ফ্যাসিবাদ : আজকের পরিসরে ফিরে দেখা – কৌশিক চট্টোপাধ্যায়
গোড়ার কথা –
শাসকের দেশদ্রোহী ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়াটা নতুন নয়। এটা কোনো হঠাৎ করে প্রকাশ পাওয়া ঘটনাও নয়। ইতিহাসের পর্যালোচনায় দেখা যায় যে ফ্যাসিবাদের উন্মেষের সঙ্গে পুঁজিবাদের সঙ্কটের একটা সম্পর্ক আছে। সংসদীয় নির্বাচনী ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের অনিশ্চয়তাকে বর্জন করে কর্তৃত্ববাদী পুলিশী শাসনের দমনমূলক প্রতিষ্ঠানকে ফ্যাসিবাদ ধরে নিলে আজ কিছুটা ভুল হয়। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার পরিচালকগণ যে ধরনের বাঁধার মুখোমুখি হন, সেই চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করার রাজনৈতিক হাতিয়ারের নাম ফ্যাসিবাদ।
ফ্যাসিবাদ অবশ্যই একটা দমনমূলক রাজনৈতিক পন্থা। এটা পুঁজিবাদের নিজস্ব ধরনের একটা প্রবণতা। টিঁকে থাকার কৌশল। গত শতাব্দীর তিনের ও চারের দশকে এই পথেই ইউরোপের বহুদেশ তার ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটিয়েছিল। ইতালিতে বেনিতো মুসোলিন, জার্মানিতে অ্যাডল্ফ হিটলার, স্পেনে ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো, পর্তুগালে আন্তোনিও দ্য অলিভিয়েরা সালাজার, ফ্রান্সে ফিলিপ পেতেইন, হাঙ্গেরিতে থিকলস্ হোর্থে, রোমানিয়ায় ইয়ন আন্তোনেস্কুম এবং ক্রোশিয়ায় আনতে পাভেলাস্ক। অনেক নাম, অনেক দেশ।
এই সকল দেশে পুঁজিবাদের সমান প্রসার ঘটেনি। আবার সকল ক্ষত্রেই ফ্যাসিবাদী শাসকের জন্মও একই পথ ধরে হয়নি। তাদের উত্থানের ইতিহাসেও বৈচিত্র্য ছিল।
ফ্যাসিবাদী বৈচিত্র্য –
সেই বৈচিত্র্যের মাঝে, এই সকল শাসকের একনায়কতন্ত্রী রাজনৈতিক শাসনের সমীকরণে, দুটো সাধারণ বৈশিষ্ট্য আমরা দেখতে পাই।
এক, সকল শাসনেই শাসক তার সরকার ও সমাজকে যে পথে চালনা করার চেষ্টা করে তার সঙ্গে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মৌলিক নীতিগুলির কোন বিরোধ নেই। কোথাও দেখা যায় না যে ব্যক্তিগত মালিকানানির্ভর পুঁজিবাদী সম্পত্তি ফ্যাসিবাদের অপছন্দের তালিকায় আছে। এই পছন্দ কেবলমাত্র একটা পুঁজিবাদী সমাজের রাজনৈতিক পরিচালনার প্রতিস্পন্দনেই সীমায়িত থাকে না, তা একটা আধিপত্যশালী পুঁজি প্রতিষ্ঠা করতে ফ্যাসিবাদী সমাধানকে বাস্তবায়িত করে, যেখানে হিংসা এবং তীব্র সামাজিক সংকট অনিবার্য হয়। সংকট সৃষ্টি হল ফ্যাসিবাদের অনিবার্যতা।
দুই, পুঁজিবাদী সমাজকে পরিচালনা করতে ফ্যাসিবাদ গণতন্ত্রকে সবার আগে পরিত্যাগ করে। গণতন্ত্র ধ্বংসের সেই কাজটাকে রাজনৈতিকভাবেই নতুন সংজ্ঞা সহযোগে করা হয়। এই নতুন সংজ্ঞা সেই সব ধারণাকে বদলে দিতে চায় যেখানে মতামতের বৈচিত্র্য, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সংখ্যাগুরুর মতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। জাতিগত বা ধর্মীয় সংখ্যালঘুর অধিকারকে নিশ্চিত করার বিপক্ষে এখানে দেশের ভালো করার নামে গণতন্ত্রের অবলুপ্তি ঘটানো হয়। মূল্যবোধের পরিমাপে এই নতুন সংজ্ঞা “সকলের স্বার্থ” উল্লেখের উল্লাসে নিষ্প্রয়োজনের আইনি আয়োজন অনুভবে বদলে যায়। উগ্র জাতীয়তাবাদের মতাদর্শে ফ্যাসিস্ট শক্তি সমাজের পরিচালক হয়।
