পাঠপ্রতিক্রিয়া : উমাপদ কর
রাত্রির রঙ বিবাহ / অরবিন্দ চক্রবর্তী
তোমার কবিতার বই ‘রাত্রির রঙ বিবাহ’ পড়লাম। কিছু কথা শেয়ার করতে ইচ্ছে করল। কিন্তু কবিতা সব পড়ার পর (আমি সাধারণত কবিতার বই পড়তে গিয়ে ব্লার্ব, পরিচিতি, ভূমিকা ইত্যাদি আগেই পড়ি না। অনেক সময় পড়িই না।) দেখলাম, আমারই প্রিয় এবং কাছের বন্ধু স্বপন (রায়) লিখেছে বইয়ের ভূমিকা। ভালো করে তা পড়লাম। আমার কিছু কথা ও তো বলে দিয়েছে। দেখি আমার আরেক বন্ধু শিমুল মাহমুদ লিখেছে ব্লার্ব। তার লেখাটাও পড়লাম। ওরা দুজনে মিলে কবিতার তত্ত্বগত, ভাবগত, চিহ্নগত এবং নির্মাণগত কথাবার্তা মণীষীদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে। তাহলে আমি আর কী লিখব? থমকে গেলাম। কিন্তু সামান্য প্রতিক্রিয়া জানাতেও ইচ্ছে করছে। তখন প্রতিক্রিয়া জানানোর উপায় হিসেবে একটা পন্থার কথা স্থির করি। আমি ‘রাত্রির রঙ বিবাহ’ নিয়ে ‘বুক-ক্রিকেট’ খেলব। আমি তিনবার ব্যাট করব। মানে, চোখ বন্ধ করে বইটা খুলব। দুটো পৃষ্ঠা আলতো করে চলে আসবে আমার চোখের সামনে। দুটো কবিতা। প্রথমে ভেবেছিলাম, দুটোর যে কোনো একটা বাছব। পরে ভাবলাম, না, দুটোই ফের পড়ব, আর আমার মনে হওয়াগুলো লিখব। তাহলে, তাই হোক। তিনবার। মানে ছটা কবিতা। আশা করি, এতে আমার বলা কথাগুলো সারা হবে। কারণ, গোটা বইয়ের প্রথমপাঠটা তখন আমার মধ্যে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করতেই থাকবে। এর আগেও পাঠপ্রতিক্রিয়া লেখার সময় আমি ঠিক এরকমটা নয়, কিন্তু র্যানডাম বাছাই পর্ব চালিয়েছি। তাতে খুব একটা খারাপ ফল মেলেনি। অতএব—
চোখ বন্ধ। দু-হাত চালু। খুলে গেল ১৪-১৫ পৃষ্ঠা। কবিতা—“ঔঁ = চিহ্ন অথবা শরীর অথবা বীজ”, আর “ইজারাস্থান”। বেশ। পুনঃপাঠ। প্রথমেই কবিতাদুটোতে, কিছু শব্দ, শব্দ-বন্ধ, বাক্যাংশ, এমনকি পঙক্তি আন্ডারলাইন করলাম। উল্লেখ করি। ‘ত্রিভুজে পেশোয়া মাখানো’, ‘সর্বজয়া পাখি’, ‘নিউটন নিউটন খেলব’, ‘মারুত চাষ’ ‘ফুর্তিগণ’, ‘নিথুয়া’, ‘ঘটনাত্যকায়’, ‘কান্নামঙ্গলে’, ‘আমি মাতৃক হব, সে হবে আজানু পিতার বীজক’, ‘উল্লোল’, ‘জয়োস্ত’ ‘নাভিমূলে’ ‘ঔঁ’, ‘গানশালায়’, ‘ব্যবহার হলো’ ‘খুলিসমগ্র’, ইত্যাদি। ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে। বেশকিছু নতুন আমদানির একটা প্রয়াস। শুধু শব্দে নয়, ভাবে, ভাবনায়। যেমন ত্রিভুজ একটি জ্যামিতিক চিহ্ন বিশেষ, যা একটা সেপকে রেফার করে, এবং তা অনেক কিছুতেই আরোপ করা যায়, যেমন ভূমিতে, আসবাবে, খেলনায়, যন্ত্রে, আরও অনেক কিছুতে। কিন্তু এখানে যেভাবে প্রয়োগ করা হলো, তা বায়বীয়ে, বা শুধুই আকৃতিতে, যা কিনা রাজারাজড়া বলি, মহারানা বলি, সিন্ধিয়া বলি, বা পেশোয়া বলি তাই মাখানো। তো বাস্তবে এটা অসম্ভব, কিন্তু ভাবজগতে এই পেশোয়া মাখানো ত্রিভুজ শুধু চলে না, একটা চিহ্নকেও চিহ্নিত করে। সেটাই করেছ তুমি। ‘সর্বজয়া পাখি’ এরকম পাখির নাম কই আমি তো শুনিনি, আপনারা শুনেছেন? কিন্তু তুমি এমন একটি নতুন পাখি আবিষ্কার করেছ। হতে পারে সে সবকে জয় করা পাখি, যে গান গাইবে। হতে পারে সে অপু-দুর্গার মা সর্বজয়া, আর তিনিই পাখি, তাঁর সাংসারিক গান গাইবে কবি তথা তুমি। আবার এ-দুটোর কোনোটাই না-হয়ে সর্বজয়া একটা প্রপার নেম মাত্র, যে পাখি হতে পারে, গাইতে পারে নিজস্ব গান। একটা সম্ভাবনা। ভাবনাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে একটা সম্ভাবনার সৃষ্টি। ‘নিউটন নিউটন খেলব’। আরে মিথ হয়ে যাওয়া সেই গল্পটা। আপেল মাটিতে পড়ে। ওপরে উঠে যায় না, বা কিছুটা পড়ে শূন্যে দাঁড়িয়ে থাকে না। মাধ্যাকর্ষণ। তো আগেই তুমি ঢুকে পড়েছ আপেল বাগানে, যেখানে টুপ-টাপ পড়বে আপেল, তোমাদের নিউটন খেলার মাধ্যমে। মিথের সঙ্গে কল্পনা মিশে একটা নতুন খেলা বলা যায়। ‘মারুত চাষ’— তা, মারুত তো বাতাস যা