কমলকুমার মজুমদারের ছবি: এক তুমুল হারাকিরি – অর্ক দেব
বিস্মরণই ভাল। কারণ যে মনীষার আলোর দীপ্তি সময়ের থেকে কয়েক যোজন এগিয়ে, যে অনিন্দ্যসুন্দর শিল্পসত্তা আত্মনৈপুণ্যের চরম শিখর স্পর্শ করেও উদাসীন, তাকে আলগা হাতে স্পর্শ করা স্পর্ধা, ভালো মন্দের আটপৌরে আতস কাচে বিচার করা ধৃষ্টতা। তাকে পুরোপুরি বুঝতে গেলে, তার দানবীয় প্রতিভার অভেদ্য স্তরগুলো মাঝে মাঝেই অলঙ্ঘনীয় হয়ে দাঁড়ায়। ফলত কুয়াশার মোহ আবরণটুকু থেকে যেতে দেওয়াই আবশ্যক। সেইদিক থেকে দেখতে গেলে বাঙালি শিল্প-ঐতিহাসিকরা যে কমলকুমারের চিত্রে অবগাহন করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেননি তা একপ্রকার ভালোই হয়েছে। আমরা তাঁকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসপুরুষ হিসেবে যতটা বুঝেছি, ততটা বুঝিনি তাঁর শিল্পসংক্রান্ত অতলস্পর্শী পাণ্ডিত্যকে। চিনতে পারিনি সমকালের এক অনুচ্চার আত্মমগ্ন আর্টিস্টকে। কমলকুমারকে আত্মস্থ করার জন্যে আমাদের আরও অনেক বেশি প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল। পদকর্তা লিখেছেন “ফুলের বনে কে ঢুকেছে সোনার জহুরি / নিকষে খসয়ে কমল আহা মরি মরি”। কমলকুমারের ছবি নিয়ে দু’কথা লেখার অভিপ্রায় তৈরি হতেই এই পদ মাথায় ঘুরছে।
পরিবারে দুজন আর্ট স্কুলে হাতে কলমে কাজ শেখা শিল্পী, ভাই নীরদ মজুমদার এবং বোন শানু লাহিড়ী। নীরদ ফ্রান্সে খোদ আন্দ্রে হল্যান্ডের অ্যাকাডেমি থেকে এনগ্রেভিং শিখে পড়ে এসেছেন। সেজানমুগ্ধ শানু লাহিড়ীও ল্যুভর, জুলিয়ন অ্যাকাডেমিতে কাজ শিখে তৈরি করেছেন সম্পূর্ণ নিজস্ব ধারা। এদের দাদা আর্টিস্ট কমলকুমার কখন মনোজগতকে ফ্রেমে বাঁধতে শুরু করেছেন কালি কলমের মরমিয়া আঁচড়ে আঁকিবুঁকির ছলে, তার দিনক্ষণ বলা অসম্ভব। মোটামুটিভাবে ৪০’এর দশককেই চিহ্নিত করা যায় আর্টের সূতিকাগারে তাঁর প্রবেশের কাল হিসেবে। চল্লিশ-এর দশক বাংলা চিত্রকলার এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক বদলের শুভ মহরত। মন্বন্তরের বছর ১৯৪৩-এ প্রতিষ্ঠিত হয় ক্যালকাটা গ্রুপ। স্বাভাবিকতাবাদ ও নব্যভারতীয় ঘরানা এই দুই থেকেই সরে এসে বিশ্বযুদ্ধ মন্বন্তর কালোবাজারি সঞ্জাত পরিস্থিতিতে নতুন আঙ্গিক নতুন প্রকাশভঙ্গীতে ঝুঁকলেন একদল শিল্পী। ওরিয়েন্টাল আর্টের বাধা গত থেকে বেরিয়ে এসে কেউ মানব অবয়বের চরিত্র, কেউ ঘনকবাদ কেউ বা চিজলিং করে ভর ও আয়তনের