রাষ্ট্র বনাম দেশবাসী : জারি অঘোষিত যুদ্ধ – মৃন্ময় সেনগুপ্ত

যুদ্ধ দেশের মানুষের বিরুদ্ধে। অঘোষিত যুদ্ধ জারি রেখেছে দেশের সরকার। অবশ্য দেশের সব মানুষের বিরুদ্ধে বলাটা সঙ্গত নয়। বলা ভালো, কার্যত ১ শতাংশ মানুষের প্রতিনিধি সরকার ৯৯ শতাংশ মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে। দেশের ১ শতাংশ অতিমানব(পড়ুন, দানব)দের সম্পদ ৯৫ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষের মোট সম্পদের চার গুণ। প্রায় ১৩০ কোটির দেশে মাত্র ৬৩ জনের মোট সম্পদ কেন্দ্রীয় বাজেটে বরাদ্দ অর্থের থেকেও বেশি। ধনকুবেরদের সম্পদের এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধি কোনো সহজ সরল পথে হয় না। হয় দেশের সিংহভাগ মানুষকে আরও রিক্ত,দরিদ্র করে। ১ শতাংশের শাইনিং ইন্ডিয়ার পাশে সাম্রাজ্য বিস্তার করে অন্ধকার ভারত। ক্ষুধা,দারিদ্র্য,বেকারত্ব,অশিক্ষা আর মৃত্যু মিছিল নিয়ে পেছন দিকে এগিয়ে চলা ভারত। ২০১৯ সালের বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১১৭ টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান হয় ১০২ নম্বরে। প্রতিবেশী বাংলাদেশ,পাকিস্তান,নেপালের থেকেও পিছিয়ে। বিশ্ব মানব উন্নয়ন সূচকে ১৮৯ টি দেশের মধ্যে ভারত ১২৯ তম স্থান লাভ করে। দেশে মারা যাওয়া পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৬৯ শতাংশের মৃত্যুর কারণ অপুষ্টি। সরকারের নীতিতেই বৈষম্য বেড়ে চলে। দেশ-বিদেশের কর্পোরেট সংস্থাগুলির মুনাফা বাড়ানোর লক্ষ্যেই আমজনতার বিরুদ্ধে শাসকের এই যুদ্ধ।
আরও বেশি সংখ্যক মানুষকে ফালতু আদমিতে পরিণত করার সেই যুদ্ধই বিকাশের মিথ্যা ফানুসটাকে একসময়ে চুপসিয়ে দেয়। আর্থিক বিকাশের আলো ঝলমলে চিত্র বিবর্ণ হতে থাকে। আর্থিক মন্দা গ্রাস করে জাতিকে। এখন আর বিকাশ, কর্মসংস্থানের মিথ্যে গপ্পোগুলোকে গেলানো যাচ্ছে না। কাজ পাওয়ার বদলে ছাঁটাই হওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বেঁচেবর্তে থাকার অনিশ্চয়তা আতঙ্কের জন্ম দেয়। আতঙ্কের নির্মাতা স্বয়ং রাষ্ট্র। দেশের মানুষের কাছে বিদেশি আক্রমণ নয়, সবচেয়ে বেশি আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে সরকারের আর্থিক নীতি। মানুষের প্রকৃত আয় কমলেও, সরকার তাদের আয় বাড়ানোর কথা ভাবছে না। বরং কর ছাড়, সুদের হার কমানো, সরাসরি আর্থিক সাহায্যের নামে কর্পোরেটগুলিকেই সাহায্য করে চলেছে। সেই অর্থ পুঁজি হিসেবে বিনিয়োগ করা হয়, শেয়ার বাজারসহ নানা ফাটকা কারবারে। তাই আর্থিক বিকাশের হার তলানিতে চলে গেলেও, শেয়ার সূচক বেড়েই চলেছে। মন্দা সত্ত্বেও মুকেশ আম্বানির সম্পত্তি বেড়েছে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার। গৌতম আদানির প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। সরকার আয় বাড়ানোর নামে একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেচে দিচ্ছে। পরোক্ষ কর বাড়িয়ে চলেছে। আর ব্যয় কমানোর নামে কোপ পড়ছে আমজনতার ভর্তুকিতে, নানা সরকারি প্রকল্পে।
