আখ্যানে ভারতীয় LGBTQIA+ : অভিষেক ঝা
প্রথম কিস্তি
মূল গল্প: চকলেট
মূল ভাষা: হিন্দি
লেখক: পাণ্ডে বচন শর্মা ‘উগ্র’
প্রথম প্রকাশ: ৩১ শে মে, ১৯২৪, ‘মতভালা’ পত্রিকায়।
বাংলা ভাষায় অনুবাদক: অভিষেক ঝা
প্রাককথন:
পাণ্ডে বচন শর্মা যিনি ‘উগ্র’ ছদ্মনামেই পরিচিত ছিলেন ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে উত্তরপ্রদেশের চুনারে জন্মগ্রহণ করেন। ঔপনিবেশিক সময়কালের একজন সংবেদনশীল লেখক হিসেবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের বিরোধিতা তাঁর প্রথমদিকের লেখাগুলিতে পাওয়া যায়। তাঁর লেখা বিতর্কিত হয়ে ওঠে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ‘মতভালা’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর আটটি গল্প দিয়ে যা ‘চকলেট’ সিরিজ নামে খ্যাত। এই গল্পগুলি পুরুষের সমকামকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। গল্পগুলিকে মহাত্মা গান্ধী বিপজ্জনক মনে না করলেও, পণ্ডিত বণারসীদাস চতুর্বেদীর মত জাতীয়তাবাদী মনন অশ্লীল দেগে দিয়ে “ঘাসলতি সাহিত্য ” তকমা দেন। উগ্রর জনপ্রিয়তা এতে কমার বদলে বৃদ্ধি পায়। শুদ্ধ হিন্দি ব্যবহারের বদলে, হিন্দির সঙ্গে উর্দু মিশিয়ে, সেই মিশ্র ভাষার সঙ্গে আবার আঞ্চলিক উপভাষা মিশিয়ে উগ্র ‘হিন্দুস্থানি’ ভাষা নির্মাণে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ন্যারেটিভ বুননের সময় স্যাটায়ার ও জার্নালিস্টিক রিয়ালিজম বারবার মেশাতেন নিজের সময়ের উপর টিপ্পনি কাটতে। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লীতে তাঁর মৃত্যু হয়। এই সিরিজের গল্পগুলির অনুবাদ এখানে প্রকাশিত হবে। এইসংখ্যায় রইল প্রথম গল্প ‘চকলেট’।
চকলেট
। ১।
“কী যাতনা প্রেম সায়রে পড়ি!
খানখান মন এবার কেমনে জুড়ি?”
হা ক্লান্ত ভাবে বলতে বলতে বন্ধুবর বাবু দিনকর প্রসাদ, বি.এ., মাল খাওয়া মানুষের মত টাল হয়ে চেয়ারে এলিয়ে পড়লো। আমি শালা চুপচাপ বুরবক হয়ে আছি। মালটার এত পিরিত উথলাচ্ছে কেন কে জানে? “ ঠিক আছিস তো ভাই? মজনুগিরি করছিস কেন?”। দিনকর লাল হতে হতে বললো, “ জানতাম না কাকে বলে ব্যথা, কাকে বলে যাতনা । প্রেমে পড়ার আগের সুখী দিনগুলোর কথা মনে পড়ে” ।
প্রথমে কাব্যি, তারপর রাঙা বদন, আর তারপর দাঁড়ি! মেজাজ খিচড়ে গেল। পাশে বসা আরেক বন্ধু মনোহর চন্দ্রকে বললাম, “ দেখছিস বে মন্নু? শালা দিনকর কাব্য সভায় এসেছে যেন! আমাদের কাছেও লুকায়! কে যে জাদুটোনা করেছে!”। মনোহরও দিনকরের হেঁয়ালিতে বেকুব বনেছিলো। এতটাই বেকুব যে নিজের স্বাভাবিক ষাঁড়ের মত চিল্লামিল্লিও করতে ভুলে গিয়েছিল। এখন মুখ খুললো, “ বাবু দিনকর প্রসাদ আজব দুনিয়ার মানুষ। আমাদের মত নয়। দিনকর কবিতা শোনঃ
‘ওই মনোময় ভ্রু যুগলে রাখিলাম চুম্বন
ওষ্ঠে আসিয়া ঠেকে তরবারি ভীষণ!’ ”
“কেয়া বাত! পুরা বেনারসী শাড়ি তো! কার লেখা রে?”
