ধর্মনিরপেক্ষতার সন্ধানে : সুমন্ত ঘোষ

বর্তমানে ভারতের রাজনৈতিক জটিলতার মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকৃত সংজ্ঞা খোঁজা অত্যন্ত দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রাচীন ভারতে মৌর্য সম্রাট অশোকের শিলালিপিগুলিতে ধর্মনিরপেক্ষতার বহু নিদর্শন এখনও দেখতে পাওয়া যায়। তবে, বর্তমানে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলি ধর্মনিরপেক্ষতাকে তাদের অন্যতম স্লোগানে পরিণত করতে সর্বদাই ব্যতিব্যস্ত। যদিও তারা হয়তো অনেকেই জানেন ধর্মনিরপেক্ষতা রাজনীতির উর্ধ্বে কিন্তু জানলেও তারা বিষয়টাকে মানেন না,  সেটাকে অগ্রাহ্য করেন। তাদের কাছে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি বর্তমানে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার অন্যতম হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটিকে যেভাবে এবং যে অর্থে ব্যবহার করা হতো বর্তমান সময়ে তা একেবারেই হয় না। যদি ধর্মনিরপেক্ষতাকে ভারতবর্ষের সংবিধান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তাহলে গণতন্ত্র এক অভাবনীয় ভবিষ্যতের শিকার হয়ে পড়বে। ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে এই আলোচনার অর্থ হল, ভারতবর্ষের সমাজে বর্তমানে যেভাবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ব্যবহার করা হচ্ছে তার একটি দিকচিহ্ন তুলে ধরা এবং আগামীকালের সুন্দর সমাজ গঠনের জন্য কিছু আশা ব্যক্ত করা।

প্রথমেই বলি, আমরা যদি ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ গড়তে চাই তবে প্রথমেই আমাদেরকে বেশকিছু বিষয়কে একেবারে অগ্রাহ্য করতে হবে, তা হলো নিজেদের ধর্ম, ভাষা, জাত ইত্যাদিকে দূরে সরাতে হবে; প্রত্যেককে আসতে হবে একই ছত্রতলে; একই সুরে গান গাইতে হবে সকলকে এবং নিজেদেরকে একই জাতির সমান অংশ হিসেবে গণ্য করতে হবে। এরূপ হলে তাহলেই এক সুন্দর সমাজব্যবস্থার দিকে আমরা অগ্রসর হতে পারব।

ধর্মনিরপেক্ষতা ১৮৫১ সালে যখন প্রথম ব্যবহৃত হয়, তখন এর একটি প্রধান অর্থ ছিল। এটা তখন সুষম ও সুস্থ মানবসমাজ গড়ে তোলা ও রক্ষা করার জন্য মানুষের তৈরি করা নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ সংক্রান্ত আইনগুলিকে বোঝাত। এই আইনগুলি কোনো ঐশ্বরিক প্রভাবে সৃষ্টি হয়নি, আর এগুলি কার্যকরী করার জন্য কোনো ঐশ্বরিক কর্তৃত্বের দরকার পড়েনি। যাঁরা এই সমাজ সৃষ্টি করেছেন, তাঁদের যুক্তি ও সংবেদনশীলতার উপর ভিত্তি করে সমাজের জন্য যা সবচেয়ে ভালো, সাধারণভাবে স্বীকৃত সেইসব সহনশীলতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধের ভাবনা, তারই উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল এর কর্তৃত্ব। সেই কর্তৃত্বই আইনের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। অতএব, যুক্তবাদী চিন্তা, বিতর্ক এবং আলোচনার মধ্য থেকেই জন্ম নিয়েছে সামাজিক মূল্যবোধ। কোনো একটি ধর্মসম্প্রদায়, জাত অথবা শ্রেণির জন্য নয়, গোটা সমাজের সমস্ত মানুষের নৈতিকতার ধারণাকে যুক্ত করার জন্য এটা দরকার ছিল।

