অর্ধেকের খোঁজে: নিজস্ব বুননে ভারতীয় নারীদের নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ – অমৃতা সরকার

নবম কিস্তি: প্রথম পর্ব

‘কৃষ্ণের রাধা’ থেকে ‘রাধার কৃষ্ণ’ হয়ে ওঠাঃ মুদ্দুপলানির ‘রাধিকা সান্ত্বনম’-এর নির্বাচিত অনুবাদ

(প্রথম পর্ব)

মুদ্দুপলানি (১৭৩৯ খ্রিষ্টাব্দ – ১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দ) তাঞ্জোরের সম্রাট প্রতাপসিংহের রাজসভার একজন খ্যাতনামা গণিকা। তাঞ্জোরের নাগবর্ষমে জন্মগ্রহন করেছিলেন মুদ্দুপলানি। তার দিদিমা তঞ্জানয়কী ছিলেন খ্যাতনামা গণিকা যার সঙ্গীত ও কাব্যের নবরসের দক্ষতার সুখ্যাতি ব্যাপ্ত ছিল সমগ্র দাক্ষিণাত্যে। মুদ্দুপলানির সময়ের তাঞ্জোরের রাজনৈতিক অবস্থা খেয়াল করলে মুদ্দুপলানির ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও প্রকাশভঙ্গীর প্রেক্ষিত বুঝতে সুবিধা হয়। ১৭৩০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দ অবদি প্রতাপসিংহের শাসনকালের তাঞ্জোর এক বহুজাতিক, বহুসাংস্কৃতিক এবং প্রাক-ঔপনিবেশিক ও সদ্য-ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের এক মোহনা বিশেষ। শাসক মারাঠি, প্রশাসনের ভাষা তেলগু, বিশাল সংখ্যক তামিল ভাষা ও সংস্কৃতির সাধারণ মানুষের বাস, ফরাসী ও ইংরেজরা নিজের বাণিজ্যের বিস্তারের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে তাঞ্জোরে নিজ-নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি বিস্তার করতে চাইছে। সম্রাট প্রতাপসিংহ নিজে রাজা তুকোজী ভোঁসলে ও অন্নপূর্ণা নামের এক গণিকার ‘অবৈধ’ সন্তান । এর ফলে ‘বংশ আভিজাত্য’ থেকেও ‘ব্যক্তির নিজস্বতা’ মুদ্দুপলানির সময়ের তাঞ্জোরে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এর সুফল অবশ্যই পেয়েছিলেন মুদ্দুপলানী। ভারতীয় নৃত্য , সঙ্গীত এবং কাব্যকলার পাশাপাশি ইউরোপীয় সঙ্গীত ঘরানার ভায়োলিন মুদ্দুপলানি শিখেছিলেন নিজেকে ‘ব্যক্তি’ হিসেবে বাকি গণিকাদের চেয়ে পৃথক দেখাবার জন্যই। নিজের অর্জিত এই দক্ষতার জোরে দাক্ষিণাত্যের পুরোটা জুড়ে তার কদর অনেক বেড়ে যায়। ‘ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য’ সামন্ততান্ত্রিকতা থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠায় তাঞ্জোরে ব্যক্তি ভিত্তিক আয়করের প্রচলন করেন প্রতাপসিংহ । মুদ্দুপলানির ভায়োলিন কনসার্ট তার ব্যক্তিগত আয় অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়। এবং তিনি তাঞ্জোরের প্রথম ব্যক্তি যার বংশানুক্রমিক কোনো জমি না থাকা সত্ত্বেও আয়কর দেন। নথিভুক্ত ভাবে তিনিই প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি কোনো স্টেটকে আয়কর দিয়েছিলেন। মানুষ হিসেবে মুদ্দুপলানি