এই দুই বৈশিষ্ট্যের নিরিখে আমরা যদি ইউরোপের আধুনিক ইতিহাসের পর্যালোচনাকে পুনরায় তুলে ধরি, তবে চারটি ভাগে আমরা ফ্যাসিবাদকে দেখতে পারি।
এক, ফ্যাসিবাদ যেখানে প্রভাবশালী কর্তৃত্বমূলক পুঁজিবাদী ক্ষমতায় বলীয়ান –
নাৎসি জার্মানীর কথা ভাবুন। ১৮৭০-এর পর থেকে জার্মানীতে শিল্পের দ্রুত বিকাশ, প্রতিযোগী ফ্রান্স ও গ্রেট বিটেনের কর্তৃত্বশালী ক্ষমতাকে তারা চ্যালেঞ্জ জানায়। ১৯১৮র পর সেই জার্মানী যখন জাতীয়তাবাদী হিন্দোলে একচেটিয়া পুঁজিবাদের প্রয়াসকে নিশ্চিত করতে চায় তখনই শত্রু চিহ্নিতকরণে ক্ষমতা লাভের পথ খোঁজে কর্তৃত্ববাদী পুঁজিবাদ। এই একই বর্গে জার্মানীর সঙ্গে জাপানের কথা এখানে বলা যেতে পারে। ১৮৯৫ থেকে জাপানে আধুনিক পুঁজিবাদের প্রসার দ্রুত ঘটতে শুরু করে। আপাতভাবে উদারনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আশ্রয় করে জাপানে ফ্যাসিবাদের উন্মেষ ঘটে। সেটি তার সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের ভ্রূণ। আধুনিকতার নামে সামরিক শাসনের সাহায্যে গোটা পূর্ব এশিয়ার দখল সে চায়।
দুই, ফ্যাসিবাদ যেখানে দ্বিতীয় সারির পুঁজিবাদী ক্ষমতায় বলীয়ান –
ইতালিতে মুসোলিনির উত্থানের কথা এখানে ভাবা যেতে পেরে। সাবেকী অভিজাততন্ত্রের আঁচে নতুন বুর্জোয়া সম্প্রদায় যখন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংযোগকে সেঁকে নিল তখনই দক্ষিণপন্থী মতাদর্শের দাপাদাপি হিসেবে ফ্যাসিবাদকে দেখা গেল। লক্ষ্য হল প্রথমে ইউরোপ, এবং পরে সমগ্র বিশ্বের ওপর প্রভাব বিস্তার করা। এই বর্গেই আমরা পর্তুগালের সালাজার এবং স্পেনের ফ্রাঙ্কোর ফ্যাসিবাদী রূপকে বসাতে পারি। একটা সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী ব্যবস্থাকে ভেঙে ক্যাথলিক চার্চের পৃষ্ঠপোষকতায় শাসক হিসেবে দক্ষিণপন্থী একনায়কতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা এই দুই ক্ষেত্রেই হয়েছে। এবং এই বর্গে পুঁজির বিকাশে রাজনৈতিক পন্থা সহযোগী হয়েছে।
তিন, ফ্যাসিবাদ যেখানে পরাজিত ক্ষমতাসমূহের ব্যবহারে বলীয়ান –
ফ্রান্সে সামরিক শাসন ব্যবস্থার পরিচালনা রাজনীতির সংসর্গে পরাজিত ক্ষমতাকে ব্যবহার করে ফ্যাসিবাদকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ফ্রান্সের উচ্চ শ্রেণী পপুলার ফ্রন্টের তুলনায় জার্মানীর হিটলারকে বেশী পছন্দ করতো। সেই পথ চারের দশকে ত্যাগ করে জাতীয় বিপ্লবের নামে বিপ্লবী দলগুলিকে একত্রিত করে ফ্যাসিবাদী উচ্চাভিলাষী কর্মসূচী পালিত হয়। পরের পর্বে ন্যাটোর সদস্য হয়ে কমিউনিস্ট নিধনের পথ খোলা হয় ফ্যাসীবাদী কায়দায়।
চার, ফ্যাসিবাদ যখন পূর্ব ইউরোপের নির্ভরশীল সমাজে বলীয়ান –
পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে বলকান অঞ্চলের দেশগুলি শিল্পসমৃদ্ধ দেশ। পোলান্ড, রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, গ্রীস যখন পোলিশ শাসকের অধীন ছিল। পশ্চিম ইউক্রেনের অংশও তখন এই অঞ্চলের মধ্যে বিবেচ্য। এই অংশের নির্ভরশীল পুঁজিবাদ নাৎসি জার্মানীর প্রতি তাদের সংসক্তিপ্রবণতা প্রকাশ করে। এই অভিপ্রায় তখন লক্ষ্য করা যায়। যদিও হিটলার তাদের ইহুদী, রোমা অথবা অন্য কোন জাতির রক্ত বিশুদ্ধতায় বিচার করতেন।
রোমানিয়ায় আন্তোনেস্কু, হাঙ্গেরিতে হোর্থে জার্মানীর নেওটা ছিলেন। কমিউনিষ্ট নীতি তাদের নিম্নবর্গীয় মিত্রশক্তি অবস্থানে নাৎসি জার্মানীর সহযোগী করে তোলে। হাঙ্গেরীতে বেলা কুনের পর, এবং রোমানিয়ায় উগ্র জাতীয়তাবাদ বা “শোভিনিজম”, সেই নির্ভরশীল চরিত্রের মধ্যেও ফ্যাসিবাদের বিকাশ ঘটায়। ক্যাথলিক চার্চের ভূমিকা এই ধরনের বর্গীকরণে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়।
দুই বৈশিষ্ট্যের নিরিখে চার ধরনের পরিসরে বেড়ে ওঠা ফ্যাসিবাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি আজও ঘটে। সারা পৃথিবীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে পুঁজি সঞ্চলনের জোয়ার-ভাঁটার প্রেক্ষিতে দেখলে ফ্যাসিবাদের দাত-নখ আমাদের চোখে পড়ে।
আজকের পরিসর ও ভারতীয় ফ্যাসিবাদ –
ফ্যাসিবাদের সর্বজনীন দুই বৈশিষ্ট্যের নিরিখে ভারতবর্ষ আজ ফ্যাসিস্ট শাসনাধীন। বিশ্বায়িত পুঁজিবাদের আজকের অবস্থান “দারিদ্রের আধুনিকীকরণের” নামে সাম্রাজ্যবাদের সংসর্গে ফ্যাসিবাদের বিশ্বজোড়া রূপকে স্পষ্ট করছে। ভারত তারই অংশ। লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা এবং এশিয়ার বিস্তীর্ণ রাজনৈতিক অঞ্চলের মতাদর্শ জাতীয়তাবাদী কল্পনায় দেশের একটা অংশের মানুষকে শায়েস্তা করতে নেমে পড়ে। ময়দান আর্থিক সঙ্কট থেকে পরিত্রাণের পথ হিসেবে দেশের মধ্যে ঘৃণা আর বিদ্বেষ জিইয়ে রাখতে চায়। নির্ভরশীল সমাজে ফ্যাসিবাদের এই রূপ দেখতে ব্রাজিলে বোলসেনারোর শাসন, ভারতের মোদী সরকারকে পাশাপাশি আসনে বসায়। ফ্যাসিবাদী জাতীয়তাবাদ ভ্রান্ত আগ্রাসী ধারণায় বিভাজনের রাজনীতিকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকে।
আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলির সমকালীন শাসন ফ্যাসিবাদের চর্চা জারি রাখে। বিশেষ করে রাজনৈতিক ইসলামী কর্মকান্ড সেই দিকটিকেই চিহ্নিত করে। পাকিস্তান থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে এবং আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে ভ্রাতৃত্ববোধে ইসলাম অনুভূতি “সালাফিস্ট” সংগঠনের মতাদর্শে ফ্যাসিবাদের চর্চা চালায়।
