রাজনীতির বেড়াজালে নাগরিকত্ব বড়ই অসহায় : জানে আলম

ওরা রাতের ঘুম কেড়ে নিল। ওরা মসনদ চায় আর আমরা চাই শান্তি। আমরা দুবেলা দুমুঠো অন্নে সন্তুষ্ট ভারতবাসী। আমরা সত্তর শতাংশ মানুষ কায়িক পরিশ্রম করে বউ বাচ্চাদের মুখে আহার তুলে দিতেই হিমশিম খেয়ে যায়। তাতে পা ভেজাতে হয় মাথার ঘামে। কখনো খেয়ে কখনোবা না খেয়ে অথবা আধপেটা খেয়ে দিন চলে যায়। দিব্বি সুন্দর রাতের ঘুমটা হয়ে যেত। পরের দিন সকালে ফের কাজের সন্ধানে ঘোরা। তবুও কোন সমস্যাই ছিল না। আমরা অনেকেই পড়ালেখা করার সুযোগ পায়নি। কাগজ পত্র সেরকম বুঝি না। যাকে বলে চোখ থাকতে অন্ধ। সত্যিই! কি যে দিন এলো? বিভ্রান্তি, ভয়, আতঙ্ক আজ মানুষের মনকে হতাশ করেছে। গোটা দেশ উত্তাল। ভারতবর্ষ এক ভয়ঙ্কর সামাজিক রাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

এই সঙ্কটের মূল কারন কি? বা কারা রয়েছে এই সংকট তৈরির পেছনে? তা আর বলার অপেক্ষা থাকেনা। সবকিছু শুনতে শুনতে মানুষের কানের পোকা নড়ে গেছে। দেশে সিএএ, এনআরসি, এনপিআর করার এক অমানবিক, অসাংবিধানিক ষড়যন্ত্রই মানুষকে আজ পথে নামিয়েছে।

ধর্ম-বর্ণ, রাজনৈতিক -অরাজনৈতিক, স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, সাহীনবাগ, এন জি ও, ট্রাস্ট, বুদ্ধিজীবীমহল এবং আইন-আদালতে সব কাজ ছেড়ে সবখানেই জনগণ ব্যস্ত আন্দোলন করতে। পথে নেমে প্রতিবাদে মুখর হয়েছে দেশবাসি। গোটা দেশের নারী-পুরুষ, যৌবন-তরুণ, প্রবীণ, ছাত্র-ছাত্রী আপামর স্বাধীন ভারতের নাগরিক রাত-দিন এক করে আজ পথে নেমেছেন দেশ বাঁচানোর তাগিদে। সংবিধান বাঁচানোর তাগিদে। কানে প্রতিনিয়ত আন্দোলিত হচ্ছে ‘কিয়্যা চাহিয়ে- আজাদী!’

আজাদী শ্লোগান উচ্চ আওয়াজের সাথে সাথে রাজপথে উচ্চ কণ্ঠে ধ্বনিত সদা ‘NO NRC, NO NPR, NO CAA’ এই বিষয়ে সরকার আর বিরোধীরা পরস্পর ভিন্ন প্রচারে ব্যস্ত। এক ইঞ্চি জমি ছাড়তে নারাজ। সরকার যা বলে বিরোধীরা ঠিক তার উল্টো। আসল ব্যাপার টা কি? আপনাকে আমাকে সবাইকে জানতে হবে।

NRC, NPR, CAA কি? একি খাবার জিনিস?, না মাখার জিনিস? না পড়ার জিনিস? NRC, NPR, CAA হলে দেশের কত লাভ আর কত ক্ষতি ? তা আজ হিসেব নেওয়া জরুরী নয় কি?

