সন ২১২১ : গৌতম সরকার

[সন ২১২১, এক মা তাঁর বালক পুত্রকে নিয়ে পথে নেমেছেন, ভারতবর্ষ, ভারতবর্ষের ইতিহাস চেনাবেন…]

পুত্র: মা,এই দেশ বুঝি আমাদের জন্মজন্মান্তরের সুবাতাস,রক্তঋণ…

মা: এইদেশ আমাদের দীর্ঘ কর্মফল, আমাদের সংগ্রাম চিহ্ন…

পুত্র : কি সেই সংগ্রাম মা, কে লড়ে কার বিরুদ্ধতায়? প্রতিদিন বিধানের বলে বলিয়ান রাজচ্ছত্র, রাজচক্ষু অস্বীকার করে কোন সে দূরন্ত প্রাণ? কেন তার সে অভিমান?

মা: সে এক সুদীর্ঘ সংগ্রাম বৃত্তান্ত… শতবর্ষ প্রাচীন এক মহাযুদ্ধের কাহিনী…
পুত্র: তবে যে শুনি শতবর্ষ আগেও গণতন্ত্র, সুমহান গণতন্ত্র বিরাজিত দেশে…প্রজাসব মহানন্দে, মহাউৎসবে মতদানে নির্বাচিত করেনিত রাজা…সকলই তবে অলীক ছিল? কেবলই কথন ছলনা মাত্র?

মাতা: তা নয় পুত্র, সবই অলীক নয়, তবু কিছু ভ্রান্তি ছিল নিশ্চয়…

পুত্র: আরও কিছু বিষদে বল, মা। তোমার থেকে জেনে নেব আমি আমার থেকে আমার উত্তর কাল…

মা: তবে শোনো, এখন যেখানে দাঁড়িয়েছ তুমি,এ পবিত্র দিল্লী ভূমি থেকে তখন শাসিত হত প্রিয়দেশ।
শাসক চিরকালই শোষোকের চিহ্ন বহন করে… সেখানেও অন্যথা ছিলনা কিছু…
প্রতিবাদী প্রজামাত্রেই রাজরোষে দণ্ডপ্রাপ্ত হত। তবু…
তবু সুখেদুঃখে প্রজাসকল ভরে তুলত জীবন…।
কিন্তু, কিন্তু হল্লারাজ যবে ক্ষমতায় এল,
অশেষ দুর্গতি নেমে এল দেশ জুড়ে…
সিংহাসন আরোহণ মাত্রেই জনতার দিকে ধেয়ে এল নব কর, নাম হল জি এস টি।

পুত্র: সে কী? কেন মা?

মা: প্রয়োজন ছিল, রাজার বিলাস ব্যাসনে সে অর্থ প্রয়োজন ছিল। বড় শৌখিন ছিল রাজমন, পোশাক ছিল দশলাখি, তাছাড়া ভ্রমণপ্রিয় রাজার বিশ্ব ভ্রমণে রাজার ছিল মতি… পাইক,বরকন্দাজ আরম্বরেও ছিল অর্থের প্রয়োজন।

পুত্র : তাই বুঝি জনতার পথ্য ও অসুখেও চেপে যায় করের ভার !

মা: তাই হয় পুত্র, অমনই হয় চিরকাল…
রাজার বিলাস ব্যসনের ভার চিরকাল বয়ে চলে শ্রমজীবী প্রজা…।

পুত্র: তারপর, তারপর কি হয় মা?

মা: আরো দুর্দহন অপেক্ষা করে, জনতার সঞ্চিত সামান্য সব সঞ্চয় ফরমানে অবৈধ হয়ে য়ায়, রাজা চিৎকার করে “নোটবন্দী”। জনতা লাইনে দাঁড়ায়,হোঁচট খায়, হুমড়ি খেয়ে পড়ে, ভেঙে যায় অর্থনীতি… দেশে ঘনিয়ে ওঠে অন্ধকার…

পুত্র: তারপর?

মা: শুধু দেশ নয়, রাজাও বিপন্ন হয়…
ভেঙে পড়ে মিথ, আচ্ছে দিনের শ্লোগান…
বিপন্নরাজ কূট চাল চালে, সীমান্তে ডঙ্কাবাজায় যুদ্ধের, দেশে ছড়ায় ঘৃণা…
প্রতিবেশীর দিকে আঙুল ওঠে, ধেয়ে যায় বোমারু বিমান,দেশের ভেতর রাজা অশিক্ষার যত অন্ধকার।
পাড়ায় পাড়ায় গড়ে স্তাবকদল,যারা সভ্যতার চাকা ঘোরাতে চায়।

পুত্র : তাহলে দেশ? দেশের কি হয় মা?

মা: দেশ গর্জে ওঠে…
রাজাও তাই নতুন চাল দেয় দাবার বোর্ডে,
ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে বলে দেয়
এ দেশে কেউ প্রজা নয়, সকলেই অনুপ্রবেশকারী। প্রজা হতে হলে নিতে হবে রাজার সনদ…

পুত্র: তাও হয় বুঝি !

মাতা: হয় বাপ হয়, ক্ষমতামদমত্ততায় সব হয়।
কিন্তু জনতা গর্জে ওঠে বিপুল তরঙ্গ হয়ে নেমে আসে পথে, আছড়ে পড়ে সকল প্রদেশে… রাজা ভেসে যায় রোষে, জনতা বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করে – আজাদী।

পুত্র : আর রাজা?

মাতা: হল্লার রাজা যুদ্ধ ঘোষণা করে, প্রজার বিরুদ্ধে। সেনাপতি ধেয়ে যায় অস্ত্র ঝনঝনায়…
বারুদ বোমায় সজ্জিত পথে নামে অরাজক সেনা।
বীরের মৃত্যুবরণীয় করে তোলে জনতার বহু জন…

পুত্র: আশ্চর্যকথা শোনাও একি, আমি তবে কার উত্তরাধিকার?

মা: যে শহরে যত মৃতশরীর বুকে বারুদ নিয়ে শুয়ে আছে, তুমি, তুমি তাঁদের সকলের উত্তরাধিকার… তাঁদের সকলের সন্তান…

[লেখক – কবি। শ্রমজীবী হাসপাতালের অন্যতম প্রধান সংগঠক]

Facebook Comments

Leave a Reply