ধারাবাহিক গদ্য : সিন্ধু সোম

পর্ব – ৭

রাজস্থান ডায়েরিস-১১

ক্লিশ ক্লিশ ক্লিশ। মুখের ওপর ওপর জল দিলে চোখের ভেতর ভেসে ওঠে বায়োস্কোপ। টিং টিং টিং টিং। একটা সাইকেল। জাব্দা ক্যারিয়ারে বসানো বিশ্বকর্মা। রথের মেলা রথের মেলা বসেছে রথতলায়- গেয়ে ওঠেন সনৎ। একে একে পাল্টে যায় স্টিল শট। ক্যাঁচ ক্রোঁওওওও। অতীতের রিল গোটানোর শব্দ। জামার ভেতরে হানা দেয় কখনও সখনও। আওয়াজ ওঠে। আওয়াআআআআআজ। শব্দ। শব্দ আসলে কি? ধুকপুক ধুকপুক। নিজের হৃৎপিন্ড ধুলোয়। চশমার ফাঁকের গিলোটিন। ছাদে খোঁজে। মোড়ার তলায় খোঁজে। হিপ পকেটে খোঁজে। খুঁজে খুঁজে খুঁজে খুঁজে খুঁজে সারা। ভ্যাঁচর ভোঁচর। একটা জং ধরা সাবেকি সড়কি। ঠনঠন করে পেরিয়ে গেল একটা ছ্যাকরা গাড়ি। লন্ঠনের কাঁচা হলুদ রোশনাই দেয়। দোকান আছে। পাছাপেড়ে শাড়ি পরে বসে থাকে। ষোড়শী। জীবানন্দের আশায়। ছড়ানো কোলে ট্যাঁ ট্যাঁ করে নিষ্ঠুর দেড় ফুট। আমার অবাক লাগে। সব্জির ঠ্যালাগাড়ি মাতৃস্তন্য ফেরি করে আজকাল! এভাবেই ছ্যাকরা গাড়ি ল্যাম্বারগিনি হয়, শুধু লন্ঠনের কাজলকালি বদলায় না। ফঁস্‌স্‌স্‌স্‌সঁ। অদৃশ্য কাউকে শাসায় ঘোড়া। স্‌স্‌সাক। কড়ার চাবুক। ভেতরের বাষ্পে কাঁচ জোড়া অবধূতের নিঃশ্বাস। জটার প্রসন্নতা। ধুলোয় শুয়ে থাকা হৃৎপিণ্ড আশ্বাস পায়। তারপর কলমের ডগায় সড়কির প্রত্যাগমন। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বার করে আনে শেষ রক্তবিন্দু। লক্ষ্মীর আলপনায় নৌকো ভাসে খেরনের। আর্তনাদ সর্বোচ্চ শব্দ। ও ছাড়া ভাষার দশমী। একটা শকুনের পালক কুড়িয়ে নিই আমি। শবদেহে শব্দের জানাজা। শ্মশানের দোসর নদী আর কে আছে? পাশে তো সবাই থাকে একাকীত্বের বোঝা নিয়ে!

বিবাহিতা আর সময়ের ব্যাকুলতা রেখে আসি তীরে। দিতির টানে আখেরনের খেয়া। মৃদুল মন্দারে আমি নৌকো চাপি। একা নৌকো, খালি। কেউ কোত্থাও নেই। কুয়াশা আসে। সরে যায় মৃতের বার্তা নিয়ে। বাতি নেই। কালো বোরখার মতো অশিষ্টতা আমার চুলের ফাঁকে ফাঁকে। ছইয়ে হামা দেয় মাকড়সা। কেমন যেন বালতির প্রয়োজন। ছলাৎ ছল। অভিমানিনী। সতর্কতা খই-এর মতো ছড়ায় হাওয়া। আমার কণ্ঠনালী দাতাকর্ণ আজ। অনেকটা রক্ত। অনেকটা। দাম মিটানোর শব্দ করে বিলকাটানি। কেউ মানে। কেউ অর্ধভুক্ত থাকে। বাদুড়ের ডানার সঙ্গে আমি পুরুষাঙ্গের মিল পাই বরাবর। জেগে ওঠে সমুদ্র। চরাচর জুড়ে ফেনা। তার নীচে শিরার থেকে উপশিরার হয়ে শিকড়ের জাল। সোঁদা গন্ধ। ঘামে চিক চিক করে। উত্থিত কালো রাজদণ্ড। মুকুটে বিপ্লব। বড় বেশি শুকনো। অপেক্ষা করে। বেলনা দিয়ে বেলে ওটাকেই পরে থাকে। সুঁচালো দাঁতে আহ্বানের অধিকার। আকাশের কৃষ্ণ গহ্বরে মিলাতে চায় এক হয়ে। ইচ্ছার ওপরে দরদাম নেই। টুপ করে ঝরে পড়ে বকুলফুল।

সোনার কাঠি রূপোর কাঠি। ছোঁয়ালেই ঘুমের জোৎস্না। পৃথিবীর সব ছাদ তখন এপাইরাস। মরণের পারে এসে ভিড়ল খেয়া। দ্রিমি দ্রুম দ্রাম দিম। কেঁপে কেঁপে উঠছে বাডওয়িজ়ারের বোতল। দৈত্য দৈত্য। মন্ত্রোচ্চারণ। শিরার জটিলতা আমার চোখের তারা স্পর্শ করল। প্রশস্ত রাস্তার অপ্রশস্ত বুক। বুকের কাছাকাছি এক কিন্নরী। আঙুলের ভাঁজে তার শূন্যতার বেলুন। রামধনুর সুদের কারবার। ধারি জোনাকি জ্বলছে সেই শূন্যতায়। আমি দাঁড়ালাম। দৈত্যেদর্শনের কর চাই। কিন্নরী তাকিয়ে আছে চাঁদের দিকে। বিক্রিবাটায় তার মন নেই মোটে। মধুসূদনের তারার চিঠি মন আলোকবৃত্তে নামিয়ে রাখল। প্রেক্ষাগৃহের রেশ। জীবনের থেকে একটা পোড়া সুতো ঝুলে থাকে সেখানে। ভার্জিলের পাথর ঠেলায় লজ্জা পেয়ে মাটি নিজেই সরে যায়। উঠে আসে চেতনায় শোষিত নাঙ্গাপুঙ্গা একদল আসল অবয়ব। তাদের দেখে দুহাতে রঙচঙে মুখোস খামচে চিৎকার করে ওঠে চেতনা। “বহুরূপী বহুরুপী বহুরুপী বহুরুপী বহুরূপী”— বহুবার। থেকে থেকে। প্রতি কেল্লার দেয়ালে তার গন্ধ লেগে থাকে। বহুদিন। বহুজন্ম।

কিন্নরী আমাকে হাতছানি দিল। তার গোটা শরীর মেনে নিয়েছে স্বচ্ছতা। পা পা। একটু খানি কাছে। এবার জুতো আটকে রইল নোনায়। শরীর টানছে স্তব্ধতা। একটু একটু করে। ঝড়ের মতো শরীরহীনা লু বইছে। কেদার রাগে কেঁদে উঠল অন্ধকার। অপর প্রান্ত থেকে। কিন্নরীর স্বর ভাসে, “এনেছ?” আমার ঘাড় প্রয়োজনের থেকেও বেশি কাত হয়। “এনেছি।” বাড়িয়ে দিই অক্লান্ত দ্বিধা। কিন্নরী হাতের মুঠোয় দলে তাকে ব্রহ্ম বানিয়ে ফেলে। কাছাকাছি। তারপর বলে, “এস। আমার যেখানে শেষ সেখানে স্রোতের রাজ্য শুরু। পারা না পারার প্রশ্ন নেই। শুধু খোদাই করা আছে। ঘটমান।” আমার চোখ নিজের অজান্তেই কি চকচক করেছিল একটুও? “তবে যে লোকে বলে তোমার নাম সুজাতা? তুমিই নাকি সুখী সব চেয়ে?” কিন্নরী এবার আমার কৃষ্ণগহ্বরে তূণ নামিয়ে রাখল। নোঙ্গরের খাঁজে উঠে এল অহং-এর টুকরো। আমি দেখলাম নগ্ন তিরস্কারের হাসি। কিন্নরী ঠোঁটে চকচক করছে ছিন্নতা। বললে, “বেলুনয়ালীর সঙ্গে তামাশা করতে নেই সাহাব, তাতে রঙের অভিশাপ লাগে!” অভিশাপের কাছে আশীর্বাদের নেশা কতটুকু? দিতি জানে। বিবাহিতা জানে। অনুসরণ। আমি এগিয়ে চললাম শূন্যতার পিছু পিছু। খস খস। নিমের পাতারা ঝগড়া করছে। যেখানে দিগন্ত নেই তাকেই বোধহয় অন্দরমহল বলে।

