সঞ্চালিকা আচার্য-এর কবিতা
শিরদাঁড়া ও ব্যক্তিগত ফোরট্রেস
এই কি তবে শামুকজন্ম !
এই যে থেকে থেকে মুখ বের করে দেখে নিচ্ছি হেডলাইনস, গোলমাল আঁচ পেলেই ঢুকে যাচ্ছি নিরাপদ দুর্গে, কফি মাগ থেকে পোড়া গন্ধ বেরোলে পাল্টে ফেলছি ব্র্যান্ড, মাঝেমাঝে সচেতনতা শুধু প্রকাশ করছি স্ট্যাটাস আপডেটে। বাকিটা কেউই দেখতে পায় না ।
খবরের কাগজের যে পৃষ্ঠায় দৃঢ় উচ্চারণের কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত, প্রশাসনিক উপহার, সেই কাগজেই স্যানিটারি প্যাড মুড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছি ট্র্যাশে, আর হাত ধুয়ে ফেলছি ।
এই বুঝি শামুকজন্ম তবে! তিলে তিলে তৈরি করা শক্ত শ্যেলের নান্দনিকতা তবে এই !
এতো কিছু দিলে তুমি, গায়ে শুধু একটু মানুষের গন্ধ কেন দিলে না, প্রভু ?
পূর্ণতম চাঁদ, অর্ধেক আমি, ও আমাদের কথকতা
(১)
“সিগারেট নিয়ে আসি”, বলে সেই যে গেলে আর ফেরো নি। আমি বাসস্টপে দশ মিনিট দাঁড়িয়ে তারপর ৩০বি-এর জানলার পাশে বসে বাড়ি ফিরে এসেছি। কারণ, আমি অপেক্ষা শিখিনি।
আমি শিখিনি অনেক কিছুই, যেমন সম্পূর্ণ আনুগত্য, যার সমার্থক হয়তো সমর্পণ। কিন্তু তারপর আবারও আমাদের দেখা হয়ে যায়, তোমাদের ‘বনেদী’ বাড়ির তিনতলার চিলেকোঠা ঘরে। তোমাদের ওই স্যাঁতসেঁতে বাড়ি, আর ততোধিক স্যাঁতসেঁতে মানুষগুলোকে পেরিয়ে তিনতলা অব্ধি পৌঁছতে পৌঁছতে,
হে আমার প্রবল দিনের সখা,
আমি বুঝেছি কীভাবে সমস্ত বিপ্লববাসনা ট্রেনে কাটা পড়ে মরে অচিরেই।
তারপর আর কদিন! এক ভোরবেলায় লজ্জিত ঈশ্বর নিজেই এসে তাঁর প্রিয় পাখির লাশ দুহাতের মধ্যে ভরে ফেরৎ নিয়ে চলে যান।
ঠিক এখানে এসে জনৈক ডাক্তার প্রশ্ন করলো “আর তারপর, তারপর তুমি কি করলে?”
(আপনারা এত তারপর তারপর করেন কেন? বিরক্ত লাগে)
আমি কী করলাম? যে আমি আনুগত্য শিখি নি, অপেক্ষাও না, সেই আমি? উমমম কেন সারাক্ষন আমার হাতে রক্ত লেগে আছে মনে হয় ডাক্তারবাবু? না, না, সেসব রক্ত আমি ওয়াইনের গ্লাসে ঢেলে খেয়ে নিয়েছি। বুঝলেন ডাক্তারবাবু? রেড ওয়াইন।
(ডাক্তার বিহ্বল হয়ে পড়ছে না কি!)
কিন্তু এখন আমার একটা প্রশ্ন আছে। এই যে আমাকে মাঝে রেখে নিজের কক্ষপথে ঘুরলে এতদিন, এতো দিনে কি তোমার সব রোগ সেরে গেছে? এই দূরত্ব পেরোতে পারো তুমি এখন? এখন কি আরও একবার আমার ঠোঁট থেকে রেড ওয়াইনের গ্লাস-টা সরিয়ে সেখানে নিজের ঠোঁট গেঁথে দিতে দিতে বলবে “নাও আমাকে নিয়ে নেশা করো…”
চাঁদ?