এর মানে হলো এই যে, যে সব আইন ও সামাজিক মূল্যবোধের দ্বারা সমাজ পরিচালিত হয়, তাকে আইন হিসেবেই দেখতে হবে, পালন করতে হবে, কোনো ঐশ্বরিক ক্ষমতাবলে তা স্বীকৃত হবে না। জাত, ধর্ম নির্বিশেষে এই আইনের নিজস্ব ক্ষমতা আছে। ধর্মীয় ভাবনার সঙ্গে আলাদা আলাদা বিশ্বাস আর দেবতার প্রতি আস্থা এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তা মিলেমিশে আছে। যদিও, সাধারণ আইনগুলির স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতা ধর্মনিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষের উপর নির্ভরশীল, এজন্য কোনো ধর্মের স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই। অতএব, ধর্মনিরপেক্ষতা, যেমনভাবে কখনো কখনো বলা হয়ে থাকে—ধর্মকে অস্বীকার করা নয়, বরং সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধর্মের কর্তৃত্বমুক্ত করা। এই সংজ্ঞাকেই গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

ধর্মের উৎপত্তি ঘটেছে মানুষের ব্যক্তিগত আবেগাশ্রিত প্রয়োজন থেকে। এরপর এটা বিস্তৃত হয় মানুষের জীবনের অভিজ্ঞতা এবং তার বাইরে জগৎসংসার কেমন করে চলছে তার ব্যাখ্যায়। এই সবটাই তাকে অতিজাগতিক শক্তির দিকে নিয়ে যায় এবং কৃতজ্ঞতায় আনত করায়। ক্রমশ, এই ব্যক্তিগত ধর্ম জটিল ধর্মভাবনায় সংহত, সংগঠিত হয় এবং প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলে সমাজ ও রাজনীতির নিয়ন্ত্রক ভূমিকা গ্রহণে উচ্চাভিলাষী করে তোলে। এই পরিবর্তনের ফলে ধর্ম তার নিজস্ব বিশ্বাস আর সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে নিয়ন্ত্রক ভূমিকার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের মাধ্যমে ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে। কোথাও কোথাও তার ক্ষমতা সরকারি কর্তৃপক্ষ তথা রাষ্ট্রের সমান সমান হয়ে ওঠে। এই বিষয়টিতে ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধর্মের নিয়ন্ত্রণের থেকে আলাদা রাখতে চায়। এই পার্থক্যটা স্পষ্ট হওয়া দরকার কারণ প্রায়শই এই বিষয়টা আমাদের নজর এড়িয়ে যায় যখন আমরা বলি, ধর্মনিরপেক্ষতা সমস্ত রকম ধর্মীয় ভাবনাকেই অগ্রাহ্য করে।

ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থায় ধর্মীয় কর্তৃত্বের ধারণা চালু থাকলে তাকে সীমাবদ্ধ রাখতে হয়। এটা কেবলমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-আচরণের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে হয়। এই বিতর্ক কখনও কখনও ওঠে ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো শক্তপোক্ত বেড়া নেই, কিন্তু তাদের মধ্যে পারস্পরিক আলোচনার মধ্য দিয়ে নীতিগত ফারাক বজায় রাখা যেতেই পারে। এর ফলে ধর্মীয় বিশ্বাসগুলির মধ্যে অথবা ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে অন্যতর ভারসাম্য তৈরির সুযোগ করে দেয়। আইনের সামনে যেহেতু সব ধর্মই সমান, যেহেতু আইন কোনো ধর্মের প্রাধান্যই সামগ্রিকভাবে স্বীকার করে না, সেহেতু রাষ্ট্রের কাছে সব ধর্মেরই সমান অধিকারের আইনি ব্যবস্থা থাকা দরকার। যদিও এই ভাবনার মধ্যে একটি মাত্রা নির্ধারণ করা আছে, যাতে ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ সামাজিক আইনগুলি নিয়ন্ত্রণের সুযোগ আর না পায়। সামাজিক আইন সমাজকে সচল রাখতে সাহায্য করে। সমাজকে দোষমুক্ত রেখে জীবনযাপনকে সঠিক পথে পরিচালনার ক্ষেত্রে সামাজিক আইনের গুরুত্ব অপরিহার্য সুতরাং এটা অবশ্যই লক্ষণীয় সামাজিক আইন যেন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে।