সরকারের জারি করা এই যুদ্ধে জীবন-জীবিকার অনিশ্চয়তার জন্য আত্মহত্যার ঘটনা বেড়ে চলে। দেনার দায়ে কৃষক আত্মহত্যা, কাজ হারানো শ্রমিকের আত্মহত্যা সবই কেমন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্র তাকে সাজানো ঘটনা বলে গেলাতে চায়। এখন কৃষক, শ্রমিক আত্মহত্যাকেও ছাপিয়ে গেছে যুবকদের আত্মহত্যা। ২০১৮ সালের হিসেবে এদেশে প্রতিদিন গড়ে ৪১ জন যুবক আত্মহত্যা করে। সারা বছরে সংখ্যাটা ২৬ হাজারেরও বেশি। এরমধ্যে স্বনিযুক্ত যুবক ১৩ হাজার ১৪৯ জন আর বেকার ১২ হাজার ৩৯৬ জন। বড় পুঁজি গিলে খায় ছোট পুঁজিকে। স্বল্প পুঁজি নিয়ে কারবার চালাতে না পেরে যুবকদের আত্মহননের পথ বেছে নিতে হয়। এদিকে দেশের প্রধানমন্ত্রী আর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পকোড়া, চপ, ডালের বড়া ভেজে বহুতল বাড়ি তৈরির জ্ঞান বিলি করে চলেছেন। পুঁজির দালালি করতে গিয়ে এরা এতটাই নির্লজ্জ। ভারতের জনসংখ্যার বড় অংশ যুবক। কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বেশি হলে অর্থনীতিতে তাকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলে। শব্দটা পুঁজি বান্ধব। পুঁজির কাছে যেটা পৌষ মাস, সেটাই আমজনতার কাছে সর্বনাশ। কর্মপ্রার্থী বেশি হলে, কম মজুরিতে খাটানো যাবে। তৈরি হয় সস্তা শ্রমের বাজার। ২০১৭ সালের হিসেবে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী যুবকদের মধ্যে ৩০ শতাংশেরও বেশি বেকার। কাজের সুযোগ ক্রমশ কমছে। স্বাভাবিকভাবেই এই হার এখন বেড়েছে। যেমন এক বছরের মধ্যে আরও বেড়েছে যুবক আত্মহত্যার ঘটনা।
সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে শাসক আইন করে স্থায়ী কাজকেই লাটে তুলতে চায়। কেবল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানই নয়, সরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রেও শ্রমের বাজার সস্তা করা হচ্ছে। সমকাজে সমবেতনের আদালতের নির্দেশ কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্য সরকারই মানে না। মাসের পর মাস অস্থায়ী ও প্রকল্প কর্মীদের বেতন বকেয়া রাখা হচ্ছে। একদিকে শ্রমিকের দক্ষতা বাড়ানোর কথা বলা হয়, অপরদিকে পুঁজির স্বার্থেই শিক্ষার অধিকারটা ধীরে ধীরে কেড়ে নেওয়া হয়। ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ কেবল শিল্পপতিদের আর্থিক লাভই দেয় না, শাসকশ্রেণী এরমধ্যে রাজনৈতিক লাভও খুঁজতে থাকে।
ছাত্র-যুবদের ক্ষোভ, অসহায়ত্ব, হতাশাকে মূলধন করে ফ্যাসিবাদী রাজনীতির জমি প্রস্তুত হতে থাকে। পুঁজি বনাম আমজনতার যুদ্ধটাকে আড়াল করতে নির্মিত হতে থাকে আরেক যুদ্ধক্ষেত্র। নির্মিত হয় গৃহযুদ্ধের উর্বর জমি। কে শত্রু সেটা গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ থেকে শুরু করে অপর ধর্ম,ভাষা,জাতের মানুষ সবাইকে শত্রু বলে ভাবানো হচ্ছে। বিগত ছয় বছর ধরে সেই যুদ্ধক্ষেত্র ক্রমশ বিস্তৃত হয়েছে। খিদের জ্বালা ভুলে খাদ্যকে কেন্দ্র করে মানুষ মেরে ফেলা হয়েছে। গুজব রটিয়ে গণপিটুনিতে