বেড়াল – একটি সংস্রবহীন আখ্যান : শানু চৌধুরী
দৃশ্যের আগে ভোর বসে গেল। যৌনাঙ্গগুলো অবসর খুঁজতে খুঁজতে টাটিয়ে উঠছে রসের কথায়। কে, কাকে রস দিতে পারে? এই লেখার রস কোথায়? যে পথ চলতে চলতে মাছবাজারের বেড়ালগুলো ঠিক ক্রেতার পায়ের কাছে ঘুরে বেড়ায় , সেই আঁশ অথবা প্রলোভনের মাঝে দেখেছি বুলেটকে। ও নখ দিয়ে আঁশগুলোকে আঁচড় কাটে, কানকোগুলো নেড়েচেড়ে দ্যাখে। হারান দা বলে জন্ম থেকেই ওর অনীহা। তাই অনীহা থেকেই ও আলাদা হয়ে গেছে। বেড়ালের জন্মপরিচয় নেই। হারানের ও নেই। হারান ওকে শিক্ষা দিয়েছে পৃথিবীর আঁশগুলোকে ছুঁয়ে দেখতে আর ওডিসির নামে ছলনা করে পৃথিবীর কৃমিগুলোকে হত্যা করতে।
– ” অনেকদিন পর রাস্তা দ্যাখা যাচ্ছে।”
– ” এর অর্থ তুমি কেন বোঝো না?”
– ” মানে খুঁজতে খুঁজতে আমাদের পৃথিবীতে বিবমিষা লেগে যায়, মানে খুঁজো না।”
– ” প্রতিটা মানের শ্লীলতা- অশ্লীলতা খুবই হাস্যকর”
– ” যে পাখির বাসা ভেঙে উসকে দেওয়া আগুন জ্বালালে তার চোখ দ্যাখোনি তুমি। যা দেখলে তা কেবল
হাহাকার!”
– ” সাদাকালো ছবির ভিতর ভোর দেখতে পাও তুমি? তবু দৃশ্যের কল্পনায় জেনেছ, ইতিহাস যাদেরকে মনে রাখে
তারা আত্মীয়-কন্ঠী হয়নি কোনোদিন।”
– ” আত্মীয়-কন্ঠী ?”
– ” হ্যাঁ”
– ” শব্দটি সুন্দর”
– ” সুন্দরকে ছেঁকে নিলেই দেখবে রং নেই। একটি গ্রন্থকে জানার অভিলাষে যেমন ছুঁড়ে দিতে হয়, না-জানাগুলো”
– ” কঙ্কাল দেখে যেভাবে বূঝে নিতে হয় ভদ্র মাংসের আড়ালে ভণ্ডামি।”
– ” আর এক রাউন্ড চা হোক।”
– ” এ আমার কলেজের ইংরিজি অধ্যাপকের কথা। ক্লাস শেষে বলতো। কখনও শেক্সপীয়রের ৬৫ নম্বর
সনেটের কোনো পঙক্তির প্যারাডক্স বোঝাতে গিয়ে আবার কখনও এনড্রু মারভেলের কবিতার অ্যানোটেশন বোঝাতে গিয়ে।”
– ” তুমি জানলে কিভাবে? ”
– ” সব কথাই জানা হয়ে যায়! জীবনের আঁশকে পরখ করতে করতে…কারণ! অপারে কেউ থাকবে না।”
– ” মুখের মতো মুখে ঠেসে দেওয়া হয় স্মরণের পিছুটান থেকে।”
– ” আচ্ছা তুমি আয়না দ্যাখো না। না ?”
– ” দেখলে বুঝবে আয়নারও এক কড়া রোদ্দুর আছে। যাকে অনুভব করলে ছায়া পাওয়া যায়।”
এই যে দিন রাত ভেবে চলো চরিত্র অপেক্ষা সম্প্রদায় মুখ্য। ছাদের ওপরে পাতার বিছানায় একা শোও। রোদে চামড়া তেতে ওঠে সেখানে মিশে গিয়েও চিরকাল শান্তি পাওনি। আজ কফন কেনার টাকায় মদ ঢেলে নাও শরীরে।
– ” আমার সেই দিন আসেনি। ”
দিন কারোর আসে না। সারা পৃথিবীতে যতো হায়নার আচরণ দেখবে তাদের শিকার হয় নিজের ইচ্ছেমতো। গাছ যত বড় হয় তার শিকড় মাটিকে আঁকড়ে ধরে তীব্রভাবে। যে গর্তে আলোর দিশা নেই তার মসৃণ ত্বক বেয়ে পড়ে যাচ্ছে মাটির হাহাকার! এ সমস্ত না- দেখা এক ফোঁকর। যার সরু হাত কুয়াশার ভিতর টোকা দিয়ে বলছে- আসলে পরিকল্পনা না থাকাই একটা পরিকল্পনা , পাথরকে বুকের কাছে নিয়ে শুয়েছ সারাজীবন সেই পাথরই তোমার উচ্চাকাঙ্খা ও মৃত্যুর পরমান্ন। অর্থাৎ পাথরটি তোমার জীবনের স্টান্টম্যান যে নিমেষে গুড়িয়ে দিতে পারে তিলে তিলে বড় করে তোলা প্রভার আলোড়ন।
– “যে দিন তোমার চলে যায় তার প্রক্রিয়াটির কল্পনায় বমি পায়। পূর্বস্মৃতির বমি।”
– ” অতএব অভিজ্ঞতা?”
