আধুনিক বাংলার নৃত্যান্দোলন : সোমা দত্ত
নৃত্য আন্দোলন কথাটা খুব সচেতন ভাবেই ব্যবহার করছি। ব্রিটিশ ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলন যেমন দেশকে স্বাধীনতা দিয়েছে পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠেছে যা সমাজ গঠনে সাহায্য করেছে।সামাজিক আন্দোলনে সংস্কৃতি একটি বড় পরিসর যা সমাজ জীবনে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। শিক্ষা, নাচ, গান সমস্তই এই আন্দোলনের মাধ্যমেই নতুন করে গড়ে উঠেছে। নব্য শিক্ষিত সমাজের নিজস্ব সংস্কৃতি গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তাও ছিলো অন্য আর একটি দিক।
১৯২০ সাল পরবর্তী সময়কালে নাগরীক পরিসরের উপযোগী নৃত্য চর্চা ও নতুন নৃত্যধারা গড়ে তোলার উদ্যোগ শুরু হয় সারা ভারতবর্ষ জুড়ে। দক্ষিণ ভারতে দেবদাসী প্রথা বিলুপ্তি এবং সেই ধারার নৃত্যকে শাস্ত্রীয় নৃত্যধারার আদলে গড়ে তোলার উদ্যোগ শুরু হয়। উত্তর পূর্ব ভারতের মণিপুরে বৈষ্ণব ধর্মের আশ্রয়ে গড়ে ওঠা মণিপুরী নৃত্যের সংস্কার শুরু হয় মোটামুটি এই সময়েই। পূর্বদিকে ওড়িশায় মাহারী ও গোটিপুয়া নৃত্যের সংস্কারের মাধ্যমে শাস্ত্রীয় ওড়িশি নৃত্যের গঠনের কাজ চলেছে। সমস্ত উদ্যোগেরই মূল লক্ষ্য এক, বিষয়বস্তু এক। নির্দিষ্ট ধর্মের আধারে পৌরাণিক কাহিনীর ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে নতুন আঙ্গিকের নৃত্যধারা।
একই সময়ে ব্যতিক্রম বাংলা। সে ধারার কোনো পরিবর্তন হয়নি তার পরবর্তী বেশ কিছু দশক পর্যন্ত। ১৯২১ সালে বিশ্বভারতী স্থাপন করলেন রবীন্দ্রনাথ এবং সরাসরি নৃত্যশিক্ষার আয়োজন শুরু করলেন কোনো শাস্ত্রের তোয়াক্কা না করেই । তার বেশ কিছু আগে থেকেই নাটকে নাচের প্রয়োগ করে চলেছেন। শুধু আঙ্গিক নয় বিষয়গত ভাবেই আধুনিক নাচের ধারা শুরু করে দিলেন তিনি। গুরু সদয় দত্ত ব্রিটিশ সরকারের ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি করতে করতেই সংগ্রহ করে ফেললেন বাংলার লোক শিল্পের অনন্য ধারাগুলিকে। ১৯২৪ সালে শুরু করলেন ব্রতচারি আন্দোলন। রচনা করলেন ব্রতচারি ব্রতকথাঃ
“ব্রতলয়ে সাধব মোরা বাংলা সেবার কাজ
বাংলা সেবার সাথে সাথে ভারত সেবার কাজ
ভারত সেবার সাথে বিশ্বমানব সেবার কাজ”।
শরীর গঠন, কৃচ্ছসাধন, সেবা এই ছিল ব্রতচারি সমিতির মন্ত্র, সাথে বাংলার নিজস্ব লোকনৃত্যের চর্চা ও প্রসার।কয়েক বছরের মধ্যেই উদয়শংকর, ইউরোপীয় ব্যালে নৃত্যের ধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে সৃষ্টি করলেন আধুনিক ভারতের নিজস্ব ব্যালেনৃত্য। উপাদান সেই ভারতের লোকনৃত্যের ভান্ডার। বিশ্ব জয় করলেন সেই নৃত্যধারা নিয়ে।
বলার বিষয় এই যে এঁদের কেউই শাস্ত্রের তোয়াক্কা করেননি। বাঙ্গলার কোনো নিজস্ব প্রাচীন কোনো নৃত্যশাস্ত্র নেই এবং অন্যতর কোনো শাস্ত্রকে চাপিয়ে দিয়ে বাঙ্গলার নৃত্যধারা গড়ে তোলার চেষ্টাও হয়নি। তাই বাঙ্গলায় নৃত্যের সংস্কার হয়নি, পুরোদস্তুর নিজস্ব ভাষা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা হয়েছে। তাই একে আন্দোলন বলাই শ্রেয়।
