জানলার অস্পষ্ট কাঁচের জীবন : দীপ শেখর চক্রবর্তী
১
জানলার অস্পষ্ট কাঁচের মধ্যে দিয়ে তাকিয়ে থাকি জীবনের দিকে।এই সামান্য হাতের মুঠোর মাপে জীবন,প্রিয়তমার বুকে হাত রাখার মতো হাওয়া।পাখির পালকের মধ্যে নিজেকে নম্র করে মাটিতে এসে পড়েছে রোদ।একটি দিনের ভেতর দিয়ে আরেকটি জীবন কেটে যায়।সামান্য উঠোনের অবহেলার মধ্যে এসে ফুটেছে কয়েকটা ফুল পূর্বজন্মের হারানো মুখেদের মতো।তাদের ওপরে কয়েকটি কাপড় জামা প্রতিদিনের খাটনির পর দড়িতে বসে প্রতিদিনের অভাব অভিযোগের গল্প করে।তারাই কি একেকদিন উড়তে শিখে পাখি হয়ে যায়?তারাই কি একদিন কোন দূর ফেলে আসা জীবনের গান ঠোঁটে করে বহন করে নিয়ে এসে ফেলে আমার এই জানলার সামনে?বিকেলে কেউ খেলতে ডাকে না আর,এখন শুধু নিজের শরীর আত্মাকে নিয়ে লোফালুফি,হাত থেকে পড়ে গেলে যদিও ভাঙে না।দীঘির ভেতর ডুবিয়ে বসে আমাকে গান শোনায় কোন বালিকা?সেই বাংলাদেশের দুপুরবেলায় যে গান মায়ের আঁচলের নরমের মতো একটা সন্ধে ডেকে আনতো।তার মুখ মনে পড়ে অথচ তাকে কোনদিন দেখিনি।
প্যান্ডেলের শেষ বাঁশ পোঁতা হয়।কিছুদিন পর বাতাস বুকে কিশোরীর প্রথম বুকের গন্ধের মতো ভারি হয়ে আসবে।গ্রীষ্মের রুক্ষতা সরিয়ে মানুষের হৃদয় ফিরে যাবে আরেকটি মানুষের কাছে।বুঝবে এ জীবনের ভেতর শুধু জীবন নয়,বরং হেমন্তের ঘরে ফেরার দিনে যেটুকু শিশির অস্পষ্ট করে তোলে জীবনের মূল মানেগুলো,সেটুকুই…
ছাদ থেকে পথে,পথ থেকে ছাদে চলে যাবে কত চোখ।চোখের ভেতর থেকে একটি পথ মানুষকে দূর শান্তির পথে নিয়ে যেতে পারে।
একটি শান্তির পথে কোন সমীকরণ নেই,খালি মায়ের ডাক স্পষ্ট করে শোনা যায়।বোঝা যায় কাশফুলের মধ্যে,এই হৃদয় দোলানো আলোর মধ্যে,এই স্থির হৃদয়ের নরম স্পর্শের মধ্যে শুধু রয়ে গেছে মায়ের ডাকটুকু।স্বচ্ছতোয়া এক নদীর মতো।
অস্পষ্ট এক জানলার কাছে বসে বসে জেগে থাকতে চাই।আমার এ জীবন দ্রুত ছেড়ে চলে গেছে আমাকেই।আমার এই সহজ শুধু চাওয়া পাওয়ার এক জটিল বৃত্তের মধ্যে নিজেকে হারিয়েছি।তাই প্রতিদিন শুধু কিচ্ছুক্ষণ জীবনের কাছে বসা,উঠে চলে আসা সেই মন্ত্রগৃহ থেকে।
শুধু মাঝে মাঝে একটা গন্ধ আমার এই অস্পষ্ট জানলার কাঁচ ভেদ করে আসে।বালিকার প্রথম ভালোবাসার বক্ষফুল যে গন্ধ ছড়ায়।
এমন এক গন্ধ কোন কোনদিন ডাক হয়ে যায়।খেলার ডাক।ছুটে যাই,উন্মুক্ত প্রান্তর।সাথী কেউ নেই।আমাকে খেলার ডাক দিয়ে জীবন চলে গেছে কোথায় খেলা ফেলে।উন্মুক্ত প্রান্তরের মাঝে একা একা খেলার সরঞ্জাম গোটাই।কপালের ঘামের ভেতর এসে বসেছে বিকেলের মরে যাওয়া আলো।