– ” একটা মানুষের অভিজ্ঞতা বমি হতে পারে না?”
– ” জ্ঞানের মাত্রায় একটা আনকনশাসনেস শব্দ বসিয়ে দেখতে পারো।”
– ” জানি।”
– “জীবনে যেসব পাহাড়ে চড়েছি সেখানে আমার আমার নিশ্বাস বহন করেছে আমার কোনো না কোনো বন্ধু”
আমি পাহাড় বেড়াতে গিয়ে প্রচণ্ড মদ্যপ অবস্থায় রাতের পাহাড় দেখেছিলাম। ঢাল বেয়ে নীচে নেমে গিয়ে শিয়ালের সংসার খুঁজে পেয়েছিলাম আর ভেবেছিলাম আমাদের ভিতরেই সবসময় যুদ্ধ চলে, সেই যুদ্ধকে বাইরে আনলে লাভ হয়না কখনই।
আমরা সেই যুদ্ধের ভাষা জানি কমরেড! জানি গোলামির ভাষা! আর সেখানেই যদি কারণ থাকে তোমার লড়াইয়ের, তবে সেই শান্তি ভঙ্গুর হবেনা কোনোদিন।
বেড়াল। একটা বেড়াল কাটার শব্দ শুনতে শুনতে শরীর কেমন কেঁপে ওঠে! চামড়া শুকিয়ে লোম ওঠা দেখে মনে হয় আমি এখানে কেন? অবহেলার পর আমার চোখ খোলা স্বপ্নগুলো অন্ধ করে দেয় উদ্বাস্তু ব্রক্ষ্মশিলা দেখার মতো।
– ” দুধ-কোশী যাব”
– “যে রাস্তা দুর্গম হয়ে ওঠে… তার যন্ত্রণাকাতর পাথর খসে পড়বে আর আমার রক্তে প্রতিটা শীতল নদীর রঙ
হবে দুধেআলতা। আমি সেই অপেক্ষাই আজ করি।”
– “সমস্ত অঘোর মিলিয়ে যাবে মৃত্যুকে বসিয়ে রেখে”
প্রদাহ
প্রদাহের কাছে রেখেছি সিঁদুর
তবে যা উড়ে যায় তাই শ্রেয় ?
বেড়াল রাতের কাছে আসে
মাছের হদিশে
আঁশটে গন্ধঘর বিপুল
কীর্তন মেখে আছে আতপ গন্ধের সাথে
একটা তীব্র শিৎকার অপ্রতুল তথ্য থেকে হাঁক দিচ্ছে। এই কবিতা যদি স্থির রাখে আমায়? তবে কি পাঠক ভুলে যাবে ? টিকে থাকার জন্য অনৈতিক হতে রাজি নই। তবে টিকে থাকার জন্য লেখায় শুধু একটুকরো উল্লেখ পড়ে থাকতে পারে আর কিছু না। অপূর্ব সেই শক্তি! যার শৃঙ্খলা একজন মাছওয়ালা, একজন লেখক ও একটা লোম ওঠা বেড়াল খোদাই করেছে তীক্ষ্ণ আঁশ- সস্তা পাল্প- রিং টেস্টের পড়ে উপড়ে ফেলা কাঠের শরীরে।
এই লেখা ভাঙতে সময় লাগবে। এতদূর লেখার পর ধরা পড়ে যাবে শানু চৌধুরীর কারসাজি ও প্রাচীন, দুর্বল নাইলন দড়ি এক হয়ে যাবে মৃত্যুর পাতায়। অপার্থিব বিষয়-আশয়গুলিকে আছাড় মারতে মারতে বলবে মা আমার নিশ্বাস চলছে দ্যাখো। কেঊ হারাতে পারেনি। আমাদের লেখাগুলো ভিজছে দেখে যাও। আর আমি একটা শয়তান অথচ অথর্ব কাপুরুষকে দেখছি মনিটরে। যাঁর হাত বাঁধা। মুখে কালো কাপড় দেওয়া।
– ” এখন শব্দের আদল ভেঙে যাচ্ছে”
– ” মৃত্যুর আগে শূন্যস্থান বসিয়ে দ্যাখো। শুনতে পাবে এক ঈষৎ তীক্ষ্ণ অথচ ভরাট স্বর।”
– “আমার পাতাগুলো কাঁটা হয়ে যাচ্ছে”
– নতুন কবরের মতো উঁচু হয়ে আছে পবিত্র তালায় বন্ধ গেট।
যে মানুষ নিজের আত্মাকে খুঁজতে চায়, আবিস্কার করতে চায় তাকে একবার একটা আত্মাকে স্পর্শ করতে হয়।
[চিত্রঋণ : স্বদেশ মিশ্র]
Posted in: January 2020, Prose