NRC একটি ইংরেজি কথার শর্টফর্ম যার ফুলফর্ম হল National Register of Citizens আর বাংলায় অর্থ হ’ল নাগরিকদের জাতীয় নিবন্ধক। অর্থাৎ এনআরসি মানে এদেশের সমস্ত নাগরিকের একটি অফিসিয়াল তালিকা বোঝায়। খুব সহজে বলতে গেলে যারা অবৈধ ভাবে ভারতে এসেছে, তাদের চিহ্নিতকরন। কি ভাবে এই চিহ্নিত করা হবে। আর কে বা কার নাম NRC তে বাদ পড়বে?, বাদ পড়লে তার কি সমস্যা হবে? NRC প্রক্রিয়াটা কি নিরপেক্ষ ভাবে করা হবে? সেই সন্দিহানে মানুষ ভয়ে আত্মঙ্ক গ্রস্ত, কেউ কেউ আবার চিন্তায় হার্টফেল বা আত্মহত্যাও করছে।

NRC করার প্রথম ধাপ হলো NPR। কী এই এনপিআর? NPR এর ফুলফর্ম হল National Population Register যার বাংলা অর্থ হল জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জ। এনপিআর হল দেশে থাকা সকল বসবাসকারীদের একটি তালিকা। এদিকে ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী দেশে একটি নাগরিক পঞ্জি তৈরি করতে হবে। সেটি করার প্রক্রিয়া হল দেশে বসবাসকারী জনগণের মধ্যে থেকে নাগরিক ও বিদেশিদের আলাদ করা। প্রসঙ্গত, এই এনপিআরকেই বিরোধীরা এনআরসির প্রথম ধাপ হিসাবে দেখছে। সরকার ৩১ জুলাই ২০১৯-এ একটি বিজ্ঞাপন জারি করে জানিয়েছে যে নাগরিকত্ব বিধিমালা ২০০৩ অনুসারে এপ্রিল – সেপ্টেম্বর ২০২০ এ এনপিআর প্রস্তুতি মহড়া করা হবে।

এনআরসির প্রথম পদক্ষেপ জনবহুল রেজিস্টার প্রস্তুতের জন্য প্রতিটি এলাকায় ঘরে ঘরে তথ্য সংগ্রহ করা হবে। সমস্ত স্থানীয় নিবন্ধককে একত্রিত করে একটি ব্লক, মহকুমা গঠন করা হবে, তারপরে জেলা, তারপরে রাজ্য এবং তারপরে জাতীয় জনসংখ্যা নিবন্ধক। এই সময় সরকারি কোন লোক, পঞ্চায়েত, ব্লক বা কোন শিক্ষক আপনার বাড়ি আসবে। সে আপনাকে কিছু সাধারণ প্রশ্ন করবে। আপনার নাম কি ? পরিবারে কজন আছেন? তাদের নাম, বয়স, ঠিকানা, জন্মদিন, স্থান, ড্রাইভিং লাইসেন্স, আধার কার্ড এবং যেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রত্যেকের বাবা মা দুজনেরই জন্ম স্থান এবং জন্ম তারিখ কোন তথ্য প্রমাণ কিছুই চাইবে না অথবা চাইতেও পারে। আপনি টেরই পাবেন না যে সে NPR করতে এসেছে। আপনি নিঃসন্দেহে তাকে সেই তথ্য দিয়েই দিবেন। এনপিআর প্রক্রিয়ায় আপনি কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। খুবই সহজ উত্তর। আসলে ওটা ছিল নাগরিকত্বের আসিড টেস্ট। ওই টেস্টে আপনি অলরেডি পরীক্ষা দিয়েই ফেলেছেন। নাগরিকত্বের পরীক্ষা। সেই পরীক্ষা পত্রের উত্তর গুলো সরকারী আধিকারিকরা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পরীক্ষা করবে। যদি কোন একটি এদিক ওদিক হয় তাহলেই আপনার নামের পাশে বসে যাবে-D (D মানে Doubtful) মানে সংশয়। সংশয় টা কি জানেন? ভারতের নাগরিক হবেন কি না সেটা সংশয়। কি করে আপনি নাগরিক হবেন সেটা কিন্তু কখনো স্পট করেনি সরকার। আপনার নামের পাশে D মানেই আপনার নাগরিকের উপর একটা ? (প্রশ্ন) চিহ্ন আর আপনি জানতেই পারলেন না, আপনাকে জানানো হলো না কিসের জন্য আপনাকে Doubtful নাগরিক করা হল। এই ভয়ংকর বিষয়টির নামই হল NRC।