মারা হয়েছে বৃদ্ধ থেকে বালককে। লাভ জেহাদের নামে মানুষ মেরে ইন্টারনেটে সেই হত্যার দৃশ্য প্রচার করা হয়েছে। ঘাতকদের পক্ষে মিছিল হয়েছে। কাশ্মীরে বালিকাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে উল্লাসে মেতে উঠেছে একদল মানুষ। ধর্ষকদের মুক্তির দাবিতে জাতীয় পতাকা নিয়ে মিছিলও হয়েছে। জাতীয় পতাকার এমন অপমান ভারত অতীতে দেখে নি। সবই হয়েছে দেশপ্রেমের নামে। আক্রান্ত হয়েছে একের পর এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রতিবাদ আর দেশদ্রোহিতা হয়ে গিয়েছিল সমার্থক। দেশের সংবিধান লঙ্ঘন, আইন না মানাই হয়ে উঠেছিল দেশপ্রেমের নমুনা। সংবিধান বিরোধীরাই পাচ্ছিল বীরের মর্যাদা।
কেবল সরকার নয়, আমলাকুল, বিচার ব্যবস্থা, মিডিয়া – সবই চলছিল এক সুরে, এক তালে। গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলির এই অবনমন সৃষ্টি করছিল এক সামাজিক নৈরাজ্যের। গণতন্ত্রকে দুর্বল করে জমি পাকাপোক্ত করছিল কর্পোরেটতন্ত্র। গণপিটুনিতে হত্যা, এনকাউন্টারে খুন, বেপরোয়া নারী নির্যাতন, দেশের সম্পদ কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়া, আর্থিক মন্দাকে বেমালুম অস্বীকার করা – সবকিছুই চলছিল রাষ্ট্রের মর্জিমাফিক। রাম মন্দির-বাবরি মসজিদ সংক্রান্ত মামলায় বিচারপতিদের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে রায়ের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। মনে হচ্ছিল, ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু’ এই ভাববাদী দর্শনেই আগামী দিনে চলবে দেশ। আবার সেই বিচারব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা এনকাউন্টারে হত্যাকে দিয়েছিল বৈধতা। খোদ রাষ্ট্রনেতা থেকে আমজনতা মেতে উঠেছিল উৎসবে। সেই উন্মাদনায় আমরা ভুলে গিয়েছিলাম, এভাবে অভিযোগ প্রমাণের আগেই হত্যার পরিণাম আগামী দিনে ভয়ঙ্কর হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী-ছাত্ররা আজাদির স্লোগান তুললে, ব্রিটিশ আমলে রচিত রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দেওয়া হয়। আদালত চত্বরেই প্রতিবাদী ছাত্র নেতা আইনজীবীদের হাতে আক্রান্ত হোন। আইনজীবীদের বিরুদ্ধে যে দিল্লী পুলিশ বিদ্রোহ করে, সেই পুলিশই ক্যাম্পাসের ভেতরে ছাত্রী-ছাত্রদের ওপর আক্রমণ করে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রী-ছাত্র আক্রমণে মদত দেয়, অপরাধীদের আড়াল করে। সবকিছুই চলছিল বিকৃত ছন্দ মেনে।
মিডিয়াও নিরপেক্ষতার মুখোশটা খুলে তার সঙ্গে সুর মিলিয়েছিল। প্রচার চলছিল প্রধানমন্ত্রী যা বলেন, তাই নাকি করেন। প্রশ্ন ওঠেনি সরকারের দাবি অনুসারে বেকারত্বের হার শূন্য আর আর্থিক বিকাশের হার দশ শতাংশ হওয়ার কথা। অথচ কেন বেকারত্বের হার প্রায় আট শতাংশ আর আর্থিক বিকাশের হার চার শতাংশ হল? ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়ায়’ কেন যখন তখন যত্রতত্র ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করা হয়? নোটবন্দির যুক্তিগুলি ব্যর্থ প্রমাণিত হওয়া এবং আর্থিক মন্দার অন্যতম কারণ হওয়ার পরেও সরকার কেন নির্লজ্জ? বিদেশ থেকে কালো টাকা ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরেও, কেন সরকার এখন সুইস ব্যাঙ্কে টাকা রাখা ভারতীয়দের নাম গোপন করছে? ৯৯ শতাংশ মানুষকে বিপন্ন করে ১ শতাংশকে সম্পদশালী হলে সব কা সাথ সব কা বিকাশ কোথায় হচ্ছে? প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন, সরকার তার উল্টো করছে। অথচ, মিডিয়া নির্লজ্জ মিথ্যাচার করে চলেছে।
সাধারণ মানুষের আপাত নিঃস্পৃহতা ক্রমশ বেপরোয়া করে তুলছিল রাষ্ট্রকে। মনে হচ্ছিল, দেশের সংবিধান বদলে যাওয়া বুঝি কেবলই সময়ের অপেক্ষা। গডসেকেই বোধহয় আগামী দিনে জাতির জনক বলতে হবে। বেপরোয়া হয়েই এন আর সি আর নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনকে ওরা সামনে এনেছিল। গৃহযুদ্ধের উস্কানি। বিশ্বব্যাপী দক্ষিণপন্থার সঙ্গে যার মিল চোখে পড়তে বাধ্য। ইসলামোফোবিয়া আর অনুপ্রবেশের সমস্যাকে মূলধন করে রণহুঙ্কার। মনে করেছিল, ধর্ম আর ভাষার নামে দেশবাসীকে নিজেদের মধ্যে আরও লড়িয়ে দেওয়া যাবে। ধর্মভিত্তিক নাগরিকত্বের আইন হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্ন বাস্তব করবে। ভাষাগত বিরোধ হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের ডাককে সফল করবে। কিন্তু ঠিক এখান থেকেই খেলাটা ঘুরতে শুরু করল। সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বদলে সাধারণ মানুষের ঐক্য গড়ে উঠল। সংঘ পরিবার তো বটেই, বিরোধী দলগুলিরও কাছে যা ছিল স্বপ্নের অতীত। আগে থেকেই প্রতিবাদ যে হচ্ছিল না তা নয়। ক্যাম্পাসে লড়াই চলছিল। রাজ্যে রাজ্যে কৃষক আন্দোলন গড়ে উঠছিল। সংখ্যালঘু-দলিতদের ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টাও চলছিল। কিন্তু কোনোটাই দেশব্যাপী দানা বাধছিল না। তবে এসবই প্রস্তুত করছিল আজকের দেশব্যাপী লড়াইয়ের জমি। যুদ্ধটা আর একতরফা থাকছে না। দেশবাসীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে গড়ে উঠছে প্রতিরোধ। গৃহযুদ্ধের চরিত্রটাই আজ যাচ্ছে বদলে।
দীর্ঘদিনের জমে থাকা যন্ত্রণা, মনের গভীরে পুষে রাখা রাগই আজ নেমে এসেছে রাজপথে। দিল্লির শাহিনবাগে মা রেহানা খাতুনের সঙ্গে কনকনে ঠাণ্ডায় রাস্তায় থাকে শিশুকন্যা আশিয়ানা। যার বয়স এক মাসেরও কম। উত্তরপ্রদেশে চোদ্দ মাসের কন্যা আর্যাকে কয়েক সপ্তাহ বাবা-মায়ের সঙ্গ ছাড়া হতে হয়। তার বাবা-মা সি এ এ বিরোধী আন্দোলন করায় জেলে গিয়েছিলেন। পরে জামিন পান। এভাবে অজান্তেই ভবিষ্যতের নাগরিক আশিয়ানার সঙ্গে আর্যার মেলবন্ধন ঘটে যায়। আমাদের মনে পড়ে যায়, পিতার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকা আসামের শিশুর কথা। মেক্সিকো থেকে অনুপ্রবেশ করেছে বলে সন্তানদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে মায়েদের জেলে রাখার ঘটনা। রেহানা খাতুনরা রাত জাগেন, সঙ্গে থাকেন নব্বই বছরেরও বেশি বয়সের বৃদ্ধা। শাহিনবাগের অবস্থানে শিখরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। কাশ্মীরি পণ্ডিতরা আসেন। শাহিনবাগ ছড়িয়ে পড়ে কলকাতার পার্ক সার্কাস,এলাহাবাদ,লক্ষৌ,গয়ায়…। পার্ক সার্কাস গেয়ে উঠছে: ‘রঘুপতি রাঘব রাজা রাম’। এভাবেই সঙ্ঘ পরিবারের রামকে নিয়ে হিংস্রতার জবাব দিচ্ছেন মানুষ। ক্যাম্পাসের আজাদির স্লোগান আজ মাতিয়ে তুলছে গ্রামীণ ভারতকে। জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে দাঁড়াচ্ছে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মানব বন্ধন যখন গাইছে: ‘দারুণ বিপ্লব-মাঝে তব শঙ্খধ্বনি বাজে’, তখন দেশের আরেক ক্যাম্পাসে গাওয়া হচ্ছে ফইজ আহমেদ ফইজের ‘হাম দেখেঙ্গে’। সেই গানে দেশদ্রোহের উপাদান আছে কিনা তা দেখার জন্য তদন্ত কমিশন গঠন করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই উপমহাদেশ, তার ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ ‘দেশপ্রেমিক’রা যখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে, তখন এমনই হয়। দেশ সম্পর্কে বিশেষ অজ্ঞরাই আজ রাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞ। পাকিস্তানের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রচিত এই উর্দু গান শঙ্কিত করে এদেশের স্বৈরাচারী শাসককে। ফইজ আহমেদ ফইজকে পাকিস্তানের সরকার দেশদ্রোহী বলে জেলে ভরেছিল। ভারতের হিন্দু তালিবানদের আচরণের সঙ্গে পাকিস্তানের শাসকের আচরণে কোনো পার্থক্য নেই।
আন্দোলন নিয়ে এসেছে প্রতিবাদের এক অন্য ভাষ্য। যেখানে জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠে আন্দোলনের হাতিয়ার। যারমধ্যে থাকে আবেগ, স্বতঃস্ফূর্ততা, থাকে না সিনেমা হলে উঠে দাঁড়ানোর বাধ্যবাধকতা। জাতীয় পতাকা নিয়ে মিছিল হয় নগরের রাজপথ থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম – সর্বত্র। যেখানে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রমাণের চাপ থাকে না, থাকে শাসককে সবক শেখানোর প্রতিজ্ঞা। উঠে আসে নতুন নতুন স্লোগান। ক্যাম্পাস থেকে অবস্থান মঞ্চ হয়ে যা ছড়িয়ে যায় খেলার মাঠে। লাল পতাকায় ফুটে ওঠেন ভগৎ সিং, মাস্টার দা, প্রীতিলতারা। অনুপ্রেরণা যোগায় স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবী ইতিহাস। যেখানে মৌলানা হসরত মোহানির ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’কে স্লোগান হিসেবে জনপ্রিয় করেছিলেন শহিদ ভগৎ সিং। আজকের লড়াইয়ে উঠে আসেন শহিদ রামপ্রসাদ বিসমিল, আশফাকউল্লা, আজাদ হিন্দ বাহিনীর শাহ নওয়াজ খানেরা। আজাদি শব্দ নিয়ে সঙ্ঘীদের খুব আপত্তি। শব্দটা নাকি বিদেশি। ওরা জানে না অথবা আড়াল করে রাসবিহারী, সুভাষ চন্দ্রের আজাদ হিন্দ বাহিনীর কথা, বিপ্লবী চন্দ্রশেখর আজাদের কথা। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই শব্দটা ছিল খুবই জনপ্রিয়।
