দিল্লী কা লাড্ডু : দেবাশিস দত্ত
[এক]
অঘটনটা শেষ তক ঘটল !!! ঘটল রাজধানীর বুকেই। আর সেটা ঘটালেন দিল্লীর মানুষ! প্রমাণ হল অঘটন ঘটানো যায় এবং মানুষই সেটা ঘটায়, দিল্লীর মানুষ সেটা করে দেখালেন। আগের বারের মত এবারেও দিল্লীর লড়াইটা সর্ব অর্থেই ছিল অসম। মূল লড়াইটা ছিল বিজেপি বনাম ‘আপ’। এই দুই দলের শক্তি ও ক্ষমতার কোন তুলনা হয় না। ২০১৩ সালে আপ নেতা কেজরিওয়াল মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন ঠিক কিন্তু তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। এর মধ্যে ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি কেন্দ্রের ক্ষমতায় এল। ২০১৫ সালে হল দিল্লী বিধানসভা নির্বাচন। এই নির্বাচনে আপ জিতল – জিতল শুধু নয় ৭০ আসনের মধ্যে ৬৭ আসন পেল, বিজেপি পেল মাত্র ৩ টি আসন, মানে দাঁত ফোটাতেই পারল না। আর কংগ্রেস অনেক কাল দিল্লীর ক্ষমতায় থেকেও এক্কেবারে মুছে গেল। আবার এরই মধ্যে গত বছর (২০১৯) হল লোকসভা নির্বাচন। এই নির্বাচনে বিজেপি যখন নিরঙ্কুশ ক্ষমতা (৩০৩/৫৪৩) পেল এবং দিল্লিতেও সব ক’টি আসন দখল করল। শুধু তাই নয়, এটাও লক্ষ্যনীয় যে দিল্লীর সব ক’টি পুরসভাও রয়েছে বিজেপি নিয়ন্ত্রণে। এমত অবস্থায় ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ দিল্লী বিধানসভা নির্বাচন হল। এই নির্বাচনে আপ পেল নিরঙ্কুশ ৬২/৭০ আসন আর বিজেপি’র ভাগ্যে জুটল বাকি মাত্র ৮ টি আসন! কংগ্রেস এবারেও একটিও আসন পায়নি। জামানতও সম্ভবত নেই। অথচ এবারের নির্বাচনে দিল্লী দখলের জন্য বিজেপি পুরো বডি ফেলে দিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী (তিনিই ছিলেন দায়িত্বে), এছাড়াও মন্ত্রীমণ্ডলীর অন্য সদস্য, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী, ডজনের ওপরে সাংসদ, নেতা, হাজার হাজার হাফপ্যান্ট পরিহিত ট্রেন্ড ক্যাডার সমন্বয়ে ছোট মাঝারি বড় ৫০০০ সভাসহ প্রচারে কোন খামতি ছিল না। সব দেখে শুনে জয় সম্পর্কে বিজেপি নেতৃত্বের মনে কোন দ্বিধাও ছিল না।
ভোটের পর পরই প্রায় সমস্ত এক্সিট পোল আপ জয়ী হচ্ছে এমন সমীক্ষা প্রকাশ করায় বিজেপি নেতৃত্ব উষ্মা প্রকাশ করেন। হিসেব কষে কনফিডেন্টলি বলেন ‘সমস্ত এক্সিট পোলের হিসেব ভুল প্রমাণিত হবে, আর আমরাই ৪৮ টি আসন পেয়ে সরকার গড়ব।’ এমন আত্মবিশ্বাসের কারণ বা উৎস কী? কারণ বা উৎস এক) অর্থ ও পেশি শক্তির সমন্বয়ে ব্যাপক ২৪ x ৭ প্রচার; দুই) মেরুকরণে অধিকতর সাফল্য; তিন) নিরন্ধ্র নির্বাচনী সংগঠন ও নিয়ন্ত্রণ – এরই জেরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও সদ্য প্রাক্তন সভাপতি বলতে পেরেছেন ‘ইভিএম এর বোতাম এতো জোরে টিপুন যেন শাহিনবাগে কারেন্ট লাগে’। চ্যালারা পিছিয়ে ছিল না তারাও বলল ‘দেশকে গদ্দারোকো – মারো গোলি শালো কো’; ‘দিল্লী ভোট – ভারত পাকিস্তান ম্যাচ’ ইত্যাদি। এসব দেখে শুনে ‘হিন্দু’রাও কি একবার ভাবলেন ‘এরা কি সত্যি হিন্দু?’ ‘হিন্দুরা কি এমন অসহিষ্ণু হয়!’ যা সব ঘটল, ঘটান হল তার সর্বমোট ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় উঠে এসেছে ৬২-৮-০ ফলাফল। এবার ফলাফল একটু বিস্তারে দেখা যাক।
