কাহার হাতে এই ভুবনের ভার : চারুব্রত রায়

বেশ কিছুদিন আগে ‘টনি ব্লেয়ার ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল চেঞ্জ’-এর সঙ্গে যুক্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মার্টিন ইয়ারম্যান, লিমুর গুলচিন ও ইয়াসা মুঙ্ক পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিরীক্ষা করে দেখেছেন, পূর্ব-ইউরোপের দেশগুলিতে লোকরঞ্জনবাদ (পপুলিজম)ব্যাপক হারে প্রসার ঘটছে। এসব দেশে চার দশক আগে সরকারী মার্ক্সবাদী পার্টির শাসন কায়েম ছিল, যদিও সেগুলির চরিত্র ছিল টোটালিটারিয়ান।সেই সব দেশে উদারূ গণতন্ত্রী রাজ কায়েম হয়েছিল,তার প্রায় অর্ধেক দেশে রাজনৈতিক দলগুলি লোকরঞ্জনবাদী শক্তি সমাবেশের কাছে পরাজিত হচ্ছে- ১৫টি দেশের মধ্যে ৭টিতেই এখন লোকরঞ্জনবাদী দল ক্ষমতায়।ইউরোপের অন্য অংশেও লোকরঞ্জনবাদের প্রসার ঘটছে। জর্মনির জাতীয় নির্বাচনে(২০১৭) ছদ্মনাৎসিবাদী অলটারনেটিভ ফর ডয়েশল্যান্ডের (এএফডি) উত্থান ইউরোপে লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতির প্রতিফলন।অর্থনৈতিক সংকটের সুযোগ নিয়েই এই উগ্র রাজনৈতিক ধারার উন্মেষঃ মূলত ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দা, ইউরোপ জুড়ে ঊর্ধ্বগতির বেকারত্ব ও অভিবাসন নীতিকে তাস হিশেবে ব্যবহৃত হয়েছে।এই রাজনৈতিক ধারাটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্ব ইউরোপ (ব্যতিক্রম পোল্যান্ড) ও ব্রিটেন ব্যতিরেকে প্রায় গোটা মহাদেশ ঘিরে উত্থিত হয়েছিল বিশেষ করে অস্ট্রিয়া, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, জর্মনি, ফিনল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ডে।

উদারপন্থী গণতন্ত্রের কন্ঠরোধকারী কট্টর জাতীয়তাবাদ বা লোকরঞ্জনবাদের এই উদ্বেগজনক উত্থানের কারণ অনুসন্ধান করছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী,সমাজতত্ববিদ ও অর্থবিজ্ঞানীরা। ইতিহাসের পরিহাস এই যে গণতন্ত্র তার কাঠামোর ভিতরেই পদ্ধতিগত কারণেই এই মানবতাবাদবিরোধী শক্তির প্রাদুর্ভাব। হিটলারের ফ্যাসিবাদ ও মুসোলিনীও নাৎসিবাদও লোকরঞ্জনবাদের পাকদন্ডী বেয়ে ক্ষমতাপথ নির্মান করেছিলেন। প্রশ্নের কোনো সহজ উত্তর নেই। বিশ্ব গণতন্ত্রের এই সংকটের জন্য সব পক্ষই কম-বেশি দায়ী। গত শতাব্দীর শেষভাগে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের (১৯৯০) পরে মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সমাজতাত্ত্বিক ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা ১৯৯২ সালে ‘ইতিহাসের সমাপ্তি’ ও ‘উদারনৈতিক গণতন্ত্রের বিজয়’ ঘোষণা করে বলেছিলেন, ‘ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটেছে; এবং প্রমাণিত হয়েছে যে বুর্জোয়া গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদী অর্থনীতিই হচ্ছে মানব সভ্যতার শেষ কথা।’ অবশ্য তার তিন বছর সময় অতিক্রম না করতেই ১৯৯৫ সালে নয়া উদারপন্থী ফাইন্যান্স পুঁজি-নিয়ন্ত্রিত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থায় সংকট দেখা দিল। নতুন করে আবার প্রশ্ন জাগলঃ‘গণতন্ত্রের পর কী?’ তার পরেই রক্ষণশীল ও লোকরঞ্জনবাদীদের বিস্ময়কর উত্থান।

