ধারাবাহিক উপন্যাস : নীলাব্জ চক্রবর্তী
যখন সবাই ছিল সংখ্যালঘু অথবা বাথরুমের জানলা থেকে চাঁদ দেখা যাচ্ছে
একাদশ পর্ব
২১
= = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = =
এখানে
কেজি দরে
কবিতা বিক্রি হয়
= = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = =
# * # * #
— আপুনার পিতাজীকে একবার দাততো ডাগদারবাবুকে দেখিয়ে লিবেন দাদা। উ একদম সহি ওষুধ দিবে। জ্যায়দা অটর-মটর কোনও ওষুধ দিবে না। দুটা কি তিনটা। একদম চাঙ্গা করিয়া দিবে। ফিন দুসরা কোনও ডাগদার দিখানো লাগবে না। দুসরা কুনও টেস ভি কারাতে হোবে না।
— তুমি আল্লু অর্জুনকে চেনো?
— এহহ… কংগ্রেস তো একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল দেখি!
— আমার কারো কাছে কিছু প্রমাণ করার নেই গো… অনেক হয়েছে…
— এয়া কী! ছুটবউ ভাষাডা এমন কইরা এহানে এই পুকুরপাড়ে ফালায়া থুইসে ক্যান?
— ওয়েল, শোনো শোনো, আমরা ফরিদপুরের লোক, বুঝেছ… ফরিদপুর! ইয়েস, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ফরিদপুরের লোক আমরা…
— হ্যালো স্যর! গুড মর্নিং! আমার নাম বিশ্ব। বিশ্বদেব মজুমদার। একটা কাজের ব্যাপারে এসেছিলাম স্যার। একটা চাকরী। রবিদা পাঠিয়েছে স্যর। আমার… আমার খুব দরকার স্যর চাকরীটা। রবিদা আপনার সাথে দেখা করতে বলে দিয়েছিল স্যর…
— অন্যের কাছে না। প্রমাণ তো নিজেরই কাছে নিজেকে দিতে হয়। রোজ… প্রতিদিন…
— এক দেশ, এক ধর্ম, এক পার্টি, এক নেতা, এক ভাষা, এক পোশাক, এক খাদ্য, এক ব্যবসায়ী, এক নেটওয়ার্ক… দেখবেন, অ্যাজেণ্ডায় পরপর কেমন সব চলে আসবে… একদম স্মুদলি… ধরতে পারবেন না…
— মূলাডা যে আনলাম হেইদিন… ভাতে তো দিলানা! থাউক… আর দিয়া কাম নাই। রাইখ্যা দাও… আমি মরলে ওই মূলা আমার চিতায় দেবা…
— এইসব লোকঠকানো বাম-ঐক্যের নামে আদতে সিপিয়েমের হাত শক্ত করার প্রচেষ্টাগুলো মেনে নিতে অসুবিধা হয় আমার…
— কর্পোরেট শব্দটাকে বাংলায় কী বলা যায় বলো তো…
— তো উসদিন ডাগদারবাবু পেহলে আমাকে বললেন তুমার নাম কী আছে। তো হামি বললাম কী চন্দন হামার নাম ডাগদারবাবু। ফিন উনি বললেন যে চন্দন তুমি কী কাম করো। তো হামি বললাম যে রিকসা চালাই ডাগদারবাবু। উনি দুইশ টাকা নিলেন আর পাঁচদিনের ওষুধ দিলেন। লেকিন আন্যো সব লোগের থিকে পানশো রুপিয়া নিবে। ওই ওষুধ লিয়ে লিয়ে হামি তো বিলকুল তন্দুরস্ত হয়ে গেছি দাদা তারপর…
— একজায়গায় দেখেছিলাম জানো, কংগ্রেস = বিজেপি – গরু
— ছাড়ো তো ওইসব… ফরিদপুর আর যাদবপুর! রাখো। তাছাড়া, শোনো, এটা না, এনারসি আর সিএএ-র জমানা। কেমন? তোমার ওই, ওই ফরিদপুর, বঙ্গবন্ধু… এসব ভাঁটের ডায়লগ বেশী মেরো না সবজায়গায়… কেস খেয়ে যাবে যখন-তখন…
— এখনও অ্যাতো লোক কেরোসিন তেলের জন্য লাইনে দাঁড়ায়!!!