[দুই]
নির্বাচন শেষ হবার পর পরেই বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে ফলাফল সম্পর্কে যেসব সমীক্ষা করা হয়েছিল সেটা দেখার আগে দু’ তিনটে কথা স্পষ্ট বলা দরকার। এক] যারা সমীক্ষা করেছে তাদের মধ্যে অনেকেই ‘গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ’ হওয়া সত্ত্বেও প্রধানত শাসকের তল্পী বহন করছে বেশ কিছুকাল ধরে। সুতরাং তাদের সমীক্ষার আভাষ শাসক দলের অনুকুলে হওয়াই দস্তুর। দুই] কিন্তু তা কোন হিসেবেই দেখান সম্ভব হয়নি। তিন] সমীক্ষা কখনই নির্ভর যোগ্য নয়। এটি অনুমান মাত্র – মিলতেও পারে না মিলতেও পারে। সুতরাং এই সমীক্ষার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা যায় না। সে যাই হোক কী বলেছিল সমীক্ষা?
সমীক্ষক সংস্থা আপ বিজেপি কংগ্রেস
টি ভি ৯ সিসেরো ৫৪ ১৫ ১
এবিপি নিউজ – সি ভোটার ৪৯-৬৩ ০৫-১৯ ০-৪
টাইমস নাউ আইপিএসওএস ৪৪ ২৬ ০
নিউজ এক্স নেটা ৫৩-৫৭ ১১-১৭ ০-২
রিপাবলিক টিভি ৪৮-৬১ ০৯-২১ ০-১
ইন্ডিয়া টি ভি ৪৪ ২৬ ০
নিউজ ২৪ ৫৫ ১৫ ০
উপরোক্ত সমীক্ষায় একমাত্র একটি সংস্থা টাইমস নাউ এবং ইন্ডিয়া টিভি বিজেপিকে সর্বোচ্চ ২৬ টি আসন দিয়েছে। যদিও তারাই আবার আপকে সরকার গড়ার মত বলিষ্ঠ সংখ্যা ৪৪ দিয়েছে। সুতরাং বিজেপি’র দাবি কি একমাত্র ক্যাডার ধরে রাখতে করা হয়েছিল কীনা বলা যাবে না। এবার দেখা যাক গোণাগুন্তির পর কী দাঁড়াল এবং সেই সঙ্গে তুলনামূলক ফলাফল।
২০১৫, ২০১৯, ২০২০ নির্বাচনে আপ পেয়েছে যথাক্রমে ৬৭, ০, ৬২ আসন; বিজেপি পেয়েছে ৩, ৭৫, ৮ টি আসন; কংগ্রেস পেয়েছে ০, ৫, ০ আসন। আবার ২০১৫, ২০১৯ এবং ২০২০ সালে ঐ তিন দলের ভোট প্রাপ্তির শতকরা হিসেব ছিলঃ আপ – ৫৪.৩%, ১৮%, ৫৩.৬% ; বিজেপি – ৩২.৩%, ৫৬%, ৩৮.৫%; কংগ্রেস – ৯.৭%, ২২%, ৪.২৫% (৩ টি আসন ছাড়া বাকি ৬৩ টি আসনে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে)। অর্থাৎ ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর আপ-এর ৫ টি আসন ও ০.৭% ভোট কমেছে; বিজেপি’র আসন ৫ টি এবং ভোট ৬.২ % বেড়েছে; আর কংগ্রেসের আসন বাড়েনি কমেনি, শুন্যই থেকেছে কিন্তু ভোট ৫.২৫% কমেছে। কংগ্রেসের ভোট কমে যাওয়া অর্থাৎ নিজের ভোট ধরে রাখতে না পারা এই দলের আভ্যন্তরীণ সঙ্কট বা ব্যর্থতা। বা ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর যদি আপ থেকে কিছু মাত্র ভোট কমে এবং অন্যত্র যায় সেটা যেখানে গেল তার আকর্ষণ বা প্রভাবে বলে ব্যাখ্যা করা ঠিক হবে না। আপ ও কংগ্রেসের এর ভোট কমে যাওয়া ও বিজেপি’র ভোট বৃদ্ধির অর্থ হল কংগ্রেস থেকে কিছু ভোট আপ-এ গেলেও মোট ভোট যা কমেছে তার একাংশ বিজেপি-তে গিয়ে থাকবে। এবারে দেখা যাক বিজেপি’র ‘আসল’ ভোট কতটা বেড়েছে। বিজেপি’র মোট ভোট বেড়েছে ৬.