পিতৃতান্ত্রিক সংজ্ঞা মেনে ‘নম্র’, ‘ভদ্র’, ‘সুশীলা’ ছিলেন না; বরং ঠোঁটকাটা হিসাবে কুখ্যাতি ছিল তার। অনান্য গণিকাদের মত শুধু কাব্যরস শিখে, সেটাকে কলা হিসেবে ব্যবহার করেন নি; বরং তর্কে জড়িয়েছেন মারাঠি সংস্কৃতজ্ঞদের সঙ্গে। সংস্কৃত কবিদের সঙ্গে একাসনে তেলেগু কবিদের বসিয়ে বিরাগভাজন হয়েছেন সমালোচকদের কাছে। দমে না গিয়ে নিজের মনন ও দৃষ্টিভঙ্গী প্রকাশ করার জন্য বেছে নিয়েছেন কৃষ্ণ ও রাধার চিরায়ত আখ্যানকে। নিজের মত করে এই আখ্যানকে বিনির্মাণ করে নতুন কাব্য রচনা করেছেন তেলগু ভাষায়। এই কাব্যে আখ্যানের কেন্দ্র থেকে কৃষ্ণকে সরিয়ে রাধা হয়ে উঠলেন কেন্দ্র। জন্ম নিল ‘রাধিকা সান্ত্বনম’।
‘রাধিকা সান্ত্বনম’ ভারতীয় নারীবাদের প্রেক্ষিত থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বই। যৌনতা এবং রতিকে উপজীব্য করে সংস্কৃত কাব্যধারা মূলগতভাবেই পিতৃতান্ত্রিক কারণ যৌনতা ও রতিক্রিয়ার পুরো প্রক্রিয়া সেখানে পুরুষের চোখ দিয়েই দেখা হয়েছে। ফলাফল হয় নারী আনত লজ্জাশীলা, অথবা শুধুই যৌনতা সর্বস্ব অস্তিত্ব। যৌনতার সঙ্গে নারীর মনঃস্তত্ত্বের যোগাযোগ ছুঁতে পারে নি এই কাব্যধারা। রাধা নামের এক প্রবল ব্যক্তিত্বময়ী নারীসত্তা প্রায় পর্যবসিত হয়েছেন ‘কৃষ্ণের রাধা’ সত্তায়। মুদ্দুপলানি রাধাকে দেখতে চেয়েছেন শুধু রাধা হিসেবেই। সেই রাধা যিনি কৃষ্ণকে মুখঝামটা দিতে পারেন, ইলাকে ছোটোবেলা থেকে শিক্ষিত করতে থাকেন, কৃষ্ণের সঙ্গে ইলার বিয়ে প্রথমে উদার ভাবে মেনে নেন, ইলার জন্য চিন্তিত হন, প্রেমিকা সুলভ হিংস্রতায় ইলার উপর রেগে যান, কৃষ্ণের সাথে যৌনতাকালীন অবস্থায় আগ্রাসী হতে পিছপা হন না, এমনকি পিছপা হন না কৃষ্ণকে ত্যাগ করতেও। ‘কৃষ্ণের রাধা’ থেকে যখন বিনির্মিত হয়ে জন্ম নেয় ‘রাধার কৃষ্ণ’, ‘রাধিকা সান্ত্বনম’ হয়ে ওঠে নারীত্বের হরেক রঙের উদযাপন। নারীর মেয়েবেলার উদযাপন, উদযাপন নারীর ঋতুমতী হয়ে ওঠার, উদযাপন সমস্ত সামাজিকতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নারীর প্রেমে মেতে ওঠার।
এই পর্বে ‘রাধিকা সান্ত্বনমের’ ‘অবতারিকা’ এবং ‘প্রথম অধ্যায়’-এর নির্বাচিত অংশের অনুবাদ রইল। এই অংশে রয়েছে মুদ্দুপলানির এই কাব্য রচনার প্রেক্ষিত এবং রাধার কৃষ্ণের প্রতি অনুরাগ, রাধার ইলাকে বড় করে তোলা, ইলার ঋতুমতী হওয়া, কৃষ্ণের সঙ্গে ইলার বিয়ে, কৃষ্ণের সঙ্গে ইলার রতিক্রিয়া, সেই রতিক্রিয়া চলাকালীন রাধার মানসিক অবস্থা, ইলার সামনেই রাধার অবদমিত যৌনতার প্রকাশ এবং ইলার অনুপস্থিতিতে রাধার কৃষ্ণের সঙ্গে দ্বন্দ্বময় রতিক্রিয়া ও সংলাপে মেতে ওঠা।
সোর্স টেক্সট হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে সন্ধ্যা মূলচন্দানীর ইংরেজি অনুবাদ।