শুধু বয়েই যায় আর প্রাণীকূলকে বাঁচিয়ে রাখে অক্সিজেন সাপ্লাই করে, যার অস্তিত্ব আছে ঠিকই কিন্তু আকার আকৃতি নেই, সব ইন্দ্রিয়ে ধরা পড়ে না, ধরা পড়ে অনুভবে। তবে তার চাষ সম্ভব কীভাবে? হয়, হয়। জানতি পারো না। বাতাসের চাষও এক অনুভব। বাগানে (গাছে ভরা, বা ফুল, ফল, সব্জির) তার চাষ ফলন সমৃদ্ধিকেই আইডেন্টিফাই করে। বাতাসে অক্সিজেনের ফলন বেশি হলে প্রাণীকূলের লাভ, আর নাইট্রোজেন বৃদ্ধিতে চারার, গাছের, মহীরুহের। তো, অনুভবকে আইডেন্টিফাই করা যেতেই পারে এভাবে। ‘ফুর্তিগণ’ আর কিছুই না, একটা বিশেষ্যপদকে বহুসংখ্যক (Plural) করে তোলা। আনন্দসকলের কাছে ক্ষমা প্রার্থণা করা। কারণ, সে এখন ফুর্তিবৃন্দকে সেভাবে রেসপন্স করতে পারবে না। কিন্তু শব্দটি গঠনে একটা চমক আছে। এটা ভাবপ্রধান নয় চমকপ্রধান। ‘নিথুয়া’— আমার কাছে একদম নতুন শব্দ। অভিধান সহায়। হতাশ। কিন্তু যে দুই পঙক্তির মধ্যে এই শব্দের প্রয়োগ, তাতে আমার অনুভবে একটা দুলুনি লাগে। সেক্ষেত্রে প্রয়োগটির একটা ভূমিকা আছেই। নতুনকে অভিবাদন। ‘ঘটনাত্যকায়’, ‘গানশালায়’, ‘খুলিসমগ্র’ শব্দতিনটি এক সঙ্গে আনব। আমরা অনেকেই অনেকদিন আগে এই ধরণের শব্দখেলায় খেলেছি আনন্দের সঙ্গে। তুমি তরুণ। তুমি তো খেলবেই। আরও খেলো। যে তরুণরা এরকম নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় থাকে, তাদের কাজে, ব্যক্তিগত আমি খুশি হই। উপত্যকা, অধিত্যকা এসব শব্দ আমাদের জানা। উপ আর অধির জায়গায় ঘটনা এসে ভাবনার পরিসরটি বদলে দেয়। তেমনি গান জানি, হাতীশালা, ঘোড়াশালা, শালা প্রতিশব্দে বাড়ি, এসবও জানা। আর এই দুই বিশেষ্যপদ মিলিয়ে গানশালা বা গানবাড়ি। ‘কান্নামঙ্গল’— মনে করায় ‘অন্নদামঙ্গল’ ‘মনসামঙ্গল’ ‘শারদামঙ্গল’ ইত্যাদি। কান্না আর মঙ্গল এই দুয়ের শব্দজোড় শুধু কান্নাকেই যেমন বড়ো করে দেখায় না, তেমনি মঙ্গলকেও শুধু্মাত্র তার সূচকে ধরা যায় না। কান্নামঙ্গল কান্নার আখ্যান হয়ে দাঁড়ায়। একইভাবে খুলিসমগ্রের ব্যবহার। ‘আমি মাতৃক হব, সে হবে আজানু পিতার বীজক’ – আমি ও সে সর্বনামকে আইডেন্টিফাই করার সঙ্গে সঙ্গে ‘বীজক’ শব্দটি এসেছে। এই বীজ শব্দটি এই বইয়ে যে কতবার কতভাবে প্রয়োগ হয়েছে তা গুনে দেখিনি, কিন্তু বহুবার হয়েছে, কখনো অবিকৃত, কখনো কোনো শব্দ আগে বসিয়ে, কখনো কোনো শব্দ পরে বসিয়ে, আবার কখনো শব্দজোড়ে। কেন? কেন? প্রশ্নটা তুলেই ফেললাম। খেয়াল করলাম, এই প্রয়োগের মাধ্যমে তোমার অস্তিত্বের মূলে যাওয়ার একটা প্রবণতা, বীজ, যা জীবজগতের উৎস। সেই উৎস যেন তোমার অন্বেষণ। আবার এই অন্বেষণের মাধ্যমেই তুমি আত্মানুসন্ধানেও ব্রতী হয়ে ওঠো। যেমন এই কবিতাতেও ‘নাভিমূল’ শব্দটি এনেছো। সেও-তো এক কেন্দ্রক, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মূল এই উৎসটি। ‘উল্লোল’ (ঢেউ) শব্দটি আভিধানিক হয়েও প্রয়োগের মাধুর্যে একটা মাত্রা পেয়েছে। ‘জয়োস্ত’— শব্দটি অভিধানে পাওয়া যাবে না, জয়স্তু বললে হয়তো পাঠকের সুবিধে হতো, কিন্তু জয়োস্ত হয়েও ভাবের দ্যোতনা প্রকাশে বাঁধা সৃষ্টি করেনি। ‘ঔঁ’ তোমার কথায়, একটা চিহ্ন, বা শরীর বা বীজ। আমার ভাবনায় বাজতে থাকে একটা ধ্বনি, একটা নাদ বা ধ্বনন, একটা চিহ্ন, একটা বীজমন্ত্র, এবং সর্বোপরি একটা আত্মশক্তির অনুভব। সামান্যই তফাৎ। তুমি ব্যবহার করেছ ‘ব্যবহার হলো’, আমরা সাধারণত পরিচিত ‘ব্যবহৃত হলো’-র সঙ্গে। এখানেও সামান্য হলেও নতুনের স্বাদ।
আরেকটি দিক। প্রথম কবিতায় ব্যবহৃত ক্রিয়াপদ ভবিষ্যত কালকে তুলে এনেছে বা সূচিত করছে। সবই যেমন— করবে, গাইব, খেলব, ফেলবে, করব, দেখব, আসবে, দেব, হবে, দেবে, বলবে, ইত্যাদি। দ্বিতীয় কবিতায় কালটি মিলেমিশে। বর্তমান, ভবিষ্যত এবং অতীত কাল। যেমন— বসায়, ডাকবে, আসবে, নাচবে, গেছে, নিল, করল, হলো, লাগল ইত্যাদি। ভবিষ্যত নিঃসন্দেহে সম্ভাবনা, অতীত ঘটে যাওয়া বা স্মৃতি বা অভিজ্ঞতা, আর বর্তমান ঘটমান, যা মুহূর্তেই অতীত হয়ে যায়।