২ – (০.৭ + ৫.২৫) = ০.২৭% যা খুবই প্রান্তিক। এক্ষেত্রে এমনটাও হওয়া অসম্ভব নয় বিজেপি থেকেও কিছু ভোট (মধ্যবিত্ত/উচ্চবিত্ত) আপ-এর দিকে সরে গেছে। সুতরাং এটা জোর দিয়ে কোনমতেই বলা ঠিক হবে না যে বিজেপি তাদের নেতাদের ক্যারিসমা, ব্যাপক প্রচার, প্রশাসন এবং অর্থ+পেশি সংগঠন দিয়ে তার প্রভাব ও সমর্থন মাত্র ০.২৭% বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। বিষয়টা হাস্যকর হয় নয় !
[তিন]
আপ দল যে দিল্লীর বুকে দাঁড়িয়ে এতো বড় একটা শক্তির সাথে দীর্ঘ লড়াই লড়ে যাচ্ছে এবং অবলীলায় জয় হাসিল করছে তার রহস্যটা কী জানার ইচ্ছে প্রবল হওয়াই খুব স্বাভাবিক। বড় বড় পালোয়ানেরা যখন পারছে না অথচ ওরা পারছে তখন সকলেরই জিজ্ঞাসা জাদুটা কি? এই দলের তত্ত্ব ও নীতিগত অবস্থান, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, বক্তব্য এবং কৌশল সব কিছুই কয়েকটি স্লোগানে স্পষ্ট অথবা অস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। যেমন তাঁদের স্লোগান ছিল – ‘ভারত মাতা কী জয়’। কি বলবেন দক্ষিণপন্থী ? আবার ধরুন ‘ইনকিলাব – জিন্দাবাদ’। এবারে কী বলবেন বামপন্থী ? তারও পরে ধরুন ‘বন্দে – মাতরম’, কী বলবেন তাকে জাতীয়তাবাদী? কোনটাই নির্দিষ্টভাবে বলা যাবে না। আবার ‘হনুমান মন্দিরে পুজো’ বা হনুমান চাল্লিশা পাঠ ইত্যাদিকেই বা কী বলবেন! একই সঙ্গে আপ নাগরিকত্ব বিল, জেএনইউ আন্দোলন থেকে দুরে থেকেছে, শাহিনবাগ আন্দোলনকে মৃদু সমর্থন জানিয়েছে। অর্থাৎ বিভিন্ন ঘটনায় আপ-কে কোন একটা গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত বা বিযুক্ত, দারুণ পক্ষে বা বিপক্ষে ধরতে পারা যাবে না। অর্থাৎ কেজরিওয়াল কৌশলটাকে হার্ড সফট লিক্যুইড গ্যাস সব অবস্থাকে এমনভাবে সাজিয়েছেন গুলিয়েছেন যে দক্ষিণ, বাম, মধ্য, মধ্য-বাম কোন পন্থীই তেমন বিরোধিতা করতে বা আক্রমণ সাজাতে পারবে না। এটাকে বলা যায় একটা সফল সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং !! (মায়াবতী একবার এভাবেই সাফল্য পেয়েছিলেন)। রাজনীতি, তত্ত্ব, দর্শন, অর্থনীতি ইত্যাদি বাহুল্য বোধে বর্জিত! আবার বর্জিতও নয়।
