‘অপরজন’-এ প্রকাশিত প্রথম দশকের কবিদের কবিতা নিয়ে কিছু কথাবার্তা : উমাপদ কর

সেপ্টেম্বর ২০১৯ এ ‘অপরজন’ ওয়েব-ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় প্রথম দশকের ৫৪ জন কবির কবিতা। অপরজন এই ধরনের কাজ খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে করে থাকে। প্রকাশের পরপরই দেবাঞ্জন (দাস) টেলিফোনে আমাকে অনুরোধ করে এদের নিয়ে কিছু লিখতে। কিন্তু সময়াভাবে আমি তখন লিখতে পারিনি। পরে ইন্দ্রনীলও (ঘোষ) আমাকে একই অনুরোধ করে। তখনও আমার কিছু অসুবিধা ছিল। পরে আবারও দেবাঞ্জন আমার অংশগ্রহণ প্রত্যাশা করে। ততদিনে আমি বেশ কিছুটা সময় সঞ্চয় করে নিয়েছি। ফলশ্রুতিতে এই লেখা।
প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো, এক দশকেই (কারও কারও মাত্রই ৪-৫ বছর) কারও কবিতা নিয়ে সম্পূর্ণরকম প্রতিক্রিয়া জানানো খুবই মুশকিল। কেননা এরা অধিকাংশই আগামীতে নানা চিন্তা-ভাবনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বাঁকবদলের মধ্যে দিয়ে যাবে। অন্তত ২০-২৫ বছর ধরে নিরন্তর একটা চলায় এরা ভাস্বর হয়ে উঠবে। তখন হয়তো একটা দিকনির্দেশিকাসহ আলোচনার সময় হবে। তবু আজকে যে তারা লিখছে, সেটুকুর ভিত্তিতে কিছু আলোকপাত করা যেতেই পারে। কিন্তু স্বভাবতই তা হবে আংশিক। কোনও মূল্যায়ণ নয়, কোনও দিকনির্দেশিকাও নয়, সামান্য পাঠপ্রতিক্রিয়া উঠে আসবে এই লেখায়, আমার কাব্যভাবনায় আর পাঠাভ্যাসে। আশাকরি সংশ্লিষ্ট কবিরা ও পাঠক বুঝতেই পারবেন এই লেখার প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্যটুকু।
৮ জন অতিথি সম্পাদকের মাধ্যমে বাছাইকৃত ৫৪ জন কবির কবিতা। হতেই পারত আরও কয়েকজন কবি এখানে প্রকাশিত হতে পারতেন। কিন্তু কোনও বাছাই যেহেতু সম্পূর্ণ হতে পারে না, আর স্থান-সংকুলানের একটা প্রশ্ন থাকেই, তাই এদের নিয়েই কথাবার্তা। এই তরুণতম কবিদের বেশ কয়েকজনের কবিতা আমি আগে পড়িনি, বা পড়লেও মনে রাখতে পারিনি। এদের কবিতা পড়াটাই আমার কাছে এক নয়া অভিযান, নয়া আনন্দের ব্যাপার। এরা হলেন- দীপঙ্কর লাল ঝা, ইমরান মেহেদী, শাফিনূর শাফিন, সুপ্রিয় মিত্র, অনুপম মণ্ডল, সন্দীপন দত্ত, সানজিদা আমীর ইনিসী, সৈকত দে, শ্রাবণ সৌরভ, জ্যোতির্ময় বিশ্বাস, রাসেল রায়হান, সুমন সাধু, ফারাহ সাঈদ, আদিদেব মুখোপাধ্যায়, তানহিম আহমেদ, সাম্মি ইসলাম নীলা, মোস্তাফা হামেদী, আমির খসরু, জগন্নাথদেব মণ্ডল। মোট ১৯ জন। শতকরা হিসেবে ৩৫ শতাংশ। এটাই একটা ভালো পত্রিকার কাজ। এই ৩৫ শতাংশের আংশিক পাঠ ঘটিয়ে দেওয়া। যদিও না-পড়াটা কোনও গৌরবের কথা নয়। কিন্তু যেভাবেই হোক ঠিক ব্যাটে-বলে হয়নি। তো, প্রথমেই এই ১৯ জনকে পড়াই সাব্যস্ত করি, এবং লিখতে শুরু করি শেষেরজনকে আগে ধরে। সেভাবে—
জগন্নাথদেব মণ্ডল – দুটো কবিতাতেই মৃত্যুগন্ধ, চেনা বিষাদ, খুব যে তীব্র অভিঘাতে, তা অবশ্য নয়, মৃদু। পরপর বলে যাওয়া রিলে ঢং-এ, গায়ে গল্পছোপ, ভাবনাকে ডোমিনেট করেছে বর্ণনা, যেখানে পল্লীপ্রকৃতি মুখব্যাদান করে আছে। বয়স হয়তো একুশ, হয়তো মা-বাবা-দিদি নিয়ে সংসার। এ-সময়ের চঞ্চলতা, অস্থিরতা, দ্রোহ, প্রেম, রাগ-অনুরাগ, যা স্বাভাবিক তা যেন অনুপস্থিত। তবু ভালো লেগেছে, এই তিনটে শব্দ বলাই যায়। টুকটাক সমাজবাস্তবতা জড়ানো। ২য় কবিতায় শেষ পঙ্‌ক্তিটি একটা যাচ্‌না, যেন সব মানুষের হয়ে, সব মানুষের জন্য। এ-ও কম বলব না। কবিকে আরও মিত দেখলে আরও ভালো লাগবে।
আমির খসরু – রাঢ়ি শহুরে ঘুম। আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে বলতে মান্যতাপ্রাপ্ত বাংলাভাষায় এসে পড়া। কিছুটা হলেও নতুন প্রয়োগ। আঞ্চলিক ভাষার অধিকাংশই এখনও আমার অধিগত। কেননা মা-বাবা-মাসি-পিসিরা কিশোরগঞ্জেই জন্মেছিলেন। ছিলেন ’৪৭ পর্যন্ত। সেখানে লাড়ু, বয়াম, কইতর, কাইৎ কইরা, আশিন, চিন, কুপি, পড়তে ব’অ, চড়বা, ক্যামনে বা ক্যান, ইত্যাদি শব্দ ও শব্দবন্ধ বারবার শুনেছি, বেশ কিছু মনেও আছে। কিন্তু ‘ছিটাইলে’ টা ‘ছিডাইলে’ আর ‘অগ্রহায়ণে’ টা ‘অঘ্রাণে’ হতো না? আর ‘বেঁহা’ ও ‘ফরহাস’ এই দুটো আমার অধিগতর বাইরে। কথা হচ্ছে, প্রায় সব লাইনের শেষে এই যে উদ্ধৃতি চিহ্নর মধ্যে কিছু শব্দ, এসব কি অন্য কারো কবিতাংশ? না নিজেরই? নিজের হলে উদ্ধৃতি চিহ্ন কেন? এ-সবই জানার কৌতূহলে। মোদ্দা কথা কবিতাটা ভালো লেগেছে। গ্রামজীবনের এক পারিবারিক পরিবেশ থেকে উঠে আসা কবিতা। খুব বেশি ঘোর-প্যাঁচ নেই। একটা স্বাভাবিক বলা। একটা মেসেজও পুরে দেওয়া আছে শেষ লাইনে—‘সব কিছুর শরিক আছে বিদ্যার কোন শরীক নাই’। ভাই, এখানে কবিতাটা সামনে এসে পড়েছে, আড়াল পায়নি, তাই একটু বেশিই খোলামেলা। ২য় কবিতাটা কিন্তু বেশ জমাটি, কিছুটা পরীক্ষামূলকও। আপাত লিংকলেস পঙ্‌ক্তিগুলো থেকে শেষ পর্যন্ত একটা কোলাজই বেরিয়ে আসছে। কিছু শব্দ-বন্ধ ও পঙ্‌ক্তিতে কল্পনার বিস্তার ধরা পড়ে, যেমন, ‘চুরুট যুবতী’ বা ‘প্রচ্ছদ হয় অভাবী গরুর মুখে খড়ের গান’। এসব কবির গুণ। বেশ ভালো লাগে।
মোস্তাফা হামেদী – দুটো কবিতার বই হয়ে গেছে, আরেকটি হবে। তবু দুটো কবিতাতেই কমবেশি ম্যাচুরিটির অভাব লক্ষ করলাম। শুধু বলে যাওয়াটারও কবিতা হতে অসুবিধা নেই, যদি তাতে মোচড়, ওঠা-নামা থাকে, আর ভাবনার স্ফুরণে মাঝেমাঝে পাঠকমনকে স্পর্শ করা যায়, নাড়িয়ে দেওয়া যায়। ১ম কবিতায় এ-সবের অভাব স্পষ্ট। ২য় কবিতায় অপেক্ষাকৃত কম। কারণ সেখানে অন্তত কখনও কবিতাটা বেজে ওঠে। ক) ‘জংপড়া টিনের কৌটা/ মুছতে মুছতে/ কেউ ভুলে যায় সাং’। খ) ‘বালার ঘসটা লেগে ভেঙে পড়ছে/ দুপুরের থান’। ভালো লাগে।
সাম্মি ইসলাম নীলা – প্রথম কবিতাটা ঠিক জমেনি, নাম ‘বিড়ি’, যেন চমক হয়েই রইল। বিড়ি পোড়া আর মানুষ পোড়ার ধিকিধিকিটা বাজল না। আর ‘নিরবে পুড়ে’ পড়তে গিয়ে চোখ নীরব হয়ে যায়। ২য়টা অপেক্ষাকৃত প্রাণময়, জ্যান্ত। ‘চেনা পারফিউম এসো/ জেগে থাকি উষ্ণ ঘ্রাণে’, কোনও আরোপিত কিছু নয়। শেষ দু-লাইন বহুল ব্যবহৃত। নতুন ব্যঞ্জনার অপেক্ষায় থাকাই যায়।
তানহিম আহমেদ – বাঃ, প্রথম কবিতাটা খুব ভালো লাগলো। ১৭ বছর বয়সে এমন কবিতাবোধ কমই দেখা যায়। ‘আনাড়ি/ বৃক্ষের গভীরতা মাপতে গিয়ে সেদিন যে মেয়েটি স্বয়ং/ পাখি হয়ে গেলো!’ – এ এক ভাবনা, যা পাঠককে ছুঁয়ে যায়, ভাবতে শেখায়। ‘ভাঙা কাচের স্বর’ – এক বিমূর্ততা, যা কবিতার প্রাথমিক শর্ত। খুব কিছু বলে ফেলার তাড়া নেই। এসব পাই কবিতায়। সাধু। ২য় কবিতাটাও ভালো। কিন্তু সেখানে কবিতাটা আগের মতো কেন্দ্রচ্যূত নয়। যেন একটা ধর্তব্যকে মাথায় রেখেই কবিতাটা নির্মিত হয়েছে। দোষ নেই তাতে কিছু। কিন্তু একটা কনক্লুশানে পৌঁছোনোর তাগাদা উপলব্ধ হয়, যা আগের কবিতায় ছিল না। ২য় স্তবকের ৩ টে লাইনে ভাবনাটা গড়াতে চেয়েছিল। ১ম স্তবকটা যেখানে দৃশ্যকল্প। এই যে ভাবনাজগতের প্রক্রিয়ায় রয়েছে কবি, তা চলুক, ভাবনাই কবিতা হয়ে উঠুক। পাঠকের প্রত্যাশা বাড়তেই থাকবে, এটুকু বলতে পারি।
আদিদেব মুখোপাধ্যায় – ভালো লাগলো বেশ, কবিতাদুটো। টাটকা লেখা (জুন ২০১৯), টানা গদ্যে, উত্তম পুরুষে। ছবি আছে, ছবি থেকে বেরিয়ে যাওয়াও আছে। প্রেম আছে, আছে প্রেমার্তিও, তাই অশ্রুপাত। স্বজনের মধ্যে নিজেকে জাগানোর প্রার্থনা আছে, স্বজনের জন্য আছে গভীর চিন্তা ও বেদনাবোধ। তাই চোখ ভরে রক্ত আসে। কবিতার ভাষায় গতি আছে, টানা পড়িয়ে নেয়। ভালো লাগে। এরপরেও বলতে চাই, আরেকটু আবেগের মেদ ঝরিয়ে ফেলে, মিত হলে, সংহত হলে, আরও ভালো লাগত। ব্যক্ততার মধ্যে অব্যক্ততাও কবিতার প্রাণভোমরা হয়ে উঠতে পারে। এগিয়ে চলুক এই কলম। প্রাণ খুলে কবে সাবাসি জানাবো, সেই প্রতীক্ষায় রইলাম।
ফারাহ সাঈদ – টানাগদ্যে লেখা প্রথম কবিতার ১ম লাইনটা একটা স্টেটমেন্ট তথা বিবৃতি। তারপর থেকেই শুরু হলো বিমূর্ততার খেল। জমে গেল কবিতা। জন্মদাগ শুধুমাত্র জন্মদাগেই স্থিরিকৃত থাকলো না। একটা বহুমাত্রিকতার খোঁজ পেয়ে যাই এখানে। ভালো লাগে। ২য় কবিতায় যখন লেখা হয়— ‘বোতল ভর্তি বড়দিন নিয়ে তুমি ফিরে এলে ডিসেম্বরে’, বড়ো আহা করে উঠতে হয়। ‘তুমি আর যিশু’ এক কল্পলোক। কল্পনা এক উড়ান, যাতে মজে থাকেন কবি। যিশুর মদ বিলানো তখন আর বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না। যেমন অনেকদিন আগে পড়েছিলাম—‘আলেকজান্ডার বিক্রি করে দাঁতের মাজন’। সে যাক, নানা কৌণিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা ও প্রকাশ-প্রয়াস কবিতারই অঙ্গ। ‘আতপসিদ্ধ দিনে’ নিঃসন্দেহে পাঠকমনে এক নতুন ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করে।
সুমন সাধু – বাঃ! অসাধারণ লাগলো ‘এঁটোকাঁটো রান্নাঘর’-এর ১ ২ ৩। বড়ো গভীর থেকে উৎসারিত লিপিমালা। সামান্য দৃশ্যতাকে অসামান্য ভাবনাবয়ানে লেখা এইসব কবিতা। ১ নম্বরে যখন বর্তমানকে তুলে ধরা, ২ নং-এ তেমনই ভবিষ্যতের পসিবিলিটিগুলো। ‘বাসি ডাল গরম হলেই মাখো মাখো হয়ে উঠবে ভাত’। উঠবে, পসিবিলিটি। ৩য় টাও তাই। ‘নিঃশ্বাসের ঠিক নিচে বসে থাকবে প্রিয় বন্ধুটি’। ওহো। তারপরেই ছিটকে বেরিয়ে গিয়ে দুটো লাইনে লেখা হচ্ছে ১) ‘এ ফাঁকা রান্নাঘরে’ ২) ‘এ ভরা রান্নাঘরে’। এই বৈপরীত্য দূরত্ববোধক। এই দূরত্বকেই হাহাকারে পরিণত করা হয়েছে, ‘কতদিন দেখিনি তাকে’ এই শব্দবন্ধে। ফাঁকাতেও নেই, ভরাতেও নেই। এই তো কবিতা। এখানেই কবিতার আসন ও নিনাদ। খুবই চলতি ভাষায় লেখা, কোনও গমক নেই, কিন্তু বয়ে যাওয়া আছে। শব্দ নিয়ে দুটো রূপ পরিবর্তন নজর এড়ায়নি। এঁটোকাঁটো, এঁটোকাঁটায় অভ্যস্ত আমরা, অসুবিধা হয় না, বরং ভালো লাগে। আরেকটা, সূক্ষ্মভাবে, শেষ দু-লাইনের প্রথমটা ‘তাকে’ (সাধারণ), পরেরটা ‘তাঁকে’ (বিশেষ)। কিন্তু তাকে বা তাঁকে একইজন। কেন যে সুমনকে আগে পড়িনি, বা পড়লেও ভুলে মেরেছি!