সঠিক ভাগাহার ব্যবহার করে মধ্য দিয়ে নতুন শিল্পভাষা সন্ধানে নেমে পড়লেন। দলের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন গোপাল ঘোষ, রথীন মৈত্র, সুভো ঠাকুর, প্রদোষ দাশগুপ্ত, কমলা দাশগুপ্ত, পরিতোষ সেন, নীরদ মজুমদার, প্রাণকৃষ্ণ পাল প্রমুখ। ক্যালকাটা গ্রুপের প্রথম সভা হয় ১৯০/বি রাসবিহারী এভিনিউ, প্রদোষ দাশগুপ্তের স্টুডিওতে। গ্রুপের এক সান্ধ্যকালীন আড্ডা নীরদ মজুমদারের বাড়িতে বসলে অচিরেই দাদা কমলকুমারের সাথে ক্যালকাটা গ্রুপের সদস্যদের সখ্য গড়ে ওঠে। চিত্রকলা বিষয়ক নানা রসালাপের এক দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়।
কমলকুমার নিয়মিত আঁকতে শুরু করলেন। দয়াময়ী মজুমদারের কথায়, “ছবি খুবই আঁকতেন, প্রচুর ছবি এঁকেছেন, কত ছবিতে ঠাকুর সম্পর্কে কত লাইনও লিখে দিতেন। তবে নিজেকে বড় আর্টিস্ট ভাবার মত কোনও ভাবই কখনোই প্রকাশ করতে দেখি নি বা মন্তব্য শুনি নি!”
কমলকুমারের অঙ্কনভঙ্গী আর্টের চালু নিয়মবহির্ভূত, বিচিত্র ঘন আঁচড়ের মুহুর্মুহু উপস্থিতি, পার্সপেকটিভের অনির্বচনীয়তাই ছবিতে লাবণ্য যোজন করে। তিনি কি নিয়ম আয়ত্ত্ব করতে পারেননি? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তাকাতে হবে হারিয়ে যাওয়া, সামনে না আসা ছবিতেই। দেখা যাবে অ্যানাটমি বা অঙ্গসংস্থানগত জ্ঞান, হাড়ের সংগঠন সংক্রান্ত নিগুঢ় ধারনা বিচ্ছুরিত হয় প্রতিটি সমাপ্ত, অর্ধসমাপ্ত, অসমাপ্ত ছবিতে। এই অ্যানাটমির বোধ, জমি জরিপের ক্ষমতা তিনি স্টুডিয়োতে স্টাডি করে তৈরি করেননি। মাটি মানুষের সাথে অন্তর্লীন যোগসূত্র তাঁকে আব্রু-বেআব্রুর নান্দনিকতা শিখিয়েছে, শিখিয়েছে জ্যামিতি প্রকরণ। জলরঙ, রেখাচিত্র, কাঠখোদাই ইত্যাদি নানা মাধ্যমে নিমগ্ন হয়েছেন কমলকুমার সময় বিশেষে। কমলবাবুর ছবি প্রথম থেকেই প্রতিষ্ঠানবিমুখ (বিরোধী শব্দটিকে ব্যবহার করছি না)। ছবিকে কোনও একক ইজমেও বাঁধা মুশকিল। সর্বার্থেই তাঁর ইন্দ্রিয়জাত সংকল্পের মূল সুরটি বাধা আছে ‘তাবলো ভিভা’ বা সজীব চিত্রময়তার প্রতি আজন্ম লালিত অনুরাগে। মনে করা যাক, গদ্যকার কমলকুমার যেভাবে প্রীতিলতাকে রণাঙ্গনে উড়োজাহাজ উড়ে যাবার পর শান দেওয়া জিহ্বায় বলিয়ে নেন গ্যাট ম্যাট হুট ফ্যাট জাতীয় ইংরেজি শব্দ, যেভাবে রজঃস্বলা প্রীতিলতা ও রাস্তায় পড়ে থাকা ভিখিরিটি নিম অন্নপূর্ণার শেষে জীবন মৃত্যুর অপার্থিব ডাইকোটমি তৈরি করে তা। এই ছোট ছোট অণু চিত্রকল্পে তৈরি ইন্টেলেকচুয়াল মন্তাজই তাঁর ছবির বেনজির রূপাদর্শ। তিনি সেজান পিকাসো মাতিসে মুগ্ধ যে মুগ্ধতা ক্রমে ছড়িয়ে পড়বে সহোদর সহোদরার মধ্যে। নিজেরে অপ্রকাশিত রেখে তিনি ক্রমে তৈরি করবেন ছবির এলিটিস্ট মান্যভাষার মূর্তিমান বিপদ, এক নিজস্ব চিত্রাভাষ।