স্বাধীনতা আন্দোলনের যে বিভিন্ন ধারা ছিল কংগ্রেস একটা সময় পর্যন্ত সেই সব ধারাকে যূথবদ্ধ বা সমন্বয় করে চলেছে এবং ক্ষমতায় থেকেছে। কিন্তু ধীরে ধীরে বিস্মৃত হয়েছে, যে আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক নীতি গ্রহণ করেছে তা ক্রমশ দেউলিয়া বলে প্রমাণিত হয়েছে। ক্রমশ স্বজনপোষণ, দুর্নীতি, কেলেঙ্কারিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়লে মানুষ তাকে বর্জনের পথ নিয়েছে। এর বিকল্প হিসেবে আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যে তাণ্ডব-নৃত্য-রাজনীতি শুরু হয়েছে সেই যায়গাটা মানুষ ক্রমে বুঝতে পারছে। এই দুইয়ের সংযোগস্থল থেকেই আপ তাদের ‘রাজনৈতিক’ ইনিংস শুরু করেছে। সেকারণে আপ-এর হাতে কংগ্রেস মুছে গেছে এবং কংগ্রেসের পুরনো মুখও আর গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। সেদিক থেকে কেজরিওয়াল কিছুটা ভিন্ন কিছুটা স্বতন্ত্র – তবে নতুন বোতলে পুরনো কিছুই হবে ! নতুন কিছুই পাওয়া যায়নি !! আসলে মনে হয় নেইও। বিজেপি’র ফলাফল খারাপ হবার কারণ কেবলমাত্র আপ-এর সাফল্য নয়, জাতীয় অর্থনীতি থেকে সর্বক্ষেত্রে বিজেপি যে একটা চ্যালেঞ্জ এর মুখে পড়েছে এবং বিজেপিও আগের মত স্বচ্ছন্দ নয় – কারণ কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে আর মোড়ে মোড়ে শাহিনবাগ দাঁড়িয়ে গেছে — সেটাও ব্যর্থতার একটা বড় কারণ হিসেবে গণ্য করতে হবে, নইলে দিল্লী নির্বাচনের আগে সেসব রাজ্য নির্বাচনে বিজেপি হেরেছে তার যথাযথ ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না।
কয়েক মাস আগে, ৩০৩ অশ্বশক্তি নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর ঝাড়খন্ডে নির্বাচনে বিজেপি রাজ্যের ক্ষমতা থেকে অপসারিত হল। ঠিক তার আগে হরিয়ানা নির্বাচনে (২১.১০.২০১৯) বিজেপি এককভাবে সরকার গড়তে পারেনি। প্রয়োজনীয় আসন না পাওয়ায় জেজেপি দলের সঙ্গে জোট করে উপ-মুখ্যমন্ত্রী পদ ছেড়ে তবে সরকার গড়তে হয়েছে। আবার দেখা যাক মহারাষ্ট্রের দিকে। নির্বাচনের পর অনেক কায়দা কানুন করেও কয়েক ঘণ্টার বেশি টিকতে না পেরে ইস্তফা দিতে হল! তারও আগে ক্ষমতায় থাকতেই রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশের মত দুটি বড় রাজ্যে বিজেপি’কে ক্ষমতা হারাতে হয়েছে। এসব তথ্য বিজেপি’র গ্রাফে ক্ষয় যা তাদের কর্মকাণ্ডের জেরেই ঘটে চলেছে। বিজেপি’র বিগত ৬ বছরের কার্যক্রমের একটা তালিকা প্রস্তুত ও তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যাত্রার প্রথম দিন থেকে দেশকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করতে আর্থিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় আবহ তৈরি করতে একের পর এক সতর্ক, সযত্ন, সুপরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ ও রূপায়ণ করেছে। সর্বশেষ ঘটনা সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধানের ‘প্রস্তাবনা’য় বর্ণিত মর্মবস্তুকে অস্বীকার ও নির্লজ্জ উল্লঙ্ঘন, বিনা আলোচনায় ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা বাতিল, জম্মু-কাশ্মীরকে সেনা ঘেরাটোপে রেখে কাশ্মীরীদের গণতান্ত্রিক অধিকার