রবীন্দ্রনাথ মণিপুরী নৃত্য শিক্ষক আনছেন, কেরালা থেকে মোহিনীয়াট্টম শিক্ষিকাকে নিয়ে আসছেন বিশ্বভারতীতে কিন্তু বীরভূম জেলায় অবস্থিত হয়েও কেন সাঁওতাল নাচ শেখানোর উদ্যোগ নিলেন না? উত্তর সহজেই অনুমেয়। সেই সময় নাচ শেখানোর কথা তিনি প্রকাশ্যে বলতেই পারেননি। নাচের ক্লাসকে বলতে হয়েছিল ‘মৃদঙ্গের সাথে ব্যায়াম শিক্ষা’ র ক্লাস। শিক্ষিত বাঙালী সমাজে নৃত্য তখন একেবারে ব্রাত্য। নাচ মূলত বিনোদনের বিষয়। বড়লোকের বাগানবাড়িতে বাঈজী আর গ্রামীন ভূস্বামীদের মনোরঞ্জনের জন্য নাচনী এই ছিল নাচের ধারা। সামাজিক পরিসরে যা নাচ ছিল তা মূলত গ্রামীন জীবনের সাথে যুক্ত। ঝুমুর, সাঁওতালি , ছৌ, রায়বেঁশে, পাইক, ঢালি,বৌ নাচ আরো অনেক। নব্য শিক্ষিত ভদ্র বাঙালী তাকে আপন করে নেবে এত উদারতাও জন্মায়নি তখনো। বিদ্যাসাগর বিধবাদের বিয়ে দিলেন, মেয়েদের স্কুল পাঠালেন, সতীদাহ বন্ধ করলেন রামমোহন রায়। এবার বাড়ির মেয়েগুলোকে নাচতে উৎসাহ দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এত ধাক্কা সহ্য করা খুব কঠিন । তবু সহ্য করতে হল। বিশ্বভারতীর ছাত্রীরা নাচ শিখলেন।দেশের নানান অংশের উচ্চকোটি নামী পরিবারের মেয়েরা নাচ শিখলেন, মঞ্চে নাচলেন। রবীন্দ্রনাথ নৃত্যের উপাদান নিয়েছিলেন বিভিন্ন ধারা থেকে। জাভা বলী সিঙ্ঘলের নাচ থেকে যেমন তেমনি দেশীয় ধারার মূলত উত্তর পূর্বের মণিপুরী এবং দক্ষিণের কথাকলি থেকে সংগ্রহ করলেন উপাদান , বিষয়ের ভাবের সাথে মিলিয়ে গড়ে নিলেন নতুন নৃত্যশৈলী।
একই সময়ে দেশের অন্যান্য অংশেও শিক্ষিত নামী পরিবারের মেয়েরা নাচ করতে শুরু করছেন তাই নয় পাড়ি দিচ্ছেন বিদেশেও। বালা সরস্বতী, রুক্মীনি দেবী অরুন্ডেল, জোহরা সায়গল, ইন্দ্রানী রহমান, আরো অনেক শিল্পী আত্মপ্রকাশ করলেন সেই সময়। শাস্ত্রীয় নৃত্যধারা দেশে ও বিদেশে ভারতবর্ষের যে পরিচয় প্রতিষ্ঠা করল তা এক নির্দিষ্ট ধর্মের পরিচায়ক,নিবেদনই যার সংস্কৃতি। সাধারণ মধ্যবিত্ত তাকিয়ে থাকেন উচ্চকোটির মানুষদের দিকেই। সমাজের মাথা তারা। এ যেন একপ্রকার অনুমতি দান , এতে অসুবিধে কিছু নেই, সমাজে একঘরে হওয়ার ভয় নেই, তাহলে নাচ করা যায়। একরকম আগল ভাঙলো, আরো অনেক মানুষ এলেন নৃত্যশিল্পে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে কথাকলি ও মণিপুরী নাচের প্রবেশ ঘটেছিল বাঙ্গলায়।যার বহুল প্রসার হল একবিংশ শতকে এসে। আর ছিল কথক নৃত্য ও ভরতনাট্যম। ১৯৬২ সালে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হল।নৃত্য চর্চা ধীরে ধীরে সামাজিক সম্মান আদায় করল ।
রবীন্দ্রনাথ, উদয় শংকর, যে দুটি নৃত্যধারার জন্ম দিলেন তা কিন্তু শুধু নিবেদনের সংস্কৃতির কথাই বলেনা। রবীন্দ্রনাথ চন্ডালিকা,শাপমোচন লিখলেন নৃত্যাভিনয়ের জন্য। উদয়শংকরের ‘লেবার মেশিনারি’ আধুনিক যন্ত্রসভ্যতার কথা বলে।শংকরস্কোপ, কল্পনা চলচ্চিত্র নৃত্যশিল্পের ভাষাকে এগিয়ে দিয়েছিল অনেকদূর।অমলা শংকর, সাধনা বসু, রশিদ আহমেদ চৌধুরি ওরফ বুলবুল চৌধুরি ,শম্ভু ভট্টাচার্য, অনাদিপ্রসাদ, শান্তি বসু , অসিত চট্টোপাধ্যায়,গায়ত্রী চট্টোপাধ্যায় বেশ কয়েক দশক ধরে এই ধারাকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন। উদয়শংকর ঘরানার অনেক শিল্পী এখনো সে ধারা অব্যাহত রেখেছেন।