আমরা দেখি কমলবাবুর ছবি লোকায়তকে ধরেছে চিত্রাতিরেক এক যত্নে, যেখানে ওভার ডেকরেটিভনেস নেই, রঙের জৌলুস নেই, আছে অপর্যাপ্তির বোধ। ধর্মবোধপ্রসূত এক মানবিকতার নিগড় গড়েছেন রেখার ক্রমিক টেনশনে, গদ্যের শব্দ চয়নেও এই চিত্রযোজন প্রবণতা।
উনিশ শতকীয় ইডিলজিতে কমলকুমারকে কেউ বুঝতে এলে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় তাদের বেজন্মা বাস্টার্ড বলে দাগিয়ে দেবেন। কমলকুমারের ছবি বুঝতে গেলে তাঁর জীবন-জীবিকায় চোখ রাখতে হয়। সারাজীবন বিচিত্র সব কাজে নিযুক্ত থেকেছেন। কখনও মাছের ভেড়ি, কখনও ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট-এর কাজ। ১৯৫১ সালে অশোক মিত্র মহাশয়ের বদান্যতায় ভারত সরকারের জনগণনা বিভাগে কাজ পান তিনি। সাইকেলে চেপে কমলকুমার সরেজমিনে ঘুরে দেখলেন বাংলার বাজা গ্রাম, পোড়ামাটির মন্দির, লৌকিক জীবনযাপন, সুযোগ পেলেন লোকায়ত জীবনের শিকড় ছুঁয়ে দেখার। ফলত তার চিত্রের টানটোন, রেখার বুনোটে সেইসব লৌকিকতার প্রভাব স্পষ্ট। কমলকুমার-এর চিত্রে তাই যে ভল্যুম তা ইউরোপীয় ইল্যুশান নয় বরং কালীঘাট পটুয়াদের গোলেল ও আলতানুটির উত্তরাধিকার বলেই মনে হয়। মাতিস, পিকাসো, দেলায়া গুলে খাওয়া কমলকুমার ফর্মের দিক থেকে বৃহদার্থে মনস্তাত্ত্বিক, প্রাচ্যের দর্শন তাঁর শিল্পঅঙ্গুরীর হিরণ্যজল।
স্বাভাবিকতাবাদী ছবি সনাতনী ভারতীয়ত্ব থেকে ছবিকে ছিন্নমূল করেছিল। এ কথা অনুধাবন করেন অবন ঠাকুর। ‘ঘরোয়া’য় তিনি তাই লিখছেন- “ছবি দেশি মতে ভাবতে হবে। …বিলিতি পোর্ট্রেট আঁকতুম, ছেড়েছুড়ে দিয়ে পট পটুয়া জোগাড় করলুম। যে দেশে যা কিছু নিজের শিল্প আছে সব জোগাড় করলুম। অবন ঠাকুরের বিষয়ে সশ্রদ্ধ ছিলেন কমলকুমার। অবন ঠাকুরের মৃত্যুতে বড় কাগজে অবিচুয়ারিও লেখেন তিনি। আমার ধারণা কমলকুমার ছবি আঁকার ক্ষেত্রে অবন ঠাকুরের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে পাথেয় করেছিলেন। তাঁর লেখার সঙ্গে রেখার যাত্রার এটাই প্রধান পার্থক্য। লেখায় তিনি অন্তর্মুখী, রেখায় গভীর ভাবে লৌকিক, সহজিয়া, বহির্মুখী। ছবি আর লেখা পাশাপাশি রেখে পড়লে মনে হয় যেন কোনও গ্রামীণ পটুয়ার নগর অভিমুখে যাত্রা।