সি এ এ, এন আর সি বিরোধী আন্দোলন মিলে যায় ছাত্রী-ছাত্রদের ফি বৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে, জল,জম,জঙ্গল,খনি বাঁচানোর লড়াইয়ের সঙ্গে। জে এন ইউ’র ওপর হামলা যাকে আরও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ করে। ৮ জানুয়ারির সাধারণ ধর্মঘটের সাফল্য অনুপ্রেরণা দেয়। মোদির বাংলা সফরের প্রতিবাদ তাকে আরও সঙ্ঘবদ্ধ করে। উঠে আসছে আন্দোলনের অজস্র মুখ। মহিলা ও ছাত্রী-ছাত্ররাই হয়ে উঠেছেন চালিকাশক্তি। জীবনে কোনোদিনও রাজনৈতিক কাজে অংশ না নেওয়া মানুষও চলে আসছেন নেতৃত্বে। আন্দোলন শাসক-বিরোধী পক্ষের প্রচলিত ধারণাটাকেও নস্যাৎ করে দিয়েছে। সংসদীয় রাজনীতির বিচারে শাসক-বিরোধী পক্ষ বলে যাদের দেগে দেওয়া হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের মধ্যে নীতির প্রশ্নে মৌলিক পার্থক্য থাকে না। সাধারণভাবে অকথিত ঐকমত্য গড়ে ওঠে। আজকের আন্দোলন সেই ছকটাকেই ভেঙ্গে দিয়েছে। উত্তরপ্রদেশে তীব্র রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মোকাবিলা করে মানুষ যখন লড়ছে তখন, প্রধান বিরোধী দুটি দলের নিষ্ক্রিয়তা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে এন আর সি বিরোধী আন্দোলনকে নিজেদের একচেটিয়া বলে মনে করেছিল শাসক দল। ধামাধরা মিডিয়াও সেই প্রচার এখনও করে চলেছে। কিন্তু সাধারণ ধর্মঘট ও মোদির রাজ্য সফরকে কেন্দ্র করে রাজ্য সরকারের ভূমিকায় সত্য সামনে চলে এসেছে। বিজেপি ও তৃণমূল দুটি দলই পরিচয় সত্তার রাজনীতিকে সম্বল করে নির্বাচনী ঘুঁটি সাজাতে ব্যস্ত। হিন্দুত্ববাদীরা যত সক্রিয় হবে তত, সংখ্যালঘুদের রক্ষক হিসেবে তৃণমূলও ভোট ব্যাঙ্ক অটুট রাখতে পারবে। তার সঙ্গেই শুরু হয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনীতি। যেমন ভাবে অসমিয়া জাতীয়তাবাদ উত্তর-পূর্ব ভারত জুড়ে গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে রেখেছে তেমনই এই রাজ্যে করতে চায় তৃণমূল। পোষা মিডিয়া দিয়ে তাই প্রচার চলে, তৃণমূলই এই আন্দোলনের প্রধান মুখ। এখন কিন্তু তীব্র গণআন্দোলনে তৃণমূলের আর নিয়ন্ত্রণ থাকছে না। আন্দোলনে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মেলবন্ধন ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতিকে আপাতত দুর্বল করেছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনীতিও অনেকখানি জমি হারিয়েছে। আন্দোলনের স্লোগানে, গানে উঠে আসছে হিন্দি,উর্দু। আসলে পথই পথ চেনাচ্ছে। কোনো বৈঠকি সভা বা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি নয়, নিচুতলা থেকেই কৌশল রচিত হচ্ছে।
যদিও রাষ্ট্র যে পিছু হটবে না, সেটাও পরিষ্কার। সে এখন সবকিছু গুলিয়ে দিতে চায়। শত্রুপক্ষকে (পড়ুন আমজনতা) নতুন নতুন আক্রমণের মুখে ফেলতে চায়। এন আর সি থেকে এখন সি এ এ নিয়েই তাদের বেশি লম্ফঝম্প। এখন এন আর সি নিয়ে ধমক, চমক কিছুটা স্তিমিত। আসামের এন আর সি তালিকায় ঠাঁই না পাওয়া উনিশ লক্ষেরও বেশি মানুষ চরম অনিশ্চয়তায়। মানুষের অবস্থা এখন শাঁখের করাতের মতো। এন আর সিতে আবেদন করতে গেলে প্রয়োজনীয় নথি চাই। নথি না থাকলেই বিপদ। আবার সি এ এ অনুসারে আবেদন করার অর্থই হল নিজেকে অনুপ্রবেশকারী বলে