বামপন্থীদের গ্রুপ থিয়েটার থাকলেও বামপন্থা কোন দিকে? – সুমিত্র ব্যানার্জী
পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন বামপন্থীরা ক্ষমতায় থাকাকালীন ঐতিহ্যশালী পেশাদার রঙ্গালয় অবলুপ্ত হয়েছে। তাতে বৃহত্তর বাঙালি সমাজের কিছু যায় আসেনি। সরকার পক্ষেরও অনেক বড় বড় সমস্যার সামনে এইসব ছোটখাটো বিষয়ে মনযোগ দেওয়ার অবকাশ হয়েছে বলেও মনে হয়নি। ৮০-৯০’র দশক থেকে একের পর এক রঙ্গালয় বন্ধ হয়েছে, আগুনে পুড়েছে, প্রমোটারি থাবা গ্রাস করেছে কিন্তু সে’সব কাণ্ড বন্ধ করার বা রঙ্গশালাকে নতুনভাবে বাঁচিয়ে তোলার কোন ‘সিরিয়াস’ উদ্যোগ চোখে পড়েনি। অবশ্য এক্ষেত্রে বাম মনোভাবাপন্ন, ক্ষমতাশালী সংস্কৃতি কর্মীরা বা রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ পেশাদার রঙ্গালয়কে যথেষ্ট প্রগতিশীল মনে করেননি বা তাদের কাছে বিকল্প হিসেবে ছিল—বাম আন্দোলনের হাতিয়ার, প্রতিবাদী গ্রুপ থিয়েটার।
প্রতিবাদী ও সংগ্রামী রাজনৈতিক থিয়েটারের যে ঐতিহ্য গ্রুপ থিয়েটারে তৈরি হয়েছিল বামপন্থাকে কেন্দ্র করে, বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পরে তা ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হয়ে যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে গ্রুপ থিয়েটার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেতে শুরু করে এবং দ্রুত হারাতে শুরু করে ক্ষমতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারার মতো কণ্ঠস্বরের জোর। যে সমস্ত প্রতিবাদী নাট্য বামফ্রন্ট জামানায় হচ্ছিল সেগুলো সেই সময়ের ব্যতিক্রমী দিক। নাট্যসংস্কৃতির সিঙ্ঘভাগটাই ছিল স্থিতাবস্থাপন্থী।
বামফ্রন্টের শাসনকালের শেষদিকে যখন রাজনীতি অন্য দিকে বাঁক নিচ্ছিল, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম ও জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে রাজ্য উত্তাল হচ্ছিল—সেই সময়ে তার প্রভাব পড়তে শুরু করে রাজ্যের নাট্য জগতেও। নাট্যশিল্পী ও কর্মীদের মধ্যে বিভাজন হয়ে যায়। রাজনৈতিক পালাবদলের আগে এবং পালাবদলের ঠিক পরেই নাটকের মানুষরা অনেকেই চলে যান বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে। তবে তারা বামপন্থা ত্যাগ করলেন কিনা সেটা বোঝা যায়নি অনেকের কাজের মধ্যেই। অনেকে আবার স্পষ্টভাবে অস্বীকার করলেন বামপন্থাকে। বাংলার রাজনীতিতে লাগল নতুন সুর, নতুন রঙ। নাটকেও যার প্রভাব দেখা গেল অনিবার্যভাবেই। নাটকের মানুষরা অনেকেই সরাসরি চলে এলেন রাজনীতির ময়দানে, সরাসরি, অংশগ্রহণ করলেন নির্বাচনে, হয়ে উঠলেন ক্ষমতার অঙ্গ। এমন উদাহরণ বামফ্রন্ট আমলে খুব একটা দেখা যেত না। বুদ্ধিজীবীরা বাইরে থেকে সমর্থন জানাতেন সরকারকে, সরাসরি অংশ নিতেন না সরকারি ব্যবস্থায় বা প্রশাসনে।
গ্রুপ থিয়েটারের প্যাটার্ণও বদলে যেতে লাগল। যে সঙ্ঘতির চর্চা ছিল নাট্যসংস্কৃতির অঙ্গ তা ভেঙ্গে গেল। নব্বই দশক থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদানে পুঁজি বৃদ্ধি হতে থাকা নাট্যসংস্কৃতিতে সমষ্টির অবদান কমতে শুরু করে। দলগুলো হয়ে পড়ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এবার বৃহৎ নাট্যসমাজেও নিয়ন্ত্রণ চলে গেল কয়েকজন ব্যক্তির হাতে, আগে যা ছিল মূলত পার্টিকেন্দ্রিক। পার্টির সুনজরে থাকাটা সেই সময়ে সংস্কৃতি কর্মীদের কাছে ছিল অবশ্য কর্তব্য যা পরবর্তীতে হয় ব্যক্তিতে। নাহলে পশ্চিমবঙ্গে নাট্যজগতে কল্কে পাওয়া শুধু কঠিনই নয় প্রায় অসাধ্য। পেশাদারী থিয়েটারের যেহেতু মৃত্যু হয়েছে ফলে সেখানে কর্মসংস্থান হবে শুধুমাত্র প্রতিভা সৃজনে ক্ষমতার জোরে সেই সম্ভাবনাও আর খোলা নেই। রাজনৈতিক বা সামাজিক ঘটনায় প্রতিক্রিয়া না করে, নিজের মধ্যে থাকা বিরুদ্ধস্বরকে হিমঘরে পাঠিয়ে সরকারি কর্তা-ব্যক্তিদের কাছে মাথা নত করলে পাওয়া যাবে সংস্কৃতিচর্চার দেদার সুযোগ। নচেৎ যখন বিবেক সমর্পনের মহাযজ্ঞ চলছিল পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীমহলে তখন প্রশ্ন হতে পারে বামপন্থীরা কী করছিলেন, বিশেষ করে সেইসব মানুষরা, যাঁরা শিবির বদলালেন না। উত্তর, প্রায় নিশ্চুপ থাকলেন। কারণ, দীর্ঘদিন স্থিতাবস্থায় থেকে, বাম আমলে প্রতিবাদ না করে করে তাঁদের যে প্রতিবাদী একটা স্বর ছিল সেটাই তাঁরা ভুলে গেছিলেন। অথবা সেইসব কণ্ঠের আর গ্রহণযোগ্যতা মানুষের কাছে ছিল না। বামপন্থী রাজনীতির প্রতি সমর্থন প্রতিটা নির্বাচনে কমতে শুরু করল। ফলে বাম বুদ্ধিজীবীদেরও সাহসে ভাটা পড়তে শুরু করল, সেই সঙ্গে হয়ত দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সঙ্গে নতুন করে ঝামেলায় না গিয়ে সমঝোতার পথ খোলা রাখলেন অনেকে, রাজনৈতিক প্রাজ্ঞতা থেকে। পরিবর্তনের পর ইতিমধ্যে দ্বিতীয়বার নির্বাচনে জেতার পরে সরকারও আস্তে আস্তে কিছু নরম মনোভাব নিতে শুরু করল বামেদের প্রতি, বাম বুদ্ধিজীবীদের প্রতি তো বটেই। কারণ হিন্দুত্ববাদীদের দেশময় বিশাল অভ্যুদয়। পশ্চিমবঙ্গে সেই বিজয়রথকে আটকাতে হলে বিরোধী ভোটকে ভাঙ্গতে হবে, সেক্ষেত্রে বামেরা গুরুত্বপূর্ণ শাসকের কাছে। ফলতঃ বামেদের মিছিল-কর্মসূচী-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আবার একটু বাড়তে শুরু করলো, যা দেখে অনেক বামনেতা ও নাট্যশিল্পী ভাবতে শুরু করলেন, আবার তারা ক্ষমতায় ফিরে আসছেন নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে।
ইতিমধ্যে কেন্দ্রে রাজনৈতিক সরকার তাদের ‘অ্যাজেন্ডার’ বাস্তব রূপায়ন শুরু করে দিয়েছে দ্বিতীয়বার একক ভাবে সংখ্যা গরিষ্ঠতায় আসার পরে। সেইসব সরকারি পরিকল্পনা ও প্রস্তাবের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে বিরোধিতাও চলছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে আশ্চর্যজনক ভাবে এখনও বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি একজোট হতে পারেনি। বাম-কংগ্রেস সহ এরাজ্যের সরকারও আন্দোলনে পথে নেমেছে। জনমতও গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছে। সেই চেষ্টার প্রতিফলন কীভাবে ‘প্রতিবাদ’ অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া বাঙলা থিয়েটারে আসে, বামপন্থী ও সরকারপন্থী বিদ্দজনের কোন সমীকরণে একত্রিত হয়ে ওঠেন এবং সেই হয়ে ওঠার পথে বামপন্থীরা কতটা নিজস্বতা বজায় রাখতে পারবেন, নাকি বামপন্থাবিহীন বামপন্থী হওয়ার দিকে এগোবেন এখন সেটাই বিচার্য। মনে রাখতে হবে শিক্ষিত নাগরিক সমাজ বা সংখ্যালঘু মুসলিমরাই শুধু নয় তার বাইরে দেশের সংখ্যাগুরুকেও সঙ্গে পেতে হবে। পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি জাতিসত্ত্বাকে অস্বীকার করে এখন বামপন্থী আন্তর্জাতিকতাবাদীরা কতটা রাজনৈতিক তথা নাট্য আন্দোলনে সফল হতে পারেন তা আগামী সময়ে বলবে কিন্তু হিন্দু জাতীয়তাবাদের মোকাবিলায় নেমে সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে শুধুমাত্র মুসলিমদের মুখপাত্র হয়ে লড়লে, আগামী দিনে নাট্যসংস্কৃতি আরও ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়বে বলেই মনে হয়। সেই সঙ্গে দক্ষিণপন্থী দলগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অ্যাজেন্ডা কেন্দ্রবিরোধিতার সময়ে আলাদা হবে কীভাবে? কীভাবে তার প্রতিফলন হবে বামপন্থীদের শিল্প-সংস্কৃতিতে সেটাই এখন দেখার।
[লেখক – নাট্যকার, অভিনেতা এবং নাট্যনির্দেশক। ১৯৯৮ সাল থেকে খ্যাতিসম্পন্ন থিয়েটার গ্রুপ ‘থিয়েটার ওয়ার্কশপ’-এর সাথে যুক্ত। নাট্যকার ও পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন ‘সংযোগসূত্র’ থিয়েটার গ্রুপের সাথেও। ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন। ২০০৫ সালে ‘শ্যামল সেন স্মৃতি পুরষ্কার’ ও ২০০৮ সালে ‘সুন্দরম পুরষ্কার’ পেয়েছেন। তথ্যচিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যও লিখেছেন বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের জন্য।]
Posted in: Essay, January 2020