ধারাবাহিক গদ্য : সিন্ধু সোম
পর্ব-৫
রাজস্থান ডায়েরিস-১০
ফাঁসিকাঠ। আলপনাদির কুয়োটা প্রিয় ছিল খুব। মিষ্টি জল। হাত দিলে ছবাং করে আপত্তি করত ভরে আসা বুকের মতো। জেলারের রুলারেও মাথা ফেটে রক্ত আসে। সমাজ তাকে সিঁদুর চাপা দিয়ে হত্যা করে আচম্বিতে। ব্যঙ্গ তখন বেরিয়ে আসা জিভে। দিতি দিতি দিতি। দৈত্য তাকে ছিনিয়ে নিতে জন্ম পাঠিয়ে ছিল। আলপনার মুছে যাওয়াটা কারোর চোখে পড়েনা কোনোদিন। কাদম্বরীর মৃত্যুচেতনাকে সূর্যের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে স্বস্তির পিক ফেলে বিচারক। চাবুক চলে। গুনতি। বেনারসীকে আমার সেদিন থেকেই ব্যান্ডেজ মনে হয়। থির থির। মেঘের বুকে কাঁপে সূর্য। পর্দা টাঙানো। ধোঁয়া ওঠে। আড়ালে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানে জল্লাদ। গোঁফের টুবো টুবো কালি যাপন করে পটের ভূমিকা। উপসংহারের প্রতীক্ষা-রতা ঘুনসি। কেউ দোলে। আমার কাঁধে মাথা রাখে সময়। ক্লান্ত চোখ। হাতে ধরা শব্দের শবদেহ তখনও তরতাজা। নিজেকে প্রবোধ দিতেই হয়ত আলপনাদির চোখ দুটো মুঠো থেকে বের করে আনি—
“আমার রক্তের মধ্যে লোহিত কণার মতো মিশে আছে
গণিকার ঠোঁটের লিপস্টিক, ধবল শঙ্খের দাঁত খুলে খুলে
সাজানো চুম্বন। কোনও ব্যাধি আমাকে ছোঁবে না।
আমি এই শতাব্দীর গণঘৃণ্য রোগের সন্তান,
কোনো পাপ আমাকে ছোঁবে না।
আমার হাতের মধ্যে স্বেচ্ছায় খুলে-দেয়া
বেশ্যার রাজদ্রোহী স্তনের গর্জন, কোলাহল,
কোনো শৃঙ্খল আমাকে ছোঁবে না।
আমার কণ্ঠের হাড়ে অহংকারী যুবতীর খোঁপার শেফালি,
মৃত্যুমাখা নীল-পাট আমাকে ছোঁবে না।
আমার মাংসের মধ্যে লাল ঘুণপোকা,
ছিন্ন পেশী কণা, কোনো প্রেম আমাকে ছোঁবে না।
সমস্ত ফাঁসির রজ্জু জ্বলে যাবে প্রচুম্বিত কণ্ঠনালী ছুঁয়ে,
ছিঁড়ে যাবে বেদনার ভারে। মৃত্যুদণ্ড আমাকে ছোঁবে না;
কোনো শৃঙ্খল আমাকে ছোঁবে না।”[১]
বিধবা হল মরুভূমি। ক্লান্ত দিগাঙ্গনার বুকের কাপড় পড়ল খসে। ড্রপসিন। মুখ নামিয়ে হাততালি। চটাপট চটাপট। নিভে গেল মেঘ। পা ভারী হচ্ছে ক্রমশ। শোক নয়। স্বার্থপরতা। ঝোঁক। মরুভূমি ফিরিয়ে দিলে মরুদ্যানে আশ্রয় নিতে হয়। অগত্যা। গুড়ুক গুড়ুক। হুঁকোর শব্দ। একটু ধোঁয়ার আশ্রয়। টোলট্যাক্সের রাস্তা শেষ পর্যন্ত আলেয়া হাতেই জলের দিকে ছোটে। সাদা কাপড়। মুখ ঢাকে রঙ্গ। একটা উঁচু স্ট্রীটলাইট। তার নীচে পরিখার ভাষার স্কুল। তাবু। ঝিল দিচ্ছে বিদ্যুৎ। বিবাহিতা দ্বারের কাছে। একা ঢুকতে সাহস পায় না। শিকড়ে যখন অবাধ হাওয়া তখন চণ্ডীদাস মেলে ধরে কাঁটা। তার সবটুকু আবেদন ঢেলে। “মনের মরম কহি জুড়াবার তরে।/ দ্বিগুন আগুন সেই জ্বালি দেয় মোরে।।” [২] মাটিতে পাতা গদি। তাত ছম তাতা ছম। ঘাঘরা কাঁপে। ঘাঘরা জপে চরণ-ধূলার নিভৃত অনুদান। কে জানে! কে জানত? সময়ের পাশে অন্তরঙ্গরাও গন্তব্য হয়ে ওঠে। বৃন্দাবন বা নির্বাসনকে জিগ্যেস করে দেখো! চিঠির আদল তার কত কাছাকাছি!