অশোক মিত্র মহাশয় এক সাক্ষাৎকারে বলেন “কমলবাবু ইউরোপীয় পেন্টিং-এর কাজ অনেক জানতেন, অসাধারণ জ্ঞান ছিল, অন্তর্দৃষ্টি ছিল। দেখতে শেখা, চিনতে শেখা, ছবির ইতিহাস জানা সবই তো তার কাছ থেকেই শিখেছি। ছবির ব্যাপারে তার কাছে আমি ঋণী”। “ধর্মীয় চেতনায় নিমগ্ন কমলবাবুর ছবিতে মাতৃশক্তির আবির্ভাব দেখা যায় বারবার। লোকজ অনুষঙ্গ ও নিখুঁত ডিটেলিং-এ গড়ে ওঠা একটি ছবিতে আমরা দেখি পূজারী মাতৃশক্তিকে বন্দনা করছেন পটে। সামনে স্বস্তিক চিহ্ন আঁকা ঘট, পিলসুজ এবং পুজোর ষোড়শ উপচার। কালীঘাটের মাতৃমন্দিরের খাস তালুকের চোদ্দ মাইলের মধ্যে মূর্তিপূজা করা যাবে না বলেই তো পটে পুজো করার রীতি। কালীঘাট মন্দির থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে সিডলি হাউসের নীচতলার তদানীন্তন বাসিন্দা কমলকুমার সেকথা জানতেন। বাংলার মৃৎশিল্প প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন- “কালীঘাটের নিকটবর্তী স্থানে মূর্তিপূজা বিশেষ হইত না,পটপূজা হইত”।
অসংখ্য বার মা ও ছেলের ছবি এঁকেছেন কালি কলমে। সেগুলিতে রামনগরের গনেশজননীর দ্যোতনা স্পষ্ট। বেলা বইয়ে গাঁ উজাড় করে পুতুল ও তার বৈশিষ্ট্য খুঁজেছেন কমলকুমার। ওঁর লেখা শিল্পপ্রবন্ধগুলিতে ধরা আছে সেসব।
আবার কালিকলমেই আঁকা অসমাপ্ত দুর্গাপরিবারের ছবি যেন কোনও পালশিল্পীর পেপার ওয়ার্ক। দুর্গার শরীরে বর্তুলতা আনতে কমলকুমার পটুয়া পাড়ার টেকনিক ব্যবহার করেছেন বলে মনে হয়। বেঙ্গল স্কুলের মধ্যে যে অতীত চেতনা, সাধারণ মানুষকে বিষয়বস্তু করে তোলার প্রবণতা আছে তা কমলকুমারের ছবিতে সদাভ্রাম্যমাণ। কাগজ আবহাওয়া তৈরি করেছে, কলম পার্থিব জগতকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। আর কমলকুমার ভঙ্গিতে লুকানো চরিত্র খুঁজছেন আঁচড়ে আঁচড়ে। বিশ্বাস করি ছবি দেখার, আঁকার চালু অভ্যেসের কাউন্টার একটি লোকজ ভাষা তৈরি করতে পেরেছেন কমলকুমার, সেটা অবশ্য আমরা আবিষ্কার করতে পারিনি।