মনে করুন আপনার ব্লকে ১,০০০ জন Doubtful ‘সন্দেহজনক নাগরিক’ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। যাদের নামের পাশে D লেখা আছে। তাদের বাড়িতে চিঠি আসবে বা কোন ভাবে জানানো হবে যে নাগরিকত্বের প্রমাণ সরবরাহ করুন। একটা আশংখা থেকে যায় যে হয়তো মায়ের নামে চিঠি এলো বাবার নামে চিঠি এলো না, বা স্বামীর এলো তো স্ত্রীর নামে এলো না। অদ্ভুত মজার বিষয়টা কি হলো জানেন? যে সরকার বলেই দেয়নি যে কিভাবে এই নাগরিকত্বের প্রমান দেওয়া যাবে।

আমাদের সামনে জ্বলন্ত উদাহরণ আসাম; সেখানে এবারে নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র হিসেবে আধার কার্ড, ভোটার কার্ড ভোটার লিস্ট, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্টেটমেন্ট, প্যান কার্ড কিংবা জমির কাগজ পত্রকে অস্বীকার করল গুয়াহাটি হাইকোর্ট। বলা হয়েছে কোনটিই নাগরিকত্বের জন্য যথেষ্ট নয়। আপনি অশিক্ষিত, খেটে খাওয়া গরীব মানুষ। এখন আপনি কি প্রমান করতে পারবেন? কোথায় আপনার জন্ম হয়েছিল? ৫০ বছর আগের ভোটার লিস্টে আপনার নাম ছিল কি না ? বা আপনার পরিবারের কোন সম্পত্তি আছে কি না? আপনার বাবা মায়ের জন্ম তারিখ ও স্থান কি ভাবে জোগাড় করবেন? এসব জোগাড় করতে পারলে উত্তম আর যদি না পারেন ? যদি নিজেকে ভারতের নাগরিক হিসেবে প্রমান করতে না পারেন তো পৌঁছে যাবেন ফরেন্ট ট্রাইব্যুনালে। প্রসঙ্গত আসামে ২০১৯ সালে অগাস্টে বেরোনো NRC এর চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ পড়ে প্রায় ১৯ লক্ষ মানুষ। তারা নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে প্রথমে ট্রাইব্যুনাল কোর্ট, পরে হাইকোর্ট এবং পরে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করতে পারে বলে নির্দেশ রয়েছে। সেই মর্মে জাবেদা বেগম নামে এক মহিলাকে ট্রাইব্যুনাল বিদেশী হিসেবে চিহ্নিত করে আসাম প্রশাসন। কেননা উক্ত মহিলা তাঁর মা বাবার সাথে সম্পর্কের কোনও নথিপত্র দেখাতে পারেনি। তিনি নিজের নাগরিক হিসেবে প্রমাণ স্বরূপ ব্যাংকের কাগজ, জমির দলিল, এবং প্যান কার্ড জমা করেছিলেন। কিন্তু গুয়াহাটি হাইকোর্ট এইসব নথিকে ইতিমধ্যে নাগরিকত্বের নথি হিসেবে নাকচ করে দিয়েছে।

এখন আপনার ব্লকে ঐ সন্দেহজনক ১,০০০ জন নাগরিকের মধ্যে মনে করুন ১০০ জন কাগজ পত্র জোগাড় করতে পারেনি। তাদের বলা হবে আপনি ফরেন্ট ট্রাইব্যুনাল গিয়ে প্রমান করুন যে আপনি এই দেশের নাগরিক । তবে যদি আপনি মুসলিম হন তো কোন সুযোগ নেই। আপনার জন্ম এখানে, আপনার বাবা দাদার জন্ম এখানে, আপনার চোদ্দ গোষ্ঠীর জন্ম এখানে, ১০০ বছর বা তার বেশি দিন এখানে বাস করছেন তাতে কি? যদি কোন প্রমাণ পত্র আপনার কাছে না থাকে মুহূতের মধ্যে আপনাকে বিদেশী বলে ঘোষণা করা হবে।
আর যদি আপনি মুসলিম না হন তো আরো জটিল সমস্যা, সেখানে আপনাকে প্রমান করতে হবে যে আপনি পাকিস্তান, আবগানিস্থান বা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। অমুসলিম ভাই বোনদের বলছি দেখুন! পারবেন তো প্রমাণ করতে ঐ দেশ থেকে এই দেশে এসেছেন। আর যদি ব্যর্থ হন হিন্দু বলে কোন রেহাই পাবেন না বন্ধু। তখন আপনাকেও বিদেশি বলে ঘোষণা করা হবে। তখন পাঠানো হবে ডিকটেশন ক্যাম্পে এমনটাই নিয়ম। কি নির্মম পরিহাস! নিজের দেশে বিনা দোষে বিদেশী তকমায় জেলে। এ জেল সে জেল নয়। সমস্ত সুযোগ সুবিধা কেড়ে নেওয়া হবে।অনাহারে বিনা চিকিৎসায় পচে পচে মরতে হবে ডিটেনশন জেলে।