কী বলতে চাই আমি? কবিতা নিয়ে এত কাঁটাছেঁড়া কেন? এ-কি আদৌ শোভন? কাঁটাছেঁড়া আর প্রতিক্রিয়া তো এক নয়। তবুও কেন? আরেকটু বুক-ক্রিকেট খেলে, শেষে এর উত্তর দেব এবং শেষ করব। অগত্যা— দুইহাতে আরেকবার বই খোলা। বেরিয়ে এল ৫৪-৫৫ পৃষ্ঠা। কবিতার নাম ‘বাঁক’, এবং ‘প্রস্তাব অথবা’। এরপরেও আরেকবার তো খুলতে হবে, ভেবেছিলাম, মাঝামাঝি এলে ভালো হয়। একটা ক্রম থাকবে। না, তা এল না। এল শেষদিক থেকে। যাক, এবারে আর শব্দ, পঙক্তি, বাক্য এসব নয়। এবারে দেখা, ভাবনা, কল্পনা, চেতনা ও তার প্রসার এবং নির্মাণ ইত্যাদির খুব সামান্য কথাবার্তা। রাত্রির রং সাধারণত বিনা চন্দ্রে কালো, অন্ধকারের রং, আর পূর্ণ-চন্দ্রে রজতাভ, মধ্য-চন্দ্রে কিছুটা দুইয়ের মাঝামাঝি। তো সেখানে রঙের কোনো নাম না নিয়ে যদি বলা হয় বিবাহ, তবে ভাবতেই হয় এটি একটি বিমূর্ততা। এই বিমূর্ততা কবিকে পেয়ে বসে কবির কল্পনার ডানামেলায় আর চেতনার প্রসারণে। কল্পনা আর চেতনা এক বিষয় নয়, এটা সকলেই জানে। কল্পনার বিস্তৃতিতে বিমূর্ততা আসে ফ্যান্টাসি জড়িয়ে। আর চেতনার প্রসারণে বিমূর্ততা আসে প্রথমে অনুভবে পরে যা লিপিত হতে চায়, সবটা পারে না, কিছুটা হয়। তো বিবাহ মিলনের দ্যোতক, অন্তত আমি যেভাবে ভাবতে চেষ্টা করেছি তাতে রাত্রির সেই রঙের কথা, যা মিলনের প্রক্রিয়াকে আশ্রয় করে, প্রশ্রয় দেয়। অন্যজন অন্যভাবে ভাবতেই পারেন। এখানে এই দুটো কবিতায় আমি তোমার সেই চেতনালোকের রশ্মিগুলোর বিস্তৃত স্পেকট্রামকে লক্ষ্য করি, অনুভবে আনার চেষ্টা করি, মৌহূর্তিক দেখাগুলো তোমার মধ্যে যে ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে তা শুধু তোমাকে এক দর্শকে আবদ্ধ করে রাখে না। তা থেকে তুমি রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ আত্মস্থ করে জারণ-বিজারণের মাধ্যমে তার প্রকাশ ঘটাতে চাও। তাই আড়াল খোঁজো, ইশারা-ইঙ্গিত খোঁজো, খোঁজো নানা অনুষঙ্গ। এই যে ব্যক্তিক বিস্তৃত চেতনার রূপরেখাটি তার উৎসমূল হচ্ছে, তা একটা নিরন্তর প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে ভাবনাকে চালিত করতে পারার অভ্যাস। আর ভাবনার উদ্রেক হচ্ছে তোমারই চারপাশের পরিমণ্ডল ও জীবকূলের সঙ্গে জড় ও জীব নিরপেক্ষে সংসর্গে, সংঘর্ষে আর মিথস্ক্রিয়ায়। যাকে উপকরণও বলতে পারি। এবং যখন সে অনুভবমালা লিপিত হয় তখন তার বিমূর্ততার জন্য আর একরৈখিক থাকে না, হয়ে পড়ে বহুরৈখিক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তুমি আমার উপরের কথানুসারে নির্মাণকাজে মগ্ন থাকলেও ব্যত্যয় হয়নি তেমনটা নয়। যেমন প্রথম কবিতায় তুমি লিখছ— “পুলিশি টিয়া চৌকি থাকার অজুহাতে/ কোনো এক দুলুনি দৃশ্যের ভয়ানক প্রেমে পড়ে যেতে বাধ্য।” আমি পড়লাম ‘প্রেমে পড়ে যেতে পারে।’ একটা বড়ো তফাৎ। বাধ্য হলো কবির প্রত্যয়, মিমাংসা, যা পাঠককে একমুখীন করে। আর পারে হলো একটি সম্ভাবনা যা পাঠকের সামনে অনেক দিগন্ত খুলে দেয়। কিন্তু শেষে গিয়ে “যদি হ্যাঁ-থাকে তুমি এই পথচেনারে জায়মান করে দাও।” ‘যদি’ এই শব্দের চিন্তাটাই ‘জায়মান করে দাও’ এই যাচঞা বা প্রার্থনাটিকে একমুখী করল না, হয়ে গেল খোলামুখ, মিমাংসা নয়, পরিণতি নয়, খুলে রাখা। দ্বিতীয় কবিতায়, একটা মৌহূর্তিক দেখা “কুহু উড়ে গেল, ভাইপাখিটাও উড়ে যায়…”। শুধু একটা ছাপ রেখে যায়, আহা, ওদের “নাম জানা হয় না।” অসাধারণ। নাম এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয় আদৌ। ওরা চলেছে অজানায়, অচেনায়, কবিও পা ফেলে অজানায় অচেনায় অন্ধকারে, আবিষ্কারের নেশায়, সেও এক অন্তহীন ভ্রমণে, ওইসব পাখির মতোই। অজানা-অচেনায় পা ফেলে, আবিষ্কৃত হয়। অন্ধকারে পা ফেলে, আলো হয়। সেই ভ্রমণের আনন্দ, চেতনার বিস্তৃতি, অজানা-অচেনায় আবিষ্কারের প্রেরণা, অন্ধকারে পা-ফেলে আলো হয়ে ওঠা আমি পাই তোমার কবিতায়। তুমি যখন লেখ, “হৃদয়ে যেন ফুর্তি বারোমাসি অথবা ময়ূরী দেখেছে নুরানি মেঘ”, তখন ঝলকানো মেঘ দেখে ময়ূরীর পেখম মেলার অবসরে নিজের পাখনাদুটোও কল্পরাজ্যে মেলতে পারি। স্পর্শ করে খুব। এ-পর্বে এটুকুই।