একবিংশ শতকে যে নতুন আর একটি ধারা যুক্ত হলো বাঙালির নৃত্যধারায়। বিশ্বভারতীর ছাত্রী মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার আধুনিক নৃত্যভাষা গঠনে তাঁর অবদান রেখেছেন আঙ্গিকগত পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে। তিনি রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘চন্ডালিকা’ অবলম্বন করে নিজস্ব ভাষ্য উপস্থাপন করেছেন ‘তোমারি মাটির কন্যা’। এমন আরো অনেক মনে রাখার মত নৃত্য প্রযোজনা তৈরি করে গেছেন তিনি। ‘নবনৃত্য’ আধুনিক বাংলার নিজস্ব নৃত্যধারায় শেষ সংযোজন।
১৯২০-২১ সালকেই যদি এই আন্দোলন শুরুর সময়কাল ধরি তাহলে তার একশ বছর কেটে গেল। রবীন্দ্রনাথ এখন গুরুদেব, তাঁরই সৃষ্টিতে তাঁর নিত্যপূজা চলছে। ব্রতচারি সমিতি মৃত। কতদূর এগোনো গেল? আদৌ একচুলও এগোল বাঙলার নিজস্ব নৃত্যধারা? যে ধারায় শিল্প বোধ আছে, আছে মানুষের সুখ দুঃখের কথা, শিল্পীর কল্পনার স্বাধিনতা আছে, শিল্পীর নিজস্ব ভাষ্য আছে। বিপুল একটা পরিসর তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিলেন এই আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিগণ। বাঙালির নৃত্যধারার অর্থ একটি নির্দিষ্ট কোনো ধারা নয়। কোনো আগল নেই তার। কল্পনার মুক্ত আকাশে মননে সমৃদ্ধ বাঙালির নৃত্যধারা হবে নদীর মত স্রোতস্বিনী, একই সাথে বাঙলার তথা ভারতের। যা গোটা বিশ্বের কাছে ভারতের সৌভ্রাতৃত্বের রূপটি তুলে ধরবে,শক্তিশালী করবে বিশ্বভ্রাতৃত্বের আদর্শকে।
বাংলার ঘরে ঘরে আজ নৃত্যচর্চা হচ্ছে। ছেলের সংখ্যা কম হলেও তৎকালীন সময়ের তুলনায় অনেক সংখ্যায় ছেলেমেয়ে আসছে নাচ শিখতে, তাদের মধ্যে একটা অংশ নাচ করেই জীবিকা নির্বাহ করতে পারছে। সরকারি স্কুলে না হলেও বেসরকারি স্কুলগুলিতে নাচের শিক্ষিকার পদ আছে। দেশ বিদেশে প্রচুর নৃত্য উৎসব হচ্ছে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আছে নাচের গুরুদের জন্য,নৃত্যগোষ্ঠীগুলির জন্য। পাড়ায় পাড়ায় নাচের স্কুল গড়ে উঠেছে যেগুলিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা নেহাত কম নয়।এই শতাব্দীর নবতম সংযোজন বেসরকারি টি.ভি চ্যানেলে নাচের প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানগুলি শহর থেকে গ্রামের মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্তের কাছে সৌভাগ্যের চাবিকাঠি। রাতারাতি বিখ্যাত হওয়া থেকে প্রচুর আর্থিক পুরষ্কারের প্রলোভন সেখানে। অর্থাৎ নাচের যুতসই একটা বাজার তৈরি হয়েছে। তাই ব্যবসা যাতে লাভজনক হয় তাই একমাত্র লক্ষ্য ও বিবেচ্য। শিল্পের বালাই সেখানে না থাকলেও চলে। মঞ্চ থেকে মিডিয়া সবখানেই এখন বাজারের দাপট, শিল্প ঠেকেছে তলানিতে। গ্রামজীবনও মজে যাচ্ছে ডিজে, ইউটিউব আর টিকটক ভিডিওতে । উপরদিকে তাকিয়ে তাদের অন্ধ অনুকরণে উপরে উঠে আসার বাসনা তারিয়ে বেড়াচ্ছে নিচের তলার মানুষকে।
একদিকে ধর্মের পরিচয় আর শাস্ত্রের অনুশাসন, অন্যদিকে বাজার অর্থনীতি এই দু’য়ের মাঝে বাঁধা পরেছে বাঙালির নিজস্ব নৃত্যভাবনা,নৃত্যধারা। মানুষের শিল্প মানুষের সুখ দুখ, প্রেম বিরহ, স্বপ্ন ও সংগ্রামের কথা বলবে, তবেই তা তার একান্ত নিজের হয়ে উঠবে।শত বছর পরে্র মানুষ সেই একই পুরোনো জীর্ণ রাস্তায় হাঁটবে নাকি অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন রাস্তা গড়ে নেবে তা তাকেই ঠিক করতে হবে। গড়ে নেওয়া কঠিন তবে অসম্ভব নয়। সেই কঠিন কাজে ব্রতী হোক বর্তমান ও আগামী প্রজন্ম। বাঙালির নৃত্যধারায় বেঁচে থাকুক শিল্পচেতনা ও মানবিক বোধ ।
Posted in: Essay, February 2020