শালা ভুরু আর তরবারি! তুলনা দেখছিস? কী বে ন্যাকাশ্বরী উর্দু এমন উপমা দিতে পারবে?” ফিকফিক করতে করতে মনোহর আরেকটা শুরু করে,
“জিজ্ঞাসাইলাম, বঁধূ চোখে কাজল কেমন?
হেসে বলে, ছুরির জন্য পাথর লাগে যেমন।”
দিনকর: “ব্রাভো! চোখ আর ছুরি, কাজল আর পাথর। খাসা হয়েছে”। দিনকরের প্রশংসার মাঝেই আমি মনোহরকে বললাম, “ এই ‘ফাঁস’ নিয়ে কবিতাটা শোনা প্লিজ। দিনকরের ওটাও ভালো লাগবে”। মনোহর শুরু করে:
“তোমার দীঘল কেশের রেশম ফাঁসে আমার নিঃশ্বাস,
হে রাম! যেন ভুলভুলাইয়া এক।
আধবোজা চোখ খুললেই তুমি থাকবে আমার বিশ্বাস,
হে রাম! প্রেম যেন নেশার ঠেক!
তোমার নেশাতুর প্রেমের ফাঁসে আটকে গিয়েছি,
রাজা, চোর, সাধু জবাইয়ের জন্য একসাথে আছি।
পৃথিবী ছেড়ে এসেছি তোমার গলিতে রিক্ত সাজি,
আমার পৃথিবী জানে কেন আমি এখানে আজি”।
আমি মনে করতে পারি তারপর কী হয়েছিল। মনোহরের আবৃত্তির মাঝেই বাইরে থেকে কেউ ডেকেছিল “ দিনকর বাবু!”
“আরে তুমি! আসছি”। “ এই যেতে হবে রে, একটা জরুরি কাজ আছে। কাল দেখা হবে বেরাদররা”, বলতে বলতে দিনকর দরজার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। একটা তেরো চোদ্দ বছরের ছেলে দরজার কাছে অপেক্ষা করছিল।
। ২।
“কে রে ছেলেটা? দিনকরের কোন আত্মীয় নাকি?”, মনোহরকে জিজ্ঞাসা করলাম।
“উঁহু। দিনকরের ‘চকলেট’”।
“চকলেট ? মানে?”
“চটি পড়িস না বে?”
“ধ্যার! বল না? চকলেট, চটি সব শালা লাতিন আর গ্রীক ঠেকছে। ঝেড়ে কাশ”।
“লাতিন আর গ্রীক জানা এর চেয়ে সোজা সোনা। চকলেট এত লবঞ্চুস না ! প্লেগ আর কলেরার চেয়েও মারাত্মক এই চকলেট। শালা লোকে বেশ্যাদের খিস্তি করে, বিধবা বিয়ে করলে লোকের ঝাঁট জ্বলে যাচ্ছে , কিন্তু এই নিয়ে একটা কথা নাই! কেন? লজ্জা পায় বাবুরা। বাড়িতে আগুনে লেগেছে, এইদিকে বাবু পায়খানায় আছে বলে লজ্জায় বেরোচ্ছে না!”
“আর একটু বিশদে বল তো”।
“যে বাচ্চা ছেলেরা আমাদের দেশের কিছু দানবের উগ্র কামনার শিকার। শালা ভদ্রলোকের মুখোশ পরে এই বাচ্চাদের চরিত্রহীন করে চলেছে কিছু লোক। এই বাচ্চাগুলকেই আমাদের ইউপিতে ‘চকলেট’ বলে, ‘চটি’ও বলে। আরো অনেক কিছু বলে, ভদ্রলোকের ছেলে বলে বলতে পারছি না”।
“ কী বলিস! দিনকর বাবুর মত শিক্ষিত লোক এমন! ভুল করছিস না তো মনোহর?”
“ ভুল! মালটার সামনে এই বিষয় নিয়ে একটু নরম ভাবে কথা বলে দেখিস একদিন। ও শালা তোকে পুরাণ, বেদ, ইতিহাস দিয়ে তোমায় বোঝাবে ছেলেতে ছেলেতে হয়! এটা নাকি স্বাভাবিক! একদিন শালা একটা ভারী ইংরেজি বই দেখিয়ে বলে সক্রেটিসও নাকি এই কাজ করেছে! শেক্সপীয়ারও নাকি! অস্কার ওয়াইল্ডও!
। ৩।
‘প্রিয় গোপাল!