শেষবারের মতো ব্যাট করব, যেন একই বলের সম্মুখীন না-হই তেমন একটা প্রার্থনা ছিলই। প্রার্থনা মঞ্জুর। খুলে গেল ৪২-৪৩ পৃষ্ঠা। কবিতার নাম ‘প্রস্তাবনা’ আর ‘আয়ত’। একটু যেন খুশিই হলাম। একটা ভিন্ন কবিতালিপির আকৃতি দেখে। সোজা বললে দাঁড়ায় টানা গদ্যে লেখা কবিতা, যতিচিহ্নসহ। এতক্ষণ ভাষা নিয়ে একটি কথাও বলিনি। তাহলে ভাষা দিয়েই শুরু করা যাক। শব্দ যেমন প্রাথমিক উপাদান কবিতা নির্মাণে, শব্দ দিয়ে ভাষা সেখানে ভাব-ভাবনা বহনকারি মাধ্যম, সুন্দরে-অসুন্দরে, কবিতাময়তায় বা না-ময়তায়। এখানে তুমি খুব ছোট ছোট বাক্যে চালু কথা দিয়ে তোমার ভাষাবয়নটি করেছ। প্রথম কবিতা একটা সামান্য প্রস্তাবনা মাত্র। একটি গল্পের ছোপ লাগা (একটি মেয়ে, নাম নূপুর, পথ পেরোতে হুইসেল, ঘন্টাধ্বনি, ইত্যাদির সম্মুখীন হয়েও নিজেকে বাঁচাতে অক্ষম। নূপুর ছিটকোয়, নামটাই হয়তো পায়ে পরা ছিল, রক্ত, নূপুর বিভিন্ন যন্ত্রনায় ও মূর্চ্ছনায় বেজে চলল। সময়টা আনুমানিক দুপুর।) কবিতার ভাষা হিসেবে এই চলমান ভাষাটি প্রযুক্ত হয়েছে বলে মনে করি। এখন প্রস্তাবনাটা হলো, এমন একটি ‘দুপুরের শিরোনাম আহাজারি হলে কেমন হয়?’। এটি কি তবে একটি গল্প বিশেষ? না। তবে কী? এটা একটা দেখা, বা কল্পনায় দেখা, গল্পছোপের কবিতা হয়ে ওঠা নির্মাণ-কৌশলে আর ভাষা বিন্যাসে। কেমন? যেমন— ‘চাকা। শরীর। রক্ত। ভাবতে আমার ডোরাকাটা লাগে’। বস্তুসমূহের ইঙ্গিত ও ইশারায় ডোরাকাটা ভয়। একটা কবিতাংশ। ‘জেব্রাক্রসিং খেলতে খেলতে’ ‘ফণি করা চুল’ ‘নূপুর’ মেয়েটির চলা একটি কবিতাংশ, বর্ণনা হলেও। আবার, ‘শরীরজুড়ে বাজতে লাগল সজন;’ মুখরায় ‘অচিন ঝিরঝিরি, অন্তরায় ছায়াসঙ্গীত’ আরেকটি কবিতাংশ। এসবকে সম্মিলিত করে কবিতাটি, যা একটি শিরোনাম খোঁজার প্রস্তাবনায় (আহাজারি) শেষ হয়। হ্যাঁ কবিতাটি একটি ক্রমানুসারে প্রস্তাবনা ও পরিণতির দিকে গেছে শেষের প্রশ্নচিহ্নটির মাধ্যমে। ভালো লেগেছে, কিন্তু মন ভরেনি, যেহেতু এই বইয়ে আমি আরও অন্যরকম তোমাকে দেখেছি।
দ্বিতীয় কবিতার ভাষাও একই রকম। কিন্তু এখানে কয়েকটা মাঝারি ও একটা দীর্ঘ বাক্যের মিলিজুলি কবিতাসংসার। না এখানে আর কাঁটা-ছেঁড়া নয়। কত সামন্য মোচড়েই কবিতা হয়ে ওঠে টানাগদ্যও তারই টুকরো দুটো উদাহরণ তুলে শেষ করব শেষ দফার ব্যাটিং। ‘আকাশ মাখল ঝোল’। পাখা খুলে দেওয়ায় গতি মচকে গেল, ফুলস্ব ফল ফাটল না, ফুটে গেল। তারপরই ছোট্ট একটা টুসকি ‘আকাশ মাখল ঝোল’, ব্যাখ্যাতীত কিন্তু ভাবনাতীত নয়। আর শেষবাক্যের অন্য কিছুকে উল্লেখ না-করেও বলা যায় কবিতার মোচড়টা একটা তুলনামূলক ভাবসম্পন্ন ছবি মাত্র। ‘আর পতাকা রোপণ করে রেহেলপাঠের প্রজাপতি’। একদিকে পতাকা রোপণ করে, যার পতপত করে ওড়ার কথা সে রোপণ করে, আসলে মাটিতে এনে বসায় রেহেলটাকে, যা দেখতে একটা ডানামেলা প্রজাপতি। খুব সুন্দর কল্পচিত্র। পরিচিত চিত্রকল্প নয় কিন্তু। উপমার সব বিষয়গুলো থাকলেও, প্রথাগত উপমার মতো করে কবিতায় হাজির করানো হয়নি। সাধু।
