আহমেদ মুগ্ধ-এর কবিতা
কাঁটা কম্পাস
আমার হাতে রাখা ওয়াইনের গ্লাস রীতিমত আমার চোখকেই পান করে যাচ্ছে, এখন এর মধ্যে ডুবে যেতে পারে গোটা প্যারিস শহর;আমার মুখের হাসি প্রতিদিন বাতাসের কান্না শুষে নিচ্ছে,এই হাসিতে কারোর মন আটকে গেলে সে হয়ে যেতে পারে এই শহরে সুখের প্রতিরক্ষাকারী দুঃখের ছাঁকনি যন্ত্র
কিন্তু এত বড় ভার আমি তাকে দেব না, যখন জানি সবাই ছুটে বেড়াচ্ছে উন্নত জীবনের দিকে,তখন তার হাতে তুলে দেয়া যায় না আকাশের মানচিত্র।
প্রতি রাতে আমার গলায় আটকে যাওয়া কাঁটাগুলো আমার কাছে জানতে চায় খুব প্রয়োজন ছিল কিনা এই পৃথিবীতে তাদেরকে তাদের প্রিয় সমুদ্র কিংবা নদী থেকে ভূমিষ্ঠ করবার;আমি বলি প্রয়োজন ছিল যেমন প্রয়োজন বৈরী আবহাওয়ায় গর্ভযন্ত্রণায় কাতর হওয়া নারীর কাছে অশীতিপর বৃদ্ধার সফেদ চূর্ণ রাতে উত্তাল সমুদ্রের সামনে নিজেকে নগ্ন করে গোরস্তানের কাছে নিজেকে এবার বিনিয়োগযোগ্য
দাবি করার ;আর যেমন আমার প্রয়োজন তার হৃদয়ের পরজীবি হয়ে ধুঁকতে ধুঁকতেও নারীর কোমল উদর ছুঁয়ে জীবনোত্তর মূর্তিগুলোকে বলা গোটা মানুষটাকেই প্রয়োজনে হতে হবে মরে যাওয়া ভালোবাসার এপিটাফের লিখন।
মধ্যরাত্তিরে চারিদিকের ঘনীভূত অন্ধকারে পিচঢালা সড়কে ফেলে সাদা আলো আমি ভাবি,যেমন ভাবি তোমার কালো চুলগুলোর মাঝে সাদা সিঁথি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যে তোমাতেই বেষ্টিত এই শহরে তোমারই পথে তুমি পাশে এসে না বসলে অচিরেই তোমারই শহরে আমাকে হারাতে হবে, আর তখন তুমি আমায় শনাক্ত করবে না,মাতাল ডোম তখন শরীরে আমার বেওয়ারিশ লিখে নিয়ে যাবে মর্গে যেন সিদ্ধার্থই তার কোল হতে মাতাল ডোমের হাতে তুলে দিল সেই মৃত হাঁস….
আর তুমি আসো না বলে অষ্টমী তিথিতে আমার ভেতরে চাঁদ-সূর্য-পৃথিবী ভুল বিজ্ঞানে বেছে নিচ্ছে ভিন্ন কোণ ;আমি তোমার দূরত্ব মাপছিঃযেন নাবালাক শিশু কাঁটা কম্পাস হাতে দূরত্ব মাপছে মৃত্যু থেকে জন্মের।
স্বচ্ছ ঝর্ণার পাশে এসে জ্যোৎস্নাপীড়িত হরিণের কানে চোখ-গেল পাখি বলে যদি তার চোখে তোমার চোখই না পড়ল তবে তোমার চোখকে চোখ কে বলল!
আর এখানে কর্দমাক্ত রাস্তায় পত্রহীন বৃক্ষেরা দাঁড়িয়ে আছে নিঃসন্তান নারীর বেদনার মতন;আমি সেই বৃক্ষের কাছে গিয়ে বলি কবিতার বাঁকে বাঁকে মনের এই সাংঘর্ষিকতায় তোমার বেদনারা কীভাবে শান্তি খুঁজবে আমার কবিতায়?
দুঃখের সমবণ্টন
মেঘলা দিন-এই ব্যস্ত শহরে মন আটকে আছে কেমন কাপড়ের দলছুট সুতোর মত,আকাশের শরীরে একখণ্ড আকাশে; জীবন আজ ফেরারি,জীবনকে দু’হাতে উড়িয়ে আমি কবিতা লিখছি,তুমি নেই-ঘড়ির কাঁটায় আমার মৃত্যুর বয়স দেখি।
কলেজ স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে কিশোরী, রিফিউজি কবুতরের কাছে শোনে তার দেশের গল্প- আকাশ জুড়ে এখন দুঃখের সাম্রাজ্যবাদ ;কিশোরীর দেহাভ্যন্তরে অতল সমুদ্রের জল-চাপে ভেঙে যেতে থাকে সমস্ত হাড়,তার অতল জল তার স্তনে জমে স্ফীত স্তনের ব্যাকরণে-
সকল সুখই সময়ের সাথে সাথে স্মৃতি হয়-সকল সুখই দুঃখ কিন্তু সব দুঃখ যখন সুখ নয় তবে কি মার্ক্সবাদ সমাজে দুঃখের সমবন্টনের কথা বলে? আর যে সমাজ এই সমবন্টনের নামে শুধু হাঁটছে পেছনে, সেখানে এক মুঠো বাদামের বিনিময়ে জীবনকে আমি নিলামে তুলে দিতে পারি— অথবা সেখানে জীবনকেও ক্রমশ পেছনে নিয়ে আমি বর্ম হিসাবে তুলে দিতে পারি মৃত্যুকে–
আর আমি আকাশের একগুচ্ছ তারার নাম তোমার নামে দিলেই তারা লেগুন হয়ে যায়;আমার যান্ত্রিক পত্রে তোমার মুঠোফোন ভরে যায় অথবা যায় না কোনো পত্রই–আমরা দূরে অনেক আলোকবর্ষ, যেখান থেকে মৃত্যুর খবর পৌঁছাতে পৌঁছাতে তোমার দরজার কপাট ভেঙে যায়, আর সব আলো-অন্ধকারের নথিপত্রে সিলমোহর দিয়ে জানালা প্রান্তরের বাতাসে নদী হয়ে জলকণা ছড়ায় শস্যের বুকে; তখনও দূরের ব্রিজটার পাশে, ছোট্ট মেলায়; মানুষগুলো নীলাকাশের নিচে অন্ততকাল অল্পবিরতির যতিচিহ্ন হতে চেয়েও পূর্ণচ্ছেদ যতিচিহ্ন হয়ে যায়।
আর এটা মেঘলা দিন-এই ব্যস্ত শহরে মন আটকে আছে কেমন কাপড়ের দলছুট সুতোর মত,আকাশের শরীরে একখণ্ড আকাশে;এখন আমি কবিতা লিখছি কারণ গতকাল হতে কোনো যান্ত্রিকপত্র এখনো আমি তোমাকে দেইনি,
আর এভাবে কোনোদিন তোমাকে কোনো পত্র না দিয়ে আমি অর্থমন্ত্রী হয়ে যদি দাঁড়িয়ে যাই বাজেট প্রণয়নে,
তুমি নিশ্চিত হতে পারো সবকয়টি খাতে আমি তোমাকেই বরাদ্দ করে দুঃখের সমবন্টন করে যাব…
Posted in: March 2020, Poetry