রাসেল রায়হান – পড়লাম। দুটো কবিতাই মোটামুটি একটা ভালো লাগাকে রেফার করল। খুব বাজিয়ে তুলতে পারলো না। ‘মাছ’ কবিতাটা স্টেটমেন্টধর্মী। ‘নস্টালজিয়া’ অপেক্ষাকৃত কল্পনাশ্রিত ভাবনাময়। প্রথমেই পড়তে গিয়ে, ‘সূর্যাস্তকালীন অনিয়ন্ত্রিত’, একটু হোঁচট খাই বৈকি। ভারী ভারী দুটো শব্দ পাশাপাশি। ‘অশ্রুসিক্ত’ পড়তে গিয়েও একটা বাঁধোবাঁধো ঠেকে। এত ব্যবহৃত গদ্যশব্দে কবিতা করতে চাওয়া ডিফিকাল্ট, মনে হয়। তবু বলব, মোটামুটি লেগেছে, হয়তো কবিতা আরও বেশি অভিনিবেশ দাবি করে।
জ্যোতির্ময় বিশ্বাস – ‘পুষ্পরাণী’ খুব একটা ভালো লাগেনি। সুরেলা স্বরে গল্প বললে কবিতা হয় কিনা এ-নিয়ে প্রবল সন্দেহে থাকি। অন্যকেও সন্দেহ করতে বলি। তারপার যার যেমন ইচ্ছে। কবিতার তো স্কুল হয় না। স্ব-চিন্তাভাবনাই নিয়ন্ত্রক। ‘তারা’ কবিতাটা কিন্তু ভালো লাগলো। স্বল্প কথা, সংহত এবং কবিতার আমেজ। চলুক আরও পথ চলা। চলাই কবির কাজ, চলতে চলতে অন্বেষণ।
শ্রাবণ সৌরভ – ভালো বলতেই হবে, এমন যেমন কোনও কথা নেই, আবার খারাপ বলতেই হবে, তেমনও কোনও কথা নেই। লাগা না-লাগার এইরকম একটা পর্বেও থাকতে পারে কবিতা। মক্‌সো পর্বের ঠিক পরেরটা, যখন আবিষ্কৃত হতে পারে আরও অনেক কিছু, অনেক দিক। বস্তুত ভালো কবিতা খারাপ কবিতা বলে মার্ক করে দেওয়া যায় না। ভালো-লাগা মন্দ-লাগাটা হয়তো চিহ্নিত করতে পারে একজন পাঠকের পাঠাভ্যাসের নিক্তি। কবিতা হয়, নয়তো হয় না। শ্রাবণ এইরকম একটা পর্যায়ে আছে বলে আমার মনে হওয়া, যা ধ্রুব কিছু নয়। সামান্য হলেও কবিতারসের খোঁজও আমি পেয়েছি। শ্রাবণকেও আরও ঝরতে বলব, যাতে কদম্বের সৌরভ-এ আমরা আমোদিত হই।
সৈকত দে – বড়ো সোজাসাপটা। কথা ও গল্প বলাকে কবিতা করার প্রয়াস। এই প্রয়াসের (অবশ্যই এই দুটো কবিতা পাঠক্রমে) ক্ষেত্রে আমি কবিতার দিকে সদর্থক কিছু পাইনি। হতে পারে সেটা আমার সক্ষমতার অভাব। নতুনত্ব হয়তো কিছুটা আছে, সেটা যতটা না কবিতার, তার চেয়ে বেশি চমকের বলে আমার মনে হয়েছে। নিজেকে সন্দেহ হলো। দ্বিতীয়বার পড়লাম। কিন্তু কথা বদলাতে পারলাম না, যা ধ্রুব তো নয়ই, অসত্যও হতে পারে। কাউকে নিগেট করা আমার উদ্দেশ্য নয়। পাঠে যে অনুভব হলো তারই প্রকাশমাত্র। আমি জানি, (যা প্রথমেই বলেছি) এই সামান্য চলাতেই কিছু বলা যায় না। এতো দৈববাণী নয়। এক পাঠকের কথা। এ-ও জানি সৈকতরা আগামীতেই আমাকে ভুল প্রমাণ করে ছাড়বে।
সানজিদা আমীর ইনিসী – ভালোই লাগলো কবিতাদুটো। তেমন যে মনে দাগ ফেলে দিল, তা বলতে পারি না। তবে কবিতাবোধ তৈরি হচ্ছে ভেতরে ভেতরে, তার ইশারা ঈঙ্গিত আছে। ১ম কবিতার শেষ তিন লাইনেই যেন কবিতা ঝমঝম করে ওঠে। ২য় কবিতায় একটু বেশি বলা আছে, মনে হলো। দুটো কবিতায় দুই ধরনের ক্রিয়াপদের ব্যবহার লক্ষ করি। ১মটায় রাঢ়ী বাংলা চলতিভাষার ক্রিয়াপদ অভিশ্রুতির মাধ্যমে, যেমন, হলে, খসে, ধরে, নিয়ে, ছুটে, শুনে, সরে, হয়ে ইত্যাদি। আর ২য় কবিতায় বাঙ্গালা উপভাষার ক্রিয়াপদ অপিনিহিতির মাধ্যমে, যেমন, হইয়া, কইরা, মিইশা গিয়া, রাইখা, বইসা, ঘুমাইয়া, বইলা ইত্যাদি। এমন সামান্য পরীক্ষাস্পৃহাও ভালো লাগে। তবে কবিতাদুটোতে ক্রিয়াপদের ব্যবহার আরও কম করতে পারলে ভাষার গতি বাড়ত বলে মনে হয়।
সন্দীপন দত্ত – বাঃ! ভালো লাগলো বেশ। আবহমান বাংলা কবিতাধারার মধ্যে থেকে সুন্দর সাবলীল ও কবিতাময় উচ্চারণ। ১ম কবিতায় নিচুস্বরের বিষাদ, আর ২য় কবিতায় রহস্য ঘনিয়ে তুলে বিস্ময়ের দিকে যাওয়া। একটু তরল। তবে কবিতা হতে অসুবিধা হয়নি। নিজস্ব কবিতাভাষা তৈরির দিকে নিশ্চয়ই এবারে নজর গড়াবে।
অনুপম মণ্ডল – বহুল ব্যবহৃত কণ্ঠস্বরে বর্ণনার আধিক্যে কবিতাকরণ প্রয়াস। খুব যে মন স্পর্শ করেছে, তা বলতে পারি না। এখানেও দেখছি দু-ধরনের ক্রিয়াপদের ব্যবহার। এক্ষেত্রে অবশ্য চলিত ও সাধু ক্রিয়াপদের প্রয়োগ। ১ম কবিতায় চলিত, যেমন— ডাকে, আসছে, যাচ্ছে ইত্যাদি। ২য় কবিতায়, সাধু, যেমন— ফিরিতেছে, লুটাইতেছে, ফিরিতেছো, ঝরিতেছে ইত্যাদি। বেশ তো, চলুক। ক্রিয়াপদের ব্যবহার নিয়ে দু-চার বার বলছি। কারণ, আমি মনে করি, কবিতার ভাষায় ক্রিয়াপদের ব্যবহারের গুরুত্বপূর্ণ এক ভূমিকা আছে।
সুপ্রিয় মিত্র – বা! বেশ লাগলো কবিতাগুলো। ৭ টা কবিতায় একজনকে কিছুটা অনুধাবন করা যায়। সুপ্রিয় নির্মিতির সঙ্গে বিনির্মিতিকে জড়িয়ে কবিতা করে। ফলে তার কবিতায় চেনা পটেরও বিমূর্ততা ধরা পড়ে। ভালো লাগে। চেনা পরিচিত শব্দে তার কবিতাকরণ। কিন্তু দৃশ্যকল্প ও রূপকল্প থেকে কবিতাকে ভাবনাকল্পে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষমতা আছে তার। একটা মিষ্টি সুরেলা স্বরের মধ্যে মাঝেমাঝে ছন্দপতন ঘটানো তার কবিতার একটি বৈশিষ্ট্য হিসেবেই চিহ্নিত হবে। যেমন, ‘ধূপের প্যাকেটে ফুসফুসের ছবি’, ‘ভিখিরি ছেলের কাটা হাত’, ‘স্ত্রীয়ের চুড়ি, ছেলের জামার পর গরম জলের ছলক’, ‘খুচরা আগুন’ ইত্যাদি। একটা কথা না-বলে পারছি না। ৫ম কবিতায় গোটা কবিতার মধ্যে ‘তারপর ক্লান্তি’ কেমন মিসম্যাচ। কবিতায় তারপর, এরপর, বস্তুত, ইত্যাদি শব্দ কবিতার মেজাজটা নষ্ট করে দেয়। পাঠকের বিস্ময় নিরসন করে, একটা যৌক্তিক ধারাবাহিকতা আনে, একটা গল্পের ধারণা আনে। নির্মাণ-বিনির্মাণে কবিতাকরণে এসব প্রযুক্ত না-হওয়াই ভালো বলে আমার মনে হয়। সুপ্রিয়কে আগে পড়া কেন যে হয়নি, জানি না। নাকি স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, যা ইদানীং করে থাকে।
শাফিনূর শাফিন – কী বলবো, বুঝে উঠতেই পারছি না। এটুকু বলি, ছুঁয়ে যেতে পারেনি সেভাবে। টোকা-ঠোকা দিতে পারেনি, ভাবাতেও পারেনি তেমন। যদিও মনখারাপের কিছু থাকতে পারে না এক কবিতাকারীর। প্রথমত আমি অভ্রান্ত কিছু নই। দ্বিতীয়ত এ এক দীর্ঘ ভ্রমণ। সবে তো শুরু। আরও কবিতা প্রসবিত হতে থাকুক, কবিতাপ্রক্রিয়ায় থাকুক মনন।
ইমরান মেহেদী – না, তেমন কোনও কবিতাবেশ সৃষ্টি করতে পারলো না মনে। খেলে গেলো না কোনও তরঙ্গাভিঘাত। আমার অক্ষমতাও হতে পারে। বেশকিছু গদ্যনির্ভর শব্দ ও শব্দবন্ধ লক্ষ করলাম, যা কবিতাবয়নে অসাহয়তা করেছে। তিনটে উদাহরণ দিই— ১ম টা থেকে, ‘অগণিত নক্ষত্রের ন্যায়’। ২য় টা থেকে, ‘প্রক্ষিপ্ত অন্ধকারে বিলীন’ এবং ‘অভিবাদন জ্ঞাপন পূর্বক’। তবে কি শব্দকে আমি দু-ভাগে ভাগ করতে চাইছি। গদ্য-শব্দ ও কাব্যিক-শব্দ! না, ঠিক তা নয়। শব্দ প্রয়োগের কৌশলে তা গদ্যময় বা কবিতাময় হয়ে উঠতে পারে। কবিতা ভাষার ভার বেশি বহন করতে পারে বলে আমার মনে হয় না।
দীপঙ্কর লাল ঝা – ভালো লাগলো। কবিতা অনির্দেশ্য, অনির্ণেয়, অনির্দিষ্ট। এইসব কবিতা পড়লে সেই ভাবোদ্রেক হয়। আপাত লিংকলেস ছোট্ট ছোট্ট কথার টুকরোয় কোলাজ সৃষ্টি। এক ধরনের ক্যায়স আছে। মীমাংসায় পৌঁছুনোর তাড়া নেই। কবিতায় মীমাংসা থাকা আমার অন্তত ভালো লাগে না। টুকরো-টাকরা দৃশ্যও আছে, যা কবিতা হয়ে মন কাড়ে। ভাষায় এক্সট্রা চটক কিছু নেই, কিন্তু গীতলতামুক্ত। এভাবে একটা অপর/ অন্যরকম কবিতা হয়ে উঠতে পেরেছে, যা প্রচল থেকে বেশ কিছুটা আলাদা। ভালো লাগে।

