পূবালী রাণা-এর কবিতা
এই জীবন উপত্যকা আমার দেশ
১.
বছর শেষে বিধবা দুপুরের ডাকবাক্সে পাওয়া চিঠির মর্মোদ্ধার করতে গিয়ে দেখি কুয়াশার চাদর বেছানো ধানক্ষেতে কুমেরুর শীতল অন্ধকার। মানুষের মনের অলিতে গলিতে শীত। জমাট অন্ধকার। শীত জমেছে আমার গোপন কান্নায়, উষ্ণ আলিঙ্গনে। আগুনের ভোরে বন্ধকী স্থবিরতা।
বৈঠকে শুধু পঞ্চাশের মধ্যাহ্নের বর্ণময় গরম ভাত আর তা ছিনিয়ে নেওয়ার গোপন মিটিং। পরিযায়ী পাখিরা এসে দিয়ে গেছে বুলেটের বীজ মন্ত্র। তাদের লাল ঠোঁটে লেগে ছিল আগুনের স্পর্শ। আদিবাসী কিষানের বুক নিঙড়ানো জমি থেকে গোটা মানচিত্রের পাললিক উপত্যকায় ছড়িয়ে দেব সেই বীজ।
এই চিঠিগুলো এখন একটু রোদ্দুর চায়। তারপরে আগুন। রোদ্দুরের স্পর্শে প্রতিটি বর্ণমালায় ফুটে উঠবে নতুন পৃথিবীর বীজ মন্ত্র।
আর আগুনের ফল্গুধারায় ভালোবাসাকে নয় ছড়িয়ে দেব মহা পৌষের মহাকালে।
২.
একটা মৃত্যুর পর আমি নিভে যাওয়া চিতাভষ্ম ঝেড়ে ফেলে পরিযায়ী পাখির মতো ফিরে আসি নিজের দেশে। আমার শরীরে হয়তো লেগে রয়েছে আগুনের স্পর্শ! সেসব অনুভব করি রাতজাগা অন্ধকারে। তারপর কবিতার কাছে এসে দাঁড়াই। অভিমানী কবিতা মুখ ফিরিয়ে নেয়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে রেহেনা খাতুনের অসহায় মুখ। পাতাল উত্থিত ঝিঁঝিঁর ডাক সম্বল করে হাঁটতে থাকি গন্তব্যহীন পথে। ক্রমাগত বুকের ভেতর বেজে চলে ডমরুধ্বনি। গোপন গহ্বর থেকে শূন্য স্থানে উঠে আসে শুখা আর অনাহারে মলিন শিশুর মুখ।
দিশেহারা লাগে। কাঁটাতারে ক্ষতবিক্ষত হয় শরীর। এ ঘর আর আমার নয়। এ দেশও কি আমার? আবগারি ভোরের কাগজে ভেসে আসে ফাঁদ। রেহেনার কথা মনে পড়ে। কোলে কুড়ি দিনের সদ্যোজাত! সেও কি জানে এই দেশ তার নয়, তার জন্মভূমি তার নয়! রাতভোর লংমার্চগুলো মানুষের কান্নার ওপর মেহগনি ভোরের প্রলেপ দিয়ে যায়। বুকের ভেতর অবৈধ রুট মার্চ তোলপাড় করে।
তবুও বাতাস বয়। শ্বাস নিই। শিরদাঁড়া টানটান করে আবার স্লোগান তুলি। আমরা আগুন নিয়ে ক্রমশ এগোতে থাকি
আধো ঘুমে স্বপ্ন দেখে চোখ। জার্মান থেকে সেই বুড়োটা এসে বক্তৃতা দিয়ে যায় সাগেনগাওতার মাঠে। রক্তবর্ণ প্রবাল প্রাচীর ভেদ করে তার কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। সুবর্ণরেখার লাল ডাকঘর থেকে চিঠি আসে। সে চিঠিতে লেখা থাকে এক অলৌকিক ভোরের কথা। সে চিঠির গোপন উদ্যান থেকে কোজাগরীর চাঁদ ওঠে।
মানুষ স্বাধীন হোক
এমনকি পোকারাও স্বাধীনতা পাক
পুড়ে খাক হয়ে যাক অপ্রেম বিরোধী
আমরা যাবই যাব জিতে
তারপর আধো জ্যোৎস্নায়
যন্ত্রণাগুলো স্তব্ধতা খোঁজে। একটা মিছিলের সামনে এসে দাঁড়াই। খুঁজে ফিরি তাকে যার বুকে মাথা রেখে আমি অন্তর্জলিযাত্রা করেছিলাম! আসছে ফাগুনে আগুন ঝরানো পলাশের বিছানায় শুয়ে আমি কি তাকে খুঁজে পাবো! যে আমায় সামনের পাহাড়ে নিয়ে যাবে পথ দেখিয়ে!
সাইরেন বাজার আগেই আমরা ঠিক পৌঁছে যাব।
Posted in: Cover Story, January 2020