একটা ভয়াবহ মুহূর্ত, যেখানে দেশ জুড়ে সবচেয়ে বেশি চর্চা, আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক, প্রতিবাদ-পাল্টা প্রতিবাদ চলছে একটি জ্বলন্ত বিষয় Citizenship Amendment Act (CAA) 2019. পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে Citizenship Amendment Bill (CAB) পাস হলে সেটা আইনে পরিণত হয়। ফলে CAB হয়ে যায় CAA
CAA-2019 একটি তিন পাতার আইন। 1955 সালের একটি আইনের দুই নং কলমের সংশোধন। এই রকম যে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান এই তিনটি দেশ থেকে আসা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন,পারসিক এবং খ্রিস্টান ছয়টি ধর্মালম্বী মানুষদেরকে ভারতবর্ষে খুব সহজে সিটিজেনশিপ দেওয়া হবে। এই আইন পাশ হওয়ার পর গোটা ভারতের সাথে সাথে পৃথিবীতে যেখানে যেখানে ভারতের সমর্থনকারী মানুষ আছে যারা ভারতকে ভালোবাসে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে তারা এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে করছে। এর আগে মানুষ কখনও এতো ক্ষেপে উঠেনি। যখন পরকীয়া আইন পাস হল, সমকামিতা আইন পাশ হল, লাভ জিহাদ নিয়ে মাতামাতি, মবলিংচিং, তিন তালাক থেকে ৩৭০ ধরা যা ইচ্ছা তাই করেছে গায়ের জোরে। তখন মানুষ কিছুই বলেনি। শুধু ধৈর্য্য ধরেছিল। এই সরকার ক্ষমতায় এসে ভেবে নিয়েছে যে মুই কি হুনু এখানে ভাববার বিষয় আছে সিএএ পাশ করায় মানুষ এতো ক্ষেপে উঠল কেন ?

নিশ্চই এই আইনের কোন গলদ আছে। যা সবার জন্য কল্যাণ নয়, দেশের জন্য কল্যাণ নয়। আমরা সাধারণ মানুষ আইন কানুন এত বুঝিনা। যারা আইন নিয়ে পড়াশোনা করে, আইন বেঁচে জীবিকা নির্বাহ করে, পবিত্র সংবিধানকে মাথায় রেখে চলে। সেই আইনজীবী এডভোকেটরা আজ দেশের নারী পুরুষ যৌবন তরুণ প্রবীণ ছাত্রছাত্রী আপামর নাগরিকদের সাথে সাথে পথে নেমে আওয়াজ তুলেছে দেশ বাঁচাও সংবিধান বাঁচাও। এই কালা কানুন সংবিধানকে আঘাত করেছে। সিএএ ভারতীয় সংবিধানের ৫, ১০, ১৪ এবং ১৫ অনুচ্ছেদের বিপরীতে গেছে যা আইন, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জন্মের স্থান বা তাদের যে কোনও ভিত্তিতে যে কোনও বৈষম্যের বিরুদ্ধে আইনের আগে সুরক্ষা এবং সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেয়।

আসলে দেশের সংবিধান বিরোধী এই আইনের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিও নষ্ট হচ্ছে।
ধর্মনিরপেক্ষ এই ভারতে মানুষে-মানুষে ধর্মে-ধর্মে এই আইন বিভেদ তৈরি করছে। ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, গোষ্ঠী, লিঙ্গ ইত্যাদির বিভেদ এই আইন দেশে সংবিধানের আত্মাকে আঘাত করছে। এদেশের ধর্ম নিরপেক্ষ জনগন কখনো ধর্মীয় ভাগাভাগ, বৈষম্য চাই না। তাই সারা ভারতবর্ষ জুড়ে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ এবং পারসিক সব ধর্মের মানুষ পথে নেমেছে এই আইনকে বাতিল করার জন্য।

