এই সময় নিয়ে ভাবতে গিয়ে, এই সময় নিয়ে লিখতে গিয়ে : স্বর্ণেন্দু সেনগুপ্ত
গুয়ান্তানামোর ডিটেনশন ক্যাম্প-এর বন্দিদের লেখালিখির অনুবাদ শুরু করেছিলাম যখন, এমন ভেবে সে কাজ করিনি, যে, খুব শীঘ্রই আমাদের দেশে এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, আমাদেরও এমন এক বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হবে। ভাবিনি, পাশের রাজ্যে গড়া হবে, এশিয়ার বৃহত্তম ডিটেনশন ক্যাম্প! গুয়ান্তানামোর লেখালিখি প্রসঙ্গে হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প-এর বন্দিদের লেখালিখির কথা এসেছে, প্রিমো লিভির কথা এসেছে। প্রিমো লিভি, ইতালীয় এই লেখক হিটলারের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প-এ বন্দি ছিলেন, যদিও তাঁকে হিটলারের বাহিনি শেষপর্যন্ত হত্যা করতে পারে নি। প্রিমো লিভি বলেছিলেন, ‘এটা ঘটেছে। সুতরাং এটা আবার ঘটতে পারে। এটা যে কোনো জায়গাতেই ঘটতে পারে’। অন্ধ জাতি বিদ্বেষ, তার ভয়ংকর পরিণতি খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন প্রিমো লিভি, জাতি বিদ্বেষের স্বীকার হয়েছিলেন, পরবর্তীকালে এমন ঘটনা যেন না ঘটে, আর কোনোভাবেই যেন না ঘটে, তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর মতো আরও সবাই চেয়েছিলেন, তাঁরা লিখে গিয়েছিলেন সেসব কথা। সেসব কথা লিখে গিয়েছিলেন আমাদের জন্য, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। আমরা কেউ শুনেছি সেসব কথা, শুনে বুঝতে চেয়েছি কী মানে সেসব কথার, কেন সেসব কথা, আমরা সচেতন হয়েছি, সাধ্যমত সচেতন করার চেষ্টা করেছি। আবার আমরা কেউ কেউ শুনি নি সেসব কথা, শুনতে চাই নি, শুনলেও বুঝতে চাই নি, বুঝতে পারলেও বিশ্বাস করিনি, কথার কথা মনে করেছি। তাই, একবার ঘটেছিল যা, তা আবার ঘটতে পারে, তা আবার ঘটছে, আমাদের নাকের ডগায় ঘটছে। প্রিমো লিভির সময় থেকে আমাদের সময়, এর মাঝখানের ব্যবধান খুব বেশি নয়, তাহলে ? যাক সে কথা।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, স্কুল থেকে, নিয়ম করে হলোকস্ট লিটেরেচার পড়ানো শুরু করেছে। হলোকস্ট শব্দটি এখন আর আমাদের কাছে অপরিচিত শব্দ নয়। কিন্তু দীর্ঘ একটা সময় অপরিচিত করে রাখা হয়েছিল, যেমন এখনও প্রায় অপরিচিত রয়েছে হলোকস্ট এর আর একটি প্রতিশব্দ, শোয়া (Shoah), ইহুদিদের মধ্যে এই শব্দটি ব্যবহারের চল রয়েছে। কেন অপরিচিত ? শোনা যায়, লেখাপত্র পড়া যায়, আমাদের এখানে হলোকস্ট শব্দটিকে ইচ্ছেকৃত এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, হিটলারকে নিয়ে ইতিহাস লেখার সময়, হিটলারের ইতিহাস বলার সময়। এখন লেখা হচ্ছে, বলা হচ্ছে, শব্দটি ক্রমে পরিচিত হচ্ছে। আর হলোকস্ট লিটারেচার কী ? খুব সহজভাবে বিষয়টিকে বলতে হলে, হলোকস্ট এর সময়ে, হলোকস্ট এর পরে, হলোকস্টকে কেন্দ্র করে যাবতীয় লেখালিখি, চলচিত্র, স্থিরচিত্র, গল্প, কবিতা, গান, নাটক, পোস্টার, প্যামফ্লেট