৫৪ – ১৯= ৩৫। রইল বাকি। পড়েছি, কিন্তু কম, যারা, তারা হলো— আনিস আহমেদ, মণিদীপা সেন, স্নেহাশিস রায়, শুভদীপ সেনশর্মা, আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়, হাসনাত সোয়েব, জ্যোতির্ময় মুখার্জি, রাজা সাহা, বুদ্ধদেব হালদার, শুভজিৎ গাঙ্গুলী, অহনা সরকার, বিবস্বান দত্ত, শাশ্বতী সরকার, বিশ্বরূপ বিশ্বাস, কৌস্তভ গঙ্গোপাধ্যায়, বিপ্লব চক্রবর্তী, শিমন রায়হান, অভিষেক মুখোপাধ্যায়। মোট ১৮ জন কবি। এবার তাদের নিয়ে কিছু কথা।
আনিস আহমেদ – মুখচোরা, লাজুক হয়তো। অলস কিনা, জানি না। তবে সে দুটো কবিতায় মাৎ করে দিয়েছে। ওর মধ্যে একটা নিরিবিলি কাজ করে। ১৮ বছর বয়সে এমন নিরিবিলি যে সে কোথা থেকে পায়! অবাক করে। ‘চুলের ওপর রাত ভুলিয়ে’, ‘ইঞ্চি মেপে ফুলের গন্ধ’, ‘ডাকনামে নুলোর ঘ্রাণ’, ‘টান টান স্নায়ু আসছে মাথায়’ ইত্যাদি শুধু আমাকেই নয়, অনেককেই মাৎ করবে। ওর ভাবনাপ্রবাহে একটা ছড়িয়ে পড়া আছে, আবার ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতাও আছে, যা প্রচলে থাকে না। নিজের সঙ্গে মনোলগে ভাবনাটা কেমন কবিতা করে দিল, সাবাস। ২য় কবিতায়, শুরুটাতে একটা চমক। নামখানা (স্থান), না নামখানা (নামটি) এই দোলাচলের মধ্যে কবিতাযাত্রা। নানা নাম, গিঁট দিলে যা সম্পর্কে চলে যায়, আর পাখির গলায় ডাকে। আপাত সরলতার মধ্যে এই সম্পর্কের কামরা থেকে কামরায় যেতে ভয় হয়, যা বাস্তব। খুব ভালো। তবে শব্দ নিয়ে দুটো কথা বলি। বলা দরকার। ডায়লেক্ট নির্বিশেষে কয়েকটি শব্দের প্রয়োগ সম্পর্কে সচেতনতা দাবি করি। ‘ছোটোছুটি’ (যদি এটা খর্বকালীন ছুটি না-হয়, তবেই। সম্ভাবনা কম), ‘ওড়াওড়ি’। আর ‘আসলে’ শব্দের ব্যবহার কি খুব জরুরি?
মণিদীপা সেন – ভালো লাগলো। বেশ ভালো লাগলো, দুটো কবিতাই। টানা গদ্যে, কিন্তু কবিতার ধরা ছাড়াটা বেশ উপভোগ্য। কবিতার অনেক রকম জলাশয় হয়। সমুদ্র, নদী (নানা প্রবাহের), সরোবর, খাল-বিল, পুকুর, আরও ছোটো জলাশয় (যেমন ডোবা)। এখানে পাই সরোবরের দেখা। সরোবর আবার দুই রকমের। স্তব্ধ জল, আবার ঢেউ সংকুল। এ-দুটো উচ্চাবচ ঢেউ-তোলা সরোবর। স্নিগ্ধতার সঙ্গে যেখানে মিশে আছে একটা উত্তল বাতাবরণ। দুয়ে মিলে চলন তার। দুটো কবিতাতেই ডিটেইলিং আছে, কিছু বর্ণনাসহ। কিন্তু তা চলনকে স্লথ করেনি। করেনি বলার ঢং-এ, উপস্থাপনার গুণে। একদম সামনে থেকে সবার দেখা প্রত্যক্ষতাগুলো একটা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থাপিত হয়েছে কবিতায়। ভালো, ভালো।
স্নেহাশিস রায় – রাগ, অভিমান, উপযুক্ত না-পাওয়ার ক্ষোভ, বেদনাভরা জীবন। জীবনের পাঠ থেকে প্রত্যক্ষভাবে কবিতা লিখলে, তাতে প্রতিফলিত হবেই সেইসব অভিজ্ঞান। স্নেহাশিসের কবিতা এভাবেই উপস্থাপিত হয় তার সকলটুকু নিয়ে। শিল্পের সঙ্গে জীবনের কোনও বিরোধ নেই। জীবন থেকেই শিল্প, আর তার বিকাশ। প্রকৃতি আর মানুষ আলাদা কিছু নয়, মানুষ প্রকৃতিরই দান। সেই প্রকৃতির একটা অংশ নিসর্গ, যা প্রকৃতিরই আরেকটা অংশ মানুষের পরিপূরক। এই দুই অংশের রসদ নিয়ে স্নেহাশিসের কবিতা, সঙ্গে দ্রোহ, অভিমান, বেদনা ও কষ্টবোধ। বিবমিষাও আছে, ‘বমি মাখা মুড়ি’ খাওয়ার অনুষঙ্গে। প্রশ্ন আছে, ‘ফানুস বাজি’ কিনা? এই-ই তার কবিতাকরণের কৌশল এবং ঢং-ও। ভালোই লাগে।
শুভদীপ সেনশর্মা – শুভদীপের কোনও কবিতার বই আমি পড়িনি। তবে বিচ্ছিন্নভাবে ওর কিছু কবিতা পড়েছি। এটা তথ্য মাত্র। মূলকথা, বাংলা কবিতায় এখন আমি একটা বিশেষ অঞ্চল খেয়াল করি, যেখানে বেশ কিছু কবি (সব বয়সের) একটা সেফ জোনে খেলেন। ক্রিকেটের ভাষায় ভি-জোনে খেলা, ব্লক-পুশ-হালকা ড্রাইভ নির্ভর খেলা। কবিদের ক্ষেত্রে অঞ্চলটা হলো —পরিবার তথা বাবা-মা-ভাই-বোন, ঘর-বাড়ি-ছাদ, মাঠ-বাগান-পুকুর, বড়জোর সামনের নদীটা, আর আমি-তুমি-তুই-সে, কিছু হৃদয়জ কথাবার্তা। এসব নিয়েই কবিতা করা। অসুবিধা কিছু নেই, হতেই পারে। শুভদীপ কবিতার এই অঞ্চলে খেলতে (লিখতে) ভালোবাসে এবং অনেকটা অধিগত তার। সোজা-সাপটা বলতে বলতে কবিতার খোঁজ ও আশ্রয়। মন্দ নয়। কিন্তু পিচ্‌-এ রান থাকলে, বড়ো ইনিংস খেলার জন্য তো সিঙ্গল, ডাবল, চার-এরও প্রয়োজন। শুভদীপ তার বর্তমান ভালোটুকু নিয়ে আরেকটু জাগুক, চর্চায় মাতুক— এটা তো চাইতেই পারি।
আকাশ গঙ্গোপাধ্যায় – গ্রুপটা অনেকটাই শুভদীপ-এর। যে কথা আগে বললাম। আকাশ বড়ো মিঠি করে লেখে। একটা সুর ভরে দেয়। শেষে গিয়ে একটা হালকা বেদনাবোধের চাটি দেয়। ভালোই লাগে পড়তে। কবিতা নির্মাণে ওর কলমের ওপর বিশ্বাস জমা করে তাকে সুপরিকল্পিত করে। প্রাত্যহিকতার মধ্যে জীবনের যে সঞ্চার, তাই তার কবিতার ভরকেন্দ্রে। অগোছালো নয়, শিল্পিত ও সুষমামণ্ডিত। আরও পথ চলার রসদ সম্বলিত।
হাসনাত সোয়েব – দুটো কবিতা। ১ম টায় ৩টে পার্ট। বুক, চিবুক, নখ। শারীরীক অঙ্গবিশেষ। শরীরী প্রেমভাবনা কবিতায়, যেখানে মিশে আছে কিছু জ্বালা ও যন্ত্রণা। গার্লফ্রেন্ডকে প্রেমিকা ভাবতে কষ্ট আর কতটুকু, স্থানিকতায় দূরবর্তী, কিন্তু মানসে খুব কাছাকাছি। এই মানসচিন্তা থেকেই কবিতাটা নির্মিত। ফলে স্বপ্ন-কল্পনা-প্রেম-শরীর-দূরত্ববোধ আর সম্ভাবনা সব মিলেমিশে একাকার। ভালো লাগে। আবেগ কিছুটা প্রাধান্য পেয়েছে, যা এই কবিতায় অস্বাভাবিক নয়। প্রেমিকা মৃত, এই ভাবনার ওপর দাঁড়িয়ে কবিতাটি। তাই যা পুরাঘটিত অতীত (ক্যান্ডেল জ্বালাত, চিবুক থেকে উড়িয়ে দিত, ইত্যাদি) থেকে বর্তমানের কবর ভাবনা, যেখানে রেখে আসা যেতে পারে গোলাপ, নখ, যেখানে নামতে পারে সন্ধ্যা। একটা সম্ভাবনা তৈরির আঁচ। দু-চারটি বাক্যে গার্লফ্রেন্ডের কতগুলো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আঁকা হয়েছে, যাতে বোঝা যায় মোলায়েম প্রেমিকা নয় সে। ফাঁসিতে যাওয়ার আগে গাঁজা-আফিমের কোলাজ মাঙে, পাতার আড়ালে মাষ্টারবেট সারে, কবরে গিয়ে বুকে গাজর গাছ জন্মায়। আর ভালোবাসে যে, সে প্রেমিকার বুক দেখে না, কবর দেখে, স্বপ্নের জেরুজালেম ভাবে, কিছু গোলাপ রেখে আসে কবরে। ফলে একটা বৈপরীত্যও পাই এখানে, যাতে একটা কষ্টবোধ ও যন্ত্রণা লীন হয়ে থাকে। ২য় কবিতাটা কল্পনাপ্রসুত ভাবনার। দুই মাধ্যমের প্রায় সমসাময়িক দুই ব্যক্তিত্বকে এক ফ্রেমে আনা, এবং শেষে ফ্রেম ভেঙে বিপরীতমুখী করে তোলা। বেশ লাগে, ভালো লাগে।
জ্যোতির্ময় মুখার্জী – এখানে কিছুটা সাদামাটা কবিতা রাখলেও, জ্যোতির্ময়ের অন্য ধরনের কবিতা আমি কিছু পড়েছি। সে যাক, আলোচ্য এ-দুটোই। ‘ঘর আর বাইরের মাঝে একটা দরজা থাকে’, এই শেষ পঙ্‌ক্তিটি উপস্থাপিত করতে নির্মাণের বাকিটা যেন দাঁড় করানো। আগের পঙ্‌ক্তিগুলো এই লক্ষ্যস্থলে আসতে একটা যুক্তিক্রমে অগ্রসরমান হয়েছে। এও এক কবিতাধরন। ‘চটি’ কবিতাটাও অনেকটা প্রথম গোত্রীয়। গোটাটা পড়তে খারাপ লাগে না। একটা আবেশ সৃষ্টিতে সক্ষম। কবিতাবেশই বলব। জ্যোতির্ময়ের জন্য উল্লেখ করার মতো একটা কথা। ‘চটি’ কবিতায়, এই যে ‘রাখলেই’, ‘নিয়েই’, ‘দিয়েই’ ইত্যাদি ক্রিয়াপদগুলো বারবার ব্যবহৃত হয়েছে, এর স্পেশাল এফেক্ট কী! যা ‘রাখলে’, ‘নিয়ে’, ‘দিয়ে’ ইত্যাদি দিয়ে ঠিক স্পষ্ট করানো যায় না? কৌতূহল বশত জানতে চাওয়া। একই রকমের ক্রিয়ারূপ বারবার ব্যবহারে কবিতা কি তার বিচিত্রতা হারায় না?