জেয়সলমীর। পাতাল উঠে আসছে পাতলা কুয়াশার মতো এই ছাদে। আমার সরণের হিসাব রাখছে নোনা। দূর দৃষ্টি এক মহলের ওপর। কিন্নরীর আঁচলের অমোঘতাই নাবিক। সে মহলের উপরে রূপোলী ঝুরি নেমে আসছে মেঘ থেকে। এক বৃদ্ধ। চারটে মোট। বাহনের অপেক্ষায়। আমার বস্তিতে জলের লাইনের প্রতীক্ষাও ঠিক এরকম। প্রেমে জলে চিরকাল যেখানে মিশ খেয়ে এসেছে পলাশ গাছ সেখানে আপনি জন্মায়। পলাশের ফল ডুব দেয় আলগোছে রেখে যাওয়া কোনো হাঁড়িয়ার পাত্রে। আমার বাদুড়মারার চুলে বিলি কেটে বয়ে যায় অজয়। সেখানেও কারোর প্রেমিকা এরকম প্রতীক্ষায় থেকে এসেছে চিরকাল। গব গব গব। কলসী ভরে নেয় কিছুটা শূন্যতা। আলোয়ান চড়িয়ে ব্রিজটাকে ঢেকে রাখে কেউ। অনেক দিনের পুরোন নেশার মতো। সবটাই পুঁজি। ভাঙ্গিয়ে বাঁচার পথে একলা শোষিতা পড়ে থাকে মুখ ঢেকে। চর বেদনার ছাই ভস্ম মেখে চিকচিক করে ওঠে। জ্যোৎস্না নিতে চায়না অজয়। তাই ফিরিয়ে দেওয়ার আগে একবার হাসে।

“সারাদিন আলোর তরঙ্গ থেকে ধ্বনি জাগেঃ
দূরে যাও।
সারারাত্রি অন্ধকার কানে কানে মন্ত্র দেয়ঃ
দূরে যাও।
………………
তোমরা কেউ কি
উন্মাদের মতো ঢিল ছুঁড়ে যাচ্ছ স্মৃতির অতলে?”[১]

ধূপের গাঢ়ত্ব ধোঁয়ার আবেশ কতটুকুই বা ধরতে পারে! মুঠো খুললেই ছোঁ। ঝাপসা ঘনায় ঘোর। আমার তরলের নেশা তরলীকৃত চাঁদ গোনার চেষ্টা করে। একটা বিরাট বালি-মাঠের সীমানা এ। রাত কেটে দিন। টিপের করাত। কে এনে দেয়? কেন? আকাশে রূপোর থালার কোণ ধরে পায়চারি করছে একটা চিল। অন্ধকারে বাদুড় ধরছে কি? অথবা পেঁচার সাথে বচসার হাটে। টুপি ছেঁড়া অজয় মনে পড়ে আবার। মরুভূমির বুকে। পাথরের এস্কেলেটরে। ঘটাং ঘটাং। এ সীমানায় একটা ফাঁকা সিংহদ্বার আছে। ঠাঁই একা। পাঁচিলের ঘোমটা পর্যন্ত নেই। আনন্দের ভারী জং ধরা বিরাট দরজা খুলে গেল। কিন্নরী পিছন ফিরল এবার। দুলে উঠল তার পাছাঢাকা চুল। আহা! অজয় যদি ওকে ভালবাসত! আমি অজয়ের শরীরের ওপর নিজেকে দেখতাম একবার। অন্ধকারে মেজে ঘষে। হয়ত পরিষ্কারও একটা বৃত্তি। জোৎস্না-স্কলারদের জন্যে তোলা থাকে! জলের স্রোত। স্রোতের কাছে বন্ধক ভাঙানি। ভাঙতে গেলেই উষ্ণ প্রস্রবণ। কিন্নরীর হাতে তুলে দিলাম অন্ধত্ব। একটু ঝুঁকে সেলাম করল সে। সেই নোনার রাস্তায় দোকানটুকুর নিঃসঙ্গতা ঢেকে নিল তাকে। আমি আমার খালি পায়ের অভিমান আর মধ্যবিত্ত জটিলতা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম দরজায়। মুখ থেকে ঠোঁট। ঠোঁট কেটে চোখ।