সকলই আসলে হলোকস্ট লিটারেচার এর অংশ। লেখাগুলো পড়ানো হয়, ছবিগুলো দেখানো হয়, গান শোনানো হয়, নাটক মঞ্চস্থ করা হয়, আর এভাবেই এগিয়ে চলে হলোকস্ট লিটারেচারের ক্লাস, বা চর্চা। এইভাবে, পড়ানো দেখানো শোনানোর আগে, গড়ে নেওয়া সিলেবাস কমিটি আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে ঠিক করে নেয়, কোন ক্লাসে কী পড়ানো হবে, কতটা দেখানো হবে, কীভাবে শোনানো হবে, এবং এমন সবকিছু। বিশ্বের অনেকগুলি দেশ, এমনকি জার্মানি পর্যন্ত, হলোকস্ট লিটারেচার নিজেদের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভূক্ত করেছে। পরবর্তী প্রজন্মকে একেবারে স্কুল-এ যাওয়ার বয়স থেকে সেইসব কথাগুলি জানিয়ে দেওয়া, জানানো কথাগুলি বুঝিয়ে দেওয়া, যে, এ রকম ঘটেছে, একবার ঘটেছে যখন আবার ঘটতে পারে। দেখা গেছে যে, যে যে জায়গায় এমন ধরনের ক্লাসগুলি নেওয়া হয়, কনসেনট্রেশন ক্যাম্প-এর বন্দিদের লেখাগুলো পড়ানো হয়, হলোকস্ট নিয়ে বানানো ছবিগুলো দেখানো হয়, বা ছাত্রছাত্রীদের সরাসরি সেইসব মানুষদের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়, যারা হিটলারের ক্যাম্প থেকে কোনোভাবে বেঁচে ফিরে এসেছেন, এখনও জীবিত রয়েছেন, সেইসব জায়গায় ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সহনশীলতা বেড়েছে, পর ধর্মের প্রতি সহনশীলতা বেড়েছে, সামাজিকতা বোধের উন্নতি ঘটেছে। এগুলি-ই ছিল প্রাথমিক উদ্দেশ্য, হলোকস্ট লিটারেচার পড়ানো হবে কেন, তার সপক্ষে একেবারে গোড়ার যুক্তি এগুলি। একবার যা ঘটে গিয়েছে, ঘটে গিয়েছে। আবার যেন না ঘটে, সে নিয়ে সতর্ক থাকা, সতর্ক রাখা নিজেদেরকে, সতর্ক করা অপরকে। এ গেল এক দিকের কথা।
অন্য দিকটির দিকে এবার তাকানো যাক। এমনও অনেক দেশ আছে, যারা এইসব কথাগুলি নিয়ে ভাবে নি, হলোকস্ট লিটারেচার পড়ানোর কথা, একেবারে স্কুল যাওয়ার বয়স থেকে বিষয়টি ছাত্রছাত্রীদের জানিয়ে দেওয়ার কথা, এইসব দেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় নি। ভারতে এমন কোনো ব্যবস্থা নেই, একেবারে স্কুল যাওয়ার বয়স থেকে জানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। সাম্প্রতিক সময়ে, প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের স্নাতকোত্তর বিভাগে এমন একটি বিষয়কে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে, ‘আ হিস্ট্রি অফ মাস ভায়োলেন্স : টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি টু দ্য প্রেজেন্ট’। প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, নাভরাস জে. আফ্রিদির চেষ্টায় এই বিষয়টি পাঠক্রমের অন্তর্ভূক্ত হয়। নাভরাস আফ্রিদি নিজে এক ইহুদি পরিবারের সন্তান, জাতিবিদ্বেষের স্মৃতি তিনি জাতিগত সূত্রে বহন করেন, তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করলেন। পশ্চিমবঙ্গে একজন হিন্দুর এগিয়ে আসা উচিত ছিল, একজন মুসলমানের উচিত ছিল এ কাজটির জন্য, এতদিনে তা ঘটে নি। বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় জেনোসাইড স্টাডিজ। এদিকে, নভরস জে. আফ্রিদি ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যে হিটলারের ‘গ্রোয়িং পপুলারিটি’ লক্ষ করেন।