ভারতের মানুষ শান্তিকামী, ধর্ম নিরপেক্ষ তাই তারা এই জঘন্যতম এনার্সি, এনপিআর ক্যা এর আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতের মানুষ মসজিদে নামাজ পড়ে মন্দিরে পুজো করে গির্জায় প্রার্থনা করে তখন তারা মুসলিম,হিন্দু বা খ্রিস্টান যথাক্রমে। যে যাই হোক না কেন তার বাইরে ওভার অল সকলেই মানুষ। সরকার মানুষে-মানুষে যে বিভেদ বৈষম্য করার চেষ্টা করছে তা এদেশের মানুষ কখনো মেনে নেবে না। মোক্ষম জবাব দেবে শুধ সময়ের অপেক্ষা।

ধর্ম, বর্ণ ,রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক, স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, শাহীনবাগ, এন জি ও, ট্রাস্ট বুদ্ধিজীবী আইনজীবী নারী পুরুষ শিশু যুবক তরুণ তরুণী বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সব ধরনের মানুষের তীব্র প্রতিবাদী আন্দোলন দেখে সরকার চরম বিপাকে পড়েছে। শান্তিকামী মানুষের শান্তিপূর্ন আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করতে আত্মঙ্কবাদী তকমা লাগাতে দেশদ্রোহী অপবাদ দিতে তারা এখন নির্লজ্জ হয়ে উঠেছে। লেলিয়ে দিয়েছে তাদের পোষা গোণ্ডাদের। আমরা ইতিহাসে দেখেছি যুগে যুগে যে কোন অন্যাযের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে প্রথম সরব হয় ছাত্র সমাজ। তারপর মুসলিম ও অন্যান্য বুদ্ধিজীবীরা। যেকোন বিষয়ে প্রথম রিয়াক্ট করে সংবেদনশীল ছাত্র সমাজ। তাদের উপর আজ আক্রমণ চলছে ফ্যাসিস্ট কাদায়। JNU এর ছাত্রদের উপর ফ্যাসিস্ট আক্রমন কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ইহা অত্যন্ত নিন্দনীয় জেএনইউ নিয়ে বিজেপির এত অসন্তোষ কেন জানেন? ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক দলিত পড়ুয়া শিক্ষিত হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা হচ্ছে যা ওদের মাথা ব্যাথা। এরা সরাসরি দলিত দের বিরুদ্ধে কথা না বলে বাম দের কথা বলছে। এরা শিক্ষক ছাত্রকে একসাথে পিটিয়ে হাসপাতালের বেডে পাঠাচ্ছে। অন্য দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, মোদী আর শাহিনবাগের মধ্যে একটা বেছে নিতে। মন্ত্রী প্রকাশ্যে বলছেন, ‘গোলি মারো শালোঁ কো!’ তাই যারা প্রতিবাদীদের গুলি ছুড়ছে, তারা ভাবছে সরকার এটাই চাইছে। জামিয়া মিলিয়া আর একটি বিশ্ব বিদ্যালয় সেখানে ও প্রকাশে দিবালোকে পুলিশ পাহারায় গুলি। একেবারে নাটকীয় কায়দায়। আক্রমণকরি রামভক্ত গোপাল কে বাঁচিয়ে নিল ওরা। একেবারে জামাই আদরে। আর হিন্দু মহাসভা তার হাতে পুরস্কার তুলে দেয়। ২০০০ সালে যার বাবা মারা যায় সে কিনা ২০২০ তে নাবালক। দেশের আইন শৃঙ্খলা নিয়ে কি কেউ প্ৰশ্ন করবে না ? এটা কি স্বাধীন ভারতে কাম্য? আর ১৫ই ডিসেম্বর রাতের সেই ভয়ংকর দৃশ্য জামিয়ায় বিজেপি সরকার নিয়ন্ত্রিত পুলিশ লাইব্রেরিতে ঢুকে ছাত্রছাত্রীদের বাহাদুরি দেখাচ্ছে। দিল্লী পুলিশের এই অমানবিক অত্যাচারের সিসিটিভি ফুটেজ ফাঁস। “এটা কী সন্ত্রাস নয় ? ” কয়েকটি মানুষ ও তার দল বিভাজন ও ক্রিমিনালাইজেশন চালাচ্ছে স্বাধীন ভারতে এর চেয়ে জঘন্য আর কি হতে পারে? তবে এই ভাবে প্রতিবাদ থামানো যায় না। মানুষ প্রতিরোধ তৈরি করে অস্তিত্বরক্ষার মরিয়া।