প্রান্তরের পাশে এক লম্বা পথ।সে পথ দিয়ে একের পর এক হেঁ টে যায় ভালোবাসা।অভাব বলে,অভিযোগ বলে,বলে ভালোবাসো।অথচ কেউ নেমে আসে না প্রান্তরে।ঘাসের নরমে পা রেখে কেউ চোখ বুজে দেখে না বিরাট আকাশের সাথে কেমন ঘর করে এক সামান্য বালকের আশা।দূরে কোথাও বেজে ওঠে পুরোনো গানের আশ্চর্য মায়া।
সামান্য বালকের আশা যে কতদূর তা শুধু মা জানে,জানে কোন কোন বালিকার কাশফুল ফুটে থাকা বুক।
২
এখনো সামান্য মাটির আলোর বিকেলে পরিচিত মুখেদের মাঝে একটা ধান রঙের পথ দেখতে পাই।সহস্রাধিক যন্ত্রণার মাঝে এমন একটা পথ দিয়ে হেঁটে যাই পরাজয় এবং জয়ের মাঝে,দিগন্তরেখায়।ঘর থেকেও যে আশ্রয়হীন তার কাছে পৃথিবীর সমস্ত বড় ছোটোর লড়াই তুচ্ছ।সে শুধু ভাবে জীবনের সমস্ত অবহেলার মাঝে কোথায় সে ফেলে এসেছিল ঘরখানি।একটি ঘর,বিকেলের আলো এসে যার বারান্দায় দাঁড়িয়েছে।উঁকি দিয়ে দেখছে সে ঘরে কেউ থাকে কিনা।
আমি সেই মাটির আলোর মতো বিকেলের সমস্ত অপ্রাপ্তি জানি। জানি শ্রাবণের দিনে যাকে নিয়ে একটা ডিঙি ভাসিয়ে দেওয়া যেত সুখ দু:খ দীঘিতে তাকে কতভাবে ফেলে এসেছি জীবনের অবহেলায়।জীবন এক বিরাট কর্মকান্ডের পরিচালক হয়ে এখন কেবল বেত চালায়।তার দাগ শরীরের সর্বত্র,অথচ তার শাসন এখনো সম্পূর্ণ অবিশ্বাস করতে পারিনে।দুরন্ত অশ্বের পিঠে কোন ভুবনমোহিনী নয়,উন্মাদ অন্ধকারে সে বসে আছে,সামান্য মাটির আলো জ্বালিয়ে।একটা গান নিয়ে বসে আছে,একটা কান্না নিয়ে বসে আছে,একটা ডাক নিয়ে বসে আছে।
সে নাম কারো নয়।অথচ সে নাম বারবার শোনার জন্য জীবন এতই মত্ত যে বেত ভুলে যায়।
বিভ্রান্তিবশত এই অনিয়ম থেকে শুরু হয় এক ভালোবাসা।যেন দারচিনি বয়ামের অর্ধেক ভরে থাকা।
যাকে খুঁজে ফিরেছি সে যে আমার সমস্তটা নয় এ সত্য আমাকে আশ্বস্ত করে।আমি জানি ঘাসের জমির পথ ধরে মাটির আলোর বিকেলে একদিন তার পাশাপাশি আমার ঘরে ফেরা হবে-এইটকুই।
ভালোবাসা এক নিঃসঙ্গ মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে ধান রঙের শাড়িতে দাঁড়িয়ে থাকে।হাতে তার একগোছা হার,অমূল্য।
যত্ন তার প্রয়োজন অথচ সমস্ত অযত্নের মাঝে একটি দুটি গাছে রোজ পাশাপাশি লেগে থাকে।
ফুলের দৃশ্য পাঠায়,রাতের বেলা ডাল জড়িয়ে ধরে কাঁদে।
৩
শীতকাল তার জাদু দেখানোর উপকরণ নিয়ে ফিরে যাচ্ছে মাটির ওপর দিয়ে।তাকে অনুসরণ করে চলেছি।চারিদিকে অসংখ্য মানুষের উদযাপনের মধ্যে কাজলদীঘির খোঁজ পাইনি।মলিন হৃদয় গভীর এক বিষন্নতার পায়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে,আজ ঘরে ফেরার পালা।