কাল সন্ধ্যায় ‘চকলেট’ নিয়ে তোর সাথে কথা হল। বাড়ি ফিরে মনে হল বিপদটা তোকে ঠিক বোঝাতে পারি নি। আজ লিখছি। সামনাসামনি দেখা করে বললেই ভালো হত, কিন্তু প্রয়াগে আসতে হয়েছে কিছু জরুরি কাজের জন্য।
দেশ ভুগছে এই সমস্যার জন্য। তরুণরা মেয়েলি হয়ে যাচ্ছে । একটা অল্পবয়সী ছেলে যখন দেখছে তারই বয়সী আরেকটা ছেলে যখন শিক্ষিত ভদ্রলোকদের চকলেট হয়ে উঠছে, সে মরিয়া হয়ে উঠছে। চকলেট হওয়ার জন্য সারাদিন ধরে মুখে মাখছে ভেনোলা, তারপর হোয়াইট রোজ মুখে লাগাচ্ছে, তারপর পিয়ার্স সাবান। লেখাপড়া ছেড়ে সারাদিন রূপচর্চায় মেতে থাকছে। বুদ্ধি কমছে, যৌন ইচ্ছা বাড়ছে আর নোংরা সব অভ্যাসের দাস হয়ে পড়ছে। বেশিরভাগ বাবা নিজেদের ছেলেদের ব্যক্তিগত গুপ্ত জীবন জানেই না। স্কুল যাচ্ছে , পড়াশুনা করছে, পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করছে—ব্যাস! আর কী চাই!
সব জায়গায় ছেলেদের উচ্ছন্নে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সবচেয়ে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে বোর্ডিং ইস্কুল, ব্রহ্মচর্য আশ্রম, পার্ক, মেলা, হুল্লোড়ের জায়গাগুলো। প্রায়ই শুনি শিক্ষক নিজের ছাত্রকে চকলেট বানিয়ে নিল। এমন কোন ইস্কুলই নাই যেখানে বছরে পাঁচ দশটা ঘটনা হেডমাস্টারের কাছে এসে পৌঁছায় না। এমন একটা ছাত্রও নাই যার চকলেট নাই। বন্ধু, আত্মীয় কতভাবে যে চালিয়ে যায় এরা! এই বন্ধু আর আত্মীয়দের সাথে এরা কী না করে!
গোপু, এই নোংরামি শেষ হওয়া দরকার। নইলে, আমাদের দেশের এই প্রজন্ম ভবিষ্যত প্রজন্মকেও শেষ করে দেবে। খুব তাড়াতাড়িই শৌর্য, বীরত্ব, পৌরুষ সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। আজ এখানেই থামলাম—সাক্ষাতে কথা হবে।
ইতি
তোমার মনোহর ’
***
মনোহরের চিঠি পড়তে পড়তে আমার মুখ লাল হয়ে উঠছিল। শালা ভাগ্যও দুর্বল জাতিকে মেরে রাখে! আর কত ভাবে ভারতবর্ষকে দাস বানাবে ঈশ্বর?
কী কপাল! সেদিনই বেলা দশটায় দিনকর তার সেই বন্ধুকে নিয়ে হাজির! ছেলেটার মুখে বুদ্ধির ছাপ। তার বুদ্ধিদীপ্ত চোখে ঝিলিক দিচ্ছে এক ভারতীয় মনন, শুধু ঠিক পথে পরিচালিত হওয়ার অপেক্ষায়। এমন সুন্দর ঈশ্বরের দান কিনা যাবে গাধার গাঁড়ে! দিনকরকে দেখে গা গুলোচ্ছে। সরাসরি জিজ্ঞাসা করলাম, “ এ তোর কে হয়?”
“এ—এ আমার বন্ধু বনোয়ারীলাল, ঐ যে উকিল, ওর ছেলে।”
“এটা উত্তর নয়। এ তোর কে হয়?”
“আমার কেউ না। আমি ওর বাপের বন্ধু বলে আমার কাছে একটু পড়াশুনা করতে আসে। ছোট ভাই বলে মনে করতে পারিস।”
“আচ্ছা। বস। একটু জলযোগের ব্যবস্থা করি।”
ইচ্ছে করেই তাদের নিরিবিলিতে ছেড়ে এলাম। বেরোতে বেরোতে চোখে এল বাচ্চা ছেলেটির চোখে লজ্জা ছায়া মেলছে। বউকে গিয়ে পুরি ভাজতে বললাম। একটু আড়াল থেকে দিনকর আর দিনকরের ‘ছোট ভাই’এর উপর নজর রাখলাম। দরজার ফাঁক দিয়ে চোখে আসছিল যেটুকু । একটি টেবিলের পাশে বসে আছে তারা। একে অপরের থেকে একটু দূরে।
কিছুক্ষন চুপচাপ। দিনকর গলা খাঁকারি দিল, “ কাল কোথায় ছিলে?”
