অনুবাদ কবিতা : রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়
কেন্ট জনসনের দুটি কবিতা
কবিতা তোমার জীবন বাঁচাবে
(Poetry Will Save Your Life)
একটা আদর্শ যা আমি বহু বছর ধরে রেখেছিলাম, তা বেশ ঠিকই ছিল,
সম্ভবত ছয় কি সাত বছর, উনিশ থেকে পঁচিশ ছাব্বিশ বছর।
কিন্তু আমার মধ্যকুড়ির বয়সে, আমি বুঝতে পারি
কবিতা নিশ্চিতভাবে তোমার জীবন বাঁচাবে না। সত্যি বলতে কি
আমি নিজেকে বলেছিলাম এ কেবল জীবনকে আরও খারাপ করে দিচ্ছে!
এ আমি বুঝেছিলাম আমার ধসলাগা ভাগ্য দেখে আর
আমার নানা আসক্তি, দুর্ঘটনা ও বন্ধনদশার দিকে তাকিয়ে,
আর অবশ্যই আমি যখন বোদলেয়ারের কয়েকটা পঙ্ক্তি
চিৎকার করে বলেছিলাম আর দ্রুত পান করেছিলাম এক গ্লাস নির্মলি,
যা আমার খাদ্যনালীকে প্রায় দ্রবীভূত করে ফেলেছিল,
যাতে আমার গলায় এক চিরস্থায়ী গর্ত তৈরি হয়,
যার মাধ্যমে আমাকে খাবার ও জল খাওয়ানো হয়,
আর যার ফলে আমার কণ্ঠস্বর অশুভ রোবটের মতো শোনায়
যখন আমি আমন্ত্রিত হই কবিতা পাঠের জন্য, কোন সন্দেহ নেই
যা আমার অস্বাভাবিক অবস্থার কারণে মানুষকে বাধ্য করে,
যেমন আমার এক কবি “বন্ধু” একবার ইশারায় হেসে বলেছিল,
এ খুব সুপরিচিত যে আমার প্রশ্নবোধক চিঠিতে আমি সেই বিশ্বাসকে
তুলে ধরি যে আমি নিশ্চয়ই জানি যে তাদের প্রতিষ্ঠানটি
পোষ্য মানুষের সঙ্গে কখনই বিভেদে যায় না। বেশিরভাগ কবিদের মতো,
সেই মানুষটিও তেমন সুবিধের নয় বলে পরিগণিত হয়,
আর এই কারণেই আমি জানি যে কবিতা তোমার জীবন বাঁচাবে না:
তোমাকে যা করতে হবে তা হল চারপাশের কবিদের দেখা,
সেটা নিউ ইয়র্ক সিটি হোক বা উদ্ভট মিডওয়েস্টার্ন কলেজ টাউন হোক
আর দেখো কী নির্দয়, অবিনীত আর আত্মমগ্ন মানুষ ওরা,
কবিরা মূলত নিজেদের জন্যই আর তাদের কবিতাবৃত্তির জন্যই বেরিয়েছে,
তাদের জীবনপঞ্জি যত বড় হয় ততই অপ্রীতিকর হয়।
আমার তৃতীয় প্রাক্তন স্ত্রী, নিজের অনেক ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও,
যিনি কোনো বিষয়ে বলতে গেলে তার সারমর্ম নিখুঁত তুলে ধরতে পারতেন,
একবার আমাকে শুধিয়েছিলেন “কোনও কবি কি পুরোনো আনুকূল্য ছাড়া
একবারও তোমার ভালো কিছু করেছে দ্বিতীয়বার?”