রাজা সাহা – প্রথম কবিতায় তিনটি চরিত্র। আমি, তুমি ও সেই লোকটা, যিনি আঁকতেন, যিনি তার রং-তুলি বেচে দেন, প্রতিবাদ করেন না, পলায়ন করেন। বাকি আমরা দুজন অভিশাপগ্রস্ত। (কেন তা জানা যায় না। যদিও তার দরকারই বা কী?) আমাদের সম্পর্কজনিত অবস্থান থেকে ছলে বা কৌশলে পোড়াকাঠ জড়ো করা একটা কাজ, যেন তা প্রিয় মুখের জন্য। একটা গল্পের আদলে কবিতা প্রয়াস। ২য় কবিতাটা ভালো লাগলো। বলায় ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে একটা অভীপ্সার দিকে এগিয়ে যাওয়া। সুখ (সুস্থতা) ও অ-সুখের মধ্যে সূক্ষ্ম বার্তাটিই কবিতার প্রাণকেন্দ্রে। ভালো লাগে।
বুদ্ধদেব হালদার – বুদ্ধদেবকেও একটু অন্যরকম লাগলো, আমার সামান্য পড়ার থেকে। এখানে যে দুটো কবিতা পড়লাম, তাতে মন মজলো না। প্রথমটি গল্প করে বললে খারাপ লাগত না, যদিও বহুশ্রুত, যদিও প্রশ্ন উঠবে কবিতায় গল্প বলা কতটা গ্রাহ্য। চলতি কথায় প্রেমিকাকে ঘিরে মেঘলাদিন ও স্ব। সেই স্ব-ও আক্ষেপঝরা। ২য় কবিতাটা অপেক্ষাকৃত অন্যরকম উপস্থাপনার। কিছু কিছু পঙ্‌ক্তি পড়ে ভালো লাগলো। কিন্তু শেষ বাক্যটি কী ব্যঞ্জনার দ্যোতক তা আমার মস্তিষ্ক ধরতে পারে না। (এটা হতেই পারে)। কিন্তু প্রশ্ন একটা উঠে পড়তে পারে— কোনও চমক কি!
শুভজিৎ গাঙ্গুলি – দুটো কবিতাই বেশ ভালো লাগলো। মূল কারণ— গল্প বলার ঝোঁক নেই, বলে ফেলাটাই প্রাধান্য পায়নি, জ্ঞান দেওয়ার বাসনা নেই, বর্ণনা প্রধান নয়, বিষয় বলে মূলাধার কিছু নেই, অনেক কেন্দ্রক ও সেইসব কেন্দ্রক থেকে উৎসারিত হয়ে ছড়িয়ে পড়া, পাঠকের জন্য প্রতুল স্পেস, বিমূর্ততাসহ নির্মাণ-বিনির্মাণে আত্মপ্রণালীর উন্মোচন এইসব কবিতা। কবিতা এমনই, নিগেশন এন্ড নিগেশন। কী থাকবের চেয়েও জরুরি কী কী থাকবে না। শুভজিৎ-এর ভাষা আপডেটেশনসহ সরল, কিন্তু তরল নয়। ভাব-ভাবনায়, চিন্তা-চেতনায় এবং তার বিস্তৃতিতে জারিত কবিতা। দেখাগুলো একই, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গিটা ভিন্ন, উপস্থাপনাতেও মুনশিয়ানা আছে। শব্দ স্থাপনে ধ্বনিমাত্রিকতাও লক্ষ করা যায়। একটাই উদাহরণ— ‘শিশিরে উথলে যাবে রাত নোলকে ভোর লেগে/ নূপুর হবে বালিকার’। আহা, নূপুর যেন বেজে গেল…। বানান নিয়ে একটু সতর্ক হওয়া ভালো নয় কি? ‘দিচ্চে’, ‘রোব্বার’, বুঝলাম ইচ্ছাকৃত প্রয়োগ। কিন্তু, ‘প্রোকষ্টের’ আর ‘বাদামী’ ইচ্ছাকৃত তো নয়!
অহনা সরকার – ‘আ-বিস্তৃত’ একটা দীর্ঘ কবিতা, টানা গদ্যে লেখা। একটা গল্প বলার ঝোঁক আমার লক্ষ এড়ায়নি। দীর্ঘ কবিতায় একটা টানটান ভাবের প্রত্যাশা থাকে, যা পড়িয়ে নেয়। এখানে যা কিছুটা এলিয়ে পড়েছে বলে মনে হলো। তবু কোথাও কোথাও কবিতারসে সিক্ত হয়েছি। ‘বক’ অপেক্ষাকৃত বেশি ভালো লেগেছে। ভাবনা প্রতিফলনে অতিকথন প্রবণতা নিয়ে কবিকে আরও বিবেচক হতে হবে বলে আমার মনে হয়েছে। তবে পরবর্তীতে তাকে আরও পড়ার ইচ্ছা জেগে থাকলো।
বিবস্বান দত্ত – দুটো কবিতাই ভালো লাগলো। তবে, পড়েই কেন যে মুখ থেকে বেরিয়ে এল না বাঃ!, বা আহা! নিজেকে সন্দেহ করলাম। কোথাও কি কবিতা কম পড়িয়াছে? আবার পড়লাম। কিন্তু পুনরাবৃত্তিই ঘটলো। বুঝলাম, এ আমারই কোথাও খামতি রয়ে গেল। ভালো লাগছে, স্পর্শ পাচ্ছি, অনুভাবিত হচ্ছি, কিন্তু ট্রিগারিত হতে পারছি না। হয়, এমন হয়, আগেও এমন হয়েছে আমার। ১ম কবিতায় ‘আমি’ আধিক্য কিছুটা পীড়াদায়ক। আর ‘চণ্ডাল কাব্য’ কাব্য হলেও গদ্যানুষঙ্গে আহত হয়েছে বলে আমার মনে হওয়াকে একদম উড়িয়ে দিতে পারছি না। একটু যেন বেশি বলাও আছে। তবু সবশেষে বলব, ভালো লেগেছে, যেমনটা প্রথমে বলেছি।
শাশ্বতী সরকার – দুটো কবিতাই ভালো লাগলো। নরম করে লেখা। কিছুটা লিরিক্যাল মেজাজের। সংহত লেখা। একটু সোজাসাপটা। তবে ভাবনায় চমৎকারিত্ব লক্ষণীয়। দেখায় কবি-দৃষ্টির ছাপ আছে। উপস্থাপনায় আবহমান ধারা। ভাষায় স্বাভাবিক চলন, কিন্তু পুরোনোপন্থী নয়। দুটো দেখার তথা পরিবেশিত দৃশ্যতার কথা তুলে আনি। ক) ‘যেন বক দেখতে বেরিয়েছে জলের কিনারা’, খ) ‘পাখি তার বাসাটা গুছানো’। দুটো দেখাই প্রত্যক্ষতা থেকে, কল্পনাশ্রিত নয়। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে এমন কিছু আছে, যাতে দুটো দৃশ্যতা দিয়েই পাঠককে কিছুটা ভাববার অবসর তৈরি করা গেছে। এই ভাবনাবসর নির্মাণ, কবির কাজ।
বিশ্বরূপ বিশ্বাস – কী যে বলি বিশ্বরূপের কবিতা নিয়ে! পড়ে তো ফেললাম। বলতেই হবে এমন কোনও কথা নেই। আমার কথায় খুব একটা আসবে-যাবেও না। তবুও… । প্রথম টানাগদ্যে লেখা দীর্ঘ কবিতাটা টানাই পড়ে গেলাম। একবারে হলো না। ২য় বার দাবি করল। অতএব গমন। বহুৎ রাগ, দ্রোহ বললে বোধহয় মানানসই হয়। বহুভাবে ফালাফালা করে দেখা নিজের পরিমণ্ডলের প্রেক্ষিতে নিজস্ব অবস্থানকে। অভিঘাতে একইসঙ্গে সংক্ষু্ব্ধ-নম্র, দেখা-দর্শন, ভাবনা-ভাবনার গ্রাফ, জন্ম বনাম জীবনসংগ্রাম, ন্যাকাবোকা বনাম চাবুক, প্রেম ও ছলনা সব চাবুক মারতে থাকে মনে। একটা প্রতিকবিতা জন্ম নেয়। চাবুকের দুটো গুণ। একটা সপাং (ধ্বনি), আরেকটা দাগ রেখে যাওয়া। ভালো-মন্দের কেন বিচার করতে যাবো, এই কবিতার! সে চলুক নিজস্ব গতিতে। ২য় কবিতাতেও ভাবনা অনুরণনে একাত্মতা আছে। পরিবেশনের ঢং কিছুটা আলাদা। কবিতা সেই পাশের বাড়ির রাগী মেয়েটা, সাজতে ভুলে যায়, টন্ট করলে টিট করে, যখনতখন গলা ছেড়ে পল্লীগীতি ধরে, চুলে মার্জিত তেল-সাবান নেই, হাঁটে গট্‌গট্‌ করে, কখনও হরিণদৌড়, কাজল পরে না, টিপ পরে না, স্নো-পাউডার নৈব নৈব চঃ, কিন্তু একঝলক দেখলেই বোঝা যায় সে প্রচল সুন্দরীর চেয়ে অন্যরকম সুন্দর, আরেকটু খেয়াল করে দেখলে বোঝা যায়, সে তথাকথিত ভদ্রতায় বিশ্বাসী নয়, কিন্তু বিদূষী, মনোযোগসহ দেখতে থাকলে বোঝা যায় একটা দীপ্তি শোভা পাচ্ছে তাকে ঘিরে।
কৌস্তভ গঙ্গোপাধ্যায় – ভালো লাগলো কবিতাদুটো, বেশ ভালো। প্রচুর বাহ্যিক অনুষঙ্গ তুলে এনে কোলাজ করে জীবনগাথা। একটা যাদুভাব সমৃদ্ধ, যে দণ্ডটি একের পর এক খেলাকে মঞ্চে নিয়ে আসে, থামতে দিতে চায় না। এ-ও কবিতারই অন্যরকম এক স্বাদ, যা প্রচল থেকে আলাদা, অপর। শব্দ ও ভাষার খেলাটাও একটা প্রক্রিয়ায় থাকার ফসল, হয়তো এখনও তার পূর্ণবিকাশ সম্ভব হয়ে ওঠেনি, কিন্তু যা দূরভ্রমণের বীজ হতে পারে। একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, বহু ব্যবহৃত লঘুর পাশেই ভারী, কিছুটা অচেনা বা আভিধানিক শব্দ মানানসই বসিয়ে দেবার সাহস ও ক্ষমতা, অন্য ভাষার চালু শব্দের প্রয়োগ, আর বাংলভাষার পদবিন্যাসে হালকাচালে কিছু বদল। সব মিলিয়ে চ্যালেঞ্জিং। এসব তার কবিতাচলনে ভিন্নতা এনেছে। ভাবনা কবিতা। স্থবির ভাবনা দিয়ে তার চলে না। আর চলমান ভাবনাকে প্রতিফলিত প্রতিসৃত করতে ভাষাতে (মাধ্যম) যে বদলের প্রয়োজন, এ দুটো জিনিস মাথায় রেখে একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে সে। আমরা তাকিয়ে থাকতে পারি।
