঙতে হবে। শাসকের স্পষ্ট উচ্চারণ ‘ক্রোনোলজি সমঝিয়ে’। দু হাজার চৌদা সে মিলা কে দেখো সভি ‘ক্রোনোলজি’ মান কে হুয়া হ্যায়। আউর হোতা ভি রহেগা … এক সওয়াল উঠ খাড়া হোতা হ্যাঁয় – সায়তাল্লিশ সে লাগাতার ক্যায়া হুয়া?
অচিন-পাঠ বলছে শাসকের “হাঁকডাকে ‘অর্থনীতি’ শব্দটি বেশ কিছুকাল কেমন কানে আসেনি। এই চার অক্ষরকে দুর করে দিয়েছে অন্য চার অক্ষর – ‘গোলি মারো’। কোথায় আমরা এক পরিবার বলে সবাইকে খাইয়ে পরিয়ে পারিবারিক ঐতিহ্য উচ্চাসনে রাখব, তা নয় নিজেদের মধ্যেই ‘গদ্দার’ সন্ধান করে বেড়াচ্ছি।” আর সেই সঙ্গে ‘সিডিশন অ্যাক্ট ১৮৭০’ দ্যাট অ্যালাউড দ্যা গভর্নমেন্ট টু অ্যারেস্ট অর ডিটেন অ্যানি পারসন উইদাউট অ্যানি ফেয়ার ট্রায়াল ইন দ্যা কোর্ট হু ওয়াজ সিন প্রটেস্টিং অর ক্রিটিসাইজিং দ্যা [ব্রিটিশ অর দ্যা প্রেজেন্ট] গভর্নমেন্ট … প্রতিবাদীদের ‘উইচ হান্টিং’ এবং সম্পূর্ণ ভারতীয় সংস্করণ ‘মব লিঞ্চিং’ বা যে কোন ধরণের কুৎসিত দৈহিক পীড়ন ও নিকেশ-এর কাছে শাসকের জানু নত যা হল নীরবতাজনিত আস্কারা, সমর্থন – ফলিত গণতন্ত্র পাঠ বা সিলেবাসের আওতাভুক্ত।
আবার ‘ক্রোনোলজি’। এনআরসি। সিএএ। এনপিআর। শরণার্থী। ঘুষপেটিয়া। আমরা। ওরা। হিন্দু। মুসলমান। ভারত। পাকিস্তান। ধর্ম। ধর্মনিরপেক্ষতা। দেশপ্রেম। দেশভক্তি। দেশদ্রোহী। শহীদ। সন্ত্রাস। টুকরে টুকরে গ্যাং। আরবান নকশাল। আখলাক। জেএনইউ। জামিয়া মিলিয়া। দলিত। দ্বেষ। খুন। ধর্ষণ। বিকাশ। বিশওয়াস। বিনাশ। স্বৈরতন্ত্র। গণতন্ত্র। নাগরিক। বেনাগরিক। সংবিধান। ৩৭০। হিন্দুত্ব। দুই কোটি চাকরি, নোট বদল, জিএসটি, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, রাজন, নীরব পলায়ন, এনপিএ+, শেয়ার বাজার, সেনসেক্স, মন্দা, ধস সবই ক্রোনোলজি – ইত্যাকার সব শব্দ এই সময়ের সবচেয়ে বাছা সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত ‘গণতান্ত্রিক’ শব্দ। আরও হয়তো আছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উচ্চারিত হয়নি বা কম উচ্চারিত হয়েছে যেমন – রুটি। রুজি। শিক্ষা। স্বাস্থ্য। আশ্রয়। প্রশ্রয়। নিযুক্তি। ছাঁটাই। বেকারি। মূল্যবৃদ্ধি। অধিকার। দুর্নীতি। কেলেঙ্কারি। ঋণ। ব্যাঙ্ক লুঠ। বঞ্চনা। শোষণ। পীড়ন। অপুষ্টি। আত্মহত্যা। দারিদ্র। বৈষম্য – ইত্যাদি। সমগ্র তালিকা হল শাসক ও শাসন চেনার কষ্টিপাথর। বা মাইলফলক। এই শব্দগুলো দুনিয়ায় আমাদের স্থান নির্দিষ্ট করে দিয়েছে: গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় একান্ন, সামাজিক উন্নয়নে ছিয়াত্তর এবং বিশ্ব ক্ষুধায় একশো দুই ইত্যাদি…