আমি কিছুক্ষণের জন্য স্মৃতি হাতড়ে দেখি একটা ‘না’ উঠে আসছে
আমার অনেক নিঃস্বার্থ কাজ সত্ত্বেও, অন্য কবি বিশেষত তরুণদের জন্য,
যারা কখনও আমার জন্য একাধিকবার কিছু করেনি
যতক্ষণ না আমি তাদের জন্য কিছু করে আনুকূল্য ফিরিয়ে দিয়েছি,
তুমি জানো কবিরা সাধারণত যে কাজগুলো করে, কিছু সমালোচনা বা ব্লার্ব লেখা,
সম্পাদকের সঙ্গে কিছু কথা, জোসেফ বা মেরিকে কবিতাপাঠের আমন্ত্রণ,
এইরকম সবকিছু। তারপর যখন আমি এ সম্পর্কে ভাবি, আতঙ্কগ্রস্ত হই, বুঝতে পারি
পরিবর্তে অন্য কবির জন্য দ্বিতীয়বার কিছু করেছি বলে মনে করতে পারছি না।
এটা হয়েছিল নির্মলি পান করার ঠিক আগে, আমার বয়স তখন ছত্রিশ হবে মনে হয়,
এক দশক আগে আমি যেমন বলেছিলাম যে কবিতা কখনও তোমার বা আমার
জীবন বাঁচাতে পারে না, তাই পূর্বাপর বিবেচনা করলে আমার মনে হয়
আমি এর আগে এই ধারণা দিয়েছিলাম যে আমি আমার বছর কুড়ির বয়সে
এই নির্মলি পান করেছি। যাই হোক, তখন আমার বছর তিরিশ বয়স হবে,
যখন আমি উইকিপিডিয়া থেকে নকল করে আমার নিজের কাজ বলে
চালিয়েছি যতক্ষণ না এক নীচ ও খুঁতখুঁতে সমালোচক আমাকে ধরে ফেলে,
যার প্রবন্ধ অনেকগুলো বড় সংবাদপত্রে ও আন্তর্জালে ছাপা হয়,
যার পর সমস্ত কবিতাপাঠের আমন্ত্রণ বন্ধ হয়ে যায়। তো আমি এইখানে,
আমার যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর নিয়ে এই কবিতা লিখছি। তাই আমি বলি
এইসব অসুবিধে সত্ত্বেও লড়ে যেতে হবে, আমার এই চৌষট্টি বছর বয়সে
আমি কী একটা পুরুষ রক্ষিতা হব? আমি হয়তো একটা বই লিখবো
যার শিরোনাম হবে ‘কবিতা তোমার জীবন বাঁচাবে’, এক স্মৃতিচারণ সংকলন,
কোথাও দেখেছি এমনই বাক্যব্যবহার, যা কোনো বড় প্রকাশক দিয়ে
বাজারে ছাড়া যেতে পারে স্বনির্ভর ম্যানুয়াল হিসেবে। পিছনের মলাটে
আমার ছবি থাকবে, আমার বাঁচোখের ওপর তাপ্পি সহ, অর্ধেক কানকাটা
আর ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের মত একটা নল বেরিয়ে থাকবে আমার গলা থেকে।
অথবা কোনো নল নয় বরং একটা গর্ত। আমার মনে হয় না
এমন গলায় হাঁ-করা গর্ত সহ কখনও কোনও লেখকের ছবি ছাপা হয়েছে
আর এটা শিরোনামের সঙ্গে বেশ ভালোই খাপ খাবে।
কবিতার জন্য সত্যিই আমার এক বড় বাড়ি আছে
(Because of Poetry, I Have a Really Big House –to Michael Basinski)
কবিতার জন্য সত্যিই আমার একটা বড় বাড়ি আছে।
বাড়ির পিছনে বিনীত বুনো হাঁসের সংসার।
তারা খেলা করে চারপাশে আর আপাতসুন্দর রোদে
ঝলকায় আশ্চর্য আলো। তারা নম্র ও শান্ত,
এমন এক প্রজাতি যেখানে সোনালি কেশর ঝলকে
খেলা করে পুরুষ পাখিরা। হ্যাঁ, আমি হাঁটতে ভালোবাসি।
আমি এটুকুই করি আর চলতে চলতে ক্রোধে ও উপহাসে
কথা বলি নিজের সঙ্গে, গান করি ক্রিস্টোফার স্মার্টের মতো
নতজানু আমি। মাথার ওপর হামিংবার্ড ও চিলের ওড়াউড়ি
জন্ম দেয় বাদুড়ঘেরা বন। তাই আমি বৃক্ষবিদ বন্ধু
টেডের কাছে যাই। সে আমাকে শুধায় সাদা মন্দিরে
আমি যেতে চাই কিনা কিছুক্ষণের জন্য, যেখানে তারা
প্রতিটা মন্দিরে গজ রাখে আর দাঁত বসায় নীল চামচে।
আমি স্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠে দেখি আমার নীচের চাদরটা
বাদামি ও ভেজা ভেজা। তবুও টেড হাসে আর বলে,
“তুমি ভা্লো করেছ কবি!” আর তারপর সে ঈশ্বরকে
ফোন করে আর সব অন্ধকার হয়ে যায়। এসব নিশ্চয়ই ঘটে
যখন দানবী আমাকে নিয়ে যায় বাড়ির পিছনে থাকা
ভালো কবিতার বইভরা ঘরে। আমাকে বলে, এ বেশ মজার,
কোনো শব্দই কবিতার সঙ্গে সুর মেলায় না বর্ণসংকর ঢল ছাড়া
যেমন পোপতন্ত্র, গোষ্ঠীতন্ত্র আর অ্যাশবেরি…
প্রসাধনাদি, বলে দুষ্টু দানবী। তার মুখ ছায়াময় রহস্য।
এখন আমার বিছানায় সাত ফুট নেরুদামুখী ইঁদুর বসে আছে।
তবে তা ঠিকই আছে: কবিতার জন্য সত্যিই আমার একটা বড় বাড়ি আছে।
Posted in: February 2020, Translation