হিটলারের আত্মজীবনীর বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ, এবং বিপণনের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে আমাদের দেশ-এ। পরিহাস এই, কোনো কোনো বুকস্টোরে, একই শেলফ-এ অ্যান ফ্রাঙ্ক এর ডায়েরি ও হিটলারের আত্মজীবনী পাশাপাশি ডিস-প্লে করা হয়! হিটলারের দেশ জার্মানিতে তার আত্মজীবনী নিষিদ্ধ হলেও, ভারতের একটি বুকস্টোর-এর কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, প্রতিমাসে দশ কপির মতো এই বইটি বিক্রি হয় সেখান থেকে, তাই বইটিকে তারা স্টক থেকে ফুরোতে দেন না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ছেলে মেয়েরা যে বয়সে হলোকস্ট লিটারেচারের পাঠ নেয়, আফ্রিদি লক্ষ্য করেন, সে বয়সে এখানে একজন যুবকের টি-শার্ট হিটলারের ছবি শোভিত হয়ে ওঠে। সিনেমা, টেলি সিরিয়াল এর অনেক চরিত্রের নাম করণ করা হয়ে থাকে হিটলারের নামে। মুম্বই এ বড় একটি রেস্টুরেন্ট এর নাম হিটলারের নামে রাখা হয়েছে। জনমানসে বিশেষ প্রভাব সৃষ্টিকারী এমন দশজন ব্যক্তিত্বকে নিয়ে শিশুপাঠ্য বই লেখা হলে, তাবড় তাবড় ব্যক্তিত্বের সঙ্গে হিটলারের জীবনীও আলোচিত হয় সেখানে, আলোচিত হয় এ দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নাম, প্রচ্ছদে মুদ্রিত হয় হিটলার সহ সকলের ছবি। স্কুল পাঠ্য ইতিহাস বইয়ে হিটলারের প্রসঙ্গ আসে, তার ঘৃণ্য কাজগুলিকে বাদ রেখে, তাকে একজন প্রকৃত নায়ক হিসেবে তুলে ধরা হয় সেখানে। হলোকস্ট শব্দটির উল্লেখ মাত্র করা হয় না, এ কথা আগেই বলা হয়েছে।
২.
কিন্তু এখন করা হয়, করা হচ্ছে। পাঠ্যসূচিতে হলোকস্ট লিটারেচার না নিয়ে আসা হলেও, এমন অনেক টেক্সট-কে স্থান করে দেওয়া হয়েছে, যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হলোকস্ট এর সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ হল না, আরও কিছু বাকি রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ মধ্য শিক্ষা পর্ষদের সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির ইংরেজি বইয়ে হলোকস্ট লিটারেচারের প্রসঙ্গ এসেছে। সপ্তম শ্রেণিতে অ্যান ফ্রাঙ্ক-এর ডায়েরি পাঠ্যসূচিতে রাখা হয়েছে, অষ্টম শ্রেণিতে হলোকস্ট এর প্রসঙ্গ এসেছে একটু অন্যভাবে। ইংরেজি বই শুরু হচ্ছে একটি লোককথার গল্প দিয়ে, ‘দ্য উইন্ড ক্যাপ’। ছোটদের জন্য লেখা এই গল্পের লেখিকা জেন ওলেন এর পরিচিতিতে লেখা হয়েছে তাঁর অন্য আর একটি আলোচিত উপন্যাসের নাম, ‘দ্য হলোকস্ট নভেলা’। একটি স্কুলের এই দুই ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, হলোকস্ট কী তারা জানে না, পড়ানোর