এখানে এসে প্রত্যেক ব্যক্তিত্ব একবার দীর্ঘশ্বাস মাপে। ঢুলুঢুলু শব্দে। স্রোতের কাছাকাছি…

আলোকলেখ্য—স্বয়ং
২৬শে অক্টোবর ২০১৮
সকাল ১১টা ২৭

পক্ষীরাজের অ-ডানালীন একটা বিকেল-চিকুর ছায়া আমাকে কবর থেকে জ্যোৎস্না তুলতে পাঠিয়েছে সেদিনও

গগন দ্যোতনাহারা বদন তোমার সখী, কালো তিলে আলোকিত নাভিতলে বিধুআঁখি

রাজস্থান ডায়েরিস-১২

“স্বপ্নের বদলে এইসব জীবাশ্মপ্রস্তরের মহাকাব্য মহাকালের
ঝঞ্ঝানাচন মারণযজ্ঞ কাল থেকে কালান্তরে রেখে যাওয়া মমি প্যাপিরাস
মেসোপটেমিয়ার
পাথর কুঠার
গয়নাগাঁটি
দেখে নেওয়া যাক হে নিয়তি তো সময় থেকে
সময়ান্তরের মাটি আর ছাই
ছাইচাপা শূন্যতা
মরারক্ত
দুঃস্বপ্নে দেখে নেওয়া যাক স্বপ্নকামী মানুষের দ্বিচারিতা আর সিঁড়িভাঙ্গার কাদামাখা
ইতিহাস বুকে বর্বর শহর আর প্লাস্টিক গ্রাম খাদ্যব্যাভিচারের অবশিষ্ট সিফিলিসরাত
প্রভাতহীন অন্ধকারে ডুবে থাকা কামলালাজর্জর সভ্যতার তেজস্ক্রিয়ভয় ও আর্তনাদ
সঞ্চয়ীও সুদজীবিদের কীটগ্রন্থ হৃদয় ফুঁড়ে রাসায়নিক ভাইরাস এলিটদের শুক্রথলিতে
ওফ্‌ দেখে নেওয়া যাক আর যা যা বাকি কুয়াসার পরতে মাকড়সাজালের ভাঁজে
সাইবারনেটিকষড়যন্ত্র নষ্ট চেতনার শিকড়হীন স্কাইস্ক্র্যাপার যাবতীয় সাফল্যের
গোপনভল্টে
রক্তমাখা বেড্‌শিট
পিলের শিশি
ফর্মালিনে ডোবানো
সন্তানের আধখাওয়া দেহ

এইসব দুঃস্বপ্নের শেষে, হে তুমি পাগলমাতালনগ্নশিশুপ্রেমিকযিশু অতিবেগুনীরশ্মীবিহীন
এক বসন্তভোর দেখে ফেলতে পারো
ঈভের গর্ভধান ও নদীর জন্মদৃশ্য” [২]