রাধিকা সান্ত্বনম
অবতারিকা

প্রভু, ভালবেসে রাধার দিকে চেয়ে বললেন,
“হে সুন্দরী ,তোমার তুল্য সুন্দর কেউ কি আছে?”
জ্বালাতন কোরো না,সারা জীবন কি তোমাকেই ভালোবাসি নি?”
রাগী মেয়ে উত্তর করে।
আর তাই, রাধার রাগ ভাঙাতে কি নওল কিশোর তাকে জড়িয়ে ধরে বুকে
তাই, এখানেই শুরু করি, মন যা চায় বলি।

****

মু্দ্দুপলানি ভালোবাসে যে কবিদের তাদের সকলের আশীর্বাদ নিয়ে শুরু করতে চায় তার কাব্য। সংস্কৃতজ্ঞ মহাকবি বাল্মীকি, ব্যাস এবং কালিদাস, তেলগু কবি নান্নায়া, টিকান্না, নাচানা সোমানা,শ্রীনাথা, ভাস্কারা,ভেমুলাভাদা এবং ভীমা কবি।তারপর সে তার কাব্য রচনার কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে অস্বীকার করে সমস্ত কুকবি ও পক্ষপাতদুষ্ট সমালোচকদের যত তত্ত্ব।

***

কুৎসায় কেটে যায় যে কুকবি আর পক্ষপাতদুষ্ট সমালোচকদের জীবন তাদের দিকে মনযোগ দিও না। পড়ার সময় বাছবিচারও জরুরি। স্পষ্ট ভেদাভেদ করিও ভালো ও খারাপ লেখাকে। ভেদাভেদ করিও ভালো ও খারাপ লেখককে। এড়িয়ে চলো কুকবিদের। নিজে যেচে কে বা কুকাব্যের কথার তীরে এফোঁড়ওফোঁড় হতে চায়?

***

কিন্তু নিন্দুকেরা কখনোই থামে নাঃ
“এত কাব্য রয়েছে যা মানে গুণে শ্রেষ্ঠতর
আর একটি কাব্যের কি প্রয়োজন?”
তাদেরকে বলিঃ
“ যে মৌমাছি পদ্মমধু খায়
সে কি আর পাঁচটা ফুলেও একই
আগ্রহ নিয়ে আসে না?”

অধ্যায়ঃ এক

মুদ্দুপলানি জানত যে তার কাব্যের বিষয় এবং রচনাশৈলী নিয়ে সমালোচকেরা নিন্দামুখর হবেন,সে জন্যই বুদ্ধিমত্তার সাথে সে বেছে নিল রাধা কৃষ্ণ এবং ইলার প্রেমের আখ্যান ।এই আখ্যান বিদ্বান রাজা জনককে শোনাচ্ছেন ঋষিশ্রেষ্ঠ মহামতি শুক ।

***

উৎসুক রাজা জনক সুবিখ্যাত মহামতি শুক মুনিকে শ্রদ্ধাপূর্বক শুধালেনঃ
“ হে মহর্ষি, ভগবান বিষ্ণুর উপাখ্যান জেনে আমি অত্যন্ত আনন্দিত ! কিন্তু জানতে চাই যে রাধা যিনি ইলাকে ছোট থেকে বড় করেছেন,তিনি বিরক্ত হলেন কীসে? কী তার রাগের কারণ? আর রাখালরাজা দেবকীপুত্রই বা কী উপায়ে মান ভাঙালেন প্রেমিকার?দয়া করে আমাকে এই কাহিনী শোনান , শুনে ধন্য হই আমি!
রাজার কথা শুনে, ঋষি শুক ভক্তিভরে শ্রীকৃষ্ণের চরণদুটির কথা মনে করলেন, আত্মহারা শুকের দুই চোখ দিয়ে আনন্দ বারি ধারা বইতে লাগলো, তিনি বললেনঃ
নন্দর অন্তপুরে শুয়ে আছেন কৌস্তুভমণি শোভিত, দানবদলন , হৃদয়হরন, সকল গুণের আধার মদনগোপাল।