সময় স্যার এ বিষয়ে কিছু বলেন নি। অ্যান ফ্রাঙ্ক কখন এই ডায়েরি লিখেছিলেন, এ ঘটনার সঙ্গে জার্মানিতে যে ইহুদি সহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের অনেক মানুষকে হত্যার এক ভয়ঙ্কর ইতিহাস জড়িয়ে আছে, ছাত্রছাত্রীরা জানে না, তাদের জানানো হয় নি, এমনকি অ্যান ফ্রাঙ্ক এর পরিচিতিও সবার কাছে স্পষ্ট নয়। কেন এমন হল, মাস্টারমশাইরা জানালেন না কেন তাদের, জানাতে চাইলেন না কেন, এসব কথাগুলি এরপর আমার জানার ইচ্ছে হয়েছে, জানার জন্য বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছি যাঁরা শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত। আমি জানতে চেয়েছি তাঁদের কাছ থেকে, মূলত যাঁদের এই দুই শ্রেণিতে পড়ানোর অভিজ্ঞতা আছে। গ্রামের স্কুলে ও শহরের স্কুলে শিক্ষকতা করেন তাঁরা, এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছি। একেবারে সবাই এই বিষয়গুলি নিয়ে নিশ্চুপ থেকেছেন, নিশ্চুপ থাকেন, ব্যাপারটি এমন নয় যদিও, কেউ কেউ বলেন বা বলার চেষ্টা করেন। গ্রামে বসবাসকারী ছাত্রছাত্রীরা বিষয়টি মনোযোগ সহকারে শুনেছে, ঘটনার প্রেক্ষাপটটি শুনে বিষয়টি আরও ভাল ভাবে পড়ার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। শহরের স্কুলের ছাত্রছাত্রী বিষয়ে দু-রকমের তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে অনাগ্রহ লক্ষ করেছেন এক স্কুলের শিক্ষিকা, এমন একটি ঘটনার প্রতি তাদের মনোযোগ বিশেষ একটা দেখা যায় নি, ফলত তিনিও বেশি কিছু বলার আগ্রহ বোধ করেন নি । আবার এই ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ দেখতে পেয়েছেন কেউ, তিনি বলার চেষ্টা করেছেন যতটা বলার, আমাদের দেশের সমাজ বাস্তবতার সমান্তরালে এই বিষয়টি রাখেন নি, ব্যাখ্যা করেন নি, এমন একটি ঘটনা থেকে আমরা কী কী শিক্ষা নিতে পারি সেগুলি বলেন নি, অন্তত সপ্তম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের কাছে যতটা তুলে ধরতে পারলে ভাল হত, সেভাবেও চেষ্টা করেন নি তিনি। বিদেশে হলোকস্ট লিটারেচার পড়ানো হয়, পড়ানোর সুফল সরাসরি প্রত্যক্ষ করা গেছে, তা প্রায় সকলেরই অজানা। এ ব্যাপারগুলি অজানা থাকলেও, ক্লাসে পড়ানোর সময় মূল ইতিহাস এর প্রসঙ্গে অনেকেই যান না, ছাত্রছাত্রীদের বিষয়টি যথার্থ অনুধাবনের জন্য যেগুলি বলা খুব প্রয়োজন। মূল ইতিহাসে না যাওয়ার পেছনে দুটি কারণ জানতে পারা যাচ্ছে। ইতিহাস জেনেও, অনেকে বলতে চান না, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বলার প্রয়োজন নেই এসব, এমন বিশ্বাস থেকে বলেন না। ছোটদের যদি এই ইতিহাসটি না জানানো যায়, তাহলে তাদের সিলেবাসে এই বিষয়টি রাখা হল কেন, এমন প্রশ্ন যদিও শিক্ষক মশাইদের করা হয় নি। দ্বিতীয় কারণটি হল, অনেকে কোনোরকম রাজনৈতিক ঝুটঝামেলায় জড়াতে চান না, বরং বিষয়গুলিকে আড়াল করতে চান। একটা অংশ অ্যান ফ্রাঙ্কের ডায়েরি লেখার পেছনের ইতিহাসটি যথার্থভাবে জানেন না, তাঁদের কারো কারো সঙ্গে কথা বলে এমনও মনে হয়েছে। এ গেল শিক্ষক মশাইদের কথা।