খেলাটা গুটোতে হয়। কিন্তু তার আগে একটা ব্যাখ্যা বা উত্তর দেবার পালা আছে। সংক্ষেপে, প্রথম ব্যাটিং-এ মূলত শব্দ, শব্দ-বন্ধ, বাক্যাংশ, পঙক্তি ইত্যাদির খোঁজ নিয়েছি, কাঁটাছেঁড়া করেছি। দেখতে চেয়েছি কবিতার মূল উপাদান শব্দ (দুই অর্থে Word এবং Sound), তার অন্বেষণ, চয়ন, প্রচল-অপ্রচল, বাঁধাধরা-নতুন, এবং শব্দকে কবিতায় খেলিয়ে তোলা, প্রাণ দেওয়া আর কবিতাময় করে ঝমঝম করে বাজিয়ে তোলা, সে কেমন তোমার! এই কাঁটাছেড়ায় কবিতা সম্পর্কিত কিছু তত্ত্বকথাও এসে পড়েছে, চিহ্ন, চিহ্নক, চিহ্নিত; অনুভব আইডেনটিফাই করা- আইডেনটিফায়ার গোছিয়। এসেছে নতুন-পুরাতনের ধার বাড়ানো, আর ক্ষয়িষ্ণু-প্রচল থেকে বেরোনোর প্রয়াসের কথা। এসেছে ক্রিয়াপদ ব্যবহারে কালের কথা, এবং কবিতায় এই কালের প্রভাব কিভাবে আসতে পারে ইত্যাদি। তাই কাঁটা-ছেঁড়াটা কবিতার হাড়-মাস বার করা নয়, নাঙ্গা করা নয়। সাজসজ্জাসহ তার অন্তর বোঝার চেষ্টা। ২য় পর্বে, ভাব-ভাবনা, চিন্তা-চেতনার কথা এসেছে। এসেছে নির্মাণ-কৌশলের কথা এবং সেখানে যে তুমি যথেষ্ট অগ্রসরমান তা সেখানেই উল্লেখ করেছি। আর তৃতীয় পর্বে ভাষা নিয়ে সামান্যটুকু। তোমার ভাষা সমকালীন থেকে এগিয়ে থাকা, এ কথা স্বীকার করেও বলব, মাঝে-মধ্যে তার ব্যতিক্রম খেয়াল করেছি গোটা বইয়ে। এখানে একটাই উদাহরণ তুলি, দু-তিন বার অন্তত কোথাও দেখেছি ব্যবহার করছ ‘পরে’ শব্দটি। ওপরের প্রতিশব্দ হিসেবে। ‘মাথার পরে ছাতা’। কেন? একি একটা মোহ, একটা পিছুটান না অন্য কিছু তা আমার কাছে পরিস্কার নয়।
ভালো লেগেছে বইটি তাই এই খেলা, এত কথা। আমরা বন্ধু-বান্ধবরা অনেকেই কবিতা নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রচলকে ভাঙার চেষ্টা করেছি, এখনো নতুনের সন্ধানে থাকি। তাই কেউ (বিশেষত তরুণরা) আলাদা লিখছে, ভিন্ন মাত্রার আয়োজন করছে, চিন্তা-চেতনায় প্রসারণ ঘটাচ্ছে, নতুন প্রয়োগ কৌশল গ্রহণ করছে, ভাষার ওপর কাজের নমুনা রাখছে এসব দেখলে, পড়লে মনটা ভরে যায়। তাকে সাধুবাদ জানাতে ইচ্ছে করে। তার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় জড়াতে ইচ্ছে করে। স্বপন ঠিকই লিখেছে কবিতাকে ভালোবেসেছ তুমি।
খেলা শেষ। বুক-ক্রিকেট। যথেষ্ট ভালো বলের এগেনস্টেও ব্যাটে কম রান ওঠেনি। ৪/৫, ৪/৫, ২/৩। নিয়মটা তো তুমি জানো। মিলিয়ে নিও। ভালো থেকো ভাই।
কাব্যগ্রন্থ: রাত্রির রঙ বিবাহ
লেখক: অরবিন্দ চক্রবর্তী
প্রকাশনী: বেহুলা বাংলা, ঢাকা, বাংলাদেশ।
ভাষাদের শস্যদানা / শিমুল মাহমুদ
আপনার পাঠানো বই থেকে বেছে প্রথমেই পড়লাম ‘ভাষাদের শস্যদানা’ কবিতার বইটি। সম্ভবত আপাত প্রকাশিত এটাই আপনার শেষ কাব্যগ্রন্থ। তাই এটিকেই সবার প্রথমে পড়ার কথা চিন্তা করলাম। বাকি বইগুলো (কবিতার আর গদ্যের) আরেকটু সময় নিয়ে পড়ব। বইটা পড়ার পর আমার সামান্য ও সংক্ষিপ্ত পাঠ-প্রতিক্রিয়া (যা আদৌ কোনা কবিতালোচনা নয়) জানাতে ইচ্ছে হলো, তাই এই চিঠি।
আমি এর আগে বিচ্ছিন্নভাবে খুব সামান্যই আপনাকে পড়েছি, যদিও একত্রে পড়ার বাসনা একটা ছিলই। তা এবারে মিটল। আমি কবিতাকে কবির এক মানসভ্রমণ হিসেবে দেখি। দেখি সেই ভ্রমণে স্বাভাবিক কিছু চড়াই-উৎরাই, বাঁক-গভীর-বাঁক, পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর নিজস্ব বহমানতা, যা প্রথার সঙ্গে মিলতেও পারে, না-মিলতেও পারে। এখানে ‘কবিতাক্রম’-এ কবিতার শিরোনামগুলো দেখতে গিয়ে কেমন একটা পরীক্ষা-নিরীক্ষার আভাস পেলাম। যদিও এটা মানি, সবসময় শিরোনাম কবিতাকে বহন করে না, শুধুমাত্র একটি চিহ্ন হিসেবেও ব্যবহৃত হয়, (সবার ক্ষেত্রে নয়) আইডেন্টিফিকেশনের জন্য। তো স্বাভাবিক কারণেই এখানে আমাকে কবিতায় গমন করতে হবে। আমি ঠিক করেই নিয়েছিলাম কবিতাগুলো একটু এলোপাথাড়ি পড়ব। যেমন শুরুর কয়েকটা পড়লাম, চলে গেলাম একদম পেছনে, তারপর ফিরে মাঝখানে, কবির ক্রমানুসারে নয়, আমার (পাঠকের) ক্রমানুসারে। সেভাবে পড়তে গিয়ে “‘হাহাকার’ শব্দটির অর্থবিস্তারী সম্ভাবনা” ১, ২, ৩, ৪, ৫, পাঁচটিই পড়ে নিলাম। একটু ঝাঁকি খেলাম বৈকি। নামে যেমন, তেমন কবিতাচলনেও। নামের ক্ষেত্রে প্রথমেই হালকা একটা বিরোধে নামি। ‘অর্থবিস্তারী’ শব্দটি একটু কাটাছেঁড়া করা যাক। অর্থ বিস্তার করে যা, তাই অর্থবিস্তারী। কার অর্থ? না, শব্দের অর্থ। শব্দের অর্থ হয় কি? আমার ভাবনাটা বলি একটু। শব্দ একটি চিহ্ন-বিশেষ যা বস্তু-অবস্তু, জড়-জীব, মানবিক-মানসিক অবস্থান ও বিশ্বের তাবৎ ভাবনাকে রেফার করে। কোনো উদাহরণে না-গিয়ে সরল-চিন্তায় অর্থ ধরে নিয়েই এগোই। এখানে সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। ১ নং কবিতার প্রথম পঙক্তিটি— ‘আমার চোখ হা করে তাকিয়ে আছে ‘হাহাকার’ বরাবর’। প্রয়োগ থেকেই ‘হাহাকার’ শব্দের মজাটা আমার অনুভবে এল। ‘হাহাকার’ একটি শব্দ, (Word)। আবার ‘হাহাকার’ একটি শব্দ বা ধ্বনি, (Sound)। আর চোখ এই দুটো বরাবরই তাকিয়ে আছে। ‘শিশিরের ঠোঁট থেকে ঝরে পড়ছে স্মৃতি। নৈঃশব্দের ছবি আঁকতে গিয়ে/ এঁকে ফেলছি সিগারেট,”। এক বিমূর্ততা— দু-দুটো কল্পচিত্রের মাধ্যমে। হ্যাঁ, আমি এদের কল্পচিত্রই বলব। কেননা, হয়ে থাকা চিত্রের সঙ্গে এখানে কল্পনা মেশেনি, কল্পনার বিস্তৃতির ফলে চিত্রটি মানসে এসেছে, যা কদাপি ছিল না। কবিতা বিমূর্ত-শিল্প, এই আমার বিশ্বাস। গেল একটা দিক। একদম শেষে— “ঘন + গভীর। আমাদের ‘যমজবৃষ্টি’”। দাঁড়ালো ঘনবৃষ্টি, একইসাথে গভীরবৃষ্টি। সুতরাং হাহাকার= যমজবৃষ্টি। ২ নং-এ, জানালা থেকে বা দিয়ে একটা ইচ্ছেকে পাত্তা না-দিয়ে হারিয়ে যাওয়া অস্তসূর্য। ইচ্ছেটা বাস্তবায়িত হচ্ছে— “জানালার বাইরে ‘হাহাকার’ শব্দটি ঝুলে রয়েছে।” বলা যায় হাহাকার= ‘স্পর্শকাতর সূর্য’। ৩ নং-এ, হাহাকার ছড়িয়ে পড়ছে তার রূপ-অরূপ নিয়ে অনেক কিছুর মতো। “নোনা বাতাসের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ফোটোগ্রাফ।/ মনখারাপগুলো হেঁটে যাচ্ছে ফরেস্টের দিকে।” জড়ে এবং মানসিক-অবস্থানে প্রাণ-প্রদান ও বিস্তার। কবিতায় এসব এক ধরনের কাজ। ভালো লাগে। “লাগোয়া বনাঞ্চল। আদিম ও স্বাধীন।” এখানে সম্ভাবনা, ক) হাহাকার = মনখারাপগুলো। খ) হাহাকার = আদিম ও স্বাধীন-প্রত্যাশা। ৪ নং-এ, “দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে আয়ু। আয়ু= হাহাকার”। আয়ুর জন্য হাহাকার, এটুকু বলা ছাড়া বাড়তি কিছু বলার অবকাশ নেই। ৫ নং-এ, কবির কথায়—“ ‘চুম্বন’ হলো সেই চাবি যে তোমাকে পৌঁছে দেবে অর্গানিক আলোর কাছে”। আবার, “চোখ +চুম্বন = জানালাবিহীন দেয়াল/ যে জানালা কোনো কালেই খোলা হলো না তোমার।” লক্ষণীয়, ক) ১ থেকে ৫-এর প্রায় সবটাই (৪-এ একবার মাত্র ‘তোমার’) ‘আমি’ সর্বনামে লেখা। ৫-এর শেষ সর্বনামটি ‘তোমার’। বকলমে কি ‘আমার’? প্রশ্ন জাগে। খ) হাহাকার = আলো প্রত্যাশা/ হাহাকার = খোলা জানালা, বকলমে সেই আলোই। রইল বাকি সম্ভাবনা, যা নিয়ে এই পর্বে আবার একবার আসব পরে।
এলাম, ‘লিবিডো-পাঠ ও পাঠসম্ভাবনাঃ ১ ২ ৩ ৪ ৫ ৬’ ছটি। পড়লাম। কাকতালীয়ভাবে হলেও এখানেও সম্ভাবনা। খুব সংক্ষেপে। কারণ এতক্ষণে আপনি বুঝে গেছেন আমার প্রতিক্রিয়া জানানোর তরিকা, কিছু হোক আর নাই হোক। ১ নং-এ, “একটি নদীর দুটো তীরের ভেতর/ ক্রমশ দূরত্ব বেড়ে ওঠা। বিরতিহীন আপসোস।” এই দূরত্ব একটি বোধ, যা বাড়া-কমায় দুটি পরস্পরকামী অস্তিত্বের অনেক কিছু যায় আসে– প্রকৃতিতে, মানসে, যৌনতায়। আদম আদিকবি, ভালোবাসা মাধুর্যের প্রণেতা, আপেলের ভেতরে পোকা-কামড়ের সৃষ্টিকারী। তাঁর যৌন-আকাঙ্খার (Sexual desire) প্রবেশ আমাদেরও মধ্যে, যা দূরত্ব বাড়লে আপশোসে দাঁড়ায়। ২ নং-এ, ভালোবাসা ও লিবিডো-পাঠকে একীভূত করা হলো।