ধারাবাহিক উপন্যাস : নীলাব্জ চক্রবর্তী

যখন সবাই ছিল সংখ্যালঘু অথবা বাথরুমের জানলা থেকে চাঁদ দেখা যাচ্ছে

দশম পর্ব

২০

১) আমণ্ড
২) পাতিলেবু
৩) পুদিনা পাতা
৪) শসা
৫) বাদাম দেওয়া শুকনো চিঁড়েভাজা
৬) এটিএম যেতে হবে

মনে রাখব। মনে রাখব। মনে রাখব। তবু, লিস্ট করে রাখলাম। লিখতে লিখতে মনে হোলো, শসা বানান তুমিও কি আমারই মতো দন্ত্যস-ই লেখো? নাকি তালব্যশ? আমি কেন শশা না লিখে শসা লিখি জানো? ‘শশা’ লিখলে কেমন শুকনো খটখটে মনে হয়, পক্ষান্তরে, ‘শসা’-য় কিন্তু একটা সরস সজীবতা পাই… জলজল… ভেজা ভেজা… দু-চার ফালি শসা কাগজে মুড়ে রাখা… কাগজটাও ভেজা ভেজা… এরকম মনে হয়… তুমি কখনও এভাবে ভেবে দেখেছ কি না জানতে ইচ্ছা করে… কতকিছুই তো ইচ্ছা করে এরকম…

= = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = =

এখানে লাইফ সার্টিফিকেট জমা নেওয়া হয়

বাঁদিকের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে

তিন নম্বর ঘর

= = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = =

# * # * #

এখন দাঁড়িয়ে থাকার অভিনয় করছি… এখন গান শোনার অভিনয় করছি… এখন বসে থাকার অভিনয় করছি… এখন দুটো ড্রয়িং চেক করার অভিনয় করছি… আর লক্ষ করছি… রাস্তার একদিকে ছায়া… অন্যদিকে একটা মিনিংফুল পাথর… মিষ্টি মিষ্টি পাঁউরুটি… ছিঁড়ে ছিঁড়ে… মিষ্টি মিষ্টি কবিতা… ছিঁড়ে ছিঁড়ে… নিজেকে বিরত রাখা… একা একাই একটা স্লোগান… পার হয়ে যাচ্ছে রূপ ও শস্যের মাঝে ছেড়ে রাখা বাদামী অভ্যাস… অথচ, শুধু ক্যামেরা এলেই আমাদের কন্টিন্যুইটির কথা মনে পড়ে… একটা কাঠের স্মৃতি পর্যন্ত এই আঙুল… গতকালকের ঠিক এইসময়ে লেখা স্নানবিষয়ক কবিতা আজকেও একইরকম ভেজা ভেজা হয়ে…

নির্বাচন জিনিসটা ঠিক কী আসলে? মূলতঃ ফ্যাসিস্ট, আধা-ফ্যাসিস্ট ও সিকি-ফ্যাসিস্টদের মধ্যে থেকে কাউকে বেছে নেওয়া। এই বেছে নেওয়াটা যে যার রুচি, বোধ ও অন্ধত্ব অনুযায়ী করে থাকে। এইটুকুই। বিনয় মজুমদারের ‘হায় হাসি হায় দেবদারু / মানুষ নিকটে এলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়’ এইটাকে ভাবতে ইচ্ছে করে ‘হায় টাকা হায় ভালবাসা / কবিতা নিকটে এলে প্রকৃত মানুষ পুড়ে যায়’। ফেসবুকে পোস্ট করি। নীচে ব্র্যাকেটে লিখে দিয়েছিলাম ‘সরি বিনয়বাবু’। তারপর ভয় লাগে। কেন লিখলাম ‘হায় টাকা’? ওটাকে এডিট করে ‘হায় স্নায়ু’ করে দেওয়ার কথাও ভাবি। আবার ভাবি, ধুউউর… পুড়ে গেলে আর টাকাই বা কী আর স্নায়ুই বা কী। এইভাবে আমরা একই সাথে তিন-চারটি সমান্তরাল ও পরস্পরবিরোধী সত্যের মধ্যে অবস্থান করি। এটাই সবথেকে বড় সত্য ও নির্মমতা। কম্যুনিকেশনের বাইরে যে দিনগুলো পড়ে থাকে আর মরে যায়; সেগুলোও, প্যারালালি, সত্য আর নির্মম। এই যে তোমার সঙ্গে অনেকক্ষণ একটা সারাজীবন… কিছু শ্লীল হয়ে চাঁদ ওঠে তারপর… এই যে গতির ভেতর বসে তুমি আর আমি পরস্পরের আঙুল বদলে নিচ্ছি, এটা তো কখনও ঘটেইনি; তা বলে কি এটা সত্য নয়? অবস্থান, বস্তুতঃ, শুধুই একটি চমৎকার ভ্রম নয় কি? অবস্থানহীনতাও তো তাই। হে কাঁচের গভীর দিয়ে চলে যাওয়া একটি নাম, তোমার সাথে থাকতে ইচ্ছা করে। তোমার সাথে মিছিলে হাঁটতে ইচ্ছা করে। মুঠোভর্তিকরা স্লোগান ছুঁড়তে ইচ্ছা করে তোমার সাথে। আজাদি যতই ঝুটা হোক না কেন, স্বীকার করো প্লিজ, আজাদির স্লোগানগুলো কিন্তু সাচ্চা। আজাদির দাবিটা কিন্তু সাচ্চা। এই যেমন, ধরো না কেন, ভূত নেই, কিন্তু ভূতের গল্পগুলো… দাঁড়াও দাঁড়াও, এর চেয়েও ভাল আরেকটা উদাহরণ এক্ষুনি মনে পড়ছে – প্রেম বলে তো কিছু নেই, তবুও, প্রেমের গানগুলো তো আছে বলো, কী ভীষণভাবেই না আছে!