হিন্দুত্ববাদী ভারত সরকার তার আর্থিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক কর্মকান্ডে নয়া-উদারবাদী পুঁজিবাদের প্রসারে সাহায্য করে। রাষ্ট্রের দমনমূলক হাতিয়ারের সাহায্যে নাগরিকের ওপর জুলুম কায়েম করা হয়। সমাজের প্রয়োজনকে বৃহত্তর অলীক কোনো প্রয়োজনের নিরিখে এজেন্ডা খাড়া করা হয়। কিন্তু এই শাসনে কখনই ১) পুঁজিবাদী ধারার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা হয় না; বরং ২) অগণতান্ত্রিক পথে রাজনৈতিক কৌশল ব্যবহারে সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে পুলিশ ও সামরিক শক্তির ব্যবহারকে নিশ্চিত করে তোলা হয়।
ভারতের আর্থিক সঙ্কট, কর্মসংস্থান সংকোচনে তৈরী হওয়া সামাজিক বৈষম্য, ধর্মন্ধতা, বিদ্বেষ, হানাহানির পরিসর যে রাজনৈতিক মতাদর্শকে প্রচালিত করতে চাইছে তা ফ্যাসিবাদের মোলিক ঐ দুই বৈশিষ্ট্যে পরিপূর্ণ। সেই দুই বৈশিষ্ট্যের নিরিখে ভারত চতুর্থ বর্গের ফ্যাসিবাদী রূপকে ক্রমশ স্পষ্ট করছে যা নির্ভরশীল সমাজের পরিসরে ইউরোপে দেখা গিয়েছিল।
নতুন যে প্রশ্নাতীত আনুগত্যের পছন্দ ফ্যাসিবাদে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সেখানে গণতন্ত্রের পরিসরকে মুছে ফেলা সহজ হয়। ‘বিতন্ডাবাদী’ সাংস্কৃতিতে পুষ্ট ভারতীয় সমাজ আজ সেই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে যেখানে কর্পোরেট ক্ষমতাবাণ দেশদ্রোহী দেশের শাসন ক্ষমতাকে পরিচালনা করে। সামরিক বাহিনীর ব্যবহারের ওপর আস্থাশীল হওয়া তাই সরকারের কাছে অতি প্রয়োজন হয়ে পড়ে। একটা সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রের চেহারা নিতে চাইছে আজকের আরএসএস এবং তার রাজনৈতিক অলিন্দে ফেরা বিজেপি শাসিত ভারত সরকার। লক্ষণগুলি ক্রমে যেভাবে স্পষ্ট হচ্ছে এবং তাতে দেখা যাচ্ছে যে সকল ধরনের সংস্থার ওপর রাষ্ট্রের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। গণমাধ্যমের কন্ঠ চেপে ধরে রাষ্ট্রের বিভাজনী কৌশলকে রাজনীতির লক্ষ্যে প্রচারে নিয়ে আসা হচ্ছে। হিন্দুত্ববাদের জোয়ার সেই ফ্যাসিবাদী কায়দাকে ধারালো করছে। হিন্দু রাষ্ট্রের ধ্বনি ফ্যাসিস্ট স্বর। ধর্ম ছাড়া রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদী চিন্তা এখানে বিফল বলে ধরে নেওয়া হয়।
ভারতবর্ষের সনাতনী ঐতিহ্যেও বিরোধী মতের একটা অবস্থান আছে। শাসকের বর্তমান ভূমিকায় সেই ঐতিহ্য ভুলুন্ঠিত। রাষ্ট্র তার বিরোধী মতবাদের প্রতি তীব্র ঘৃণা এবং প্রতিহিংসাপরায়নতায় ভরা আচরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। ‘আরোপিত পরিচিতি’তে দেগে দিয়ে প্রতিবাদীকে বন্দী করা হচ্ছে। দেশ তার নাগরিকদের রক্ষা করার দায় থেকে মুক্ত হয়ে নাগরিকহীন মানুষ তৈরীর কর্মশালায় মেতে উঠেছে। প্রযুক্তির ব্যবহার এমন মাত্রায় করা হচ্ছে যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন একটা স্বতঃসিদ্ধে পরিণত হয়। পুঁজিবাদের সঙ্কট দূর করতেই তা করা হচ্ছে।
শেষের কথা –