(?) “ভালোবাসা হেলেঞ্চা সাপ;/ আদম-হাওয়ার প্রথম যৌনজ্ঞান;… …… … বিষাক্ত বেলফুল; ডালিম ফলের লাল রক্তদানা।” এ-ও এক পাঠ তথা জ্ঞান তথা অনুভব তথা প্রত্যয়ে মেশা— ‘এরা সকলেই জন্মেছে আমার ঔরসে’। ৩ নং-এ, প্রথম পঙক্তি—“ভালোবাসা নিজেই একটি সুতোবাঁধা রঙিন ঘুড়ি”। শেষ পঙক্তি— “আর, প্রেমিকার হাতে লাটাই ছেড়ে দিয়ে অসহায় তাকিয়ে থাকা।” আমি কি সিদ্ধান্তে আসব— লিবিডো-পাঠ= ভালোবাসা? লিবিডো-পাঠে প্রেমিকার একটি অব্যর্থ ভূমিকা আছে? ৪ নং-এ, “মেয়েটির কালো স্তনের চূড়ায় থমকে আছে রোদ”। কালো স্তন, হলুদ রোদের থমকে থাকা। থমকানো রোদের স্তন চুম্বন, লেহন, পেষণ, আরও সব কাম-বাসনা। “খালি পায়ে হাসতে থাকা সাঁওতাল বালক।” (বলা বাহুল্য মেয়েটি সাঁওতাল মেয়ে)। এই বালকটি স্তনে চমকে ওঠা রোদ দেখেই হাসতে থাকে। বালকটি কবি হিসেবে আপনিই তো, নাকি? বালকটি পাঠক হিসেবে আমিই তো, নাকি? অসাধারণ এক লিবিডো-পাঠ। ৫ নং-এ, “ভালোবাসা এমন এক পাখি/ যাকে লুকাতে হয় আকাশ-গুহায়। দূরগামী কামনার বিষ।” আকাশেরও গুহা থাকে, যদি চেতনাকে বিস্তৃত করা যায়, থাকতেই পারে। ভালোবাসা ও কামনা মাখামাখি। লিবিডো-পাঠের একটা সঞ্চয় বা অভিজ্ঞান। কিন্তু সে কি কেবলই বিষ, এমন একটি প্রশ্ন উঠে পড়তে পারে। “ভালো থেকো প্রিয় চন্দ্রবোড়া সাপ।” চন্দ্রবোড়ার বিষ শুনেছি ধীরগামী, কিন্তু অব্যর্থ। তাকে প্রিয় বলা, ভালো থাকতে বলা, লিবিডো-পাঠের পরিণাম হতেই পারে। ৬ নং-এ, “পরকীয়া পালঙ্কে আধশোয়া রমণীর শাস্ত্রীয় কিতাব;”। রমণী শব্দটি এল শেষমেশ। “ক্রমশ ওলটাতে থাকা শরীরবিদ্যার সংখ্যাবিহীন পৃষ্ঠা।” শরীরবিদ্যা তথা শরীরখেলা তথা শৃঙ্গার। ভালোবাসা ওরফে মৃত্যু, তাকে দূরে সরিয়ে, “নিজেকে দাসবাজারে নিয়ে বিক্রি করে দেওয়া।” হতে পারে একটা পাঠের সম্ভাবনা। এ-পর্বেও ফিরে আসব পরে সম্ভাবনা ও দু-চারটে কথা নিয়ে।
একটু ফিরে যাই, নাম কবিতায় “ভাষাদের শস্যদানা- ১ ২ ৩”। এদের একসঙ্গে নিয়ে কথা বলি। আমার ভাবনায় ভাষাদের শস্যদানা হলো অক্ষর। বিভিন্ন ভাষার বিভিন্ন বর্ণলিপিতেই সেই ভাষাটি পুষ্ট। আমাদের বাংলাভাষায় বাহান্ন-বর্ণমালাই ভাষার শস্যদানা। আর সেই শস্যদানাই তৈরি করে কবিতালিপি, যার মাধ্যমে আমরা অবয়বহীন কবিতার একটি আপাত সাকার রূপ দিয়ে থাকি। তো, “তারিখবিহীন আকাশের নাম, ‘তুমি’”। এই ‘তুমি’ আপনার শস্যদানা, যা আবার প্রেমিকাও। বহমান প্রেমধারায় এই শস্যদানা (আপনি বলছেন ‘লিপিচিহ্ন’) এক বড়ো ভূমিকা রাখে, অতীতকে জানায়, হৃদয়ঙ্গম করায়। কবি “ঢাকনা সরিয়ে দেখতে চাই/ কী লেখা ছিল বোতলবন্দী লিপিচিহ্নের ভিতর।” দেখতে চান সেই শস্যদানা ওরফে লিপিচিহ্ন, উদ্ধার করতে চান পাঠ, প্রেম, কবিতা। কবিতাটায় স্বল্প হলেও একটা গল্পের ছোপ এসেছে, যা আর কোথাও দেখিনি। কোনো এক অজানা পথ ধরে হাঁটলে পাওয়া যেতে পারে ‘ফিনিক্স পাখির কঙ্কাল’ পাওয়া যেতে পারে ‘মমিবৃক্ষ’। অজানাতে পা ফেললে আলো হয়। ওই বিশ্বস্ত নয় এমন এক পথ, অজানা অচেনা পথে যাঁরা হাঁটেন, তাঁরাই ‘যথার্থ প্রেমিক’, যিনি আবিষ্কার করেন বিমূর্ততা ( ফিনিক্স পাখির কঙ্কাল, মমিবৃক্ষ), আবিষ্কার করনে সাধের শস্যদানায় নির্মিত কবিতা, যাকে ‘অমীমাংসিত সৌন্দর্য’ বলে বিবেচনা করা যায়। ভালো লাগে।
আর দু-তিনটি কবিতার দরজায় যাই। ‘মোম+আগুন=?’ (অন্যত্র যখন এইভাবে প্রকাশ করা হয়েছে তখন দু-পাশকে সমানে দেখানো হয়েছে। এখানে জিজ্ঞাসাচিহ্ন। ব্যতিক্রম।) এই জ্যোতিচিহ্নটি জিজ্ঞাসার, অনুসন্ধানের, যা নির্ণীত নয়, অপরিমেয়ও। কবিতার শেষ পঙক্তিটি বলে দিচ্ছে জিজ্ঞাসার উত্তর। “এইভাবে মোম ও আগুনের ভিতর বসবাস করছি।” সুতরাং বলা যায় মোম+আগুন= জীবনযাপন। তার আগে কিছু কথা আছে, যা এই পরিণতিতে আনে।
‘আমি হই একজন নকল মানুষ’ নামের পরের কবিতাটির নাম ‘মানুষ হয় কতটুকু ‘মানুষ’। দুই-এ দুয়ের পরিপূরক নয়। একটা ফ্যালাসি। দুটো থেকে দাঁড় করালে দাঁড়ায়— “আমি, এক নকল মানুষ, কতটুকু ‘মানুষ’”। কিন্তু কবিতা দুটো পড়ে আমার দাঁড় করানো শব্দ-বন্ধের সত্যতা উদ্ধার হয়নি। ফলে এ-কোনো ফ্যালাসি নয়। দুটো নাম বিশেষ। দুটো কবিতাই একটা প্রত্যয়ের পরিণতির দিকে গেছে। ১) ‘সত্যিকারের একটা সাপ আর একজন নকল মানুষ’ আসলে বন্ধু, যারা, ‘গল্প করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে শহরের দিকে’। ২) মরার পর মানুষের হাড়-হাড্ডি কোথায় যায়? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকা এক মানুষ বুঝতে পারে— ‘সে নিজেও ক্রমশ পশু অথবা পাখিতে বদলে যেতে শুরু করেছে।’ এক কথায় মেটামরফসিস।