বাংলার তদানীন্তন ছবির বহু ধারা এসে তার ছবিতে মিলেছে। স্নানসিক্ত পোশাকের যে মেয়েটিকে কমলকুমার রেখায় ধরলেন তা শশী হেশের প্রতিকৃতি চিত্রের কথা মনে করায়। দিদরো কথিত তেনেব্রেস অর্থাৎ কুহকময়তায় তিনি সর্বাংশেই উত্তীর্ণ। মুহুর্মুহু আছড়ে পড়া ঘন লাইন, ব্যাকগ্রাউন্ডে স্বকীয় এক ম্লানিমা, এসব কমলবাবুর বস্তুর সারে পৌঁছনোর জন্যে তৈরি করা ধর্ম ও রসের প্রবল সংশ্লেষ। তিনি নিজেই বলেছিলেন, “বাস্তবতা যেখানে চরম নিশ্চিন্ত, তুলির পারদর্শিতা যাকে রূপায়িত করে, উহা হয় অবস্তু, তাহার মধ্যে সাদৃশ্য থাকে না। শুধু থাকে তাহার চরিত্র। এই চরিত্রই বঙ্গদেশে চিত্রপটে সর্বময় হয়ে উঠেছে।”
সত্যজিৎ রায় কমলকুমারের সম্পর্কিত মুগ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। লিখেছেন “আপাত তুচ্ছ দৃশ্যের মধ্যে থেকেও তিনি যেসব ডিটেল আহরণ করতেন- যেটা পরে তার লেখায়ও প্রকাশ পেয়েছিল, তা ছিল বিস্ময়কর”। ক্যালকাটা গ্রুপের কোনও এক প্রদর্শনীতে কমলকুমার ও সত্যজিতের আলাপ হয়। ধীরে ধীরে সখ্য বাড়লে কমলকুমার ফিল্ম সোসাইটিরও একজন হয়ে ওঠেন। ‘ঘরে বাইরে’ ছবির জন্য অসংখ্য স্কেচ করেছেন। ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পটির সিনে নির্মাণে মজে কমলকুমার হাজারের বেশী স্কেচ করেন বলে শোনা যায়। পঞ্চাশটি স্কেচ সত্যজিৎ রায় দেখেছিলেন। এমনও শোনা যায়, ব্রাহ্ম জল হাওয়ায় বেড়ে ওঠা সত্যজিৎ রায়কে পথের পাঁচালির হিন্দু বিধবা ইন্দিরা ঠাকুরণকে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল কমলকুমারের ডিটেলিং। রিখিয়া থেকে পোস্টকার্ডে ছবি এঁকে সত্যজিৎ রায়ের ঠিকানায় পাঠাতেন কমলবাবু। এই ল্যান্ডস্কেপ সত্যজিতের আকাডেমিক স্ট্রাকচারে বেড়ে ওঠা ‘আর্টের’ মন ছোঁয়নি।
হিরণ মিত্রর মুখে শুনেছি ৪০’এর অন্যতম শিল্পী গোপাল ঘোষ প্রায়ই বলতেন কমলবাবু ছবিটাই মন দিয়ে আঁকলে আমাদের মত কতজনের ভাত মারা যেত।
১৯৬০-৬১ থেকে আমৃত্যু কমলকুমার প্রচ্ছদ চিত্রণ ও অলংকরণের কাজ করে গেছেন। “ঈশ্বর গুপ্তের ছড়া ও ছবি”, “আইকম বাইকম”, “পানকৌড়ি”—কমলকুমারের অলংকরণ করা তিনটি ছড়ার বই। দেখা যাবে তিনটি বইয়েই কমলকুমার দেশজ রূপাদর্শকে স্থাপন করেছন। সলভিনস, মাদাম বোলেনোসারা, জেন জমস, টমাস প্রিন্সেপদের চোখে ভারতের যে চরিত্র তাঁকে পরাভূত করতেই বাঙালির ঘরে জন্ম নিয়েছিল কাঠখোদাই শিল্পীরা। অসিত পাল তাঁর ‘উনিশ শতকের আটপৌরে কাঠখোদাই শিল্পী’ প্রবন্ধে এমন ৩৪ জনের কথা বলেছেন। এদের কোনও প্রথাগত শিক্ষা ছিল না। শিল্পী কমলকুমার এই ধারারই ফসল।
