উত্তাল কুড়ি ও সে সূত্রে কিছু কথা : দেবাঞ্জন মিত্র
কিছু কিছু সময় আসে যখন মানব সভ্যতার কিছু মূল বৈশিষ্ট্য প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়। সমাজের নানা স্তরে এ ক্রান্তিলগ্নে ফুটে ওঠে বিপন্নতা। জীবন ও যাপন হয়ে ওঠে সঙ্কটদীর্ণ। ২০২০ বোধহয় সেরকমই এক সময়। ভারতবর্ষের নানা স্থানে এ সময়ে প্রতিবাদের কল্লোল গজিয়ে উঠছে। ভারতীয় উপমহাদেশের সংবিধানের অন্তর্গত বেশ কিছু মৌলিক ও মানবিক অধিকার আজ বিপন্ন। খাদ্য, জল, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চাকরি ও উৎপাদন–সর্বর্ত্ৰই আজ হাহাকার। ধর্মের নামে, জাতি ও বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের মৌলিক অধিকার আজ বিপর্যস্ত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হওয়ার সুবাদে যেটুকু মনে হয়, মানুষের মানবিকতা আজ ভারতে ও তার জাতীয় পরিচয়, আজ বিশ্ব দরবারে বিপন্ন। অর্থনৈতিক অবনতি থেকে হিংসা ও সন্দেহ আজ আমাদের সর্বস্তরে ছেয়ে গেছে, যা আমাদেরকে পক্ষান্তরে সবকিছু নিয়েই সন্দিহান হয়ে উঠতে বাধ্য করে তুলেছে। ভারতীয় মানুষদের, তারা আদেও ভারতীয় কিনা, কথায় কথায় এ পরীক্ষা দিতে হচ্ছে, পরীক্ষা দিতে হচ্ছে তার দেশপ্রেম নিয়ে, তার জাতীয় সংহতি সংক্রান্ত ধারণাসমূহ নিয়ে। ছোট ও মাঝারি ব্যবসাগুলি ডুবছে, কর্মসংস্থান নেই ও দীর্ঘমেয়াদি চাকরি আদেও রইবে কিনা এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ দেখা দিচ্ছে।
সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশে এ সময়ে দাঁড়িয়ে খুব মনে পড়ে, যেমন মনে পড়ে যায় সমরেশ মজুমদারের উত্তরাধিকার ও কালবেলার অনিমেষকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘরে বাইরের সন্দীপ ও নিখিলেশের কথাও খুব মনে পড়ে। রবি ঠাকুর ওখানে দেখিয়েছেন যে কি করে উগ্র জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক মোহময়ী ডাক সাধারণ মানুষের ঘর ও বাহিরের অর্থাৎ জীবনের সব দিকগুলোকেই কালিমালিপ্ত করে তোলে ও তার সাধারণ জীবনযাপনের প্রতিনিয়ত সত্ত্বাকে গ্রাস করে। সে দিক থেকে দেখতে গেলে হয়তো উদারতাবাদী নিখিলেশের থেকে সন্দীপের জ্বালাময়ী জাতীয়তাবাদী বক্তব্য আমাদেরকে সবসময়ই বেশি টানবে–আমরা তার স্বপক্ষে হই বা বিপক্ষে। হীরক রাজাই হয়তো রাজতন্ত্রের মূল কথাটি সবচেয়ে ভালো বুঝেছিলেন: রাজতন্ত্র ততদিনই সফল যতদিন মানুষ তা নিয়ে চিন্তা না করে, আর তাই রাজত্ব ধরে রাখার জন্য প্রজাদের চিন্তা করতে দেওয়া যাবে না। অন্তত রাজার নিয়ম নীতি নিয়ে যেন প্রজারা বিক্ষুব্ধ না হয়ে ওঠে এটা দেখতে হবে।
প্রশ্ন হলো আজ তো রাজতন্ত্র সেভাবে নেই। ভারতে বিদেশি বহিরাগত শক্তির শাসন নেই। তাহলে কি আজ রাজতন্ত্রের অবসান হয়েছে? যদি হয়ে থাকে, মানুষের প্রশ্নে আজও কেন সমাজে হিংসা ও পেশিশক্তির প্রাবল্য ফুটে ওঠে? কেন তার হুমকি ও হুংকার নিত্য নতুন হাহাকার ও শাস্তির নিদান ফুটিয়ে তোলে? বলা হয়, রাজতন্ত্র আর গণতন্ত্রের সংঘাত এতটা জটিল হতো না, যদি না ভারতবর্ষের দারিদ্র্য আর জনসংখ্যা দুটোই এত বেশি না হতো। আবার এটাও ঠিক যে এ দেশের অন্যান্য প্রাচুর্যের মতোই এ দেশের সাম্যের দর্শন এসেছে তার বহুমুখী কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক সহাবস্থানের দার্শনিক উদারতা থেকে। ভারতীয় দর্শনের অন্যতম মুক্তমনাভাব তাই বলে যত মত তত পথ, আবার রাজতন্ত্র এহেন দর্শনকেই ভয় পায় কারণ সে জানে নির্দেশনা বা নেতৃত্রের দৃষ্টিতে যত বেশি মত তত বেশি জট।