শাহীনবাগ: রাজনৈতিক রং ছেড়ে দিয়ে, ধর্মীয় রং ছেড়ে দিয়ে, নিজের স্ত্রী, নিজের ছেলে মেয়ে নিজের জন্য, আমাদের জন্য সবার জন্য বাড়িঘর ছেড়ে দিল্লির শাহিনবাগ, কোলকাতার পার্ক সার্কাসে মা, ছেলে, স্ত্রী, স্বামী সবাই মিলে শীতে কাঁপছিল। তাদের মূল লক্ষ্য একটাই ” আমরা এ দেশে ছিলাম, আমার বাপ দাদারা এদেশে ছিল, আমাদের পূর্ব পুরুষেরা এদেশে ছিল, আমরা এদেশ আছি। আমরাই এদেশে থাকবো। গোটা ভারত নয় গোটা পৃথিবীতে।
শান্তি কামী দেশের মা বোনেরা দিল্লির সাহীনবাগে শান্তিপূর্ণ উপায়ে মুক্তি পাওয়া আশায় আন্দোলন করছে । ধর্ণামঞ্চে তৈরি করে। জনগণের এই আন্দোলনকে দেশদ্রোহী তকমা লাগাতে পাকিস্তানের পতাকা হাতে কালো বোরখা পরা অবস্থায় ধরা পড়ল গুঞ্জা কাপুর। এই ভাবে রামভক্ত গোপালের মত সরকার তাকে বাঁচিয়ে নিলো না বালিকা সাজিয়ে। কিন্তু এই গুঞ্জা বিজেপির সদস্যা, তার টুইটার মোদিজি ফলো করে। তাদের এই নির্লজ্জ্বের মুখোশ উন্মোচন হয়েগেলেও হুঁশ ফিরছে না ভক্তদের। এখন ভারতের অলিতে গলিতে গড়ে উঠেছে শতশত শাহীনবাগ। মুসলিম নারীদের গড়ে উঠা এই শাহীনবাগে আজ অমুসলিরা ঘরের মা বোনেরা দলে দলে যোগ দিচ্ছে। ফলে দিল্লির শাহীনবাগ আজ লোকাল আন্দোলনকে ছাড়িয়ে জাতীয় আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। যা আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করতে চলেছে।

CAA বিরোধী বিক্ষোভকারীদের রাজধানীর রাজপথে ফেলে পেটানো হচ্ছে। পুলিশ দর্শক। হামলা থেকে বাঁচতে বাড়িতে গেরুয়া কাপড় ঝুলিয়ে দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। দেশ জুড়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে ভীত-সন্ত্রস্ত করার জন্য এই ধরনের কর্মযজ্ঞ করা হচ্ছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে দেশ জুড়ে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে এইভাবে দমিয়ে রাখা যাবে না। দিল্লির তান্ডব ও অরাজকতার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সমস্ত মানুষ অন্য চোখে দেখছে।