দ্রিমি দ্রিমি। হারমোনিয়ামের বাইরে গলা। স্কচের গ্লাসে তানের কম্পাঙ্ক। বুকে আসে মাথুর। পর্ব আসলে প্রকোষ্ঠ। রক্ত এলে বাড়ে, গেলে কমে। জয়দেব জানতেন। আমার হাত ধরে প্রাঙ্গণে নিয়ে এল ছায়া। মৃতদেহের ভিড়ে। রঙ। খালি গলা। বুক জ্বলে। আমি নাচের পোষাক পাই নি কখনও। ছিটে ফোঁটা। কুমারসম্ভবের আটে আমি আটকে পড়ি। পাথুরে দেয়াল। গলায় ব্যথা। সুরার পর সঙ্গমের তীব্রতা থাকে না। কালিদাস জানতেন না কি? চোখ ঝলসে ওঠে হঠাৎ। অহল্যা আমার থেকে অনেকটা দূরে বসেছে। প্রকাণ্ড একটা গাছের কাণ্ডে অনেক গুলো মুখ। নড়ছে। আমি শুনতে পাচ্ছি না। শুধু মুখোশটা দেখতে পাচ্ছি। বসে বসে ঘোরে। জামায় আগুন। মুখে আগুন। তাই কৃষ্ণ? একটা নীলকুর্তি কৃষ্ণবদন আগুন ছোঁড়ে। ড্রাগনের দক্ষতায়। আমি জ্বালানির বোতলটা দপ করে ধরে ফেলি। আগুন গোঙায়। ছটফট করে। ঘূর্ণি লাগে। লেগেছে। নীলের সঙ্গে হলুদের ভাব হচ্ছে খুব। বিবাহিতার পায়ের আঙুল নিভৃতে চাপ দেয়। আমি ওর বুকের জড়ত্ব মাপি। আঘ্রাণে। আখেরনের তীরে।
অপ্সরা আখেরনের মরুদ্যানের দ্বারী। আনুবিস ওর পায়ের কাছে গুটিসুটি পড়ে থাকে। ঝাপসা হতে থাকে অনুবীক্ষণ। হিমালয়ের গল্প বলি আমি অপ্সরাকে। সে উত্তর দেয় না। তার শরীরে তাল পড়ে মৃদু। ওকে ছোরাটা দেখাই। কালো ধারের ওপরে চকচকে একটা বিন্দু। বাতাস ফোঁস করে ওঠে। ঈর্ষায় কাতর হয়ে বলে ওঠে ছায়া,”কিছুটা আমার চূড়ায় রেখো!” অপ্সরা বলে,”আমি পুরোটাই তোমার, ছায়া! নাচনেওয়ালীর ছায়া হয় না।” আমি অলকানন্দার জল আনি। টল টলে। বৃত্ত ঢেউ। তাতে দিতি আর আমার প্রতিবিম্ব। না-বাঁধানো। অনামিকা ছাদের নেশায় শরীরের মন ছোঁয়ার মতো। বিবাহিতা আড়চোখে তাকায়। লাস্য লালার মতো অচেতনে গড়ায়। আমার আফসোস। ইন্দ্রজাল। তাসের দান শিখতে পারতাম আগে। অপ্সরা আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে। অন্ধকারে জোনাকি। কৃষ্ণ অপলক তাকিয়ে আছে এদিকে।
অপ্সরা তার ঘাঘরা ছড়িয়ে বসেছে চারিদিকে। কাঁচপোকা সেখানে বসে রোজ। কাঁকড়াবিছে। মাথা নীচু। ঝুমঝুমি সাপ কুণ্ডলী শানায়। আরাম একটু সরে। আমার পাশাপাশি। বসার বেদীটা ভেঙে যায়। একটা ঘেঁটুর গাছ। পাড়তে গিয়ে থমকে থাকি। মৃণালিনীর কথা মনে পড়ে। মৃণালিনী ঘোষাল। “……এইখানে; এইখানে মৃণালিনী ঘোষালের শব/ ভাসিতেছে চিরদিনঃ নীল লাল রূপোলি নীরব।” [৩] আমি চোখ তুলতেই একটা বাচ্চা অভাবের একটা থালা দিয়ে গেল। এই রঙটা! আমি বালিয়াড়ির কথা তুললাম। অপ্সরা এক চোখ ক্লান্তি নিয়ে আমার দিকে তাকাল। ও কি বুঝল তবে কুমারসম্ভবের ভ্রান্তি? দ্বার তবে কি খুলবে না শাক্তে?