এখন স্লোগান ‘ভারত মাতা কী জয়’। এবং ‘গোলী মারো সালে কো’। ব্লো হট অ্যান্ড কোল্ড ইন দ্যা সেম ব্রেথ। ইলেকশন অ্যাহেড। গোরুর গাড়ির হেডলাইট অচল। চালাও পানসি। জয় চাহি জয় এবং জয়, পরাজয় কখনও নয়। এই দশকের নজর কাড়া ‘স্লোগান’। স্লোগান একটা বার্তা। নীতি পাঠ ও শিক্ষার সোপান। ছাড়পত্র। শংসাপত্র। মৃত্যু হলে পরমাত্মীয় বিয়োগ, একটা সম্পর্ক’র মৃত্যু ‘হিন্দুত্বে’ যাকে বলে বৈধব্য – হিন্দুত্বের নয়, অজান্তে দায় বৃদ্ধি অথবা ‘সহমরণ’ প্রথার শিলান্যাস – খেয়ালে থাকে না অথবা রয়েছে স্পষ্টতই। তারপর স্ট্যাচু অব … [বোনাপার্টি] সর্দার সরোবর হার মানবে … সব বেখেয়াল হয়ে যায় কেমন! অথবা এটাই নতুন খেয়াল। নতুন ভোর, নতুন সকাল, একরাশ রাত, রাতের চেয়েও অন্ধকার, শুভ খাতার মহরৎ … নতুন তান এবং লয় … অমিতুল্লা খানের সানাই। বিসমিল্লা গত। পুরনো বোতলে সভ্যতার এক নতুন পোঁ এবং পাঠ। কেমন লাগছে … ‘ইয়েস ব্যাঙ্ক’ নো রিপ্লাই। ভয় নাই ওরে ভয় নাই … ‘গণতন্ত্র’ আছে ‘গণতন্ত্রে’ আছি। চুয়ান্ন মৃত্যুতে শোক নেই। সব লাশ কেউ গোনে না। ওরা ওদের লাশ, আমরা আমাদের লাশ গুনবো – এও ‘গণতন্ত্র’। বিপরীতে [বা একই রীতিতে] এক ফ্রেমে ‘ভারত মাতা কী জয়। ইনকিলাব জিন্দাবাদ। বন্দে মাতরম’ এর ‘গণতান্ত্রিক’ চোলাই বা আইটি প্রযুক্তির ছোঁয়ায় হনুমান মন্দিরে পুজো এবং চল্লিশা পাঠের অভ্যাসে সাফল্য – সত্তরে আটান্ন।
ফ্যাসিবাদ? নাকি ফ্যাসিবাদী লক্ষণ!! নাকি ফ্যাসিবাদের ভারতীয় সংস্করণ !!! ‘গণতন্ত্র’র একটু বা অনেকটা ব্যতিক্রমী চলন দেখলেই বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে তুলনা তুলে আনার চেষ্টায় ওলিভারিয়া সালাজার, পিয়েরে লাভাল, ভিদুকুন কুইস্লিং, ফ্রাঙ্কো, বেনিটো মুসলিনি এবং সবার ওপরে বাটারফ্লাই খচিত এডলফ হিটলারের সঙ্গে মিল খোঁজা। হিটলার ঠিক জার্মান ছিলেন কিনা, জার্মানির সীমান্ত অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সীমান্তে ১৮৮৯ এর প্রোডাক্ট কিনা, জার্মানিতে তিনি শরণার্থী না ‘ঘুষপেটিয়া’ তাও খুঁজে দেখা। ওঁকে চেনার অনুষঙ্গ হিসেবে জাতিশ্রেষ্ঠতা, ‘হাতের মুঠোয়’ দুনিয়া – সর্বগ্রাসী ক্ষমতা-লোলুপতা, স্বৈরাচার, যুদ্ধ, প্রতিপক্ষ নিকেশে চরম নৃশংসতা ডিটেনশন-ক্যাম্প, গ্যাস চেম্বার ইত্যাদি প্রভৃতির মিল খুঁজেছি, দেখতে চেয়েছি