ছিনতাই, রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের নির্বিচার গ্রেপ্তার; অসমে এনআরসি-র অভিজ্ঞতা, সিএবি পাশ, এনআরসি, এনপিআর ইত্যাদি কয়েকটি মাইলস্টোন মাত্র। এসব পদক্ষেপ ও তার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ – বিশেষত ছাত্র-যুব-মহিলাদের দেশব্যাপী স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদে আম আদমি পার্টির বিশেষ কোন ভূমিকা নেই কিন্তু আম আদমি পার্টি তার সুফল পেয়েছে এটা বলাই বাহুল্য।।
এর পরে ধরা যাক কেজরিওয়াল-এর কর্মসূচি যা হল তাঁর সাফল্যের অন্যতম স্তম্ভ। কর্মসূচিতে তিনি বলছেন, জোর দিয়ে বলছেন – একেবারে প্রান্তিক মানুষ থেকে সাধারণ মানুষের কথা। তাদের সাধ্যের মধ্যে খুবই প্রত্যয়ী সাধারণ দাবি দাওয়ার কথা অর্থাৎ নিত্য প্রয়োজনীয় যেমন পানীয় জল, বিদ্যুৎ, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা তথা চিকিৎসা ও নাগরিক পরিষেবার কথা। নতুন স্কুল করার অর্থ বা তহবিল নেই, সুতরাং পুরনো স্কুলগুলোকেই কার্যকরী শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হল টার্গেট। প্রতিটি বিষয় নিয়ে মহল্লায় মহল্লায় কর্মীবাহিনী গড়ে তুলে, যা আছে যা পাওয়া সম্ভব তাকে ভিত্তি করে নিতান্তই ইচ্ছা, শুভবুদ্ধি, পরিকল্পনা, কর্মশক্তি জোটানর জেরে ও জোরে সমস্ত ব্যপারটার ভোল বদলে দেওয়া সম্ভব হল। মানুষকে জড়িয়ে নিয়ে মানুষকে হিরো বানিয়ে নিজে তাদের ‘ব্যাটা’ হয়ে গেলেন। এর সঙ্গে যা না হলে হত না সেটা হল একটা স্বচ্ছ, সরল জীবন যাপন ও ভাবমূর্তি। কেজরিওয়ালের ব্যক্তিগত ডেটা খুব সহায়ক – এমন হয় যে কারও শিক্ষা নেই, কেবল হাফ-প্যান্ট পড়া দীক্ষা আছে, কেজরিওয়ালের শিক্ষা-দীক্ষা দুইই আছে। খড়গপুর আইআইটি থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে টাটা স্টিলে চাকরি, সেটা ছেড়ে সিভিল সার্ভিস উত্তীর্ণ হয়ে আবার চাকরি আবার ইস্তফা এবং সে সময় থেকেই ‘পরিবর্তন’ আন্দোলন – ‘ইন্ডিয়া এগেনসট করাপশান’ আন্দোলনে সামিল হয়ে এই সেদিন ২৬ নভেম্বর, ২০১২ ‘আপ পার্টি’ গঠন করে করাপসন বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলা। এই আন্দোলনের উৎস ছিল সেই সময়ের কংগ্রেস। কংগ্রেস-বিরোধী সেই আন্দোলন থেকেই কেজরিওয়াল তো বটেই তাঁর যারা সাথী তাঁদের জীবন যাপন, আচার ব্যবহার, চলনে বলনে একটা ভিন্নত লক্ষ্য করা যায় যা হল দলেরও চলার রসদ। এই ভিন্নতাই অন্যের সাথে পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। সেটাই সাফল্যের চাবিকাঠি যা দিয়ে আপাতত ‘হিন্দুত্ব’র বর্বর শক্তিকে, আরএসএস নিয়ন্ত্রিত বিজেপি’র মত একটা পার্টিকে আপ-এর মত একটি আঞ্চলিক পার্টি পরাস্ত করেছে। এটাই সারা দেশের ক্ষেত্রে একটা ‘মডেল’ হতে পারে কীনা সে প্রশ্নের উত্তর রয়েছে ভবিষ্যতের গর্ভে!