আমি এদিক ওদিক পা ফেলতে ফেলতে বাসে ফিরি। নরম অশান্তিতে গোড়ালি ডুবছে। বিধবার শাড়ির পাড়ে বিবাহিতার সিঁদুর। কখন অলক্ষ্যে……। টানা গোলোকধাঁধাঁ। সংক্ষুব্ধ আরম্ভের গতি। গলির রাজ্য পেরিয়ে এসেছি। প্রকাশ্যের আওতায় বিবেক অশ্লীল। আকাশের একদিকে চাপ চাপ মনখারাপ। ঝিলিক দিচ্ছে বিদ্যাপত্য- “নয়ন কাজর তুঅ অধর চোরাওল/ নয়নে চোরাওল রাগে।/ বদন বসন অব লুকাওব কতিখন/ তিলাএক কৈতব লাগে।।” [৪] ঝিরিঝিরি। সোঁদা গন্ধ। অপেক্ষা থেকে প্রতীক্ষার মধ্যবর্তী ধারা। ঝপ ঝপ ঝপ ঝপ। ছুটতে ছুটতে এসে বাসের সিঁড়িতে পা দিয়েছি সবে, কেউ ধাক্কা দিয়ে বালির ওপর ফেলে দিলে। ব্যস্ত হওয়ার আগেই ঠোঁট ডুবে গেল ঠোঁটে। কাঁচের চুড়ির বোলে কপালে রক্তের তান ফুটল। গালিচার ডুবে গেল সন্দেহ। তবু! সীমানা ওটুকুই। দেয়াল টপকে দেখা একবার। এক মুহূর্ত। ব্যাস। অতঃপর অন্ধকার ভেজা শীতলতা।
হাতে একটা গোটা রাত ধরিয়ে দিল অপ্সরা। পুড়তে অবসর দিল। হালকা বৃষ্টি। এভাবেই ঝড়ের রাতে একে একে পেরিয়ে আসে স্বপ্নেরা। আরো বেশ কিছুটা এগিয়ে যাওয়া। দিতির কাছাকাছি। ড্রপসিনের ওপরের লাল আলোটা জ্বলে উঠল তখনি। ঠিক তখনি…
আলোকলেখ্য—স্বয়ং
২৫শে অক্টোবর ২০১৮
দুপুর ১২টা ৩৩
হাজার বছর বড় ব্যর্থ সময় বলে লতা তার ফুল ফল গর্ভাশয়া সব নিয়ে চিক পেতেছিল, গহীন শ্বাপদ-পিঠে
বস্ত্র অবস্ত্রে দিও তনু চূড়া আবরে/ মনেরও আবর রাধে কোথানু পোহাবে? আগুনালি রাতকণা সব পিয়ে যাবে
____________________________________________________________
[১] নির্মলেন্দু গুণ
[২] চণ্ডীদাস
[৩] জীবনানন্দ
[৪] বিদ্যাপতি
Posted in: January 2020, Prose