অর্ফিয়াস? অর্ফিয়াস! সঙ্কীর্ণ বালির পথ বিছানো। প্রশস্ত মরুর বুকের ঘায়ের মতো। অসীমসীমা। বাক্সবন্দী হয়ে উঠেছে ধৈর্য। আমি কুকুরের মতো গন্ধ নিয়ে এগোচ্ছি। মহল নেই। এখানেও তৃষ্ণা। পাথুরে উচ্চতা ঝুঁকে এসেছে নীচে। চশমা নীল। একটা দুটো নুড়ি কুড়োনো ইউক্যালিপটাস। ক্ষেতের মতো চষা রাস্তা। বাসের গম্ভীর ঝিমুনি। টুং টাং। লীয়র? দিতির চোখ আকাশে মনে হল একবার দেখলাম। ও কি দেখছে? দৈত্য কি সব দেখতে পায়? উইয়ের ঢিবির মতো পুরোনো শুকতারার বুকে আমি হারিয়ে যাওয়া টারজান দেখতে পাই। গুহার ভেতর থেকে ঝলকের আগুন। চোখ জ্বলে যায়। সাদা ঘোড়ার খুরের ছাপ নেই। রোদের রশ্মি-ব্যাখ্যান। ছুঁচের মতো ফোটে। গা ছম ছম করে। দৈত্য পাশার উল্টোদানে। কে তার শালুক পাতা চেনে? কেউ না! এ পৃথিবীতে হৃদরোগের রাজকর উদারনৈতিক বাজারের মতোই পাঁজর খোঁচানোর তুলনায় আকাশছোঁয়া। একপ্রান্তে চোখের মণির খর সূর্য। আমি সুর চাই একটু। এখানে কান্না নেই এতটুকু? আনন্দের খরা আমাকে ক্লান্ত করে। দিতির আঙ্গুল ছোঁয়ার প্রতিজ্ঞা আমার এ জন্মও অস্বীকার করবে কি?

দ্বিধার পুঁজিটা ঝুলছে হালকা হয়ে। প্রথমবার খাওয়া সেই আপেলের খোসা হয়ে লেগে থাকে অস্তিত্বের দাঁতে। মরুমাটিতে কাঁটা ফলের চাষ। তৈলাক্ত বারান্দা। গোবর লেপা দেয়াল থেকে গোরুর উচ্চতা পাওয়া যায়না। সম্ভোগের এককটুকু। চূড়া থেকে চূড়ায় ভাসছে অবদমন। ওকি ব্যবহার যোগ্য! আমার আবার ঘেন্না করে খুব। ভক্তি মূলে ভজন ভুলেছে বিভাজ্য। ঐতিহ্যের গুরুত্বে কান ধরে দাঁড়িয়ে একটা ভাঙা মন্দির। দুলে দুলে নামতা পড়ে সুহাসিনী। পমেটম শব্দটায় বেশ একটা সঞ্চারিণী-ছাপ আছে। মোহরখানা কার? ও পাঞ্জায় কতদূর নিয়ে যাবে? পড়া না বলতে পারা বালিকার চোখে জল। আমাদের সারদা একবার কেঁদেছিল। হেডমাস্টারের কাছে দুম দুম। আমি। ভুল করে। সারদার বিশ্বাস আর অবিশ্বাসে পার্থক্য ছিল না খুব একটা। আসলে অবিশ্বাসও তো বিশ্বাসই কোনোখানে। একটা একা জীর্ণ হাত মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় বালিকা সুহাসিনীর। কমল নয়। সমুদ্র। পড়া না বলতে পারা অবাধ্যতাকে প্রশ্রয়ের ছায়া দিচ্ছে একাকী বাবলা। বিদ্যাসাগর দাঁড়িয়ে আছেন। আমার কেমন জানি শীতের দুপুরের উদাসীনতা পেল। গুন গুন করে কানের কাছে কেউ বলতে লাগল উনি হয়তো রোজ এসে বসেন এর ধারে। ধুলোয় আঙুল বোলান একটু।