সর্বধর্মের সহাবস্থানের পীঠস্থান হিসেবে ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ বলা হয়। কিন্তু তবুও দেখা যায় ধর্মগত কারণে একে অপরকে ছোট করা, একে অপরকে ঘৃণা করা ইত্যাদি আজকাল নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আসল কথা হলো, নিরপেক্ষ হতে গেলে সর্বপ্রথম আমাদের মনকেই ধর্মীয় গোঁড়ামির গাঁটছড়া থেকে মুক্ত করতে হবে। ধর্মীয় সহাবস্থানের লক্ষ্য রাষ্ট্র আর ধর্মের মধ্যে কোন বেড়া তৈরি করা নয় বরং এর লক্ষ্য দেওয়ানী ক্ষেত্রের অধীনে থাকা কার্যকলাপের সঙ্গে ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনের এক্তিয়ারের সীমানা নির্দিষ্ট করা। গণতান্ত্রিক সাম্যের ক্ষেত্রে এটা জরুরি। যদিও বলাবাহুল্য, ধর্মের সহাবস্থান থাকলেও ভারতে এখনো সেভাবে সাম্য প্রতিষ্ঠা পায়নি। আবার ওদিকে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গরাও নিজেদের গায়ে ধর্মের তকমা লাগাতেও দ্বিধাবোধ করেন না, যা আদৌ কাম্য নয়।

আসলে ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ গড়ে তুলতে হলে আমাদেরকে এক দৃঢ় মানসিকতার জন্ম দিতে হবে, যা হবে সমস্ত গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে। একইসাথে ধর্মনিরপেক্ষতাকে যথেষ্ট যত্ন ও চিন্তাশীল ভাবনার মধ্যে দিয়ে বড় করে তুলতে হবে, তাহলেই ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ ও রাজনীতির গঠন সম্ভব হবে।  বলাবাহুল্য, ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ ও রাজনীতির অর্থ কিন্তু ধর্ম ত্যাগ করা নয় বরং এর অর্থ হলো, কোনো ভারতীয় নাগরিককে তার ধর্মীয় পরিচিতির উপর গুরুত্ব না দিয়ে তাকে সকল ক্ষেত্রে সমানাধিকারের প্রদান। ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ গড়ে তুলতে গেলে এবং গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে গেলে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু ধর্মীয় মৌলবাদকে খাড়া করে দিলে চলবে না। বস্তুত সব ধরনের মৌলবাদীই—তা সেই হিন্দু, মুসলিম, খৃষ্টান প্রভৃতি যাই হোক না কেন—আসলে পরস্পরের পরিপূরক। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রকে রক্ষা করা এবং তাকে আরো শক্তিশালী করে তোলার জন্য নানা বৈচিত্র্য ও বিবিধ ধর্মের সাধারণ মানুষের মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে তোলাটা আবশ্যক।

পরিশেষে এটাই বলব, ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ গঠন এক রাত্রির বিপ্লব নয়। এটি একটি ঐতিহাসিক পদ্ধতি এবং এটি বাস্তবায়িত করার জন্য যেমন সময়ের প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন ধৈর্য্যের। তাই আশা করা যায়, ভবিষ্যতে একদিন রাষ্ট্র ও সমাজ এই নতুন পথে চলাকে অবশ্যই যথাযথভাবে স্বীকৃতি দেবে। ঔচিত্যবোধে সমৃদ্ধ মানবিক কাজ গণতন্ত্রের জন্য দরকার। আর ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ গড়ে তোলার অর্থই হলো ঔচিত্যবোধের  অগ্রগতি।

তথ্যসূত্র :

১) Partha Chatterjee, “Secularism and Tolerance,” in Secularism and its Critics, ed. Rajeev Bharagava, Oxford University Press, New Delhi,

2010).

২) https://www.google.com/amp/s/bengali.indianexpress.com/opinion/democracy-india-changing-nature-jayanta-ghoshal-138978/lite

৩) https://www.google.com/amp/s/eisamay.indiatimes.com/west-bengal-news/others/then-leave-secularism-on-the-path-of-state-religion-maidul-islam/amp_articleshow/72766563.cms

[লেখক – কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর স্তরের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র।]

Facebook Comments

1 thought on “ধর্মনিরপেক্ষতার সন্ধানে : সুমন্ত ঘোষ Leave a comment

Leave a Reply