মানবাধিকারকর্মী জেমস এ গোল্ডস্টোন লোকরঞ্জনবাদী রাজনৈতিক ধারার গতিরোধ ও উদারপন্থি গণতন্ত্র-রক্ষার উদ্দেশ্যে শিক্ষিত জনগণের সামনে লোকরঞ্জনবাদের অন্তঃসারশূন্যতাবিরোধী প্রচারণার পরামর্শ দিয়েছেন।কোন কোন সমাজতত্ববিদ মনে করেন জনগণের মনস্তত্ত্ব বোঝার জন্য উদারপন্থিদের আরও বেশি করে জনতার কাছে যেতে হবে। কারণ লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতির বড় সমর্থন আসে বঞ্চিত জনগণের পক্ষ থেকে। এখন উদার গণতন্ত্রবাদীদের জন্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, বর্তমানের বৈশ্বিক গণতন্ত্রের যে ক্রান্তিকাল চলছে সে অবস্থা থেকে কাটিয়ে উঠে উগ্রবাদী রাজনীতির বৈশ্বিক জয় তারা কতটা রোধ করতে পারে। অনেকে আবার বলছেন পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যুগোপযোগী সংস্কারওআবশ্যক (এই প্রতিবেদকের বিবেচনায় অবশ্য এমন সংস্কার সোনার পাথরে বাটির চেয়েও অবাস্তব)।

তাহলে কি ধরে নিতে হবে যে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ইন্তেকাল আসন্ন ? কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক ডেভিড রাঞ্চিম্যান তাঁর গ্রন্থ How Democracy Ends এ এমন নৈরাশ্যবাদ নাকচ করে দিয়েছেন।কিন্তু গণতন্ত্র যে বিপন্ন তা মেনে নিয়েছেন। ‘গণতন্ত্র মৃত প্রায় নয়, কিন্তু গণতন্ত্র এখন মধ্যবয়সের অনিশ্চিত সংকটের মধ্যে পড়েছে।’ ট্রাম্পকে তিনি মনে করেন এমন এক বৃদ্ধ যাঁর মস্তিস্কের বিকাশ শিশুর স্তরেই আটকে গেছে। তাঁকে ‘প্রটো হিটলার’ বলা যায় না।“Donald Trump is its motorbike”, যাঁর কার্যকাল ‘আগুনের গোলকের মত শেষ হতে পারে । তিনি রাশিয়ায় ভ্লাদিমির পুতিনের রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে “parody democracy” বলে অভিহিত করেছেন । স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। Stable democracies retain their extraordinary capacity to stave off the worst that can happen without tackling the problems that threatened disaster in the first place.”

বলা বাহুল্য,পুঁজিবাদের এই মন্দাবস্থা থেকেই গণতন্ত্রের পতন শুরু হয়েছে।আর নয়া উদারপন্থী ফাইন্যান্স পুঁজি-শাসিত অর্থ ব্যবস্থার পতনপথে বুর্জোয়া গণতন্ত্র নিঃশক্তিহয়েছে ।তার ফাঁকেই উত্থান ঘটেছে উগ্র জাতীয়তাবাদী, রক্ষণশীল ও লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতির।লন্ডনের প্রসিদ্ধ সাপ্তাহিক ইকনমিস্টের ইকনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বিশ্ব গণতন্ত্র সূচক-২০১৯ এ লিখেছে , গত বছর বিশ্বের ৮৯টি দেশে গণতন্ত্র পিছু হটেছে। মাত্র ২৯টি দেশে গণতান্ত্রিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। গণতান্ত্রিক অবস্থারঅবনতির পাশাপাশি সেই দেশগুলিতে উগ্র জাতীয়তাবাদী, রক্ষণশীল ও লোকরঞ্জনবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর উত্থান হচ্ছে প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক পদ্ধতির তথা ভোটের মাধ্যমেই’ যদিও উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র শক্তিশালী হওয়ার কারণে সেখানে অবস্থা অতটা খারাপ হয়নি। কিন্তু ভারতের মত বিকাশশীল দেশগুলোতে রক্ষণশীল ও লোকরঞ্জনবাদী দলগুলোর উত্থানের ফলে প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র ধ্বংস হচ্ছে , ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতি মার খাচ্ছে। বৃহৎ ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোতে তোষণ ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বাড়ছে। এমন ঘটছে খোদ ইউরোপের অনেক দেশেও।

আজকে মানবতার কাছে এক ব্যক্তি হিশেবে এক মূর্তিমান বিভীষিকা মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড জন ট্রাম্পের নির্দেশে ২০২০ সালের প্রত্যূষে (৩ জানুয়ারী) মার্কিন সেনা বাহিনী জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকে হত্যা করে।

সিরিয়া ও ইরাক যুদ্ধে সোলাইমানির বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য দেশ-বিদেশে খ্যাতি ছাড়াও ইরানের পূর্ব সীমান্তে মাদক চোরাচালান ও সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে কমান্ডারের দায়িত্ব পালনে সাফল্য,কুদস বাহিনী। দায়িত্ব নিয়েই বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠন ও ইরাকের ইসলামিক স্টেটকে (আইএস) পরাভূত করা তাঁর সেনানায়ক হিশেবে মাথার মুকুটে এক একটি উজ্জ্বল পালক। নিঃসন্দেহে তিনি হয়ে উঠেছিলেন একদিকে যুদ্ধবাজ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের শিরঃপীড়া।বর্বরতার প্রতীক ট্রাম্প ভাবতেও পারেন নি যে আইসি এমনভাবে পর্যুদস্ত হবে।সোলাইমানির জানাজায় পদপৃষ্ঠ হয়ে ৪০ জনের মৃত্যু এক রহস্যজনক ঘটনা। এসবের অন্যতম কারণ তাঁর নেতৃত্ব মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্ব মানবতার সংগ্রামে আশাবাদ সঞ্চারিত করেছিল।