[চার]
এই নির্বাচনী লড়াইতে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বিতা আপ আর বিজেপি ছাড়াও ছিল কয়েকটি আঞ্চলিক দল এবং সর্বভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি – সিপিআই ও সিপিআই (এম) দল যারা একই মতাদর্শ অনুসারী কিন্তু পৃথগন্ন। সংবিধান অনুসারে দু’টি পার্টিই বিপ্লবী এবং উভয়েরই নির্দিষ্ট জাতীয় কার্যক্রম আছে। বিরোধ ও সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে চলে চলে এখন শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে, কেউ পৌঁছে গেছে, কেউবা পৌঁছবে। দুই কমিউনিস্ট পার্টির মতে নির্বাচন একটি ‘রাজনৈতিক সংগ্রাম’ বুঝিবা ‘ক্ষমতা’ দখলেরও ‘শান্তিপূর্ণ’ হাতিয়ার। ভারতীয় গণতান্ত্রিক ‘ক্ষমতা’য় দু’টি কক্ষঃ এক। ট্রেজারি; দুইঃ অপজিশন। দৃশ্যত দুই কমিউনিস্ট পার্টিই অপজিশনে মোটামুটি স্বচ্ছন্দ। তবে ক্ষয়িষ্ণু। বহু গণসংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত যে বিশাল গনভিত্তি গড়ে উঠেছিল তা আজ আর নেই। রক্ষা করা যায় নি এবং যাচ্ছেও না। ফলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বামেরা আজ প্রান্তিক শক্তি সন্দেহ নেই। নির্বাচনে জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়াটাই এখন সাধারণ চিত্র। তথাপি দুর্বল সংগঠন শক্তি নিয়ে গুরুতর রাজনৈতিক লড়াইটা লড়তে সিপিআই ও সিপিআই (এম) উভয় দলই ৩ টি করে আসন লড়েছে। ওদের লড়াইটা সরকার গঠন করার জন্যে ছিল না। বা হাং ফলাফলের সুযোগ নিতেও নয়। নিজ নিজ রাজনৈতিক বক্তব্য বিজেপি বিরোধী রাজনীতিকেই পুষ্ট করবে, মদত দেবে। এটা সবার জানাই ছিল যে ভোট সম্পূর্ণ পোলারাইজড। স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতার কাটার চেষ্টাটাও আলবাত একটা শক্তি। জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। অমনটা হয়, ঘাবড়ালে চলে না। আপ আপাতত ঠেকাটা দিল এটা তো মানতেই হয় এবং সেটা কম কথা নয়। তবে আবার সব কথাও নয়। আসল কথাটা হল কমিউনিস্টদের শক্তিকে যতই আতস কাচ দিয়ে দেখার চেষ্টা হোক, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হোক আরএসএস-বিজেপি’র ঘোষিত মতাদর্শগত শত্রু কিন্তু আর কেউ নয় কমিউনিস্টরাই। সেজন্যে আরএসএস, বিজেপি ও অন্যরা সুযোগ পেলেই কমিউনিস্টদের একহাত নিতে ছাড়ে না। যে আন্দোলনগুলো হচ্ছে সেগুলো কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে হচ্ছে না ঠিক কিন্তু সেসব আন্দোলন সংগ্রাম নির্দিষ্ট ভাবে আরএসএস-সহ সমস্ত দক্ষিণপন্থী শক্তির বিরুদ্ধে চালিত। ফলে আশঙ্কা থেকেই যায়। এই সব আন্দোলন-সংগ্রাম থেকেই তেমন একটা সম্ভাবনা ত্বরান্বিত হচ্ছে না তো !!