দূরে মেলে দিয়েছে রঙিন কাপড়।পাখিরা পায়ে মায়ার জাল জড়িয়ে নেমে আসছে প্রতিবেশী উঠোনে।
দাদা,পুতুল নেবে?-এমন এক স্বরের কাছে থেমে যেতে পারে গোটা বিশ্ব।শহরের মানুষের বিকট ক্রয় মূর্তি,সাঁওতাল নৃত্যের তালে তাল মেলাতে না পারা অপটু অনভ্যস্ত পায়ের জঙ্গল থেকে এমন এক ডাক কেড়ে নিয়ে গেল।যেন সমস্ত অরণ্য এই ক্ষুদ্র বালিকার রূপ ধরে সভ্যতার কাছ থেকে নিজেকে গোপন করে রেখেছে।
বসলাম তার কাছে।তুমি বানিয়েছো?সামান্য মাথা নাড়িয়ে লজ্জার হাসি হেসে মুখ ঘুরিয়ে নিল,সেই বালিকা।বললাম -আমার কিন্তু সবকটা চাই।
কিন্তু পুতুল তো একটাই ছিল।বাকি সব বিক্রি হয়ে গেছে।সেকি?কারা চিনতে পেরেছে এই সামান্যের মধ্যে বসে থাকা অসীমকে?তাহলে আমি একা নই,একা নই…
এমন এক আনন্দ নিয়ে দেখি,সেই বালিকা সামনে তাকিয়ে তার চোখের অতল দিয়ে ডুবিয়ে নিচ্ছে আমাকে।পেছনে তিনজন মহিলা বাউলের গানে গানে উদ্দাম নৃত্য ছড়াচ্ছেন।অথচ কী আশ্চর্য আমি দেখছি তাদের একটি পাও,আনন্দে পড়ছে না।বরং এই আনন্দ এই সামান্য বালিকার হৃদয়ের কথা হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে আকাশে আকাশে।
দেবী হাত বাড়িয়ে দিলেন এই পুতুল।না,আনন্দের সামান্য ভাগ দিলেন।অথচ তা সামান্য নয়।ফিরে এলাম আমার একার ঘরে।একটি বাতি টিমটিম করে জ্বলছে,মেঝের ওপর ছড়িয়ে আছে অনেক গানের সুর।কাগজের প্রান্তে লেখা কয়েকটা প্রিয়নাম,আচমকা কেমন আশ্রয় হয়ে যায়।এইসব হাতরাতে হাতরাতে ঘুম নেমে আসে।
প্রান্তিক স্টেশন থেকে ভেসে আসছে কোন দূরযাত্রী রেলগাড়ির আশ্চর্য করুণ বেহালা।
সেই বালিকার মুখ মনে আসে।সেই পুতুলটি মাথার কাছে রেখে চোখ বুজি।এমন উপহার তো আজ অব্ধি পেলাম না কখনো,তাই ভাবি
সারাজীবনের সমস্ত অপমান,অবহেলার পর এমন এক সামান্য উপহার কেমন গোটাটার ওপর দাঁড়িয়ে প্রিয়তমার মতো হাসতে পারে।
বিরাট সমস্ত আয়োজনের মাঝে তো হারিয়ে গেছে এই সামান্যটা।এই যে আমি,এই যে তুমি।বালিকা,বালিকা কী নাম তো তোমার জানা হল না।কী নাম তোমার? বলে যাও,বলে যাও,লিখে রাখি,লিখে রাখি…
শীতকাল এক বালিকা হয়ে ফিরে যাচ্ছে পুতুলের যাদুবাক্স নিয়ে।তার পেছন পেছন চলেছি আমি।
অথচ তার নাম জানা হয়নি।
এই নাও বালিকা,পৃথিবীর সমস্ত প্রিয়নাম,আমি তোমাকে দিলাম,যাদের পায়ের কাছে বহু পুরোনো পক্ষীরাজ ও রাজার বাড়ির ঠিকানা থাকে।
Posted in: January 2020, Prose