— পেনশন তো… হুঁ… সবাই পাবে কিছু না কিছু। খালি ফর্ম ভর্তি করতে হবে… কাগজপত্র জমা দিতে হবে…
— এতো কথার আছেডা কী! আমরা নিজেরা অহন পারুম না, বিজেপি আইসা তৃণমূলরে টাইট দিক। আমাগো কী? আমাগো তো এইডাই ভালো। অরাই তো আমাগো মেন শত্তুর…
— হা হা… এনারসি আর সিএএ… ভাল বলেছ… তাও যদি এই উপন্যাসের নামটা লভ ইন দ্য টাইম অব এনারসি রাখা যেত… তাও তো কপালে নেই…
— আরে কাল ম্যাচ দেখেছিস মেরে ভাই! সাইনি কীসব ইয়র্কার ডালছে!
— সেই, অনুপ্রেরণার রাজ্যে থেকে থেকে উপন্যাসের নামটাও মার্কেজ থেকে একদম ডাইরেক্ট অনুপ্রেরণা… অ্যাঁ… মন্দ কী?
— আরে ভাষার আমি কীই বা আর জানি… তোমাকে জানি বড়জোর… একটু একটু…
— চ-রি-ত্র চাই চো-ও-ও-রি-ত্র-ও-ও-ও…
— আই অ্যাম আ পোয়েট। ওয়ান্স আ পোয়েট, অলওয়েজ আ পোয়েট। উপন্যাস লিখছি তো কী হয়েছে… সংলাপ জোড়া দেওয়া আমার কাজ না…
— তোমার বাবা কেমন আছেন এখন?
— ওহহো… এই রাস্তার লাইটগুলো আবার খারাপ হয়ে গ্যাছে!
— কে এই মাদাম দেবানন্দ? তোমায় বলতেই হবে…
— এরা, কী বলব, লোকজনকে এমন উল্টোপালটা কথা বলে, এমন অপমান করে… এতে যে সংগঠনের কতটা ক্ষতি হয়, সেটা বোঝে না…
— বাবা মোটামুটি ভাল আছে এখন… ছুটির দিন বিকেলবেলা আমার সাথে হাঁটতে বেরোয়…
— অ্যাডটা দেখেছিস? কাল থেকে সাতরঙা চ্যনেলে প্রাইমটাইমে নতুন প্রোগ্রাম শুরু হচ্ছে… ঘণ্টাদেড়েক সঙ্গে দেড়েল…
— কেউ কেউ বলেন, হিটলারের ইহুদী নিধনের মূলে শেক্সপীয়রের মার্চেন্ট অব ভেনিস নাটকটা তথা ওই শাইলক চরিত্রটার অবদান আছে। এক অর্থে, ওই চরিত্রটা ওভাবে তৈরী করে সেক্ষপীর সাহেব ঠিক করেননি… য়ুরোপ জুড়ে ইহুদী-বিদ্বেষ অনেকটাই ছড়িয়েছিল ওই কারণে… আসলে মানুষ বিদ্বেষ খুব ভালবাসে জানো তো… বিদ্বিষ্ট হতে ভালবাসে… কোনও না কোনওভাবে বিদ্বেষ আর ঘৃণার কারণ ঠিকই খুঁজে পেয়ে যায়…
— পালং দশ… ফুলকপি দশ… জ্যান্ত… জ্যান্ত… লাফাচ্ছে… লাফাচ্ছে… পালং দশ… ফুলকপি দশ… বাঁধাকপি পনেরো… বাড়ি নিয়ে যান… জ্যান্ত সবজি… লাফাচ্ছে… লাফাচ্ছে…
— না দাদা। আমার চরিত্র লাগবে না… আমি সংলাপ খুঁজছি… দৃশ্য খুঁজছি দাদা… ঝুঁকে, নীচু হয়ে একটু একটু করে সংলাপ আর দৃশ্য কুড়িয়ে নিচ্ছি দাদা… চরিত্র লাগবে না… স্বভাবও লাগবে না। স্বভাব এমনিই ভাল আমার… চরিত্র অবশ্য… যাকগে, থাক… লাগবে না দাদা…
— হেভি অহংকার তোমার, না? ওই তো বালের লেখালেখি…
— এই রাস্তাটা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যখনই এই বাড়িটার কাছে চলে আসি, জানো, প্রতিবার উৎপলকুমারের টোকিও লণ্ড্রি গল্পটার কথা মনে পড়ে… একটা ছবি তুলে রাখব ভাবি বাড়িটার… হয় আর না…
— মার্চেন্ট অব ভেনিস ছাড়ো। টেম্পেস্ট মনে আছে তোমার? গল্পটা কী ছিল যেন…
— কী মনে হয় তোমার? এই আম আদমি পার্টি-র জেতা আর বিজেপি-র জেতার মধ্যে রাজনৈতিক কোনও পার্থক্য আছে তেমন?