পরিষ্কার কথা হল যে নাগরিকত্ব সংশোধন আইনটা একদম ভারতের যে সংবিধান আছে তাকে ভেংগে দেওয়া ছাড়া কিছুই নয়। শুধুমাত্র রাজনৈতিক চরির্থত, রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির জন্য এই আইন আনা হয়েছে। আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান এই তিনটি দেশ থেকে কোন মানুষকে নতুন করে আনা হবেনা। যারা ছিল তাদেরকেই সিটিজেনশিপ দেওয়া কথা বলছে এই আইন। কিন্তু ধর্মীয় কারনে আসা রিফিউজিদের তো ইন্টারনাশন আইনে নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলাই আছে। ২০১৬ তে তাদেরকে লঙটার্ম ভিসা অলরেডি দেওয়া হয়েছে। তখন কিন্তু কোন প্রতিবাদ করেনি মানুষ। এখন মানুষ ক্ষেপে গেছে বে আইনিভাবে এই আইন চলতে দেবে না। কারন , এই আইন আসলে কি? শুধুমাত্র আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান এই তিনটি দেশ থেকে আসা অমুসলিম দের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু শ্রীলঙ্কা থেকে দক্ষিণভরতে হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন,পারসিক এবং খ্রিস্টান ছয়টি ধর্মালম্বী মানুষদেরকে এড়িয়ে গেছে। কারন সেখানকার মানুষ ধর্মের ভিত্তিতে ভোট দেয় না। তাই তাদের কোন লাভ নেই। জোর গলায় প্রচার করছে বা অনেকেই ভাবছেন শুধু মাত্র মুসলিমদের ক্ষতি হবে। যদি তাই হয়, তাহলে ২০১৯ সালে আগস্ট NRC চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ পড়েছে ১৯ লক্ষ মানুষ তারা প্রায় ১৪ লক্ষ হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে। এটা একটা চক্রান্ত। ইংরেজি বা ইজরাইলের অনুসরণমাত্র। কি ভাবে মানুষকে দাস বানানো যায়, কি ভাবে মানুষকে শ্রমিক বানানো যায়, কি ভাব মানুষকে ক্রীতদাস বানানো যায়।

NRC ছুট মানে আপনি অবৈধ অনুপ্রবেশকরি। আপনার জমি, বাড়ি, ব্যবসা, চাকরি কিছুই কেড়ে নেওয়া হবে। আপনাকে থাকতে হবে ডিটেনশন ক্যাম্পে। ভালো খাবার নেই, বিছানা নেই, জল, আলো বাতাস কম ,চিকিৎসা নেই, সারা দিন ধরে কাজ করতে হবে। মুজিরী নাও পেতে পারেন, বা পেল একেবারে নূন্যতম। ইউরোপ , আমেরিকায় এই জঘন্যতম ব্যবস্থা চলছে। মোদি তাদের সস্তায় লেবার সাপ্লাই করবে। তাই তো কোটি কোটি টাকা দিয়ে তৈরি করছে ডিটেনশন কারখানা। এই ব্যবসা দেখতে ডোনাল মাঝে মধ্যেই আসবে ভারতে। এই ভারত আমেরিকার সবচেয়ে কাছের। এখানে বাস করবে উচ্চবর্ণের হিন্দু বণিকরা। তারা মুসলিম, ওবিসি, দলিত, বাদিবাসী, গরিব হিন্দুদের দাস ও শ্রমিক বানাবে। এছাড়া আর কিছুই নয়। সমস্ত দিক থেকে মানুষকে ভাতে মারছে কূট কৌশল। অর্থনৈতিক অবস্থা পুরোপুরি শেষ, বেকার যুবক যুবতীদের করুন অবস্থা। এখন ভারতবর্ষ পৃথিবীর সব চেয়ে পিছিয়ে পড়া দেশ। দেশের ১% মানুষের কাছে ৭৩% সম্পদ অথচ বিজেপি প্রচার করছে উদ্বাস্তু,মুসলমানরা আপনার চাকরি, অর্থ সব খেয়ে খেয়ে নিচ্ছে। এসব জনগণের কাছে ধোকা ছাড়া কিছুই নয়। জি এস টি ও নোটবন্দী করে গরীব আরো গরীব আর ধনিকে আরো ধনি করলো। এই ভাবেই ভারতের বিকাশ হচ্ছে।