রোদ আমার পাশে বসল ধুলো না ঝেড়েই। বললাম,”ওকি রে! অপবিত্রতার ভয় নেই তোর?” সে বললে,”জীবন থেকে আমাকে ছেঁচে সরিয়ে দিলে ওসব পড়ে থাকে। বাদ দে…!” একটু অবাক হলাম। “তোকে শালা কখন থেকে খুঁজছি! ছিলিস কোথায়?” বললে, “আতরভাঙা আতসকাঁচে ফুলও ফোটে। আর্কিমিডিসকে বোঝাচ্ছিলাম।” কেমন একটা বোবা হাতপাখার মতো লাগে নিজেকে। ছন্দপতনের দোষ আমরা অক্ষরকেই দিয়ে থাকি। আঁচলের তলায় দেখি না। একটা সিগারেট ধরালাম। ধোঁয়া দেখে মেঘ একবার ইতস্তত করলে বটে। তবে গড়ালো না কিছু। এ মরুভূমি দেয়াল তোলা। কুচো কুচো ‘সভ্যতা’র প্লাস্টার পড়েছে। পাঁচতলা পিরামিড। জেয়সলমীরের জোৎস্না ছেড়ে এসেছি আদিখ্যেতায়। পাতালের এই ঘের যোধপুর। এ মরু নাগর খুঁজে খুঁজে নাগরিক হয়েছে। আস্ত খেয়ে ফেলে সরলতার স্নিগ্ধতা। রাত নেই। দিন নেই। আছে শুধু দোলাচল। সুপুরি কাটার মতো বাতাস কাটছে উঁচু দেয়াল। বড় ওভারব্রিজ সারি শুকের খাঁচার মতো পূতিগন্ধময়। আসলে সব রূপকথার পিছনেই খানিকটা বিষ্ঠা লেগে থাকে। দূরবীনের অসমতা ঐ পর্যন্ত ছুঁতে পারে না। আর খালি চোখে যশোর রোড কেউ দেখেনি কোনোদিন। ওসব জায়গা বরাবরই ঝাপসা হয়ে থাকে।

দিগন্ত নেই। তবে ইতিউতিত্বে চোখে নিল এবার। মাঝামাঝি দূরত্বে পুট। একটা পুটকি। রোদ বললে, “ওখানেই দৈত্যপুরী।” শিউরে শিউরে উঠছে বালি। বহুদূর তার আকর্ষণ নিচ্ছে হাওয়া। রোদের কথকতায় বিভোর সেই গাছের ছায়া। ওরা এগোবে না। জন্মের সেই স্মৃতি। দিতিকে ছুঁতে এরপর বরাবর আমি একা হারিয়ে গিয়েছি। না হারালে ঐ মহলে পৌঁছনো যায় না। থক থক করছে পাথরের রক্ত। ফাটাফাটা ঠোঁট। বব ডিলান সুমনের কণ্ঠে জানান, “কতটা পথ পেরোলে তবে……”! পায়রা নাচছে। পায়ের নীচে সরে সরে যায় দিক। আমার চুম্বকে চিত্রহার বাসা বাঁধে গোপনে। শঙ্কিত দুরুদুরু বুকে আমি হারিয়ে যেতে হারিয়ে পড়ি। একটা তীর। বিঁধে আছে বেদীর মাঝামাঝি। তেল সিঁদুরে পিচ্ছিল। এই তীরেই ভারতবর্ষ বিদ্যাসাগর-বধ করে আসছে যুগান্তর। মাথায় বাঁধা অস্তিত্বের রুমালটা আমি খুলে রাখলাম। খেজুর কাঁটায় জন্ম নিচ্ছে সাবলীল হাসনুহানা। আমি তার শব্দ শুনতে চাইছি শুধু।

একফোঁটা কান্না চাই। শুধু এক আদুর গায়ের সুর। এটুকুই…

আলোকলেখ্য—স্বয়ং
২৬শে অক্টোবর ২০১৮
দুপুর ১২টা ২০

একাকীষ্ণ চাপ মেঘমন্দিরের শুক্র উত্থিত লিঙ্গের সহজপাঠে বজ্র শানায়, শুনতে পাও?

মহলের দাঁতসারি অঘোরীর চোখরঙ্গা ছাই, নিশুতি শস্য তবু অনুমিত কথ্যক সম, ত্রিভঙ্গ একাকার কালী জঙ্ঘাপরে

[১] নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
[২] সাত্ত্বিক নন্দী

Facebook Comments

Posted in: February 2020, Prose

Tagged as: ,

Leave a Reply