***

তার সুখ্যাতি আগুনের মত ছড়িয়ে পড়েছে ভূলোকে,
তিনিই যে চাঁদ ,এটা কি সন্দেহের বিষয়?
তার উজ্জ্বল আভায় যে ভাবে পদ্মবন আকুল হয়
তাঁকে সূর্য বলে ডাকতে ইতস্তত করব কেন?
সত্যই তিনি দানবসংহারক
তাকে দেবাদিদেব বলতে দ্বিধা করব কেন?
তার দেহ দ্যুতিতে রাজহংসও বিমোহিত ,
তাকে সমুদ্রদেব ডাকতে কী কারণে থমকাবো?
নবারুণের ছটা যেন তার দুপায়ের পাতায়
পদ্মেরই মত ফুটে উঠে না কি?
জ্ঞানীজন পূজা ও প্রার্থনা করেন
কৃষ্ণ বসে থাকেন নিস্তব্ধ , নির্জন।

***

তার চিকন কালো কুঞ্চিত কেশদাম
চাঁদের মতন মুখকে ঘিরে রাখে
উজ্জ্বল চোখের উপর বাঁকা ভ্রূর প্রহরা
সেই মেঘবরণের দুর্নিবার আকর্ষন
আটকাতে পারে না বৃন্দাবনের কোনও সুন্দরী।
হায়! এমন সম্মোহক পুরুষের কি উচিৎ কারুর পাণিপ্রার্থনা করা!
কি করে নিজেকে ধরে রাখে একজন সতী অথবা সন্ন্যাসিনী?

***

যখন রাধা তার পূর্ণ স্তনদুটিকে
দানবদলনের কাছে তুলে ধরে
ইলা তখন ডুকরে ওঠে ,”কিন্তু আমার তো কিছু নেই!”
যখন রাধা তার রক্তবর্ণ ঠোঁট মেলে ধরে
ইলা বিলাপ করে,” আমার ঠোঁট এমন স্বাদু তো নয়!”
যখন রাধা কৃষ্ণকে একটি ময়ূরপুচ্ছ উপহার দিলেন
ইলা কেঁদে ওঠে ,” আমার তো কিছু নেই দেওয়ার”
যখন রাধা হেসে ওঠেন , ঝলসে ওঠে তার কুন্দশুভ্র দন্তপংক্তি ,
ইলা বিলাপ করে, “আমার দাঁত তো এমন ঝলমলায় না”
আর যখন রাধা কৃষ্ণকে আমন্ত্রন করেন শয়নকক্ষে
ইলা ডুকরে উঠে বলে, “আমার জন্যও অপেক্ষা করো”
রাধা ও কৃষ্ণের আনন্দ উদযাপনে অপেক্ষা করো ইলার জন্যও।

***

বীনা বাজানো শেখা হল
শেখা হল সকল রাগ,
ভরতের নাট্য শাস্ত্র , মুদ্রা ,
কাব্যের আত্মাস্বরূপ রস, ছন্দ, মাত্রা,
কাব্য রচনার শিল্প
কৌশল , কূটতর্ক, কমনীয়তা
আর আবেগ;
যত্ন করে, ধৈর্য ধরে, ভালবেসে
রাধা সকল কিছু শেখায় ইলা কে ।