এইসব ক্ষীণ দৃশ্যাবলী। ক্রমে, রাজনৈতিক হইয়া উঠিতে উঠিতে। সদবিম্ব। হে এই সমকাল। হে এই উন্মুখ অধিবৃত্তাকার সময়… ভাল আছি ভাল আছি…

অল্প ভেজা ক্যাম্বিসের কাপড়ের গন্ধ।

একটা ভেঙে ফেলা দুপুর।

নোকিয়া টিউন।

— তুমি এটাকে উপন্যাস বলছ কেন? মানে, ঠিক কী কী কারণে?

(নীরবতা)

(প্রতি-নীরবতা)

— পিসিমার শইলের যা কণ্ডিশন, কহন কী হইয়া যায়…

— আজ মাল খাবই, যা ওয়েদার…

— আরে বাবা, আমি তো জানিই যে আমি ফরাসী জানি না, তুমিও তো জানো আমি ফরাসী জানি না, ব্যস! মিটে গ্যালো! উপন্যাসটা তো আর জানে না যে আমি ফরাসী জানি না!

— দ্যাখো, নকশালরা রাজনৈতিক ভুল হয়ত করেছিল… কিন্তু সেই অর্থে পার্টি লাইনে রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা করেনি কখনও…

— এত যে সরস্বতী সরস্বতী করো, সরস্বতী পুজোটা নিজে করেছ কোনোদিন?

— রাগ আবার কী… আমি ওই শুয়োরের বাচ্চাটাকে ঘেন্না করি… জাস্ট ঘেন্না…

— তুমি কি ওই বাংলাপক্ষ জয়েন করেছ নাকি? নাকি ওই যে আরেকটা নতুন হয়েছে… বাংলা সম্মেলন?

— স্টোভ সারাবেন… জনতা সারাবেন… ব্যাগের চেন সারাবেন… জ্যাকেটের চেন সারাবেন… প্যাণ্টের চেন সারাবেন…

— আরে সেই বিয়েবাড়ি থেকে ফেরার সময় কী কাণ্ড! নোয়াপাড়ায় এসে অটোর জন্য প্রায় চল্লিশ মিনিট দাঁড়ানো…

— চরিত্র কোথায় চরিত্র? এত এত সংলাপ… রাশি রাশি…

— আরে দ্যাখো একবার ওদিকে তাকিয়ে, ঝাঁকে ঝাঁকে কালো বেলুন উড়ে যাচ্ছে…

— আমরা নিজেরাই তো পাশাপাশি নেই… আমাদের সংলাপগুলো পাশাপাশি থাকবে কেন! এরকম এবড়োখেবড়োই থাকুক আর কী… মধ্যে মধ্যে যেখানে সেখানে অন্যদের সংলাপ ঢুকে পড়ে আরও ঘেঁটে দিক ক্রনোলজি ও বোধ্যতা… বরং আমাদের নীরবতাগুলো পাশাপাশি থাকুক… একদম ব্যালান্সাড, সিনক্রোনাইজড…

— ভাই আপনি সিপিয়েম না তো! হলেও রাগ করবেন না যেন, অ্যাঁ? একটা কথা বলি। এইসব চুরিচামারির রাস্তা তো ভাই বামফ্রণ্ট সরকারই দেখিয়ে দিয়ে গ্যাছে…

— আরে! তুমি তো ব্রাহ্মণের ছেলে, পুজো করতে জানো না! অপদার্থ দেখি একেবারে! ওই তো নিত্যকর্ম পদ্ধতি না কী যেন বইটা… ওতেই তো সব লেখা থাকে… কখন ফুল দিতে হয়… কোন হাতে ঘণ্টা ধরতে হয়… সঅঅঅঅব… ব্যাস… দেখে দেখে পুজো করে দেবে… কী এমন ব্যাপার? পৈতেটাও নেই নিশ্চয়ই!