একটা ছবির কথা মনে পড়ছে। বাঁশ বাগানের। চাইনিজ ব্যাম্বু পেন্টিংয়ের ছায়া ধরা দেয় তাতে। আবার এর পাশাপাশিই ছড়ার বইয়েই দেখি, বিবাহবাসরে যাওয়ার পাত্র কোঁচা সামলাতে ব্যস্ত। অতি অল্প রেখা, যা ব্যবহার না করলে চরিত্রটি অধরা থেকে যাবে তাইই ব্যবহার করেন কমলবাবু। রামলক্ষণের ছবিটিও তাই। কী গভীর অনুশীলনে তৈরি শালবনে মাদলনৃত্যর ছবি। ছবিটি যেন ওই দুলুনি তৈরি করছে।
পানকৌড়িতে প্রচুর কাঠখোদাইয়ের নমুনা পাওয়া যায়। পড়েছি চিৎপুর থেকে গামাকাঠ আর ঠনঠনিয়া থেকে নরুন কিনে বাড়িতেই তিনি স্টুডিও বানিয়ে ফেলেন এই সময়ে। আমার দেখায় , এই বইয়ের সবক’টা ছবিতেই যেন তরঙ্গ বর্তমান। শারীরিক ভাবেই পাঠককে যুক্ত করে ছবিগুলি। এতটাই যে ছবি ছাড়া ছড়াগুলি নিষ্প্রভ লাগে যেন।
‘আগা ডোম বাগা ডোম / ঘোড়া ডোম সাজে’—চিরায়ত সেই ছড়াটিতে অসি হাতে রাজকুমারকে যে গতি জাড্য দিচ্ছেন কমলবাবু, তা দেখে হালের তাকাশি মিকের ছবির ধরনধারণ মনে পড়ে যাবে। পানকৌড়ি ছড়াটিতে আবার দেখব প্যান্টোমাইম ছন্দ। সনাতন প্রাচ্যে যেহেতু ব্যাকগ্রাউন্ড ফোর গ্রাউন্ড মানে ওপর নীচ, সামনে পিছনে নয়.তাই কমলবাবু ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড ছেড়ে রাখেন। লিখতে বসেই একটি ছবি দেখছি। বড় জামাই ময়ূরাক্ষী চড়ে আসছে। আকাশটাকে ছেড়ে কমলবাবু রঙ জুড়লেন ময়ূরাক্ষীকে। দেখে মনে হবে রোদেলা আকাশ। পানকৌড়িতে আছে চুলে টেরিকাটা বরের বিয়ে করতে আসার ছবি। গ্রাফিক নভেলের কনসেপ্টে ছবি করেছেন কমলবাবু। দু’টি আলাদা লোকেশন বোঝাতে স্রেফ দু’টি দরজা ব্যবহার করেছেন তিনি। বরের চেহারায় স্পষ্ট বাবুয়ানি।
দয়াময়ী দেবী দেখেছেন কি নিবিষ্ট তাপসের মগ্নতায় কাঠখোদাই করে চলেছেন কমলকুমার। “কাঠখোদাইয়ের কাজের সময় দেখতাম, কী অমানুষিক পরিশ্রম! রাতভর কাজ চলছে, হাত কেটে রক্তারক্তি, তবু বিরাম নেই। একটা ধারালো নরুন আর একটা বুলি, এতেই কি অপূর্ব কাজ হত” , স্মৃতিচারণে বসে লিখেছেন তিনি।
আমি জোর গলায় বলব, জীবন অভিজ্ঞতায় কমলকুমার কণ্ট্যুর আয়ত্ব করেছেন। পাল, কর্মকার, সূত্রধর সকলের কৌনিকতাবোধ বর্তুলতা প্রীতি কমলকুমারের করায়ত্ব। কাঠখোদাই-এ তাঁর ডিয়েজেসিস ছাপিয়ে গেছে তাঁর আগের পরের সমস্ত স্কুলের লক্ষণগুলোকে। শিল্পরসিকের সংবেদনে আলোড়ন তোলার মত কাজ এক একটি। এখানে শানু লাহিড়ীকে উদ্ধৃত করা আবশ্যিক। তিনি ‘সুন্দর’ পত্রিকার ১৪০৩ শ্রাবণ সংখ্যায় লিখছেন-“জাঁ কঁকতোর লেখা লেজাকা টেরিবলে বইতে শিল্রী গুরি দোইয়ার ৩২ টি কাঠখোদাই কাজ অসাধারণ। এবং মার্শাল গ্রেভরির লেখা জা মেয়ত্রিসের বইতে ৩৪টি কাঠখোদাই রয়েছে। বহু পুরনো বই। অপূর্ব এবং মুগ্ধকর। দাদার ছবি এই কথা মনে করিয়ে দেয়। আমার বিশ্বাস এই সব ছবি সংরক্ষণের দাবি রাখে।”