বিপ্লব চক্রবর্তী – যতদূর মনে পড়ে যে বিপ্লবের কবিতা আমি আগে কিছুটা হলেও পড়েছি, এখানে সেই বিপ্লব যেন অনুপস্থিত। কেন যে! সোজাসাপটাভাবে নিশ্চয়ই কবিতা করা যায়। এবং করাটা খুব কঠিন। কিন্তু যদি শুধুই কিছু বিবৃতির মাধ্যমে একটা গন্তব্যে পৌঁছুতে হবে এই ধারণার বশবর্তী হয়ে কবিতাকরণ জারি রাখা হয়, তবে কবিতার মোহিনী আড়াল ও অনির্দিষ্টতা ক্ষুন্ন হয়ে কেমন ওপেন হয়ে পড়ে। কবির নির্দিষ্ট ধারণাটাই প্রাধান্য পেয়ে কবিতার স্বাভাবিক হৃদয়বেত্তা ও চলন নষ্ট করে হয়তো শেষতম বলার কথাটাকে প্রতিষ্ঠা দিতে উন্মুখ হয়ে পড়ে। অবশ্য এসব আমার কবিতাভাবনায়। বিপ্লব বা অন্য অনেকেই তা মানতে রাজি নাও হতে পারেন। আরেকটা কথা, উত্তম পুরুষে কবিতাকথন হামেশার ঘটনা (কমবেশি আমি নিজেও লিখি)। কিন্তু সেখানে নিজের আমি-টাকে অনেকের আমি করে তুলতে না-পারলে (কিছুটা হলেও নৈর্ব্যক্তিক হওয়া) পাঠকের টান কমে যেতে বাধ্য। এ-ও কঠিন কাজ। এই দুই কঠিন নিয়ে বিপ্লবের চলা। প্রত্যাশা, বিপ্লব চ্যালেঞ্জটাকে দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করবে।
শিমন রায়হান – বাঃ! বেশ লাগলো কবিতাদুটো। মিতকথনে ভাবনাকে প্রাধান্যদান। ১ম কবিতায় চারটে লাইনের মধ্যে প্রচুর স্পেস। সজীব ও জড়কে ভাবনায় এক আসন দান। আর দুইয়ের সাজুয্যে এক অশরীরী অনশ্বরের ভাবনা। ‘প্রভু’ শব্দটি শুধুমাত্র একটা মাত্রাকেই রেফার করে বলে আমার মনে হয় না। যে যেমনটা ভাবতে পারে, সেভাবেই তার প্রতিষ্ঠা। যদিও ব্যক্তি আমি মনে করি, এই শব্দটি অন্য কোনও শব্দে প্রকাশ পেলে বহুব্যবহারের কুফল এড়ানো যেত। কেননা এই শব্দটির সংস্কারগত একটা অমোঘ ব্যাপার-স্যাপার আছে। চান্স থাকে, অনেকেই একে একবগ্‌গা করে ফেলতে পারেন, যা আদৌ কবির চিন্তা-চেতনায় ছিল না, ছিল বহুমাত্রিক হয়ে। ২য় কবিতাটা এক কথায় অসাধারণ। ‘যে কোন নাম আজ এমিলিয়া শোনার’। এর মধ্যেই কবিতার ঘরবাড়ি, তার মধ্যে কবির বাস।
অভিষেক মুখোপাধ্যায় – খুব ভালো লাগলো। বড়ো পরিণত কণ্ঠস্বর। ভাবনায় নিজস্বতা লক্ষ করার মতো। আর ভাষাতেও একটা অবাধ চলমানতা, যা বেশ কিছু তৎসম শব্দের মেলবন্ধনে গড়ে উঠেছে। কবিতাকরণে এটাও একটা দিক। এর আগে কেউ কেউ করে দেখিয়েছেন। ‘ফসল উৎসার নয়, আরও কিছুদিন একা, চণ্ডাভিষেক হয়ে/ বকরক্তে ধুয়ে দেব শূন্যঘর, অশ্বমেধ’। আহা! ২য় কবিতায় নস্টালজিয়ায় পেয়ে বসার পূর্ব ধারণাটিকে নস্যাৎ করতে পেরেছে, অভিষেক। এসবই কবির কাজ। এই সময়ের কাজ। ভাবনার রূপান্তরণে প্রায় সংযোগহীন উপকরণ ও অনুষঙ্গ দিয়ে কবিতা করাও একটা বিশেষ ভঙ্গি, সেটাকে দারুণভাবে প্রয়োগ করেছে, অভিষেক। ‘খাজুরাহো শৌচালয়ে ক্লাস নাইন—অসভ্য চিহ্ন এঁকে গেছে/ আর ওকে, খুঁজে পায়নি সুশীলবাবু স্যার।’ সুশীলবাবুরা কোনওদিনও এদের পায় না, পাবে না, কৈশোর বহমান থেকে যাবে, সাথেসাথে কবিতাটাও হয়ে যায় এন্ডলেস। সাবাস!

বাকি রইল – ৫৪ – ১৯ – ১৮ = ১৭। এদের আমি বেশ কিছুটা পড়েছি। বেশ কয়েকজনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ও কবিতা নিয়ে কথাবার্তাও হয়েছে, হয়। এদেরকেও তুলে আনার চেষ্টা করি কিছু কথায়।
রাজর্ষি মজুমদার – ১ম কবিতাটার চেয়ে ২য় কবিতাটা টানলো বেশি, স্পর্শও করল। কেন যে! দুবার করে পড়তে হয়। দুটো কবিতাই প্রায় একই ধারার এবং ভাবনাবীজের তেমন ফারাক নেই। তবু কেন? হয় হয়, অনেক সময় কবিতায় পাঠক-সত্তার একটা নিজস্ব ব্যাখ্যাতীত ভালোলাগার জায়গা তৈরি হয়। দুটো কবিতাই মনোলগে। নিজের মনে বা সঙ্গোপনে। কিন্তু কথা তো কবিতা নয়। কবিতাটা থাকে কথার আড়ালে। এই সমস্ত বোধ নির্মাণে সহায়তা করেছে। ভাষার চমৎকারিত্বের দিকে না-ছুটেও তাকে প্রচল থেকে আলাদা করা যায়। এ-দুটো কবিতা অনেকটাই তা দেখিয়েছে। সব মিলিয়ে একটা আনন্দলাভ আমার। মননে আনন্দ ভরে দেওয়া সহজ কথা নয়। তবু একটা বিষয়ে রাজর্ষিকে দুটো কথা না-বলে পারছি না। ক্রিয়াপদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরেকটু সচেতন হওয়া দরকার। বিশেষত পর পর ঘটমান-বর্তমান ক্রিয়াপদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে।
হাসান রোবায়েত – রোবায়েতের কবিতা অনেকদিন থেকে পড়ি। একসময় কথাবার্তাও হয়েছে অনেক। পড়ি, ভালো লাগে। আর দশজনের থেকে ওকে আলাদা মনে হয়। রোবায়েত মাঝেমধ্যে নিজেকে নানাভাবে বদলায়, তাও লক্ষ করি। সে তো কবির মর্জি, আর ভ্রমণপথের আঁকাবাঁকা। এখানে যে দুটো কবিতা পড়লাম, তা নিয়ে বলি। দুটো কবিতাই ভালো লেগেছে। প্রথমেই বলব মিততার কথা। কত কম এক্সপ্রেশনে কবিতা করা যায়, এ-দুটো তার উদাহরণ। দ্বিতীয়ত বলব, বিমূর্ততার গঠন-বিগঠনের ক্ষমতা ও প্রাচুর্যের কথা। তৃতীয়ত, জড়-এ প্রাণপ্রদান। চতুর্থত, মাঝেমধ্যে মোচড় এনে কবিতাকে যেন ছুঁয়ে ফেলা। এই যেমন— ‘দুই একটা রোদ লাগছে পাতায়’ বা, ‘চটির উধাও থেকে হাতপাখা’, বা, ‘শিশুদের মন ভর্তি রোদ উঠে গেছে আফিম ফুলের ক্ষেতে’। শব্দের চমক-ঝমক ব্যতিরেকে ভাবনাকে সংহত অবস্থান থেকে ছড়িয়ে পড়তে দেওয়া। ব্রেভো বলতেই হয়। শেষ উদ্ধৃতির কল্পিত দৃশ্যময়তা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, যখন বলা হয় ‘মন ভর্তি রোদ’। আহা!
তন্ময় হালদার – তন্ময়ের কবিতা পড়ি বেশকিছু দিন। সামনে বসে শুনি, কথা বলি। সেসব দূরে রেখে এ-দুটো নিয়ে বলি। তার দেখা ও প্রাত্যহিক চলনের মধ্যে কবিতা লিপ্ত হয়ে থাকে। একটা গভীর ও কৌণিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে ওর। একটা আপাত সরল কথনে নির্মিত কবিতা আপনাকে ভাবাবেই। সেই ভাবনা প্রসারিত হয়ে একটা দর্শনের দিকে ঠেলে দিতে পারে আপনাকে, কিন্তু কবিতায় সেই দর্শনটা অনুপস্থিত। ওপরচালাকি ভণ্ডামি এসব নেই ওর কবিতায়। আমি মনে করি এটা একটা কঠিন কাজ। ও করে সহজেই, আর বলে এতসব সে জানে না, বড্ডো মুখচোরা। একটা টিকটিকির লেজ দরজায় চাপা পড়ে প্রায়শই, আমরা দেখিও। কিন্তু তন্ময় যেন বিশেষভাবে এই প্রথম আমাদের দেখিয়ে দেয়। লা-জবাব। ‘আমি আরেকটু ভেতরে থাকি’, একটা সাদামাটা স্টেটমেন্ট। কিন্তু এর আগে যখন সে বলে, ‘এটা আমার ঘর’, তখন এই দুটো স্টেটমেন্টের জোড়ায় ওই যে ‘আরেকটু ভেতরে’ দিয়ে কবিতা ঝমঝম করে ওঠে। ভেতরের মধ্যে আরেকটু ভেতর আমাদের হৃদয়তন্ত্রীতে বেজে যায়। ঘরের মধ্যে অস্তিত্বের অবস্থান আরেকটু ভেতরে, যা একটা অভিজ্ঞান, যাতে ভর করে আপনি একটা দর্শনের মুখোমুখি হয়ে যেতেও পারেন। ভেতরের ওলটপালটের মধ্যে ছবি রাখা, টুকিটাকি নিজস্ব কৃত্য, সুখ-অসুখ, সঙ্গ-সঙ্গী, আর শেষে গিয়ে, ‘কথা ভুলে গেছি’। কবিতায় তখন নৈঃশব্দ ভর করে। পাঠক নিজেকেই আবিষ্কার করে যেন। কিন্তু ও খুব কম লেখে, লেখে না বলাটাই ভালো, আর প্রকাশের ইচ্ছাও খুব কম। কেন যে!