— ওই তো… আমাবইস্যা লাগবো সইন্ধ্যা ছয়ডায়… তহনি চতুর্দশী ছাইড়া যাইবো…
— সরি স্যর, আই অ্যাম নট আ নর্থ ইণ্ডিয়ান… ইনফ্যাক্ট, আ বেঙ্গলি…
— বরং গাইতে থাকি… মেরে কিসমত মে তু নহী শায়দ…
— হুঁ, বুঝতে পারছি… সেই সারাক্ষণ দুঃখ-দুঃখ ভাবটা আর নেই আজকাল। সামলে নিয়েছ, না? ভাল ভাল…
# * # * #
এইভাবে কথা বলতে বলতে… আর… এর-ওর-তার কথার মধ্যে ঢুকে পড়তে পড়তে আর বেরিয়ে যেতে যেতে… আর… নিজেদের কথার মধ্যে একে-ওকে-তাকে ঢুকিয়ে নিতে নিতে আর বার করে দিতে দিতে… আর… কথা বলতে বলতে… আমরা, পরস্পরের আঙুল বদলে নিচ্ছিলাম। একটা নিষ্ঠুর আয়না কোথাও। কে কার মতো। আবার কাঁচের গায়ে আটকে যাচ্ছে একটা অস্পষ্ট ফুটো ফুটো দিন। ক্রমশঃ শরীর হচ্ছে একরকম ব্যবহার। ফল করছে। ভেঙে যাওয়া জলেদের ঘরবাড়ি। কাট। যেসব আশ্চর্য ছুঁয়ে থাকা। বিদ্ধ হয়। রেডিও-তে প্রতিটি এফ.এম. চ্যানেলে একটাই বিজ্ঞাপন বাজতে থাকে।
আসুন আসুন… দানা দানা গ্যারাণ্টি পানিফল… শুধু আমাদের প্রচার-গাড়িতেই পাবেন… যেকোনো একটি পুরনো বিকেলের পরিবর্তে নিয়ে যান ৫০০ গ্রাম দানা দানা গ্যারাণ্টি পানিফল… আর ১ কেজি পানিফলের জন্য রেখে যান বাতিল হয়ে যাওয়া যেকোনো দুটি শীতকালীন সম্পর্ক…
একটা উঁচুনীচু ঋতু। নতুন হতে চাইছে। একে বলো পবিত্রতার কনসেপ্ট। বলো কোকা কোলা কেন আরেকটু শীতল হবে না। বড়ো বড়ো জানলা। ঘরের বাকি দেওয়ালগুলি সাদা। কোনও আসবাব নেই। সারা ঘরে নড়েচড়ে শব্দরা উঠছে। রাফনেস ইনডেক্স। য-ফলা খেয়ে ফেলছে। টার্ন টু ইয়োর লেফ্ট। লো-অ্যাঙ্গেল থেকে দেখতে পাওয়া এইসব বাদামী উচ্চারণ। ঘ্রাণ হয়। একটা কমলারঙের শহর মানে সন্ধ্যা হচ্ছে তখন। ধানক্ষেতের ওপর দিয়ে প্লেন চলে যাওয়ার দৃশ্য। এভাবে ধাতু, পাঠ ও অভ্যাসের পরেও এক রূপমাত্র হয়েই থেকে গেল। স্তন একটা ইচ্ছার নাম তবে। একটা স্পর্শের নাম। যেমন জল…
= = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = =
দ্বিধা হও ভাষা
আর বলো
আমার যৌনতাটাই আমি
= = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = =
(চলবে)
Posted in: February 2020, Novel