— না, দ্যাখো, ভারতবর্ষের কোনও রাজনৈতিক দলের কাছেই অ্যাতোটা আশা করা কিন্তু আমাদের উচিত না…

— কী কথা তাহার সাথে? তার সাথে! অ্যাঁ?

— মেজাজ খারাপ না তো?

— এয়ারপোর্ট এয়ারপোর্ট… হলদিরাম… বাগুইহাটি… কেষ্টপুর… সোজা বাইপাস সোজা বাইপাস… সায়েন্স সিটি… রুবি… এয়ারপোর্ট এয়ারপোর্ট… খালি গাড়ি…

— চরিত্র… উমমম… চরিত্র… চরিত্র কোথায় পাব বলো… তাছাড়া চরিত্র তো আসলে বড় উদ্বায়ী গো… এর চরিত্র ওর চরিত্রে ওভারল্যাপও করে যায় অনেকসময়… এর চরিত্রে ওর চরিত্র ঢুকে যাচ্ছে, ওর জীবন থেকে এর জীবন বেরিয়ে আসছে… তাকে তুমি রোল-প্লেয়িং বলবে কি না সে আমি জানিনা… কিন্তু সেটা কথা নয়। কথা হল… সংলাপগুলোই আসলে থেকে যায় কোথাও না কোথাও… বা, ধরো, সংলাপগুলোই আসলে চরিত্র… এভাবে ভাবতে পারি? আর… হা হা… আমার নিজের চরিত্রেরই ঠিক ছিল না, অন্যের চরিত্র কী আঁকব? আমার চরিত্রটাই তো আমি নই আসলে…

— সাত ওভারে একুশ রানে এক উইকেট… আজ ইণ্ডিয়া শিওর হারবে…

— ‘নরেন তুমি ফরেনতেলে ভাজা, আদ্যোপান্ত খাজা’… এটা অতীন্দ্রিয়র একটা লেখায় ছিল, জানো। সেদিন স্বদেশ মিশ্র একটা কমেণ্টে লিখেছে কোটেশনের মধ্যে। এই নরেন মানে কে বলতো? বিবেকানন্দ… হে হে… আগেও শুনেছি, অন্য কারো লেখা? সুভো ঠাকুর টাইপের কেউ? কিছুতেই মনে করতে পারছি না। মজাটা হল, এটা শুনলেই সলিল চৌধুরীর ‘ঝিলিক ঝিলিক ঝিনুক খুঁজে পেলাম, তোমায় তা দিলাম’ সুরে গাইতে হবে মনে হয়… গেয়ে দ্যাখো, ‘নরেন তুমি ফরেনতেলে ভাজা, আদ্যোপান্ত খাজা’…

— হেভি বিপ্লবের সুড়সুড়ি, না? ক্যাল খেয়েছ কখনও? ক্যাল খেলে সুড়সুড়ি বল সুড়সুড়ি, চুলকানি বল চুলকানি, সব হাওয়া হয়ে যাবে…

— ‘দিল তো হ্যয় দিল, দিল কা অ্যায়েতবার, কেয়া কিজে / আয়েগা যো কিসিপে পেয়ার, কেয়া কিজে’ … এই গানটা জানো?

— ওওও মাসি, আমি এই ট্রিপটা মেরেই অটো জমা রেখে এসে পনেরোটা রুটি নিয়ে যাব… করে রেখো কিন্তু… এই ধরো আধা ঘণ্টা ম্যাক্সিমাম…

— বিবেকানন্দের জন্মদিন পালনের পোস্টারেও নেতার মুখের এই অ্যাত্তোবড় ছবি… একেবারে অসহ্য এরা…

— নিঃশর্তে বোঝ? আজীবন বোঝ? নিঃস্বার্থভাবে কথাটার মানে বোঝ? আমি নিঃশর্তে তোমায় আজীবন… নিঃস্বার্থভাবে…

— তুমি ঠিক যে যে কারণে এটাকে উপন্যাস বলবে না, আমি ঠিক সেই সেই কারণেই এটাকে উপন্যাস বলে ডাকব। এই ব্যাপারে এটাই আমার ভাষ্য, ধরে নাও…

# * # * #

১) এটিএম যেতে হবে
২) বাদাম দেওয়া শুকনো চিঁড়েভাজা
৩) শসা
৪) পুদিনা পাতা
৫) পাতিলেবু
৬) আমণ্ড

— ভাল কথা, শসা বানানটা…

— উফফ, ছাড়ো তো, এ তো বঙ্গোপসাগর বানান নয় যে, যেহেতু বঙ্গ যুক্ত উপসাগর, ও-কার-টা ঠিক ঙ্গ-এই দিতে হবে…

— হা হা

= = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = =

ডিলেমার কথাটা লিখে রাখি

যন্ত্রণাটা অভ্যাস

নাকি

অভ্যাসটা যন্ত্রণা

= = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = =

(চলবে)

Facebook Comments

Leave a Reply