এক কিনা। বা কোন অমিল ! স্বামীনাথন এস আঙ্কেলসারিয়া আয়ার যেমন লিখেছেন: ‘আই ফাইন্ড দিস ইকুয়েশন অব হিটলার অ্যান্ড দ্যা বিজেপি রিডিকুলাস। ইয়োর পার্টি [বিজেপি] হ্যাজ ফিল্ডেড সেভারাল মুসলিম ক্যান্ডিডেটস ইন ইলেকশনস। ডিড হিটলার ফিল্ড অ্যানি জিউস? ইউ হ্যাভ অ্যাপয়েন্টেড মুসলিমস টু ক্যাবিনেট পজিশনস … ডিড হিটলার হ্যাভ অ্যানি জিউস মিনিস্টারস অর স্পোকসম্যান? হ্যাজ দ্যা বিজেপি সেট ইন্ডাস্ট্রিয়াল হিউম্যান ফারনেসেস অ্যাজ অ্যা ফাইনাল সলিউশন টু রিড ইন্ডিয়া অব মুসলিমস। কলিং দ্যা বিজেপি ফ্যাসিস্ট ইজ অ্যাবিউজ, নট অ্যানালিসিস।” [টাইমস অব ইন্ডিয়া ৮ মার্চ, ২০২০] হতে পারে আইয়ার সাহেবের সঙ্গে অনেকের মিল হবে না। তিনি অনর্থ বলছেন। কদর্থ করছেন। কেউ বলতে পারেন তিনি বিজেপি’র বিপদকে খাটো করে দেখেছেন। ওদের হুঁকোয় মুখ রেখেছেন। বিজেপি’র পেছনে আরএসএস নিয়ন্ত্রণ ‘হিন্দুত্ব’ মতাদর্শ, ক্ষতিকর প্রভাব ইত্যাদিকে দেখতেই পাচ্ছেন না। বা সেই প্রেক্ষিতে বিচার করেননি। আইয়ার সাহেব ঠিক না ভুল – এটা একটা বড় বিতর্ক এবং অবশ্যই ‘গণতন্ত্র’র স্পেস।
সবটা একপেশে হয়ে চলেছে, চলতে পারছে বিষয়টা তাও নয়। প্রতিবাদ প্রতিরোধ আন্দোলন হচ্ছে, ভিন্ন সুর ভিন্ন স্বর, কিছুটা প্রাতিষ্ঠানিক, অনেকটাই তার বাইরে নিত্য ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত এমনকি বিচার ব্যবস্থার সাথে যুক্ত বিশিষ্টরা, বুদ্ধিজীবীরা তো বটেই যাদের একটা ট্রাডিশন আছে, তার বাইরে, বিশেষত, ছাত্র-যুব এবং মহিলা – যাদের মধ্যে প্রধান আর্থ-সামাজিক দিক থেকে পশ্চাদপদ, অল্পসংখ্যক বলে কথিত – তাদের মধ্যে একটা উত্থান জাগরণ সকলকে চকিত করে শুধু নয়, স্বাধীনতার স্বপ্ন চুরি ও তজ্জনিত অপ্রাপ্তি, দমিত অসন্তোষ মাটি ফুঁড়ে উঠে আসে কাউকে কিছুকে পরোয়া না করে, দ্বিতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে তুলনীয় মর্যাদার দাবি নিয়ে, সিনা টান করে এক পংক্তিতে দাঁড়াবার সাহস ঔদ্ধত্য দেখায় – সাতচল্লিশের পরে কে কবে দেখেছে! ভেবেছে!! এটাও তো সেই একই ছন্দ, পছন্দ করি বা না করি, চালু ফলিত গণতন্ত্র’র একটা স্পেস, যাকে ফ্যাসিজম অব ইন্ডিয়ান টাইপ বা ফ্যাসিস্টিক বা ফ্যাসিস্ট যাই বলা হোক না কেন! এরই মধ্যে তো রাজ্যে রাজ্যে পরাজয়ের পরে সুড়সুড় করে ‘ক্ষমতা’র অলিন্দ ছেড়ে আসতে হয়েছে, বলতে পারেনি ছাড়বো না, সে হিম্মৎ হয়নি। এর মানে এই নয় ইমারজেন্সি আর জারী হবে না? ৩৭০ টা কি?