ছাত্রছাত্রীরা পড়াটিকে জানার জন্য, জানাটিকে বোঝার জন্য শিক্ষকমশাই ছাড়াও আর একটি বিষয়ের সাহায্য নেয় — নোটবই। ভাল-মন্দ-মাঝারি সব ছাত্রছাত্রী এই নোটবই ব্যবহার করে। বিভিন্ন প্রকাশনীর দু-তিনটি নোটবই দেখতে গিয়ে আমার বিস্ময় চরমে উঠেছে। অ্যান ফ্রাঙ্ক এর ডায়েরির কথা আছে, তার ইতিহাসের কথা নেই সেখানে। কেন কখন কোথায় লেখা হয়েছিল এই ডায়েরি, সেসব কিছুই বলা নেই এই বইগুলিতে। অ্যান ফ্রাঙ্ক কে ছিলেন সংক্ষেপে লেখা হয়েছে, কেমন ছিল তাঁর শেষ পরিণতি লেখা হয়নি। তাঁকে গোপনীয়তার আশ্রয় নিতে হয়েছিল, পরিবারের সঙ্গে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল, লেখা আছে। কেন গোপনীয়তার আশ্রয়, কেন লুকিয়ে থাকা, লেখা নেই। এইসব থেকে একজন ছাত্র বা ছাত্রী-র মনে যদি প্রশ্ন তৈরি হয়, জানার যদি ইচ্ছে হয়, কেন গোপনীয়তা, কেন লুকিয়ে থাকা, এগুলির উত্তর তার নোট বইয়ে নেই, ক্লাসের মাস্টারমশাই এর বলার ইচ্ছে নেই। হিটলারের প্রসঙ্গ এসেছে, এক বা দুই লাইন। একটি নোট বইয়ে লেখা হয়েছে, হিটলারের ইহুদি বিরোধী আইন অ্যান ফ্রাঙ্ক ও তার আত্মীয়দের সমস্যায় ফেলেছিল, আর কিছু লেখা নেই। প্রকৃত ইতিহাস হল, ইহুদি, অ-ইহুদি মিলিয়ে প্রায় এককোটি মানুষ নিহত হয়েছিলেন হিটলারের দ্বারা। এই ঘটনাটিকে কেবলমাত্র অ্যান ফ্রাঙ্ক ও তাঁর আত্মীয়দের সমস্যা হিসেবে একটি নিরীহ ঘটনা বলে চিহ্নিত করে দেওয়া হল ছাত্রছাত্রীদের কাছে।
৩.
ভারতবর্ষে, জাতি দাঙ্গা, জাতি বিদ্বেষ এর একটি পরিপুষ্ট ইতিহাস রয়েছে, এমন সমস্যাগুলি সমাধানের সেই পরিমাণ সদিচ্ছা নাই। রাজনৈতিক দলগুলি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর সমাধান চায় না, এটিকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। সরাসরি, ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলগুলির অস্তিত্ব-ই বিপন্ন হয়ে যাবে, যদি এ সমস্যার একটা সুষ্ঠু সমাধানে পৌঁছে যাওয়া যায়, বরং তারা নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য এ সমস্যাগুলোকে টিকিয়ে রাখতে চায়। সমাধানের নাম করে তারা যে যে সিদ্ধান্ত নেয়, সেগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সমস্যাগুলোকে আরও জটিল করে তোলে। আমেরিকা গুয়ান্তানামো তে ডিটেনশন ক্যাম্প বানিয়েছিল, সন্ত্রাসবাদ-এর বিরুদ্ধে লড়াই এর জন্য, সন্ত্রাসবাদীদের আটক রাখার জন্য, কিন্তু একইসঙ্গে এটাও বুঝতে হবে, শুধু সন্ত্রাসবাদীদের মেরে দেওয়ার মধ্য দিয়ে কি এই সমস্যাটির সমাধান সম্ভব ? যাদের ধরা হল, বছরের পর বছর আটক রাখা হল, প্রচণ্ড অত্যাচার করা হল, যাদের অনেকেই আত্মহত্যা করল, যারা বেঁচে থাকলো প্রাণপন লড়াই করে, তাদের অধিকাংশকে মুক্তি দিতে হল, একটিও দোষ প্রমাণ না করতে পেরে ! এর ফলে কী হল, কী হচ্ছে ?