সন্দীপন ভট্টাচার্য্য লেখেন, “এই তিনটি বইয়ের পুনর্মুদ্রণ বাংলার প্রকাশনা জগতের একটি আবশ্যিক পুণ্যকর্ম বলে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য”। পানকৌড়ির কাঠখোদাইটি হারিয়ে যায় বা চুরি হয়ে যায়। অবশ্য দয়াময়ী মজুমদারের সারল্যের সুযোগ নিয়ে অনেক তাবড় লোকই কমলকুমারের বিচিত্র সংগ্রহ এবং আঁকাআঁকি নিয়ে আর ফেরত দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন নি। সেই সংগ্রহের মধ্যে পুরোনো বাংলা বই, কাঠখোদাই কিংবা এনগ্রেভ করা ইলাষ্ট্রেশানের সংগ্রহ, আবার বাঙালী মিষ্টি সন্দেশ আমসত্ত্ব তৈরীর ছাঁচও ছিল। মৃত্যুর আগের বছর (১৯৭৮) কমলকুমার ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতার বই ‘প্রিয় সুব্রত’-এর প্রচ্ছদ করলেন। জীবদ্দশায় প্রকাশিত নিজস্ব সমস্ত বইয়ের প্রচ্ছদও কমলকুমারের নিজের হাতেই করা। ‘পিঞ্জরে বসিয়া সুখ’, ‘খেলার প্রতিভা’ বইগুলোর প্রচ্ছদে অপরিমেয় যত্নের ছাপ।
সাত ভাই-বোনের তিনজনই রঙ রেখার বিন্যাসে বুঁদ। এ কোনও অলৌকিক সমাপতন নয়। দিনমানের কর্তব্যের বোঝা সামলে, সংসারের জোয়াল ঠেলে, নিশুত রাতে ক্যালিগ্রাফির চর্চা করতেন আপাত নিরক্ষর মা রেনুকাময়ী দেবী। কমলকুমার ফরাসী দেশের ম্যাপ বালিশের তলায় নিয়ে শুতেন, কেউ ফ্রান্স গেলে ব্রান্ট শায়না এনে দিতে অনুরোধ করতেন। ফরাসি চিত্রচর্চা সংক্রান্ত তার সংবেদনশীলতা সংক্রমিত হয় পরে। শানু লাহিড়ী মাতিসের প্যালেটে বিভোর হয়ে থাকেন। ছোট থেকেই ফ্রেঞ্চ প্যাস্টেলে আড়াইশ শেডের প্যাস্টেলে ছবি আঁকা অভ্যেস করেন, তার প্যাস্টেলের ছবিগুলিতে তুলো ঘষে ইফেক্ট এনে দিতেন বসন্ত গাঙ্গুলি। নীরদ মজুমদারও ফরাসি দেশেই চিত্রচর্চার পাঠ নিয়ে এসেছেন। কিন্তু কালের গতিতে দেখা গেল নীরদবাবু কিউবিজমকে গুরুত্ব দিলেন না। আবার শানু লাহিড়ী ইস্টার্ন বাই পাসের ধারে পরমা ভাস্কর্য গড়লেন দীপলক্ষী পুতুলের আদলে। কমলবাবুদের বড়বোন বাণী মজুমদার হরেন ঘোষের নেতৃত্বে ইতালিতে ছৌ নাচের ওয়ার্কশপে গিয়ে অনেকের হৃদয়ে ঝড় তোলেন। বলতে চাইছি, একটি বংশানুক্রমিক লোকায়ত প্রেম কমলকুমারদের জীবনযাপনে বাহিত হয়েছে, কলকাতার দেওয়াল শানু লাহিড়ী ভরিয়ে দেবেন ছোটদের চিরায়ত ছড়ায়, কমলকুমার নিজেও আজীবন মজে থেকেছেন দক্ষিনারঞ্জনে।