আমাদের প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ট্রাম্পের ঘোর সমর্থক। আবার সৌদি আরব ও ইসরাইলের শাসকদের পরম সুহৃদ। ইরাণের আঞ্চলিক শত্রু সৌদি আরব ও ইসরাইলের নেতাদের শিরঃপীড়ার কারণ ছিলেন সোলাইমানি। ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় তার বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা আরব দুনিয়া তারিফ করত । তাই গত দুই দশক কালে বহুবার যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও সৌদী আরবের বিভিন্ন সংগঠন তাঁকে হত্যার চেষ্টা চালায়। দায়িত্ব নিয়েই তিনি সফলভাবে বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠন ও ইরাকের ইসলামিক স্টেটকে (আইএস) পরাজিত করেন।তিনি ইরানের পূর্ব সীমান্তে মাদক চোরাচালান ও সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে উল্লেখযোগ্য সাফল্যলাভ করেন।

এই লোকরঞ্জনবাদী জাতীয়তাবাদের দৌরাত্ন্যে বিশ্বজুড়েই নানা প্রান্তে চলতে থাকবে নানা রকম প্রক্সি যুদ্ধ । বাড়বে ধবংস, মৃত্যু, হাহাকার, বাড়বে পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ। আমরা হয়তো ভুলতে বসেছি যে হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান, শিয়া-সুন্নী, সাদা-কালো সবারই প্রধান সমস্যা ক্ষুধা, দারিদ্র, রোগ, অশিক্ষা, কুসংস্কার। ধর্ম-বর্ণ-দেশ ভিত্তিক জাতীয়বাদের অন্ধ নেশার চেয়ে এই মৌলিক অভাব গুলো থেকে মুক্তি পাওয়াই হওয়া উচিত প্রধান চ্যালেঞ্জ।

হয়ত আশাহত হবার কারণ নেই। ক্রমবর্ধমান আবিশ্ব সামাজিক অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং তার বিপ্রতীপে ধূমায়িত অসন্তোষ ও তার ফলে উপ্ত হয়েছে প্রতিবাদের বীজ, যার মধ্যে সুপ্ত আছে এক ঋজু দৃঢ় মহীরুহ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা। এই বৈশ্বিক সংকটের অন্যতম কারণ রাজনৈতিক বিপর্যয় যার বিস্তৃতি বিভিন্ন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্র। যে অর্থনৈতিক সংকট বিষ বৃক্ষের মত বেড়ে উঠছে, তা যেমন পুঁজিতান্ত্রিক অর্থশাস্ত্রবিদেরাও ব্যাখ্যা করে উঠতে পারছে না (আগে থেকে আঁচ করা তো দূরস্থান), তেমনি সরকারী মার্ক্সবাদী দলগুলির তাত্বিকেরাওঅনুধাবন বা বিশ্লেষণ করতে পারছেন না। আন্তর্জাতিক অঙ্গন প্রতিনিয়ত উত্তপ্ত হয়েই চলেছে।

যেসব দেশে এক দশক আগেও বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বা তার আবরণ ছিল সেউ সব দেশে গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে স্বৈরতন্ত্র ও উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটছে এবং উদারপন্থীদের ঐতিহ্য ক্রমশ প্রান্তিক ও খর্বিত হচ্ছে, যার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত ভারত, যা একদা পৃথিবীর মানুষের কাছে ছিল জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির পাঠশালা ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কৌতূহলোদ্দীপক নিরীক্ষাভুমি।ভারতে এখন এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। অতীতে অনুন্নত ও বিকাশশীল দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাই ভারতের কাছ থেকেই গণতন্ত্রের শিক্ষা গ্রহণ করত,সেই ভারতে এখন গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বিপন্ন।

গ্রীক দার্শনিক হিরোডোটাসকে তাঁর এক শিষ্য প্রশ্ন করেছিল, মহাশয় আপনি কার পক্ষে, যুদ্ধ না শান্তি? হিরোডোটাস উত্তর দিয়েছিলেন-বৎস, আমি শান্তির পক্ষে, কারন শান্তির সময় সন্তান বহন করে তার পিতার লাশ আর যুদ্ধের সময় পিতার কাঁধকে বইতে হয় সন্তানের লাশের কঠিন ভার।

Facebook Comments

Leave a Reply