আশুতোষ সরকার – কিছুদিন থেকে ওর কবিতা পড়ি। সময়বিচারে সংখ্যায় যা খুব কম একটা না। আন্তর্জালের লভ্যতায় কবিতা পাঠায়, পড়ি, মতামত জানাই, মিথস্ক্রিয়াও হয়। খোঁজ ও আগ্রহও বেশ। ভালো লাগে। ওর মধ্যে গতানুগতিকতা থেকে বেরিয়ে এসে কবিতা করার প্রবণতা লক্ষ করি। এখানেও তার ছাপ-ছোপ বর্তমান। একটা গ্রামীন পরিমণ্ডল ওর কবিতার উপকরণ, আর ভাবনাগুলো সেই পরিমণ্ডলের প্রভাবে উৎসারিত। অনুষঙ্গ তুলে আনায় ব্যতিক্রমের চেয়ে সাধারণের দিকে তার ঝোঁক, আর সেভাবেই কবিতাকরণ। ফলে নাগরিক যন্ত্রণা নয় বরং একটা গ্রামীন প্রশান্তি ছড়িয়ে থাকে ওর কবিতায়। দৃশ্যতার পাশাপাশি বিমূর্ততা সৃষ্টির মাধ্যমে তার কবিতাচলন। ভালো লাগে। তবু কয়েকটা কথা বলা বেঠিক হবে না। যেমন— ‘একটা’ শব্দের ব্যবহারে নির্দিষ্ট করে দেওয়া নিয়ে ভাবা দরকার। ‘ক্রমশ’ শব্দের ব্যবহারে কবিতার ধারাবাহিকতা রাখা কতটা জরুরি, ভাবা দরকার। এই কবিতাকর্মীর দিকে শুধু আমার কেন, অনেকেরই নজর থাকবে।
শঙ্খদীপ কর – কর-এ কর-এ মাসতুতো ভাই নয় কিন্তু। অবশ্য হলেও কিচ্ছু যেতো আসত না। বেশ কিছুদিন ধরে পড়ে আসছি ওর কবিতা। কবিতা নিয়ে অনেক কথাও হয়। এখানকার দুটো কবিতাই আমার আগে পড়া ও শোনা। তার মধ্যে ‘শ্মশানবন্ধু’ বেশ কয়েকবার। তখনও নিশ্চয়ই কিছু বলেছিলাম, আবারও না-হয় বলি— দুটো কবিতাই গেরস্থালি থেকে উঠে আসা, দুটোতেই সম্পর্কের একটা ভাবনা বিদ্যমান। নাম দুটোও কিছু একটা আইডেন্টিফাই করতে চায়। সুতরাং উপকরণ, অনুষঙ্গ, চিন্তনের প্রাথমিক স্তর খুব ঘরোয়া। ভাষাতেও খুব একটা ভিন্নতা নেই। তবু এই কবিতাকে আমি গড্ডালিকার বাইরেই রাখব। শঙ্খ তার কবিতায় খুব ছোটো ছোটো কিছু কাজ রেখে দেয়, যা একবার পাঠে অনেক সময়ই পাঠকের নজর এড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু একটু নজর করে পড়লে উন্মোচিত হতে পারে কবিতায় তার বিমূর্ততা গঠনের নিজস্ব ভঙ্গিটা, তখন কবিতাময় হয়ে উঠতে অসুবিধা হয় না। যেমন, ‘এক বধির/ নূপুরের শব্দ ফেলে যায়’। এখানে নূপুর বধির। সোজা কথায় নূপুর শুনতে পায় না, শোনায়। তাই শব্দ ফেলে যেতে পারে। আবার বধির ও নূপুর কে এক পঙ্‌ক্তিতে না-রেখে অর্থাৎ আলাদা উচ্চারণে রেখে কিছুটা হেঁয়ালি তৈরি করা হয়, এবং বধির ও নূপুরের ওপর সমান জোর পড়ে যায়। বধির শুধুমাত্র বিশেষণের কাজ করে না। আবার এও হতে পারে, কোনও এক বধির, শুনতে পায় না বটে কিন্তু নূপুরের শব্দ ফেলে ফেলে যেতে পারে। লাভলি। আবার ‘অনন্ত শূন্যতা দুটো রাস্তা বিছিয়ে/ মরুভূমি করেছে’। ঘরোয়া থেকে বেরিয়ে আসা। এখানে শূন্যতা বিছানো রাস্তা নয় কিন্তু, শূন্যতাই রাস্তা বিছিয়ে রেখেছে, যা নিয়ে যাচ্ছে মরুভূমিতে। এই যে দুইয়ের সূক্ষ্ম পার্থক্য, উন্মোচিত হলে পাঠককে উল্লসিত করে তোলে। আবার এখানে ‘মরুভূমি’ কোনও প্রতীক নয়। মরুভূমি মালভূ্মিও হতে পারত বা অন্য কোনও কিছু। এখানেই তৈরি করা হচ্ছে সম্ভাবনার বহুমুখ। সাবাস। নানাকাজে ব্যস্ত শঙ্খ যদি কবিতার মধ্যে আরেকটু ধ্যান দিত!
হিন্দোল গঙ্গোপধ্যায় – হিন্দোলের কবিতা পড়ি বেশ কিছুদিন ধরে। এখানে প্রথমের সিরিজ কবিতাগুলো আমার মন কেড়েছে। ওর বৈশিষ্ট্য হলো, কবিতাকে শুধুই কবিতায় ভরে রাখার প্রয়াস। গল্প, নাটকীয়তা, কথন, বাণী, বর্ণনা এসব কিছুই থাকে না। আগাগোড়া একটা কবিতারেশ বজায় রাখতে পারে কবিতায়, যা পাঠকমনে সঞ্চারশীল হতে পারে। কবিতায় ভাবনাকে গড়াতে দেয় ও। ড্রাইভারের সিটে বসে খুব যে একটা স্টিয়ারিং ঘোরায়, তা কিন্তু নয়। একটা পরিমিত চলতে দেওয়া, এবং কিছু জায়গায় নির্মাণগত নিয়ন্ত্রণটা হাতে রাখে। এটা একধরনের নিজস্ব চলন, ভালো লাগে। ধরা যাক, ‘হেঁটে যেতে চিঠির আর ঠিকানা লাগে না’। এই যে অন্তিম বাক্য, এতেও কিন্তু একটা কন্টিনিউইটি আছে, অনির্দেশ ও অনির্দিষ্টতা নিয়ে। আর কবিতায় সম্ভাবনার বীজ বুনে রাখে ও। ‘অভিধান লেখা হোক সম্পর্ক শব্দটা নিয়ে’। আপাত সামান্য কথাটার মধ্যে সম্ভাবনার বীজটা লক্ষ করি। যদি সত্যিই লেখা হয় অভিধানটা, তবে ‘সম্পর্ক’ শব্দটা নিয়ে যে কত সম্ভাবনার কথা ভাবা যেতে পারে, তা নিয়ে বিস্মিত হতে হয়। ভালোও লাগে। ২য় কবিতাটাও ভালো লেগেছে। ‘নতুন ধানের দুধে ওই তার ডাকনাম লেগে রইল’। দারুণ।
রাজেশ চট্টোপাধ্যায় – রাজেশের কাছেও আমার কবিতা শোনা মতামত জানানো এবং ওকে পাঠ বেশ কয়েক বছরের। এখানে যে কবিতাদুটো পড়লাম তা শিরোনামহীন ১, ২। দুটোরই শেষ পঙ্‌ক্তি হচ্ছে—‘যত আমি ভেঙে যায়, তত তুমি গড়ে ওঠে’। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে বাক্যগঠনে ভুল আছে। তা কিন্তু নয়। ‘আমি’ অর্থে আমার সত্তা আর ‘তুমি’ অর্থে তোমার সত্তা। বোঝা যাচ্ছে দুটো সত্তার পারস্পরিক সম্পর্ক। একটা ভেঙে আরেকটার গড়ে ওঠা। এবং ইনভার্সলি ভ্যারি করছে। শেষে প্রতীয়মান হয়, একটাই সত্তা ‘আমি’ এবং ‘তুমি’ নামে। জমে যায় কবিতার খেলা। প্রেমের কথা উঠে আসে। প্রেম এক বন্ধনে বেঁধে দেয় দুটি সত্তাকে। ফলে কবিতাদুটো দাঁড়িয়ে আছে এই দুই সর্বনামের সত্তা ও সম্পর্কের পারস্পরিক ভাঙাগড়ার সম্পৃক্তিতে। কিছুটা হলেও ভিন্নতা আছে সাধারণ থেকে। ভালো লাগে এইরকমের উপস্থাপনা। রাজেশকে বলব, বানান সম্পর্কে আরেকটু সচেতন হতে। (নুপুর, পুরুষালী)। চর্চায় থাকুক সে, উদ্ভাবন করুক আরও নতুন নতুন অঞ্চল। ওর কাছে আমার ব্যক্তিপ্রত্যাশা আরও অনেক।
রঙ্গন রায় – রঙ্গনের কবিতা আমি বছর তিনেক ধরে শুনি ও পড়ি। ভালোই লাগে। কিন্তু এখানে যে-দুটো কবিতা দিয়েছে সে, তা আমাকে সেভাবে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। ১ম কবিতায় ও সহজসরলভাবে মজা করে কবিতাটা করতে চেয়েছিল। কিন্তু জমেনি। মজাটা করার জন্য অনেক খেলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু মজাটা অন্তত আমার মনে সেঁধোতে পারেনি। একজন মানুষকে অন্য মানুষের বহুত্ব প্রদান, যেন গিরগিটি বানানো এবং মানুষই একজন মানুষকে মানুষ থাকতে দিচ্ছে না অনেকটা সহজ সমীকরণের মতো লেগেছে। ২য় কবিতাটা অপেক্ষাকৃত অন্যরকম। চলনটা অনেকটা এক। কয়েকটা জায়গায় কবিতার আবেশ ছড়িয়ে পড়তে না পড়তেই, তা এলিয়ে পড়েছে। পুরুষকার ও প্রেমিকা। প্রেমিকার মধ্যে মায়ের ছায়া। ভালোবাসার কথা চিৎকার করে বলা হয় না। ঠিকই আছে। কিন্তু এসবের রসায়নে কবিতাটা যে মাত্রা পাওয়ার জায়গায় যেতে পারত, তা যায়নি বলেই আমার মনে হয়েছে। হতে পারে রঙ্গন কোনও নতুন নিরীক্ষায় আছে, এবং এসব কবিতা সেই নিরীক্ষার প্রথম দিকের। এর চেয়ে অনেক ভালো কবিতা আমি তার কাছ থেকে আগে পেয়েছি।
দেবাদৃতা বসু – ‘টিংকার বেল-১০/ ১, ২’ –এই সিরিজের পরে আর হয়তো বেশি কবিতা লেখেনি দেবাদৃতা। ফিল্মে প্রবেশ ঘটেছে ওর। দুটো কবিতার বই রেখে গেছে আমাদের জন্য। এ শিল্পী-মানুষের নিজস্ব মর্জি। যে খুশি চলে যেতে পারে যে কোনও মাধ্যমে। সর্বত্রই কাজ করার পরিধি বিস্তৃত। যাক সে কথা। ১ম কবিতায় ৬টি পঙ্‌ক্তি, ২ পঙ্‌ক্তিতে স্তবক, ২ পঙ্‌ক্তি মিলে একটি করে বাক্য। অর্থাৎ গঠনগত দিকে ৩টি বাক্যে একটি কবিতা। বাক্যত্রয় পরস্পর সম্পর্কশূন্য, ধরতাই ছাড়া। ট্রেন, দস্তানা, সেলাইমেশিন। কী করতে চায় ও? পুরোনো পন্থার বিন্যাসটা ভেঙে দিতে চায়। একটা বিশৃঙ্খলা আনতে চায়। আনুক, অসুবিধা নেই। ভাঙলো, গড়েছেও তো। নির্মাণে এলে বলতে হয়, প্রথম বাক্যটি নিজেই একটা অণুকবিতা। ২য়, ৩য়-ও তাই। এইরকম অণুকবিতার মালায় একটি কবিতা। সাধারণ সূত্র কিছু আছে? থাকতেই হবে, তার কোনও মানে নেই। সাধারণসূত্র কিছু না-থাকলে একটা কবিতা-কোলাজ বললে তো টেকসট্‌টা মার খেয়ে যাবে না। কিন্তু আমার ভাবনায় এখানে সূক্ষ্ম সাধারণসূত্র একটা থাকলেও থাকতে পারে। ট্রেন-লাইনের পাশে ডাউনট্রোডেনদের বস্তির যে কোনও একটা সংসার আর তার সংবেদন। (ভুল হতে পারে। অন্যকিছু হতে পারে। আরেকজন আরেকভাবে দেখতে পারে। আমি একটা সম্ভাবনার কথা বললাম মাত্র।) ২য় কবিতাটা আমি দেবাদৃতার পক্ষে দীর্ঘ কবিতা বলব। ভালো লেগেছে বেশ। এর নির্মাণপ্রণালীর মধ্যে বেশ একটা টান রাখা আছে। আলগা হতে দেয়নি। পরের সিনেমাটা ডেকে নিয়ে দেখাস। আর পেছনে তাকাস, মাঝেমধ্যে।