এই নির্বাচন সম্পর্কে এখানেই দেখা দিচ্ছে অন্য একটা প্রশ্ন, এমনকি আপ এর কাছ থেকেও, যা বিবেচনার যোগ্য বলে মনে হয়, সম্ভবত বামপন্থী বা কমিউনিস্টদের কাছেও। আপ যে ‘রাজনৈতিক’ অবস্থান নিয়েছে সেই অবস্থান বামপন্থী বা কমিউনিস্টরা নিতে পারে না, সম্ভব নয়। কিন্তু পানীয় জল, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ অর্থাৎ জনসাধারণের যে অতি সাধারণ দাবি দাওয়া, নাগরিক অধিকার ইত্যাদি নিয়ে লাগাতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে থাকা, তাদের কর্মী থেকে নেতা করে তোলা, প্রশিক্ষিত ও চেতনায় সমৃদ্ধ করা, কেবল নেতিবাচক নয় – ইতিবাচক পদক্ষেপ, বিকল্প সন্ধান ও হাতে কলমে নির্মাণ – এসব কাজ তো কমিউনিস্টদের করার কথা। তবেই তো বিজেপি’র ভাঁওতার বিরুদ্ধে লড়াই এর পাঁচিল গড়ে তোলা সম্ভব। কমিউনিস্টরা একাজ কোথাও কখনও করে না তা নয় – রাজস্থানে জলের দাবিতে মানুষকে নিয়ে আন্দোলন দেখা গেছে, কিন্তু ঘটনা হল এটা এখন ঐচ্ছিক, কোন কোন নেতা বা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির নিজস্ব পছন্দ, উদ্যোগের মধ্যে সীমিত হয়ে গেছে। কেন হয়েছে, কীভাবে দুর করা সম্ভব সেসব সংশ্লিষ্টদেরই বিবেচনা করার কথা। সময়ে বিবেচনা করা হলে ভালো না হলে সময় ও যায়গা কোনটাই ফাঁকা থাকবে না। আপাতত দিল্লীর লাড্ডু খেলে না খেলে যেমনটা হয়!
আসলে বিষয়টা হল জাতীয় দল হিসেবে কংগ্রেস ছিল ‘একমাত্র’ দল যাদের একটা জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গী ছিল ঠিক, এখনও একেবারে নেই তা নয়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এই দল শক্তি হারিয়েছে, পংক্তিচ্যূত। আর এই শূন্যতা পূরণে অনেক রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছে আঞ্চলিক দল যাদের আবার কোন জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি নেই। তাদের দিয়ে দেশ শাসন চলে না। অথচ চলছে। এই আঞ্চলিক দলগুলোকে সামনে রেখে দেশি-বিদেশি নানা শক্তি নানা উদ্দেশ্যে ‘কাল্টিভেট’ করছে। ক্ষতি যা হবার হচ্ছে। একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর মধ্যে একটা নীতিনিষ্ঠ জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি আছে লক্ষ্য করা যায়, যা অনেকেই মানে, স্বীকার করেন। কিন্তু নানা কারণে কমিউনিস্টরা ‘জাতীয় বিকল্প’ হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে চরম দক্ষিনপন্থী শক্তি সেই শূন্যতা পূরণে আপাতত প্রক্সি দিতে উঠে এসেছে বা তাদের তুলে আনা হয়েছে। এদের ‘জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গী’ দেশকে সংহত করে না, সংবিধানের মর্মবস্তুকে অস্বীকার করে, লঙ্ঘন করে। ফলে দেশের অনেক রাজ্যই এমন ‘জাতীয় নীতি’ অনুমোদন করে না। যার প্রতিফলন গত ছ’ বছরে ঘটেছে বিভিন্ন নির্বাচনে। সর্বশেষ দিল্লীর ক্ষমতায় থেকে দিল্লী দখল হয়ে উঠলো না … যো খায়া উহ পস্তায়া যো নেহি খায়া উহ ভী …
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০
Posted in: Essay, February 2020