এহেন পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক অধিকার ও প্রভুত্বকামী রাজশক্তির সংঘাত অবসম্ভাবী। কিন্তু এখানেও আরেকটি কথা রয়ে যায়। গণতন্ত্র ভিন্নতা ও মতবিনিময়ের উপযোগীতায় বিশ্বাসী, সেও একটি সুঠাম ও বলশালী নেতৃত্ব কামনা করে। সে রাজা চায় না, সকলের মাঝে সকলকে সঙ্গে নিয়ে চলা সহচরের সাহচর্যে নিজেকে উন্নত করতে চায়, চোখে চোখ ও কদমে কদম মেলানো বন্ধু চায়। সে হিসেবে তার দরকার একজন এমন নেতার যে জনদরদী উন্নয়ন ও কাজ করে। হিংসার পথ গণতন্ত্র নয়, তা পেশল পশুশক্তিসম্পন্ন যোদ্ধা চায় না, চিন্তাশীল মানুষের সহমর্মী ভালোবাসা ও সঙ্ঘবদ্ধতার গভীরতা চায়। এই একটি কারণেই যুবগোষ্ঠী গণতন্ত্রের মূল বাহিকাশক্তি হয়ে ওঠে, শিক্ষা ও মুক্তচিন্তার স্বচ্ছতা দেশের ও সমাজের মূল কারিগর হওয়ার দাবি করে। শিক্ষা প্রশ্ন করতে, নিজের মনকে ও মতকে যুক্তিযুক্ত পথে গঠনের পথ করে দেয়, আর তাই হয়তো জামিয়া, জহর লাল নেহেরু বা যাদবপুরে প্রতিবাদের নবীন কন্ঠ উঠলে তাকে চুপ করানোর চেষ্টা হয়। সংখ্যা বা পরিমাপের কাঠামো গণতন্ত্রে অবশ্যই লাগে কিন্তু সেটা ধর্ম বা মানুষের লোকাচার বা তার সামাজিক-অর্থনৈতিক গণ্ডী নিয়ে করা হলে তা বিভেদ ও হিংসারই নামান্তর হয়ে ওঠে।
একটি গল্প বলে এই ছোট লেখনী সমাপ্ত করি। রামায়ণে আছে রাবণ বধ সম্পন্ন হলে যখন জনকী রাবণের কারাগর থেকে মুক্ত হলেন তখন রামচন্দ্র তাকে বলেন, তুমি এখন মুক্ত, যথা ইচ্ছা চলে যাও। এবং এ কথায় সীতার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে, কারণ রাম তার স্ত্রীর অস্তিত্ব ও তার আনুগত্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। রামায়ণে এ সুবাদে সীতাকে অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে তার স্বমর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে হয়। কিন্তু তাদের দাম্পত্যের নীড় বোধহয় আর জোড়া লাগে নি। ফলতঃ রাম আবার সীতাকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় পরিত্যাগ করেন ও দ্বিতীয়বার আবার যখন তাকে খুঁজে বের করেন তখন আবার তার আনুগত্য প্রমাণ করার দাবি রাখেন। অগ্নিপরীক্ষা জয়ী, দুই বিজেতা যমজ যোদ্ধা সন্তানের জননী সীতা পর্যন্ত এই দ্বিতীয় পরীক্ষা দিতে অস্বীকৃত হন ও আত্মসম্মান রক্ষার্থে আপন মাতৃগর্ভ ধরিত্রীতে প্রবেশ করেন। আসলে মানুষ নিজের জীবনের প্রতিটি পল অনুপল দিয়ে নিজের অস্তিত্ব গড়ে তোলে আর তার অস্তিত্বের সঙ্কট তাকে আপন সামাজিক মূল্যায়ণ করতে শেখায়। আমাদের হয়তো এটাই দেখার অপেক্ষা যে ভারতবর্ষের মানুষ কবে নিজেদের অধিকার ও অস্তিত্বের মূল্যায়ণ করতে তৎপর হবেন কারণ সীতা এ দেশেরই কন্যা এবং ভূমিজা সীতার উত্তরাধিকারী হিসেবে আমরাও বার বার তার মতোই শাসনতন্ত্রের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে ও তার মতোই অগ্নিপরীক্ষা স্বীকার করতে বাধ্য হই।
[লেখক – সহকারী অধ্যাপক, মৃণালিনী দত্ত মহাবিদ্যাপীঠ।]
Posted in: Cover Story, January 2020