ঘুরে ফিরে আসি অচিন-কথায়। অচিন উল্লেখ করেছেন: “অন্যকে বিতাড়িত করতে পারলেই আমার অবস্থার উন্নতি হবে – এই মনোভাব যে চিন্তা কাঠামো থেকে আসে, তাকে বলে ‘জিরো-সাম-গেম’। বাস্তবের যে কোন খেলায় কাঠামোটি এ রকমই। যেমন তাসের জুয়া। দু’জনের মধ্যে একজন যতটা জিতবে অন্যজন ততটাই হারবে। অর্থাৎ হার-জিতের অঙ্ক যোগ করলে যোগফল হয় শূন্য।” অতীত ও বর্তমানের শাসকদের জুয়ায় ফলাফল শূন্য থেকেছে। যথেচ্ছ সম্পদ লুণ্ঠনে অসাম্য বৈষম্য তীব্রতর হবার পরেও দেউলিয়া, এক অচল আধুলি। কর্পোরেট শিরোমণিকে বলতে হচ্ছে: “ইয়েট, অ্যাজ অ্যা ক্যাপিটালিস্ট, আই বিলিভ ইট’স টাইম টু সে লাউড হোয়াট উই অল নো টু বি ট্রু: ক্যাপিটালিজম, অ্যাজ উই নো ইট, ইজ ডেড।” [টাইমস অব ইন্ডিয়া ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২০] ‘হিটলার-কাম-ব্যাক পসিবল’ – একবিংশ শতকের জিজ্ঞাসা?
বাস্তবের কাঠামোয় ‘সমাজ-অর্থনীতিতে’ ‘জিরো-সাম-গেম’ অচল – সেটা আবার যাদের বোঝার কথা তারা বুঝে উঠতে না পারায়, দণ্ডি কেটে চলায় আজকের শাসক ‘‘জিরো-সাম-গেম’-এর ‘জীবনদর্শন’ ‘হিন্দুত্ব’র ঘোলা জলে চুবিয়ে ডুবিয়ে রাখতে চাইছে, পারছেও, সমাজ ও মানুষের জীবন যাপন, বোধ, ভাবনা, সংস্কৃতি, পরম্পরা তথা ইউনিয়ন অব অপোজিটস এর ঐতিহ্য। তাই অনিবার্য সংঘাত সম্ভাবনার প্রহর গোনে। শাহিনবাগ বলতে পারে ‘করোনা ভাইরাস সে সিএএ হামে জ্যায়দা খতরনাক লাগতা হ্যায়’। শাসকের সমস্ত হামলা আর পীড়নের মোকাবিলায় জাতীয় পতাকা, সঙ্গীত, সংবিধান প্রস্তাবনা বর্ম ধর্ম হয়ে দাঁড়ায় – পরাস্ত হয় থ্রি নট থ্রি’র সমস্ত কৌশল। গর্ভস্থ শিশু পাশ ফিরে শোয়। সেটাও একটা ক্রোনোলজি – ।
Posted in: Cover Story, March 2020