ছেলেটি চুপ।
“বলো। একটা গোটা দিন আমার সাথে দেখা না করে থাকতে পারলে? আমি তোমায় ছেড়ে এক সেকেণ্ড থাকতে পারি না। আমি গোটা রাত ঘুমাই নি। তুমি কি আমার উপর রেগে আছ? তুমি তো জানো সব। কত্ত ভালোবাসি তোমায়! কাছে আয় , প্লিজ কাছে আয়!”
“একদম বাজে বকবে না। কেউ শুনলে কী ভাববে?”
“যা ইচ্ছা ভাবুক। প্রেম করতে গেলে লোকের পারমিশন নিব নাকি? কত্ত ভালোবাসি তোকে! কাছে এসো, প্লিজ কাছে এসো!”
“‘প্রেম তো এক আনমন যন্ত্রণা , ফিরে ফিরে আসা জ্বর
শেখ, তুমি কী করে চিনবে প্রেমের আনমন সুর?’
আপনিই তো আমায় এইসব শিখিয়েছেন । নিজে কী করে ভুলছেন!”
“কাছে এসো রমেশ!”
“আমি কাছে আসব না। ওখান থেকেই বলুন।”
“একটা ফিসফিস কথা আছে। আয়, কাছে আয়!”
“উম্মম! না।”
“ ‘এই পুড়ে যাওয়া তাকানোয় প্রেম লুকিয়ে আছে,
এসবের মাঝেও বাজার চালু থাকে, বাঁচি আনাজে।’
কাছে আয় রমেশ!”
“কী যাতা বকছ! এটা অন্যের বাড়ি, ভুলে যেও না।”
“ও! আসবি না? তাহলে আমিই আসছি। মহম্মদ পর্বতের কাছে না গেলে, পর্বতকেই তো মহম্মদের কাছে আসতে হয়।”
দিনকর রমেশের দিকে এগিয়ে আসে।
“এক্ষুনি আপনার বন্ধু চলে আসবে… আমার সাথে কোনোদিন কথা বলবেন না।”
“কেন? এত রেগে আছো কেন প্রিয়?” দিনকর এগোয়।
টেবিল থেকে কালো কালির দোয়াত তুলে নেয় রমেশ। দিনকরের দিকে ছোড়ার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে। ছুঁড়তে যে চায় না, বোঝা যায় । তবু মুখে বলে, “আমি কালি ছুঁড়ে দিব কিন্তু। অন্যের বাড়িতে লজ্জার শেষ থাকবে না তখন।”
এই রাগ পরিবেশকে আরো কামার্ত করে তোলে। দিনকর এগিয়ে যায় , “তুই আমার। তোমার উপর আমার তীব্র অধিকার!”
দিনকরকে এগোতে দেখে রমেশ কালির বোতল ছোঁড়ার ভাণ করে। হতবাক হয়ে সে দেখে দোয়াতের ছিপি আলগা হয়ে পুরো কালি গিয়ে পড়েছে দিনকরের মুখে, জামায়। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দিনকর লজ্জায় ফুঁসছে। দিনকর জড়িয়ে ধরে রমেশকে। “কেন এত রাগ! কেন? তুমি কত্ত প্রিয় তা কি তুমি বোঝো না প্রিয়!” দুজনের ঠোঁট মিশে যায় ঠোঁটে।
***
সেই সময় আমি ঢুকলাম। পায়ের শব্দ শুনে দিনকর রমেশকে ছেড়ে দেয়। দিনকরের কালি মাখা মুখ থেকে কালি মেখেছে রমেশেরও মুখ।
“দিনকর তোদের জন্য তো পুরি ভাজতে বললাম। এখন তো দেখছি সাবান, জল, তোয়ালের ব্যবস্থা করতে হবে। পোষাকও লাগবে। ‘ছোট ভাই’ এর প্রতি তোর প্রেম কিন্তু দেখার মত ছিল! এখানেই থাক। আমি রমেশকে ওর বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছি।”
। ৪।
দিনকরকে আর কেউ কোনোদিন দেখে নি। ছয় মাস কেটে গেল। কেউ কিছু শোনেও নি। রমেশের বাবা তার ছেলের ব্যক্তিগত জীবনে কড়া নজরদারি শুরু করেছেন। হে রাম! রমেশকে রক্ষা করো!
Posted in: March 2020, Translation