রাহেবুল – রাহেবুলের সঙ্গে পরিচয় বেশ কয়েক বছরের। ওর ‘ইবলিশ’ পত্রিকায় লিখেছিও। ওর ‘মদীয় ফ্যান্টাসি’ সম্প্রতি পড়লাম। ভালো লেগেছে, জানিয়েছিও ওকে। রাহেবুল কবিতানির্মাণে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায় এবং পছন্দও করে। এটা তারুণ্যের ধর্ম। আমি অন্তত অভিনন্দন জানাই। এখানে যে দুটো কবিতা, সেখানে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এসেছে মূলত দুটো চিন্তন। এক, বিমূর্ততার নির্মাণ-অবিনির্মাণ, আর দুই, ভাষাপ্রয়োগে ভাষাবিন্যাসের বদল ঘটানো। ভাবনাতেও এক ধরনের চমৎকারিত্ব আছে, যেখানে ব্যক্ততার চেয়ে অব্যক্ততাকে পরিপাটি করে সাজানো আছে। ‘দিয়ে বুলেটে/ বা বিরেতে ফটো শুট’,– এ ধরনের শব্দ বিন্যাসে বাক্যগঠন প্রচলভাঙা। ২য় কবিতায় কিছু উপভাষার শব্দের প্রয়োগ লক্ষ করি (ক’খান, হয়নিকো, মইধ্যে, দিশি), যা মিশ খাওয়ানো হয়েছে সাধারণ চলিত ভাষার সঙ্গে, যেখানে স্বচ্ছন্দে বসানো হয়েছে কয়েকটা তৎসম শব্দ। সব মিলিয়ে রাহেবুল এক ভিন্ন কবিতাভাষার সন্ধানী। আমার বিশ্বাস অচিরেই সে এক ভাষাস্বর আত্মস্থ করবে।
দীপ্ত প্রসাদ সিংহ – দীপ্ত যেদিন প্রথম আমার বহরমপুরের বাড়িতে কয়েকজনের সঙ্গে আসে এবং কবিতা শোনায়, তখন ও টুয়েলভ ক্লাসও পাস করেনি, বয়স ১৫ হবে। সেদিন তার কবিতা শুনে আহামরি করে উঠিনি ঠিকই, কিন্তু বিস্মিত হয়েছিলাম ওর রসদ মজুতে। পরে খুব সামান্য দিনের মধ্যেই ও অনেকটা পরিণত হয়ে ওঠে। এবার বিস্ময়ের পালা শেষে আহা করার ব্যাপার-স্যাপার। আমার হিসেবে অসাধারণ সব কবিতা লিখতে শুরু করে ও। একটা দু-ফর্মার বইও প্রকাশ পায়। এখানে যে দুটো কবিতা প্রকাশ পেয়েছে, তাতে আমি প্রীত, আহ্লাদিত। খুবই মিততার সঙ্গে ও নিজস্ব ভাবনাটাকে প্রসারিত করে পাঠকের কাছে শেয়ার করতে পারে। কোনও মূল বিষয়ভাবনার ধার না-ধেরে ও মৌহূর্তিক কিছু ভাবনাকে ছড়িয়ে দিতে জানে। উপকরণ, অনুষঙ্গ ছোট্ট পরিসরের, কিন্তু তার সঙ্গে কল্পনা মিশিয়ে কবিতায় একটা নয়া মাত্রা সৃষ্টিতে ও খুবই বুদ্ধিদীপ্ত। খুব সহজেই কবিতা করে ফেলা যেন ওর স্বভাবগত। যদিও ওকে আমি স্বভাবকবি বলব না। দীপ্ত নির্মাণই করে, কিন্তু খুব কসরতে নয়। মুশকিল একটাই, মাঝেমধ্যে ও কবিতাকে ছুটি দিয়ে দেয়, অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। অল্প বয়স, সাধনার মর্মে ঢুকতে চায় বলে মনে হয় না। তবে এ-করেও যদি এমনসব কবিতা লেখা যায়, তাহলে সাধুবাদ জানাতেই হয়।
শতানীক রায় – শতানীককে বিচ্ছিন্নভাবে পত্র-পত্রিকায় পড়ছি দু-তিন বছর। এখানে দুটো কবিতা দুই ঢং-এ লেখা। দুটো কবিতাই ভালো লাগলো দু-রকমভাবে। কী রকম! ‘প্রতীক’ কবিতায় প্রথম বাক্যটা একটা স্টেটমেন্ট, যেখানে কবিতা শুরুই হয়নি। ২য় বাক্য একটি আক্ষেপ, আমার মনে হয়নি কবিতার শুরু এখান থেকেও। ৩য় বাক্য থেকে একটা ঝাঁকুনিসহ কবিতাটার শুরু। ঝাঁকুনিটা আসে ‘ধুর শব্দ ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে’ থেকে। এরপরই চলনটা বদলে যায়। ভাবনাগুলো ভর করতে থাকে। একটা ভাবনাস্রোত বইতেও থাকে। সম্ভাবনার জায়গাগুলো সূচিত হয়। যেমন, ‘ওরকম হলে পৃথিবীর বয়স বাড়ে না’। বাক্যের শেষাংশ স্টেটমেন্ট, কিন্তু তা প্রথমাংশের শব্দ দুটিতে সম্ভাবনা হয়ে যায়। যেমন, ‘রোগ পুড়ে যাওয়া একটি মাটির নৌকার প্রতীক’। এখানে রোগ পুড়ে যাওয়া বিমূর্ততা, আর মাটির নৌকা কল্পনা। দুয়ে মিলে সম্ভাবনাটি গড়ে তোলে। আবার, ‘শরীরের ওপর সাজাচ্ছি কাঁকড়া, ফল কাটা মাথা অথবা নির্জীব মাংস’। আহা! এখানে শুধু দৃশ্যমানতাকে প্রাধান্য দিলে একটা ভয়ের সম্মুখীন হতে হয়, শরীরী একটা কষ্ট একটা যন্ত্রণা, কিন্তু এর সঙ্গেও পরবর্তী শব্দসমূহে বিমূর্ততাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ফলে, স্টেটমেন্ট, স্টেটমেন্ট ছাড়িয়ে সম্ভাবনা, সম্ভাবনার সঙ্গে কল্পনা জুড়ে দেওয়া, দৃশ্যমানতার মধ্যে বিমূর্ততাকে অবলম্বণ করা ইত্যাদির মাধ্যমে গোটাটা আমার কাছে কবিতা হয়ে ওঠে, মর্যাদা পায়। বলতে হয় ভালো লাগলো। ‘যক্ষ’ কবিতাটা কিছুটা সাদামাটা, কিন্তু ভালো লেগেছে, হয়তো সাদামাটাকেই কবিতা করে তোলার গুণে। বিস্ময়, রহস্য সেভাবে কবিতাটাকে জড়িয়ে নেই, শুধু ভাবনাকথনে কবিতাটা নির্মিত। ভালো লাগলেও, হয়তো তাই উচ্ছাস প্রকাশ করতে পারিনি। একটা কথা, ১ম কবিতায় ভাষাবয়নের ক্ষেত্রে আরও সংযমী হলে কবিতাটা আরও ঝরঝরে হতো। এখানে আর এ-বিষয়ে কথা বাড়াচ্ছি না, প্রয়োজনে শতানীকের সঙ্গে কথা বলে নেব।
রথীন বণিক — রথীনের কবিতা পড়ি ও শুনি বছর দুয়েক হবে। এখানে যে দুটো কবিতা তা মোটের ওপর ভালো লেগেছে। ১ম কবিতার নাম, যা কবিতাতেও একবার ব্যবহৃত হয়েছে তাতে শব্দের জাগলারি আছে। ধ্বনিগত উচ্চারণে শুনতে যেমন ভালো লাগছে, তেমনি একটা ভাবনাব্যঞ্জনাও প্রকাশ পায়। রথীন কবিতা নিয়ে তার মতো করে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় আছে, বোঝা যায়। মনে করি এটাই তারুণ্যের কাছে প্রত্যাশা। ওর মধ্যে একটা খোঁজ জারি, বুঝতে পারি। যেমন ও ব্যবহার করছে – ‘কত হাই ওঠা কানের কুমারে’। এর অর্থতো হয়ই না, ব্যাখ্যা করাও যায় না। কিন্তু কাউকে কাউকে একটা অনুভবে জারিত করে দিতে পারে। ‘সাইকেলের অর্জিত প্যাডেলে’ – এসব বোঝার নয়, কিন্তু ভাবা যায় শব্দ-বন্ধে গুঁজে দেওয়া ভাবনাটাকে, ভাবনাটা নানাভাবে এগিয়েও নেওয়া যায়। এভাবেই কবিতা করে ও। ভালো লাগে। ২য় কবিতায় একটা চমক আছে। চমকটা বাদ দিলে কবিতাটা ভালো। লম্বা দৌড়, খুব একটা তাড়াহুড়ার কীই বা দরকার! নিজেকে ভাঙাগড়ার প্রচুর সময় সামনে। কবিতায় থাকলে, রথীনের দিকে নিশ্চিত আমার নজর থাকবে, সম্ভবত অনেকেরই।
সজল দাস – সজলের কবিতা অন্তত বছর পাঁচেক ধরে পড়ি, শুনি, কথা বলি। এখানে যে দুটো কবিতা, তা আমার আগেই পড়া ও শোনা। কবিতায় বেশি কথা বলতে ভালোবাসে না সজল। এটা তার শৈলী। কবিতায় ওর ব্যক্তিভাবনার ভার অত্যন্ত কম। ফলে কবিতাটাও ভারী হয়ে ওঠে না। তুলো উড়িয়ে দেয় ও, যা পাঠকমনে অনেকক্ষণ ভাসতে থাকে। আরেকটা বৈশিষ্ট্য, ওর একই কবিতা বারবার পড়া যায়। হতে পারে অনেকসময় ভিন্নপাঠে অণুভাবনাগুলো ভিন্ন মর্জিতে প্রকাশ পেল। এতে বোঝা যায় তার কবিতার বহুরূপতার কথা এবং কবিতার পুর্নজন্মের কথা। আরেকটা বৈশিষ্ট্য কোথা থেকে কোথায় নিয়ে চলে যাওয়া। থিতু হতে দেয় না। যেমন ১ম কবিতায় প্রথম দুই পঙক্তিতে ঝাউবন সম্বলিত এক সমুদ্রতীরের দৃশ্যতা ও প্রথম পুরুষের ক্ষমা প্রার্থনা (কারণ অজানা)। সেখান থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে ও চলে আসে কাঠে ও গতজন্মের আলনায়। একটা নির্মাণকে ভেঙে দেয় আরেকটা বিনির্মাণ। পাঠক সন্দিগ্ধ হতে পারে এই ফ্রেম ভাঙায়, পরিণতিহীনতায়। কবিতায় পরিণতিতে পৌঁছোনো কি কোনও শর্ত হতে পারে বা বাধ্যবাধকতা? আমার তা মনে হয় না। এ-ধরনের নির্মাণে, কবিতাটা আর লিনিয়ার থাকে না, হয়ে ওঠে বহুমাত্রিক। সাবাসি জানাতে হয়। ২য় কবিতায় সে একটা কন্টিনিউয়িটি রেখেছে। বেহালার নিজেই বাদক হয়ে ওঠায় অবজেক্টটা সাবজেক্টে রূপান্তরিত। প্রথমপুরুষের কর্তার কোনও একসময় পাখিজন্ম ছিল (কল্পনা)। তার যে গাছে বসে শিস দেওয়া, বাদক হয়ে যাওয়া এ-জন্মে তারই প্রতিশোধ আওতায়। অনুভবে আসে বেহালা তৈরির কাঠ-গাছ এ-জন্মে প্রতিশোধমুখর। তো, এই-ই তার কবিতা, মিত, সংহত, স্বভাবিক ভাষা আর ভাবনানির্ভর সংবেদন। ওর জন্য একটাই বার্তা আমার, যা অন্তত পাঁচবার বলেছি ওকে। খুব সেফ জোনে খেলে ও। ক্রিকেটিয় ভাষায় V এর মধ্যে, (যেমন আগেও বলেছি) পুশ-বল্ক-ড্রাইভ সঙ্গী করে। হয়তো কখনো দেখব, ক্যামেরার ঘোরাফেরা, যা ফলো করবে স্কোয়ার-কাট, লেগ-গ্লান্স, হুক-শট, স্টেপ-আউট করে পপিং-ক্রিজ থেকে বেরিয়ে আসা। আমি অপেক্ষায় রাজি ও জারি।