***

ইলাকে শেখাতে পড়াতে কখনো কখনো রাধা
নিজেই অবাক হয় যেত তার শিষ্যার ফুটে ওঠা রূপ দেখে
ইলার দিকে চেয়ে , মজা করে বলত
“তুই আবার প্রতিদ্বন্দ্বী? ধ্যাত!”
পরক্ষনেই ইলার দিকে চেয়ে রয়
গাল টিপে, চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দেয় তাকে।

***

তারপর সকল নিষ্পাপ সারল্যকে মুছে ফেলে
বয়ঃসন্ধি এল, ধীর পায়ে ।
তার আঙুলের ডগা এখন রক্তাভ , শরীরে সুগন্ধ বয়
স্বর যেন পাখির কাকলি
আর পাকা ফল ভেবে আগড়ম –বাগড়ম বকা টিয়েগুলো
ঠুকড়ে যায় তার ঠোঁট,
রাহুসম কালো বেণী চাঁদপানা মুখটি ঘিরে রয়
মৌমাছি যেমন সূর্যমুখী ফুলের দিকে ধায়,
তার রোমাবলী গোপনে ফুটে ওঠা এক ফুলের দিকে যায়
তার চলার ছন্দ রাজহংসের মতই শোভন ও সংযত
চোখ তার হাসে, কান শোনে গোপন কথা…
সেই বালিকা টের পায় ভিতরের বদল
বুঝতে চায় যৌবন স্রোত
ফুটে ওঠে নারী।

***

আর তারপর সেই পয়মন্ত ভোর আসে,
ইলা ঋতুমতী হয়।
নতুন পোশাকে , সাজে, তরুনীরা ভীড় করে আসে
চাপা হাসি, গুঞ্জনে ভরে ওঠে উঠোন
ভোজ শুরু হয়

***

“চল সই, যশোদা মা কে খবর দি
নিশ্চয়ই উপহারে ভরিয়ে দেবে”
“চল, রোহিণী কে জিজ্ঞেস করি
যৌবনের সব লক্ষণ মিলছে তো ?”
“চল, জরো করি সব বন্ধু পরিজনদের
কাকাকে বলি, একটা শুভ দিন স্থির করুন”
“চল, গর্গ মুনিকে জানাই গিয়ে যে
নতুন কুঁড়ি ফুটেছে।“
“চল, ওকে সাজাই ফুলে, গায়ে লেপে দি সুগন্ধী
ওকে দেই খেজুর আর মধু!”

***

পুরোহিতেরা মন্ত্র তন্ত্র , পবিত্র বারি ,বিভূতি দিয়ে
গৃহশুদ্ধি করলেন
কুদৃষ্টি থকে বাঁচতে চারদিকে মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে দিলেন
সুন্দরী ইলা যাতে সকল অশুভ স্পর্শ মুক্ত হয়, নিশ্চিত করলেন তা।

***

পরের দিন সকালে , রীতি মেনে রাধা গাড়ি বোঝাই করে আশেপাশের সমস্ত গুণীজনের বাড়ি পৌঁছে দিল উপহার আর হরেক পিঠে।
উৎসবের পঞ্চম তথা শেষ দিনে ইলাকে উঁচু একটি মঞ্চে বসিয়ে , উপস্থিত সকলকে দেওয়া হল পবিত্র হলুদ, কুমকুম, নারকেল আর পান পাতা।

***

যখন সেই শুভমুহূর্ত এল,
গর্গ অন্যান্য ঋষিদের সঙ্গে আরম্ভ করলেন বিবাহানুষ্ঠান ।
মন্ত্রের সুরের সঙ্গে তাল মেলাল বাদ্যের বোল
আনন্দিত দেব দেবী স্বর্গ থেকে পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলেন
অতিথিরাও সকলে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইলেন !

***

আচার হল শেষ ,
দাঁড়িয়ে আছেন হরি ও ইলা
স্বামী ও স্ত্রী ।
সমবেত সকলে চেখে নেয় বিয়ের সমস্ত উপাদেয়।

***

“হে কৈটভনাশন ,
তোমার চুম্বনাঘাত কি এই কচি মেয়ের ঠোঁট সইতে পারবে?
হে পশুপতি সিংহ
তোমার প্রেমের আঁচড়ে কি ক্ষতবিক্ষত হবে না এই নরম বুক?
চানুরকে যে পরাস্ত করেছে কুস্তিতে
সেই তোমার তেজ কি ধারন করতে পারবে তার তরুন উরু?
হে হস্তিদলন
তার কোমল শরীর কি টিকবে?”
বিব্রত লজ্জিত ইলাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে মেয়েরা
গা টেপাটেপি করে হেসে গড়িয়ে পড়ছে
লাজে রাঙ্গা ইলার মাথা ঝুঁকে আসছে।
অধীর রাধা তাকে কাছে টেনে নেয়, পরামর্শ দেয়

***

যখন প্রেমিক তোমাকে জড়িয়ে ধরবে
বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরো তাকেও , ধীরে
সে যখন তোমার গালে চুমো দেবে
শরম কোরো সামান্য,কিন্তু ছুঁয়ে দিয়ো ঠোঁট দিয়ে তার ঠোঁট
যখন সে তোমাতে প্রবিষ্ট হবে
তালে তাল মিলিয়ে জাগিয়ে তুলো তাকে
মিলনে সে ক্লান্ত হয়ে এলে
তুমি তার উপরে উঠো
দ্রুত সক্রিয় হয়ে
তাকে উত্তেজিত কোরো
প্ররোচিত কোরো
কখনো ভুলো না সে আদ্যন্ত প্রেমিক
কামকলায় পটু, অভিজ্ঞ।
তাই তাকে আদর করো সাবধানে
আদর করো ভীষণ
আর তোমাকেও আদর করতে দিয়ো।
আমার উপদেশ এই টুকুই
বাকি তুমিও কিছু কম জানো না”

***

সত্যিকারের প্রেমের কোনো সীমা নেই
নেই কোনো নিয়ম নীতি”
এ ভাবেই রাধা কামশাস্ত্র থেকে শেখায় ইলাকে।
তারপর রাধা ইলাকে সঙ্গে করে নিয়ে যায় অপেক্ষমান কৃষ্ণের কাছে, বলে,

***

“ এর স্তন দুটি অতি কোমল, ফুটতে চাওয়া কুঁড়ি যেন
আমার মত নয়,
এরা তোমার আঁচড় সইতে পারবে না
এর ঠোঁট আমার ঠোঁটের মত নিটোল প্রবাল নয়
কচি পাতার মতন সবুজ এখনো
জোরে কামড়ে ধোরো না
এর উরু নতুন কদলী কান্ড সম
আমার অভ্যস্ত উরুর মত আঁকড়াবে না তোমায়
এর শরীর লতিয়ে উঠছে ,কুঞ্জ ছাইছে ধীরে
আমার মতন আগুনে পোড়া সোনা নয় এ।
সে কখনো আমি নয়, আমি নই সে।
নিতান্ত ছেলেমানুষ
কিন্তু এখন সে তোমার সঙ্গে নামছে প্রেমের খেলায়
তুমি তো জানোই কি করে নারীকে ছুঁতে হয়?
আমার উপদেশের প্রয়োজন নেই নিশ্চয়ই?
তুমি সুনিপুণ কামকলায় প্রেমিক প্রবর”
একলা নির্জন রাধা, ধীর পায়ে বেরিয়ে আসে, সখীদের কাঁধে ভর দিয়ে এগোয় সে, তার বাসুদেবকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলে বিরহী রাধা । মানিনী মান বজায় রাখে তবু বারে বারে ফিরে ফিরে দেখে কৃষ্ণের বন্ধ দরোজা ।

***

বিছানায় শুয়ে সে ভাবে,
“ সব চেয়ে দামি গয়নাটিও কেউ হেলায় দিতে পারে
ছাড়তে পারে নিজের সব প্রিয় সম্পর্ক
এমন কি সব চাইতে মূল্যবান বস্তুও
একজন নারী জীবন পর্যন্ত দিতে পারে
কিন্তু নিজের প্রেমিককে অপরের হাতে তুলে দিতে পারে কেউ?
কোনো মানুষ পারে তা?
কোনো নারী পারে?”