আজকের ইসরায়েল, ট্রাম্পের আমেরিকা, অথবা জেলেন্সকির ইউক্রেন, তাদের ফ্যাসিবাদী কায়দায় একই চেহারা প্রকাশ করে। ‘ইউক্রেন শুধু ইউক্রেনিয়ানদের’ – এই উগ্র কমিউনিস্ট বিরোধী জাতীয়তাবাদী আহ্বানের সাহায্যে তিনি মাত্র ৪১ বছর বয়সেই সেখানকার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। আপামর ইউক্রেনবাসীর দৈনন্দিন সমস্যা এতে বেড়ে গেলেও ‘ভালো দিনের’ স্বপ্নে তাদের একটা অংশ নেচেই চলেছেন। ঠিক যেমন প্রকাশ্যেই শ্রমিক ইউনিয়নের ধ্বংস চান যে ট্রাম্প, তাঁকে জেতাতে ইউনিয়ন শ্রমিকরা ভোট দেন। প্রতিষ্ঠিত হয় ‘হোয়াইট সুপ্রিমেসিস্ট’, যা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে কালো মানুষদের সঙ্গে ইহুদিদের মেরে ফেলে। ইসরায়েলে তখন ইহুদি পরিবার থেকে উঠে আসা ন্যায় মন্ত্রী আয়েলেত স্যাকড, গণতন্ত্রটাকেই ফ্যাসিবাদ বলে চিহ্নিত করেন। সাম্রাজ্যবাদী সখ্যতা ফ্যাসিবাদকে এখানে প্রভাবশালী কর্তৃত্বমূলক পুঁজিবাদী ক্ষমতায় বলীয়ান করে।
দক্ষিণপন্থী মতাদর্শের দাপাদাপি মানব ইতিহাসে নতুন নয়। কেন মানুষ মানবতার পথ থেকে চ্যুত হয়ে নতুন ধরনের বর্বরতাকে প্রতিষ্ঠা করে – সেই প্রশ্নের উত্তর, ঐ দাপাদাপি না থাকলে সহজে বোঝা যায় না। রাজনৈতিক ইসলাম শুধুমাত্র প্রাকৃতিক শক্তিকে ভর করে সাম্রাজ্যবাদের দোসর হচ্ছে। ফ্যাসিবাদ এখানে দ্বিতীয় সারির পুঁজিবাদী ক্ষমতায় বলীয়ান। সৌদি আরব, পাকিস্তান সহ উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোকে একই মার্গে রাখা যায়।
বিশ্বজোড়া পুঁজিবাদ তার সঙ্কট কাটাতেই এই ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক হাতিয়ার ব্যবহার করছে। সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ফ্যাসিবাদের নতুন আঙ্গিকে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হচ্ছে যেখানে নতুন সংজ্ঞায় ন্যায্যতা ন্যাটোর অনুমোদনে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। এই ফ্যাসিবাদী কায়দা পরাজিত ক্ষমতাসমূহের ব্যবহারে বলীয়ান হয়। ইউরো ও মার্কিন ডলারের বুক চওড়া হয়।
চতুর্থ বিশ্বের দায় ঝেড়ে ফেলতে এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশীয় সম্পদ লুট করতে, ফিনান্স পুঁজির আস্ফালন ক্রমশ বাড়ছে। এই পন্থায় ব্যবহৃত হচ্ছে রাজনৈতিক হাতিয়ার। ফ্যাসিবাদ তাই আজ বিশ্বজোড়া। এখন আর কোন বিশেষ জাতির গণনিধনে তা সংজ্ঞায়িত হচ্ছে না, প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত সমাজের একটা অংশ আর একটা অংশের প্রতি ঘৃণা ছড়াচ্ছে। বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে পুঁজিবাদের বিস্তার তার নিজস্ব ধরনের সঙ্কটের মোকাবিলায় ফ্যাসিবাদকে যত জোরালো করছে, ততই প্রতিবাদের বিশ্বজোড়া স্বর ঐক্যে মুখরিত হচ্ছে। লোকায়ত দর্শনে ঋদ্ধ ভারতীয় সমাজ আজ সেই বিরুদ্ধ স্বরে কল্লোলিত।
[লেখক –এম. এ, পি এইচ. ডি, সহকারী অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, প্রফেসর নুরুল হাসান কলেজ, ফারাক্কা, মুর্শিদাবাদ। ‘অপরজন’ পত্রিকার সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য।]
Posted in: Cover Story, January 2020
দারুন লেখা। শুভেচ্ছা জানাই
অসাধারণ