প্রশান্ত সরকার – প্রশান্তর কবিতা পড়ি বেশ কিছুদিন ধরে। সামনে বসে শুনেছিও। সবই বিচ্ছিন্নভাবে। ওর কোনও কবিতার বই আমি পড়িনি। এখানে যে দুটো কবিতা পড়লাম, তাতে ওর জাত চেনা যায়। দুটো কবিতাই ভালো লেগেছে। ওর কবিতার মধ্যে ও ভরে রেখেছে সামান্য কিছু সময়ের দৃশ্যপট। আর দৃশ্যতা থেকেই তুলে এনেছে কবিতা, যেখানে আবার দৃশ্যতাটাই প্রধান হয়ে ওঠেনি, অনুষঙ্গের কাজ করেছে। এটা একটা গুণ। আবার এই দৃশ্যতাগুলো কাটাকাটা, একটা স্থির কিংবা চলমান ছবি নয়, টুকরো-টাকরা। টুকরো-টাকরা হলেও অসম্বদ্ধ নয়। একটা যোগসূত্র কাজ করে। ফলে একটা দিকনির্দেশও করে। ‘পিকনিক’-এ যেমন, ‘রক্তে পরিমিত লবণ থাকলে,/ হরিণীও স্বাদু হয়ে ওঠে’। এইরকম একটা অভিজ্ঞানে সঞ্জাত হওয়ার কারণে পূর্বকথিত দৃশ্যতাগুলোর অবতারণা। দৃশ্যতার মধ্যেও কবিতাকরণ লক্ষ করা যায়। যেমন, ‘মাস্তুল’ কবিতায়, ‘রুগ্ন ছায়া যেন আলপথ/ তারই মধ্যে নেমে গেল দুপুরের প্রায়’। একটি অসাধারণ অভিব্যক্তি। কবিতাভাষার ক্ষেত্রে প্রশান্ত সচেতন। অনেক তৎসম শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলিত বাংলাকে সে রাখতে জানে। অসহ হয়নি, পীড়িত করেনি, ভালো লাগে।
অয়ন্ত ইমরুল – ফেসবুকে অয়ন্তের প্রচুর কবিতা পড়ি। ইনবক্সে পাঠায়, পড়ি। পাণ্ডুলিপি পাঠায়, পড়ি। বেশিরভাগ ভালো লাগলেও, অনেক সময় ভালো লাগে না। এটা ওর অস্থির মস্তিষ্কতার জন্য, বলে আমার মনে হয়। একটা বিশেষ প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকার ফসল কবিতা। তো সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে নানাবিধতা আসতেই পারে। কিন্তু একইসঙ্গে একই সময়কালে বা ফেজে রকমারি ভাবনাস্রোত কাজ করতে থাকলে, মূল অন্বেষণ ও প্রক্ষেপণ বিঘ্নিত ও বিক্ষিপ্ত হয় বলেই আমার মনে হয়। অয়ন্ত একটু বেশিই আবেগপ্রবণ, তাতে এরকমটা হয় বলে আমার ধারণা, ভুল হলে খুশিই হবো। এখানে যে দুটো কবিতা তা অবশ্য একই ভাবনাস্রোতের ফসল। ভালো লেগেছে। ওর কবিতার মূল প্রেক্ষাপট গ্রামবাংলা ও তার জীবনপ্রণালী। সেখান থেকেই সংগৃহিত তার কবিতার উপকরণ, উপচার, অনুষঙ্গ। তবে এসবের সঙ্গে কল্পনা ও চেতনাকে বহুদূরপথ হাঁটাতে জানে সে। ফলে বিমূর্ততা তার কবিতার প্রাণকেন্দ্রে। ১ম কবিতায় একটা প্রচ্ছন্ন রোমান্টিসিজমের ছোঁয়া পাই, যদিও তা তথাকথিত রোমান্টিক কবিতার মতো নয়। আবার ২য় কবিতায় সে-সব ছোঁয়া অনুপস্থিত। সেখানে আত্মবীক্ষণ, অথচ লিরিক প্রবণতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েনি। ভালো লাগে। অয়ন্ত শব্দ নিয়ে কিছু কাজ করতে চায়। গ্রামীন আনপড় বহু শব্দ আনে কবিতায়, আবার বহু শব্দে পানিং-এর কাজ করে। কখনও কখনও নতুন করে তোলে পুরোনো শব্দকে। সবমিলিয়ে একটা স্বতন্ত্র ভাষাখোঁজ আছে তার কবিতায়। আগামীতে হয়তো একটা স্বতন্ত্র ভাষাস্বর উঠে আসবে তার কবিতায়।
তন্ময় কুমার মণ্ডল – তন্ময়ের কবিতাও আমি পড়ছি, শুনছি, কথা বিনিময় করছি বেশ কয়েক বছর ধরে। লেখে কম। কিন্তু লিখলে অনেক ভাবনার উদ্রেক করতে পারে ও। ওর কবিতার স্বাভাবিক প্রবণতার মধ্যে যাপনচিন্তাই প্রধান। কখনও প্রশ্ন তোলা, আবার কখনও সংবেদন। ১ম কবিতায় মাত্র পাঁচটি পঙ্‌ক্তি, মাত্র কয়েকটা শব্দে একেকটা পঙ্‌ক্তি, কিন্তু এমনভাবে গাঁথা যেন একটা দেখাকে প্রতীয়মান করছে। আর দেখাটা বেশ নৈর্ব্যক্তিক। স্ব যখন শরীর বেয়ে ওপরের দিকে, ভাত-রঙা প্রজাপতি আর ধোঁয়া ধোঁয়া ভালোবাসা তখন নিম্নগামী। একটা কনট্রাস্ট, যা অবধারিত করে তুলেছে প্রশ্নটাকে— ‘নীচে কি আরো ভালো শহর আছে!’ বাঃ বলতে হয়। বস্তুত যেখানে অবস্থান তা যে ততটা ভালো নয়, সেটা স্পষ্ট, তাই ভালোর জন্য যাচ্‌না। ‘অহম-পুরুষ’ সিরিজটা আমি গোটাটাই পড়েছি এবং শুনেছি বেশ কয়েকবার। এটা তার একটা ভালো কাজ বলেই আমি মনে করি। কবিতার খুবই ভালো একটা কাজ। এখানে ৭ নং-টা। তথাগত তথা বুদ্ধ এবং স্বকাল স্বচিন্তন প্রকল্পনা। টানা গদ্যে লেখা। কিন্ত তন্ময় জানে, কোথায় ছাড়তে হয়, আবার কোথায়ই বা ধরতে হয়। একটা চলমান ভাষায় (প্রচলের কাছাকাছি) লেখা তার এই সিরিজ, যেখানে ভাষায় একটা মায়া জড়িয়ে থাকে। কিন্তু চিন্তাভাবনার এমন সুন্দর বিচরণ, যে ভাষাকে সেভাবে প্রচল মনে হয় না। একটা ভিন্নমাত্রা তুলে আনে। এসবই তার মুনশিয়ানা। অসাধারণ লাগে।

তিনটি পর্বে—১৯ + ১৮ +১৭ = ৫৪।
৫৪ জন কবির কবিতা নিয়ে আলাদা করে আমার কথা সংক্ষেপে হলেও বলা গেলো। এবারে এই সময়কালের কবিদের কতগুলো স্বাভাবিক প্রবণতার কথা তুলে ধরে লেখাটা শেষ করব।
ক) প্রথমেই যা উল্লেখের, তা প্রকরণ সম্পর্কিত। অধিকাংশের টানা গদ্যে লেখার প্রবণতা। এখানে শতকরা হারে প্রায় ৭৫ শতাংশ কবিতা টানা গদ্যে লেখা। হতে পারে এরা এতে স্বচ্ছন্দ বেশি। হতে পারে গোলগাল পদ্য লেখায় বিমুখতা। লক্ষণটি খারাপ নয়। তবে টানা গদ্যে লিখতে গেলে কিছু ক্ষমতার প্রয়োজন— যেমন, গদ্যভাষাকে কবিতার ভাষায় রূপান্তরণ, ব্যক্ততা-অব্যক্ততার সীমারেখা নির্ধারণ, ছাড়া-ধরার কৌশল বিষয়ে গভীর মনোনিবেশ, আর শেষ পর্যন্ত অতিকথন ব্যতিরেকে কবিতাকরণ।
খ) অধিকাংশের কবিতাভাবনার মধ্যে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ভাবনাই কবিতার মূলে। ভাবনা-চেতনা কাব্যিকমননে প্রক্ষেপণ করাই কবিতাকরণ। বিষয়-ভিত্তিকতা বা বিষয়-কেন্দ্রিকতা কবিতার কোনও মূল ক্রাইটেরিয়া নয়।
গ) অধিকাংশের কবিতায় এটা প্রতিফলিত কবিতায় গল্প-কাহিনি বলা, নাটকীয়তা রাখা, ভাবগম্ভীর প্রবন্ধ রচনা করা, জ্ঞান বা বাণী বিতরণ কোনও কাজের কথা নয়। অনুভূতিকে পাঠকমনে পারকুলেট করা বা তাতে জারিত করা বা তাতে আবেশিত করাই কবিতার লক্ষ্য হওয়া উচিত।
ঘ) কোথাও পৌঁছে যেতে হবে বলে অধিকাংশরই কোনও তাড়া নেই। ফলে কোনও প্রতিপন্নতা নেই। অনেকাংশে ইনকনক্লুসিভ। অনেকাংশে নেই যুক্তির অপার বাঁধুনি, ফলে নেই একমুখী ধারাবাহিকতা, ফলে লিনিয়ার নয়।
ঙ) ভাবনায় বিচিত্রতা আছে। পরিমণ্ডল থেকে উঠে ভাবনার সঙ্গে প্রকৃত সঙ্গত করেছে কল্পনা ও চেতনা ও তার বিস্তার। ফলে অধিকাংশের কবিতা মূর্ততা ছাড়িয়ে বিমূর্ততার গঠন-বিগঠনের প্রবণতাসমৃদ্ধ।
চ) মিত কথন অনেকাংশেই দেখা গেছে, কবিতার একটা সংহত রূপ এদের কলমে।
ছ) শব্দ, শব্দ-চিন্তা, নয়া শব্দ, ধ্বনি-চিন্তা ইত্যাদির অন্বেষণও আছে কিছু কবির মধ্যে। ভাষাচলনে বাক্যের শব্দবিন্যাসে তারতম্য আনার প্রয়াস দেখা গেছে কিছু কবির মধ্যে।
জ়) কবিতাভাষা গঠনে ও অন্বেষণে অধিকাংশের মধ্যে একটা প্রবণতা লক্ষ করা গেছে, যা ভালো লক্ষণ। বেশ কয়েকজন একটা পরিণত কবিতাভাষার অধিকারী। আবার অধিকাংশই এ বিষয়ে সন্ধানী ও চর্চায়।
সবমিলিয়ে আমি অত্যন্ত আশাবাদী এদের কাছে। আমার মধ্যে একটা হ্লাদ ও গর্বের উদ্ভবও হচ্ছে। কারণটা এখানে উহ্যই থাক। আমি ‘অপরজন’-এর কাছে কৃতজ্ঞ আমাদের এইরকম একটা প্রোজেক্ট উপহার দেওয়ার জন্য। কৃতজ্ঞ দেবাঞ্জন আর ইন্দ্রর কাছে, বারবার আমায় বলে এতসব কবিতাগমনে উদ্বুদ্ধ করায়। আমার যথেষ্ট উপকার করলো ওরা।

**(ব্যক্তিগত ভাবে সংশ্লিষ্ট কোনও কবির কিছু বলার থাকলে সরাসরি আমাকে বলতে পারে। আমার কোনোরকম ভুল হলে আমি শুধরে নিতে পিছ-পা হবো না।)

Facebook Comments

Leave a Reply