স্বীকার করে নেওয়া। সাধারণ মানুষের শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা। মানুষকে এই বিভ্রান্তির মধ্যেই রাখতে চায় কেন্দ্র। আর রাজ্য সরকার ঘন ঘন অবস্থান বদলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চায়। এন পি আর নিয়ে বছর খানেক আগে থেকেই বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করে রাজ্য সরকার। দেখে মনে হয়, বিজেপির থেকেও তৃণমূলের উৎসাহ বেশি। তারপর চাপে পড়ে এন পি আর স্থগিত রাখল। এখন আবার বিভিন্ন পৌরসভা কায়দা করে সেই কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। পঞ্চায়েতে সেই কাজ করা আরও সুবিধেজনক। সহজে ধরা যায় না। ডিটেনশন ক্যাম্প নিয়ে এত প্রচার, এত অর্থ বরাদ্দের পর এখন কেন্দ্র তার অস্তিত্বই অস্বীকার করছে। অথচ ২০১৯ সালেই কেন্দ্র এই ক্যাম্প সংক্রান্ত ম্যানুয়াল রাজ্য সরকারগুলিকে পাঠিয়েছিল। এই রাজ্যেও ডিটেনশন ক্যাম্পের কাজ শুরু হয়েছিল। আপাতত স্থগিত হলেও, আগামী দিনে কাজ শুরুর আশঙ্কা রয়েই গেছে।
আন্দোলন যত সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছে, তত আক্রমণ বাড়ছে। রাষ্ট্রীয় দমনের সঙ্গে রয়েছে মিথ্যা খবর গেলানোর চেষ্টা। উত্তরপ্রদেশে অবস্থান থেকে কম্বল, খাদ্য তুলে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। বাংলায় ছাত্র অবস্থানে বসলে, তাঁর বাবাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তারই সঙ্গে সি এ এ’র পক্ষে চলছে মিথ্যা প্রচার। ভুল পরিসংখ্যান যার অন্যতম অস্ত্র। এরইমধ্যে জন্ম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বাজার গরম শুরু হয়েছে। এন আর সি, সি এ এ, আগামী দিনে জন্মনিয়ন্ত্রণ আইন বা অন্যকিছু – রাষ্ট্রের ছলাকলার শেষ নেই। একের পর এক ইস্যু সামনে নিয়ে এসে আসল খেলাটা আড়ালে রাখার চেষ্টা হবে। ওদের এই খেলাটাকে ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে আসল কাজ। আজকের গণ আন্দোলনকে সেই কাজটাই করতে হবে। দাবি উঠুক, বছরে দুই কোটি বেকারের চাকরির হিসেব সরকারকে দেখাতে হবে। মন্দায় কোটি কোটি টাকা কর্পোরেটগুলিকে দেওয়া হয়েছে। সেই অর্থ কতটা দেশের কল্যাণে লাগল, আর কতটা শিল্পপতিদের সম্পদ বাড়ানোর কাজে লাগল তার কাগজ সরকারকে দেখাতে হবে। ব্যাঙ্কের সুদ কমিয়ে কত বিনিয়োগ বাড়ল, বিনিময়ে সাধারণ মানুষের কত ক্ষতি হল সেই হিসেবের কাগজ সরকারকে দেখাতে হবে। কত কোটি কালো টাকা বিদেশে গেল আর বিদেশ থেকে দেশে এলো তার কাগজ সরকারকে দেখাতে হবে। কারা টুকরে টুকরে গ্যাং সেই কাগজ সরকার দেখাতে পারে নি। কাগজ চাইতে হবে রাষ্ট্রের থেকে। প্রশ্ন করতে হবে রাষ্ট্রকে। কর্পোরেটতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধটাকে না নিয়ে যেতে পারলে, গণতন্ত্রকে বাঁচানো যাবে না। সংবিধান,গণতন্ত্র বাঁচানোর লড়াইকে পুঁজি বিরোধী লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত করলেই এই যুদ্ধে জিতবে আমজনতা।

[লেখক – একজন রাজনৈতিক কর্মী।]

Facebook Comments

Leave a Reply