চল্লিশের দশকে ক্যালকাটা গ্রুপ (সম্ভবত ১৯৪৬-এ) কমলকুমারের ছবির প্রদর্শনী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। দুর্বোধ্য কোনও কারণে সে পরিকল্পনা বাতিল হয়। সম্ভবত নীরদ মজুমদারকে দেওয়া কথার কারণে কমলকুমার জীবনে একটিও ছবির প্রদর্শনী করেননি। কমলকুমারের মৃত্যুর দশদিন পরে ১৯৭৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস-এর নর্থ গ্যালারিতে তার ছবির একক প্রদর্শনী হল প্রথমবার। এক সপ্তাহ ধরে চলেছিল সেই প্রদর্শনী। ক্যালকাটা চিলড্রেন অপেরা আরও বার তিনেক কলকাত্তাইয়া শিল্প রসিকদের সুযোগ করে দেয় অ্যাকাডেমির ঘরে কমলকুমারের ছবি দেখার। বেশীরভাগ ছবিই ছোট, এমনকি কোনওটি চল্লিশ বর্গমিটারেরও কম। কোনও প্রাক-প্রস্তুতি ছাড়াই শিল্পী এঁকেছেন খামের পেছনে, পোস্টকার্ডের উল্টো পিঠে, ফেলে দেওয়া কাগজে, বাস ট্রামের টিকিটে। কোনওটা অসম্পূর্ণ, কোনওটায় আবার মজার ক্যাপশন দেওয়া, কোনওটা বা শাক্ত রসে মদির রামকৃষ্ণ শিষ্যের বিনম্র চিত্তের আত্মপ্রকাশ। প্রায় কয়েক দশক বাদে বর্ধমানে সৃজনী আর্ট গ্যালারীতে আলোবাতাস সাহিত্যপত্রের সৌজন্যে ২০০২ সালের ২৭ মার্চ-২ এপ্রিল কমলকুমারের ৫০টি ছবির একক প্রদর্শনী হয় । কাজটি বাস্তবায়িত হয়েছিল কবি সুব্রত চক্রবর্তী ও তাঁর স্ত্রীর প্রচেষ্টায়। কলকাতার আর্ট সমঝদাররা আজ পর্যন্ত এমন উদ্যোগ নিতে পারলেন না।
কমলকুমারের ছবি সম্পর্কে শিল্প ঐতিহাসিকদের কয়েক দশক অতিক্রান্ত যে ঔদাসীন্য তা তাদের ছঁকবাধা ফ্রেমবাঁধাই ছবি বিশ্লেষণের সনাতনী অভ্যেসের আ্যাকাডেমিক্সের অন্ধকূপে আটকে পড়ার জন্যই হবে বোধহয়। রসিক পাঠক মাত্রই জেনেছেন আপাত দুর্বোধ্য কমলকুমার বাংলা সাহিত্যে এক স্বয়ংসম্পূর্ণ ঘরানা, এক উত্তরাধিকারহীন অনাবাদী জমি। রূপদৃষ্টির জন্যে যে চোখ লাগে তা থেকে ঠুলি দূর হলে কমলকুমারের ছবিও শিল্প ঐতিহাসিকদের চৈতন্যের দাঁড় দুলিয়ে দেবে। বা দেবে না। যে ‘নভোমণ্ডল মুক্তাফলের ছায়াবৎ হিম নীলাভ’ তাতে আলো আসুক।
_____________________________________
লেখার শুরুতে ব্যবহৃত কমলকুমার মজুমদারের ছবিটি এঁকেছেন দেবাদ্যুতি সাহা।
Posted in: Essay, March 2020
তথ্যসমৃদ্ধ লেখা। খুব ভালো লাগলো কলমের সহজ চলন।
পরের কিস্তির অপেক্ষায় থাকবো।
ধন্যবাদ অমৃতা।
একি…’পানকৌড়ী’ উডকাট ছবিটি কোথায়?