গোটা বইটা পড়েও এইগুলো বেছে নিলাম, যাতে দেখলাম বইটির আত্মা আমার কাছে উন্মোচিত হলো, অন্তত কিছুটা। এখন, আগেই বলেছিলাম আমি আবার ফিরে আসব এই একেকটি কবিতা-সিরিজের কাছে। ক) প্রথম পর্বে যে সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে, তা কখনো রক্ষিত হয়েছে, কখনো হয়নি। ইজ-ইকুয়াল-টু দিয়ে যা প্রতিফলিত, তা সম্ভাবনা নয় বলেই মনে করি। আর যেখানে তা অনেক-কটা ইজ-ইকুয়াল-টু-র জন্ম দিয়েছে তা, সম্ভাবনা। খ) যে কবি কল্পনার বিস্তার করতে পারেন, শানিত চেতনাকে প্রসারিত করতে পারেন, তার এক্সপ্রেশনে এতো ‘মতো’ কেন তা বুঝে উঠতে পারিনি। যেমন- ‘বহুব্যবহৃত সেলাই করা কথার মতো’। আমি পড়লাম— ‘বহুব্যবহৃত সেলাই করা কথা’। বা, ‘ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে গুপ্তঘাতকের মতো নিসর্গ’। আমি পড়লাম ‘ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে গুপ্তঘাতক নিসর্গ’। আমার পড়তে বুঝতে বা অনুভব করতে অসুবিধা হয়নি। কল্পচিত্র রচনায় এত ‘মতো’, ‘মতন’, ‘যেনো’ ইত্যাদি দিয়ে উপমা তৈরির প্রয়োজন হয় না। কল্পচিত্র নিজেই উপমার মতো হয়ে ওঠে। আর আমরা, ভাবনায়, চিন্তা-চেতনায়, পরীক্ষা-নিরীক্ষায়, প্রয়োগ-নির্মাণকৌশলে এগিয়ে থাকা এক কবির কাছে উপমায় মিথ হয়ে যাওয়া এক পূর্বজ কবির অনুসরণে মত্ত হওয়া দেখতে চাইব কেন? অন্তত আমা্র কাছে এ-এক ভাবার বিষয়। দ্বিতীয় পর্বে লিবিডো-পাঠের সঙ্গে ভালোবাসা মিলিয়ে মিশিয়ে দেওয়া ভাবগত দিক থেকে একদম ঠিক। কিন্তু বস্তুগত দিক থেকে কতটা সম্ভব তা আমার জানা নেই। আপনিও কি সম্পূর্ণ জানেন? এই ভাব ও বস্তুর ফাঁকা অঞ্চলটাতে গড়ে উঠতে পারত সম্ভাবনার বহুমুখ। ঘটে গেছে যা, এমনকি এই মুহূর্তেও, তা অতীত। তা আর সম্ভাবনার দরজা খুলতে পারে না। আপনি এখানে মাঝেমধ্যেই সম্ভাবনার বহুমুখের দিকে এগিয়ে গেছেন, কিন্তু কখনো কখনো কবির অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের কাছে সেই সম্ভাবনা হার মেনেছে। কবিকৃত পরিণতি, কোনো সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে না। সে ভবিষ্যতের, অজানা-অচেনা, বহুমুখ খুলে দেওয়া যেতে পারে শুধু। আরেকটা কথা আপনি আকাশে গুহামুখ দেখতে পান, অথচ সুতো ছাড়া ঘুড়ি ওড়া কল্পনা করতে পারেন না, লাটাই ছাড়াও নয়, সেখানে বস্তুগত দিকটাই প্রাধান্য পেয়ে যায়। এসব পারা যায় যখন চেতনাকে এই সম্প্রসারিত দিকে চালনা করা যায়। সে আপনি করেওছেন। তাই আমার মনে হয় আপনি একটা ট্রানজিশান পয়েন্টে আছেন কবিতা নিয়ে।
সবশেষে বলব, এই বইটি পড়ে আমার যথেষ্ট ভালো লেগেছে, মাঝেমধ্যে বেশ আলোড়িত হয়েছি, এর বিচিত্র ভাবনঞ্চল আমাকে ভাবিয়েছে, এর সহজ-সরল ভাষাবয়ন ভালো লাগলেও এই উচ্চমার্গীয় চেতনানুভবকে বয়ে নিয়ে যেতে কতটা সক্ষম তা নিয়ে কিঞ্চিৎ সন্দেহও আছে। ভালো লাগার কারণেই এত সব কথা, এত পরিশ্রম। নয়তো, ভালো লেগেছে বলে দু-লাইন লিখে পাঠিয়ে দেওয়া যেত। যাক, আমার ভাবনা-চিন্তা আমারই, তা ভুল হতে পারে, ভুল মনে হতে পারে, মিলতে পারে না-ও পারে, আর-এক সচেতন কবির কাছে। আমি শুধু পড়তে গিয়ে, মনে হওয়াটুকু বলতে গিয়ে কিছু কবিতাভাবনার উল্লেখ করেছি মাত্র। আপনার কবিতার প্রতি আমার আগ্রহ বাড়ল। বইগুলো পাঠানোর জন্য সত্যি বলতে কি খুব খুশি হয়েছি। আপনি অত্যন্ত গুণী মানুষ, সে আপনার বায়োডাটা পড়েই জানা যায়। আমার মতো সামান্য এক ক্ষুদ্র কবিতাকর্মীকে এই উপহার প্লুত করেছে। ভালো থাকুন। ভালোবাসা।
কাব্যগ্রন্থ: ভাষাদের শস্যদানা
লেখক: শিমুল মাহমুদ
প্রকাশনী: বেহুলা বাংলা, ঢাকা, বাংলাদেশ।
Posted in: Criticism, December 2019