(২)
দু-দু’বার স্বেচ্ছায় পৃথিবীর ছায়ার ভিতর সেঁধিয়ে গিয়েও, চাঁদ, আবার নিজেই বেরিয়ে আসার পর এখন হয়তো তুমি কোনো সস্তা হোটেলে ততোধিক সস্তা মদ খেতে খেতে মায়াকোভস্কির মতো কোনো কবিতা লিখছো; ঠিক এখনই।
আর ঠিক এখনই আমি আমার লাল কার্পেট মোড়া সংসারে বসে ফুলদানিতে অর্কিড সাজাচ্ছি, তোমার দেওয়া স্বপ্ন থেকে বহু দূরে। যেখানে মুক্তির সরণি হঠাতই অন্ধকার আর কুয়াশায় মিলিয়ে গেছে। সৌখিন মোমদানিতে মোমবাতি গুঁজে দিচ্ছি। নিজস্ব পুরুষের শরীরের নিচে শুয়ে চোখ বন্ধ করে সুখ নিতে নিতে ভাবছি সব বিচ্ছেদই একদিন সহনীয় হয়ে যাবে। আর একেই নাম দিচ্ছি শালীনতা, কেননা জানি ক্লাইম্যাক্সে তুখোড় অভিনয়ে ঢাকা পড়ে যায় সব ফাঁকি।
আর ঠিক এখনই টিটাগড় থেকে সাতাশ বছরের পাপড়ি চেপে বসেছে ডাউন ব্যারাকপুর লোকালে। পরনে ওর সবুজ রঙের শিফন শাড়ি। পাপড়ি, যাকে দেখে একদিন আমার মনে হয়েছিল কাগজি লেবুকে হাফ কেটে দিলে ওর মতো লাগে অনেকটা, আর তোমার মনে হয়েছিল রোজ একটু একটু করে নিজের শরীরে বালি ঠুসছে ও, সেই পাপড়ি আজও যাচ্ছে বৌবাজারের রাস্তায় বি ক্যাটাগরিতে কাজ করতে। আমার মতই পাপড়িও জানে ক্লাইম্যাক্সে তুখোড় অভিনয়ে ঢাকা পড়ে যায় সব ফাঁকি।
আমাদের চারপাশে বদলায়নি কিছুই। শুধু একটা আশঙ্কা আমাকে তাড়া করে ফেরে আজকাল, জানো! লেখার খাতা থেকে মুখ তুলে যদি হঠাৎ মাঝরাতে আমাকে ইনবক্সে লেখো যে এই সাত বছরে আমি কয়বার হামারি মুসকানের শ্রাবনী দি’র সাথে যোগাযোগ করেছি? কিংবা ক’বার গেছি পাপড়িদের বাড়িতে?
শুধু এই আশঙ্কা আমাকে তাড়া করে ফেরে আজকাল যে তুমি লেখার খাতা থেকে চোখ তুলে এই প্রশ্ন ছুঁড়ে দাও যদি, সর্বগ্রাসী সেই জোয়ারে আমার বেপথু নৌকা ডুবে যাবে।
আমার কি কোনো বন্দর কখনো থাকতে নেই,
চাঁদ?
(৩)
তেমন কিছু অনেকদিন আগের কথা নয়, তবু যেন মনে হয় সে এক প্রাগৈতিহাসিক সন্ধ্যায়, অর্থহীন ক’রে দিয়ে আন্তরিক সমস্ত বন্ধন তোমার সঙ্গে চাঁদ, আমি টলমল পায়ে উঠে চলে আসছি বহু দূরে, আর পিছনে ক্রমশই মিলিয়ে যাচ্ছে তোমার দৃপ্ত উচ্চারণ “এই প্রিয় দেশ যেন পুনর্বার বাসযোগ্য হয়।”
আর এরই মধ্যে কারা যেন মানবতার শরীরে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ছাই ক’রে ফেলে গেছে রাস্তার পাশে।
তারও পর নির্লজ্জ ভোগবাসনায় কোনো এক তরল রাত্রে আমি গভীরে নিয়েছি সাপ, আর তার ঠিক চল্লিশ সপ্তাহ পরে এই অলৌকিক লেবার রুমে ডাক্তারের মুখোশ পরা ভিখিরি চেঁচিয়ে গেল—
“পু-উ-উ-উ-উ-উ-শ”
টানা এক ঘন্টা,
আর আমিও প্রাণপণ চেষ্টা করে গেলাম একটা সন্তান জন্ম দেওয়ার, কিন্তু হাওয়া ছাড়া আর কিছুই বের করতে পারলাম না (ভাগ্গ্যিস)।
ঠিক তখনই খুব কাছেই কোথাও বেজে উঠলেন শস্টাকোভিচ, আহা কী উষ্ণ সে সঙ্গীত, আত্মার সাথে কী সঙ্গতি, আমিও তৎক্ষণাৎ অপারেশন টেবিল থেকে লাফ দিয়ে নেমে জীবনের সাথে ট্যাঙ্গো নেচে বিবেকের সাথে সেলফি তুলে শয়তানের দিকে ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দিতে দিতে ঢুকে যাচ্ছি মৃত্যুজাহাজের পেটের ভেতর,
আর এখন আর এক সন্ধ্যা নেমেছে,
আর তুমি কি এখনো আওড়াচ্ছ তুষার রায় আর গিটারে তুলছো তোমার খুব ব্যক্তিগত ঈশ্বর-দ্বারা রচিত সুরের মূর্ছনা,
চাঁদ?
Posted in: Cover Story, January 2020