মুক্তিপ্রাপ্ত কয়েদিদের নিজ নিজ সমাজ প্রায়ক্ষেত্রেই ফিরিয়ে নিতে চায় না, কারণ গুয়ান্তানামোর স্ট্যাম্প পড়ে গেছে তাদের পিঠে। বেঁচে থাকার জন্য কাজের দরকার, কর্মক্ষেত্রগুলি কাজ দিতে চায় না কারণ কর্মপ্রার্থীর পরিচয়ের সঙ্গে গুয়ান্তানামো শব্দটি জুড়ে আছে। এদের কারও কারও মনে হয়েছে গুয়ান্তানামো কারাগারেই থেকে যাওয়া ভাল ছিল তাদের, এই অবর্ণনীয় মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করার চেয়ে, জীবন ধারণের লড়াই-এ জেরবার হওয়ার চেয়ে। সবচে ভয়ের ও বিস্ময়ের কথাটি হল, এদের কেউ কেউ সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলিতে নাম লেখায়। সমাজ এদের ফিরিয়ে নিতে চায় না, এইসব সংগঠনগুলি এই সুযোগটা কাজে লাগায়, এই সুযোগটি কাজে লাগানোর জন্য মুখিয়ে থাকে। আমেরিকার ওপর প্রবল রাগ, প্রতিশোধস্পৃহা তাদের এই ধরনের সিদ্ধান্তের দিকে আরও দ্রুত ঠেলে দিতে থাকে। সন্ত্রাসবাদীদের নিধন করতে গিয়ে, আমেরিকা, সুচতুরভাবে, সন্ত্রাসবাদী তৈরি করে যায়। সন্ত্রাসবাদ দমনের বিজ্ঞাপন কাজে লাগিয়ে কেউ ক্ষমতার শীর্ষে থাকতে চায়, কেউ হিন্দুরাষ্ট্র নামক এক অলীক কল্পনার দিকে সংখ্যাগরিষ্ঠের মনোযোগ ঘুরিয়ে রেখে ক্ষমতাকে ধরে রাখতে চায়। অথচ কোন বিশেষ পরিস্থিতি মানুষকে হিন্দুরাষ্ট্রমুখী করে তোলে, কোন ইতিহাস আসলে মানুষকে হিন্দুত্ববাদের দিকে ঠেলে দেয়, এগুলির বিচার বিশ্লেষণ, সেইহেতু সমাধানের একটি পথ খুঁজে বের করা, এসব ক্ষেত্রেও আমাদের সমাজ-রাজনীতির প্রবক্তাদের ভূমিকা প্রশ্নহীন নয়। আমরা বুঝি না, বুঝতে পারি না, পূর্বোক্ত বিজ্ঞাপনদাতারা খুব ভাল করে এটা বোঝেন, সন্ত্রাসবাদের নিস্পত্তি হলে মানুষ আর সমাধানের জন্য তাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে না, সাম্প্রদায়িক সমস্যাগুলির মিটমাট হয়ে গেলে, ধর্ম নিয়ে যাদের রাজনীতি তাদেরও প্রয়োজনীয়তা হারাবে। ঘটনার এটি একটি মাত্র দিক, এর আরও কত দিক আছে, আরও কত বাঁক আছে, ঘাটঘোট আছে, আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায় হয়তো সেগুলি। কিন্তু এটুকু বুঝে নেওয়া যায়, সন্ত্রাসবাদ সবচে বড় ও জ্বলন্ত সমস্যা, জাতিবিদ্বেষ তেমনই আর একটি সমস্যা, আর এই সমস্যাগুলির সমাধান হয়ে গেলে সবচে বড় ক্ষতি ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায় যারা তাদের, সবাইকে দমিয়ে রাখতে চায় যারা তাদের। ফলত, এমন একটি জায়গায় এসে, প্রিমো লিভি যে আশঙ্কার কথা কটি জানিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের তা বোঝাটা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়ে, অপরকে বোঝানোটাও জরুরি হয়ে পড়ে। একবার যা ঘটেছে, তা আবার, বারবার ঘটার জন্য জমিটি প্রস্তুত করে রাখা আছে, প্রস্তুত করে রাখা হচ্ছে। কীভাবে রাখা হচ্ছে ? এই কথাগুলি আগে এসেছে, যেমন হিটলারকে নায়কের ভূমিকায় তুলে ধরার মধ্য দিয়ে এই জমিটি প্রস্তুত করা হচ্ছে। হিটলারের আত্মজীবনী বিক্রির মধ্য দিয়ে প্রস্তুত করা হচ্ছে। হিটলার ও অ্যান ফ্রাঙ্ক-এর বই পাশাপাশি তুলে ধরার মধ্য দিয়ে যেমন, হিটলারের সময়কার ঘৃণ্য ইতিহাসকে আড়াল করার মধ্য দিয়েও সেই জমিটি আবার প্রস্তুত করা হচ্ছে।
আমি আপনি জনসাধারণ সবাই সচেতন না হলে, আবার যে কোনো জায়গায় যে কোনো সময় ঘটে যেতে পারে এমন ঘটনাগুলি, যেগুলি আমরা ঘটতে দিতে চাই না কোনোভাবেই।
Posted in: December 2019, Prose
সুচিন্তিত ও দায়বদ্ধ লেখা। দময়ের দাবি।