মোদী সরকার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষায় ব্যর্থ
দেশের জনগণের মন অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিতেই অকল্যাণকর নানা ধরনের বিল পাশ করেছে, কখনো পরকীয়া, কখনো সমকামী, লাভ জিহাদ, বাবরি মসজিদ, ৩৭০ ধারা, জি এস টি, নোটবন্দি , মবলিংচিং এ জ্যান্ত মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। ছাত্রছাত্রীদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে এবং মিথ্যে মামলা জড়িয়ে দিচ্ছে। শুধু ছাত্রছাত্রীদের ওপর অত্যাচার বা পড়াশুনা নষ্ট করে শিক্ষাঙ্গণে অরাজকতা সৃষ্টি করছে তা নয়। তারবেজ আনসারী, আখলাক হত্যা,দলিত শিশুকে পুড়িয়ে হত্যা,পাটিয়ালি কোর্টে সাংবাদিকদের ওপর হামলার মধ্য দিয়ে বিজেপি সরকার গোটা দেশে একটা ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করছে । দেশের যেকোনো বিষয় নিয়ে বিবাদ হলে বিজেপি সেখানে সাম্প্রদায়িক রং ছড়িয়ে চড়িয়ে এমন ভাবে প্রচার করছে যে সেখানে হিন্দুদের আর কোন নিরাপত্তা নেই আর এইরূপ প্রচার করে বিজেপি হিন্দুদের উৎসাহিত করছে মুসলিমদের বিরোধিতা করবার জন্য । একজন দলিত আদিবাসী, গরিব হিন্দু সমাজের লোক হয়ে বিজেপির এই হিন্দুত্ববাদী লাড্ডু খেয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে ঘৃণার চোখে দেখছে। অমুসলিম সম্প্রদায়কে মুসলিমদের প্রতি খেপিয়ে তোলার জন্য মিডিয়া দ্বারা মিথ্যা সাম্প্রদায়িক প্রচার তুঙ্গে । এর কারণ কি আপনি বুঝতে পারেন ?

এদিকে মানুষ না খেয়ে মরছে,তীব্র বেকারত্ব, দারিদ্র্যতা ,অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে দেশ চলছে। এর বিরুদ্ধে কথা বললেই তাঁকে ‘দেশদ্রোহী’ বলা হচ্ছে। যা স্বাধীন ভারতে স্বৈরাচারী, অগনতান্ত্রিক, ফ্যাসিস্ট মনোভাব ছাড়া কিছুই নয়।

স্বামীজী, নেতাজী গান্ধীজি আবুল কালাম, আসফাকুল্লাহ, মাতঙ্গিনী, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন নজরুল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভারতকে রক্ষা করতে সংবিধানকে বাঁচাতে, হিন্দু ভাইদের জন্য, মুসলিম ভাইরা, শিখ ভাইরা ধর্মনিরপেক্ষ ভাইরা পথে নেমেছে। সংবিধানকে রক্ষা করার জন্য হাতে হাত মিলিয়ে, মোদিকে চ্যালেঞ্জ করছে। এটাই দ্বিতীয় স্বাধীনতার মোক্ষম সময়। আর ঘরে সবে থাকার সময় নয়, পথে নামুন দল মত ধর্ম বর্ন ভাষা নির্বিশেষে।
আর সিএএ প্রত্যাহার এবং এনপিআর এবং এনআরসি বাতিল করার জন্য গণতান্ত্রিকভাবে শান্তিপূর্ণ উপায়ে কাজ করার জন্য একত্রিত হোন। তবে কিছু টা আশার আলো জ্বলতে দেখছি মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, ঝাড়খন্ড ও দিল্লির ভোট ওদের মুখে থাপ্পর দিয়ে বুঝতে চেয়েছে অসাংবিধানিক কোন কাজ আমরা মেনে নেব না সেই সঙ্গে কেরল, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও পশ্চিমবঙ্গের সরকার ক্যা এর বিরুদ্ধে বিধান সভায় আইন পাশ করেছে। এই টুকুতেই আনন্দ উল্লাস করলে হবে না। যেমন করেই হোক NRC, NPR , CAA আটকাতে হবে
শুধু NRC, NPR , CAA আটকালেই হবে না।
এই এনআরসি-র আইনী মূল ভিত্তি কোথায় জানতে হবে তার শেকড়টা তুলতে হবে। প্রায় ১৭ বছর আগে যখন অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে প্রথম বিজেপি সরকার ক্ষমতায় ছিল তখনই ২০০৩ সালে আইন করা নাগরিকত্ব আইনের ১৪৪ ধারা, এটি হয়েছিল, তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন এলকে আডবানি। ২০০৩ সালের কালা কানুন কে উচ্ছেদ করতে হবে তবেই রেহাই।

[লেখক প্রধান শিক্ষক, নূর জাহানারা স্মৃতি হাই মাদ্রাসা, মুর্শিদাবাদ।]

Facebook Comments

Leave a Reply