***

নিশ্চিত জানি, এতক্ষনে হয়তো সে তার ঠোঁটের মধু শুষছে
নিজের স্তন চেপে ধরছে তার নগ্ন বুকে
এতক্ষনে হয়তো , ঘুঘুর মতন আধো আধো ডাকছে দুটিতে
পুরুষটিকে উপরে রেখে, সে তাকে নিজের দিকে টানছে
যদিও একটু আড় আছে, তবু সে অন্য ভাবে সে হয়ে উঠেছে পটু
এতক্ষনে হয়তো পুরুষটি তাকে আয়ত্তে এনেছে, তার সব আড় ভেঙ্গে ফেলেছে
এখন হয়তো,পুরুষের বুকের মাঝে শুয়ে সে ফিসফিসাচ্ছে মিঠে যত এতোলবেতল
এখন হয়তো পুরুষটি তার সর্বাঙ্গ স্পর্শ করে তাকে আরো কাছে টেনে নিচ্ছে
এতক্ষনে হয়তো তাকে সকল কিছু শিখিয়েছে ।”

***

তার মন ভার
প্রাণ অস্থির
মন্মথের প্রেম আর কৌশল
তাকে ভেতরে ভেতরে পোড়াচ্ছে
এক পলকের জন্যও ঘুম আসে না
রাত্রির গভীরে শুধু জল ঝরে

***

ঘুম নেই কৃষ্ণের চোখেও
নতুন প্রেমিকায় মগ্ন সে

***

ঝিয়েরা দাঁড়িয়ে, ডাকের অপেক্ষায়
নির্ঘুম রাতের ক্লান্তি সরিয়ে উঠে বসে রাধা, গুছিয়ে নেয় কাপড়
তারপর সোজা নন্দর উঠোনে গিয়ে , দরজার কড়া নাড়ে , জোরে ।

***

ইলা এসে দরজা খুলে দেয়
কৃষ্ণ হাত নেড়ে ডাকে রাধাকে
রাধার বাহু থেকে ঝটপট উড়ে যায় টিয়ে হরির কাছে, তাকে বলেঃ
“হে পদ্মনেত্র! তার চুলে নীল ফুল নেই
আছে কন্দর্পের তীর,
হে প্রভু! নীলার নথ ছেড়ে, মুক্তা পড়েছে সে ,তোমার জন্য,
তার বুকের চন্দনের লেপে কস্তুরিগন্ধ নেই
ধুলায় ভরে আছে বুক,হে অনঙ্গনাথ !
তার সারা গায়ে চন্দন গুঁড়ো নয়, লেগে আছে ফুলের রেণু”

***

“কামদেবের শরে ক্ষতবিক্ষত, দগ্ধ,
ঢেকে রাখলেও, লুকোতে পারছে না
নিডর রাধা আজ এখন এখানে এসেছে
শুধু তুমিই পারো প্রভু তার ব্যথা কমাতে!”

***

যখন কৃষ্ণ শুনছে টিয়ের কথা
আনমনা রাধা কৃষ্ণকে বিঁধছে,
মায়া হচ্ছে তার
ইলার দিকে আঙ্গুল তুলে বলছে,
“এর নরম ঠোঁট তুমি কামড়ে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করেছ!
এর সদ্য ফোটা কোমল স্তন ভরে আছে তোমার নখের আঁচড়ে
এর রেশমের মত চুল ঘেঁটে দিয়েছ
এর কাপড় কুঁচকে ফেলেছ
এর কমনীয় শরীরটাকে পিষে ফেলেছ একেবারে
মেয়েটাকে এমন ক্লান্ত অবসন্ন করে ফেলেছ!
“ওহ ! সে সব পুরুষদের লজ্জা হওয়া উচিৎ যারা নারীর তৃপ্তির কথা না ভেবে
শুধু নিজেদের তুষ্টির কথাই ভাবে,”
রাধা ইলার প্রতি উদ্বেগ দেখিয়ে , জুড়োতে চায় নিজের কামনা সকল

***

এইসব শুনে, কামনা বুঝে
এক সখী রাধাকে ঠেলে দেয় সোজা কৃষ্ণের দিকে
কৃষ্ণ তাকে বুকের ভিতর জড়িয়ে নিলে
সেও ধরা দেয় তার আলিঙ্গনে
ইলা , অপ্রস্তুত হেসে সরে আসে
মনে ক্ষোভ ,মুখে হাসি
দৌড়ে পালায় ইলা।

***

এ ভাবেই শুরু হয় প্রভু আর রাধিকার প্রেমের খেলা

***

তারপর বিরহী বারণ যেন
তারা দুজন ফুলেল বিছানায় এসে বসে
একে অপরকে আদর করতে করতে শুরু হয় তাদের প্রেমলীলা।

***

কথা দিয়ে বিঁধতে বিঁধতে
একে অপরের পোশাক ছিঁড়ে ফেলে,
আঁচড়ে কামড়ে বিপর্যস্ত করে,
লাল হয়ে আসা গাল ও জ্বলতে থাকা চোখে
চেয়ে থেকে তারা, উন্মত্ত দুই কুস্তিগীর যেন জমি ছাড়ে না কেউ কারুকে
উরুতে উরু চেপে এক অপরের উপরে উঠে ,
খিলখিলিয়ে হেসে, দস্যুর মত দুর্দম তারা
মেতে ওঠে ,
রাধা আর শ্রীহরি একে অপরের ভিতর ডুবে যেতে যেতে
ছুঁয়ে ফেলে পরিতৃপ্তি ।

***

তারপর কথা শুরু হয়,

***

দুষ্টুমি করে জিজ্ঞেস করে রাধিকা
“আমাকে সবটুকু বলো “
সাবধানী কৃষ্ণ উত্তর দেয়,
“প্রিয়তমা তোমার অপূর্ব উরু যেভাবে আমাকে আঁকড়ে ধরে,
ওর অমন নয়, ওই সরু উরু কিছুই পারে না”
“কিন্তু প্রিয়, মনে তো হচ্ছে তুমি মোহিত এবং সে মোহিনী
বলো আমায়, তুমি কেমন করে আদর করলে তাকে ? আলতো করে?
আর সে –ই কি প্রথম এগিয়ে ছিল?”
“আমাকে এসব জিজ্ঞেস করো না”
“তাহলে আমাকেও আদর করো,
তৃপ্ত করো আমাকেও”
“ তুমি পরিণত, তুমি অভিজ্ঞ, রাধিকা,
এসো লিপ্ত হই”

***

“উমম…তাকে চুমো খেলে, কৃষ্ণ?”
“নাহ! রাধা ওর ঠোঁট তেতো ”
“তুমি তার স্তন শক্ত মুঠোয় ভরলে?”
“নাহ! ওগুলো খুব ছোট ”
“তার উরু কি স্বাদু ?”
“নাহ! বড়ই রোগা , রাধিকা!”
“তার সুন্দর শরীরটা জরিয়ে ধরোনি?”
“ও বড়ই লতানে”
“ নিশ্চয়ই তার সাথে মিলিত হয়ে তুমি অসম্ভব আনন্দ পেয়েছ…?”
“কিন্তু নতুন মিলন সর্বদা অসুখী !
এমন অনভিজ্ঞ কারুর সাথে মিলন কি কখনও উপভোগ্য হয়?”
“ তার রতিকলার কি তুমি দাস নও ?”
তার মত নিষ্পাপ কি জানে রতি কলা কী, রাধে?”

***

পদ্ম কুঁড়ি ফুটে উঠছে
চখা উড়ে যাচ্ছে চাঁদের ওপারে
ছড়িয়ে পড়ছে উষার আভা
আরেকটা সকাল শুরু ..।

Facebook Comments

Leave a Reply